বাঘা যতীনের ভাস্কর্য

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

‘নব ভারতের হলদিঘাট’ বুড়িবালাম নদীর তীরে যে লড়াইয়ের কথা কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন সেই লড়াইয়ের সেনাপতি ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ইংরেজদের মিথ্যা প্রচারণা ও অর্থের লোভে উন্মত্ত জনতার তাড়া খেয়ে উড়িষ্যার বালেশ্বরে বুড়িবালাম নদীর তীরে পাঁচ বাঙালি যুবক এক উই ঢিপির আড়াল থেকে এক বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিখা যুদ্ধ চালিয়ে আত্মবলিদানের এক চরম নিদর্শন রেখেছিলেন। যুদ্ধে ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মাদারিপুরের চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, বিচারে মনোরঞ্জন ও নীরেনের ফাঁসি হয় এবং জ্যোতিষ যাবজ্জীবন দীপান্তরে দণ্ডিত হন, আর গুলিতে আহত বাঘা যতীন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৯১৫ সনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় বিপ্লবী যিনি ট্রেঞ্চ খুঁড়ে যুদ্ধ করেছিলেন।

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বাঘা যতীন নামেই সবার কাছে সমধিক পরিচিত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা বাঘা যতীনের জন্ম ১৮৭৯ সনে কুমারখালীর কয়া গ্রামে। তার পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার রিসখালী গ্রামে। যতীন শৈশব থেকেই সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। বাঘের অত্যাচার থেকে গ্রামবাসীদের বাঁচাতে তিনি একাই একটি ছোরা দিয়ে বাঘ মেরেছিলেন বলে সবাই তাকে ‘বাঘা যতীন’ নামে ডাকা শুরু করে। এই মানুষটি গতানুগতিক জীবনধারায় গা ভাসিয়ে চলেননি, ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে নিজের জীবন বাজী রেখেছিলেন। তিনি কেমন ব্যতিক্রম ছিলেন তা তার একটি লেখা থেকে স্পষ্ট হয়; দিদি বিনোদবালাকে লেখা তার একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, ‘হা-হুতাশ ত’ সবাই করিয়া থাকে, আপনি আমিও যদি তাহাই করি তবে আমরা আমাদের স্বর্গীয়া মাতৃদেবী শরৎশশীর গর্ভে জন্মিয়াছিলাম কেন? আমরা তো সাধারণের ন্যায় দুর্বল হৃদয় অবিশ্বাসী সামান্য মায়ের সন্তান নইÑআমাদের মা জীবন ভরিয়া সব ব্যাপার হাসিতে হাসিতে সহ্য করিয়া গিয়াছেন, একবার ভাবিয়া দেখুন তা, আর আজ যদি তিনি জীবিত থাকিতেন তিনি স্বয়ং আমাকে আমার কর্মে বরণ করিয়া লইতেন সন্দেহ নাই’।

সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব, এমনটাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তিনি। বাঘা যতীন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’-এর প্রধান নেতা। শক্ত-সমর্থ ও নির্ভিক চিত্তধারী যতীন্দ্রনাথ দৃঢ় আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ উজ্জীবিত ছিলেন। তিনি নিষিদ্ধ সশস্ত্র বিপ্লবী দলগুলোকে এক মঞ্চে আনতে সক্ষম হন। সব দল মিলে যতীন্দ্রনাথকে তাদের সর্বাধিনায়ক নির্বাচন করে এবং তার কমাণ্ডেই সব বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। গুপ্তসমিতি ‘অনুশীলন’-এর মাধ্যমে তারা প্রথমে একক বিপ্লবীর মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন; পরবর্তীতে খণ্ড খণ্ড আক্রমণে ইংরেজদের নাস্তানাবুদ করে দেশব্যাপী এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের অবসান করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে তারা এগুতে থাকেন।

বাঘা যতীনের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুলিশের দেশি কর্মচারীরাও যতীন্দ্রনাথের অনুরাগী হয়ে উঠেন। ১৯১৪ সনে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভারতবর্ষের দেশীয় পুলিশ ও সেনাদের গোপনে সম্পৃক্ত করে বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড ব্যাপক আকারে সংঘটিত করতে সমর্থ হন। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে এসে যতীন্দ্রনাথ নিজেই বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বারীণ ঘোষসহ তিনি একটি বোমা বানানোর কারখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। চীনের বিপ্লবী নেতা সান ইয়াত সেনের কাছ থেকে কিছু হাল্কা অস্ত্র পাওয়া গেলেও তা সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান ও জাপান ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে থাকায় ভারতবর্ষের বিপ্লবীরা ইংরেজ বিতাড়নে জার্মানির সহায়তার অনুসন্ধান করতে থাকে। ভারত সফররত জার্মান যুবরাজের কাছ থেকে যতীন্দ্রনাথ অস্ত্র ও অর্থ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন; জার্মান সম্রাট কাইজারের সঙ্গেও ভারতের বিপ্লবীদের একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বিশ্ব যুদ্ধের মিত্র বাহিনীর কঠোর পাহারা ও তল্লাশির কারণে জার্মান থেকে পাঠানো অস্ত্রের জাহাজ ভারতবর্ষে বিপ্লবীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সমুদ্রে অস্ত্র ভর্তি জাহাজের খবর পেয়ে ভারতবর্ষের ইংরেজ সরকার সতর্ক হয়ে যায় এবং বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান জোরদার করে। দেশি কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় বিপ্লবীদের গোপন আস্তানাগুলোর হদিস পেতে পুলিশের বেশি বেগ পেতে হয়নি। এই অবস্থায়ও সারা ভারতে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে একযোগে বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলে জাতীয় অভ্যুথানের জন্য প্রস্তুতি নিতে দেশীয় সেনাদের গোপনে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন যতীন; কিন্তু অভ্যুত্থানের নির্ধারিত তারিখের চার দিন আগে সব পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে ব্রিটিশ সেনা দেশীয় সেনা ও পুলিশদের নিরস্ত্র করে বিপ্লব ঠেকিয়ে দেয়। যতীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন, পালিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেয়ে যুদ্ধ করে মরা ভালো। উড়িষ্যার বালেশ্বরে পরিখার আড়ালে হাতে মাউজার পিস্তল নিয়ে বাঘা যতীনের নেতৃত্বে মাত্র পাঁচজন বিপ্লবী অসংখ্য ইংরেজ পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে যান। লড়াই চলাকালীন ভিখারির ছদ্মবেশে দারোগা চিন্তামণি সাধু ইংরেজ সেনাদের যতীন ও তার সঙ্গীদের অবস্থান অবহিত না করলে হয়তো তারা পিছু হটে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতেন।

কুষ্টিয়ায় বাঘা যতীনের বাস্তুভিটায় গড়ে তোলা কলেজটি ২০১৬ সনে বাঘা যতীনের নামে নামকরণ করা হয়। এই কলেজের গেটে থাকা বাঘা যতীনের ভাস্কর্য সম্প্রতি ভাঙচুর করা হয়েছে মধ্যরাতে। এ ভাঙচুরের মূল পরিকল্পনাকারী কয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনিসুর রহমান আনিসসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলেজ কমিটির সঙ্গে আনিসের বিরোধ থাকায় তাদের ফাঁসাতে এই অপকর্ম করা হয়েছে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার কাহিনী নতুন নয়। নিজের মাথা নিজে ফাটিয়ে বিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা সাজানোর কাহিনীও দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এমন একটি ঘটনার বর্ণনা দেখতে পাই। টুঙ্গিপাড়ায় শেখ বাড়ির পাশেই ছিলো কাজী বাড়ি। দুই বংশের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন থাকলেও আধিপত্যের রেষারেষি লেগেই ছিল। শেখদের আধিপত্য খর্ব করতে কাজীরা জমিদার রাণী রাসমণির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেও শেখদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না; পরিশেষে বৃদ্ধ সেরাজতুল্লা কাজীকে গলা টিপে হত্যা করে মরদেহ তার সন্তানেরা শেখ বাড়ির গরুর ঘরের চালের ওপর রেখে পুলিশে সংবাদ দিলে পুলিশ এসে শেখ বাড়ির সব পুরুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বিনা অপরাধে অন্যকে ফাঁসানোর প্রচেষ্টা ১৫ থেকে ২০ বছর আগে আমাদের পরিবারের সঙ্গেও ঘটেছিল; আমার ভাতিজা শিমুলকে নামিয়ে দিয়ে ডাকাতদল তার গাড়িটি নিয়ে চলে গেলে সে ফেনী থানায় মামলা করতে গিয়ে শুনে যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্দেশনায় বিরোধী দলের কিছু লোকের নাম এই ডাকাতি মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত না হলে ডাকাতির মামলা নেয়া হবে না। ভাতিজা মামলা না করেই দ্রুত থানা থেকে প্রস্থান করে। মাদক আর পিস্তল গছিয়ে দিয়ে হয়রানি করার গল্প তো অহরহ শোনা যায়। রাজনীতির মাঠে এমন অপকর্মের কারণে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে সাধারণ জনগণ। রাজনীতি পরিশুদ্ধ না হলে ভাস্কর্য গড়ে ইতিহাস শেখানো যাবে না, পুলিশ প্রহরা ও সিসি ক্যামেরার নজরদারি কোন কাজে আসবে না। পুলিশ প্রহরায় ভাস্কর্য রক্ষার বিষয়টি জাতির জন্য অপমানজনকও।

কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এমএন রায় বাঘা যতীনকে লেনিনের সঙ্গে তুলনা করে লেনিনের চেয়ে বাঘা যতীনই শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বাঘা যতীনের আত্মত্যাগে ভারতবর্ষে অগণিত বাঘা যতীনের জন্ম হয়েছিল বলেই ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে ব্রিটিশ পুলিশ চার্লস টেগার্ট বলেছিলেন, ‘বাঘা যতীন যদি ইংরেজ হতেন, তাহলে ইংরেজরা ট্রাফালগার স্কোয়্যারে নেলসনের পাশে তার স্ট্যাচু বানিয়ে দিতেন’। হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় পিপাসার্ত যতীন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার চার্লস টেগার্টের দেয়া পানি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আমি যার রক্ত দেখতে চেয়েছিলাম, তার দেয়া জলে আমার তেষ্টা মেটাতে চাই না’। যে যতীনের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে সেই যতীনের ঘুষিতে এক সময় অনেক ইংরেজের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরেছে। এক হাতে কয়টা লোককে শায়েস্তা করতে পারেন, ইংরেজ শাসকের এমন প্রশ্নের উত্তরে বাঘা যতীন বলেছিলেন, ‘ভালো মানুষ হলে একটাও নয়; দুর্বৃত্ত হলে যতগুলি খুশি সামলাতে পারব’। তাই যতীনের প্রাণহীন জড় ভাস্কর্য ভেঙে মর্দানি দেখানোর মধ্যে কোন বাহাদুরী নেই। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের লেখাপড়া নেই বলেই বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙার জন্য মধ্যরাতে তস্কর সেজেছে; যার ভাস্কর্য ভেঙেছে তিনি যুবক বয়সে শুধু বাঘের সঙ্গে লড়াই করে জিতেননি, নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাঘের মতোই যুদ্ধ করেছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য। জাতির জন্য লজ্জার বিষয় হলো, ছ্যাঁচড়া দুর্বৃত্তের জ্ঞানের অভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের বিপ্লবী এই বাঙালির ভাস্কর্যও অক্ষত রাখা গেল না।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ , ১২ পৌষ ১৪২৭, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

বাঘা যতীনের ভাস্কর্য

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

‘নব ভারতের হলদিঘাট’ বুড়িবালাম নদীর তীরে যে লড়াইয়ের কথা কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন সেই লড়াইয়ের সেনাপতি ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ইংরেজদের মিথ্যা প্রচারণা ও অর্থের লোভে উন্মত্ত জনতার তাড়া খেয়ে উড়িষ্যার বালেশ্বরে বুড়িবালাম নদীর তীরে পাঁচ বাঙালি যুবক এক উই ঢিপির আড়াল থেকে এক বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিখা যুদ্ধ চালিয়ে আত্মবলিদানের এক চরম নিদর্শন রেখেছিলেন। যুদ্ধে ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মাদারিপুরের চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, বিচারে মনোরঞ্জন ও নীরেনের ফাঁসি হয় এবং জ্যোতিষ যাবজ্জীবন দীপান্তরে দণ্ডিত হন, আর গুলিতে আহত বাঘা যতীন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৯১৫ সনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় বিপ্লবী যিনি ট্রেঞ্চ খুঁড়ে যুদ্ধ করেছিলেন।

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বাঘা যতীন নামেই সবার কাছে সমধিক পরিচিত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা বাঘা যতীনের জন্ম ১৮৭৯ সনে কুমারখালীর কয়া গ্রামে। তার পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার রিসখালী গ্রামে। যতীন শৈশব থেকেই সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। বাঘের অত্যাচার থেকে গ্রামবাসীদের বাঁচাতে তিনি একাই একটি ছোরা দিয়ে বাঘ মেরেছিলেন বলে সবাই তাকে ‘বাঘা যতীন’ নামে ডাকা শুরু করে। এই মানুষটি গতানুগতিক জীবনধারায় গা ভাসিয়ে চলেননি, ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে নিজের জীবন বাজী রেখেছিলেন। তিনি কেমন ব্যতিক্রম ছিলেন তা তার একটি লেখা থেকে স্পষ্ট হয়; দিদি বিনোদবালাকে লেখা তার একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, ‘হা-হুতাশ ত’ সবাই করিয়া থাকে, আপনি আমিও যদি তাহাই করি তবে আমরা আমাদের স্বর্গীয়া মাতৃদেবী শরৎশশীর গর্ভে জন্মিয়াছিলাম কেন? আমরা তো সাধারণের ন্যায় দুর্বল হৃদয় অবিশ্বাসী সামান্য মায়ের সন্তান নইÑআমাদের মা জীবন ভরিয়া সব ব্যাপার হাসিতে হাসিতে সহ্য করিয়া গিয়াছেন, একবার ভাবিয়া দেখুন তা, আর আজ যদি তিনি জীবিত থাকিতেন তিনি স্বয়ং আমাকে আমার কর্মে বরণ করিয়া লইতেন সন্দেহ নাই’।

সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব, এমনটাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তিনি। বাঘা যতীন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’-এর প্রধান নেতা। শক্ত-সমর্থ ও নির্ভিক চিত্তধারী যতীন্দ্রনাথ দৃঢ় আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ উজ্জীবিত ছিলেন। তিনি নিষিদ্ধ সশস্ত্র বিপ্লবী দলগুলোকে এক মঞ্চে আনতে সক্ষম হন। সব দল মিলে যতীন্দ্রনাথকে তাদের সর্বাধিনায়ক নির্বাচন করে এবং তার কমাণ্ডেই সব বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। গুপ্তসমিতি ‘অনুশীলন’-এর মাধ্যমে তারা প্রথমে একক বিপ্লবীর মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন; পরবর্তীতে খণ্ড খণ্ড আক্রমণে ইংরেজদের নাস্তানাবুদ করে দেশব্যাপী এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের অবসান করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে তারা এগুতে থাকেন।

বাঘা যতীনের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুলিশের দেশি কর্মচারীরাও যতীন্দ্রনাথের অনুরাগী হয়ে উঠেন। ১৯১৪ সনে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভারতবর্ষের দেশীয় পুলিশ ও সেনাদের গোপনে সম্পৃক্ত করে বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড ব্যাপক আকারে সংঘটিত করতে সমর্থ হন। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে এসে যতীন্দ্রনাথ নিজেই বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বারীণ ঘোষসহ তিনি একটি বোমা বানানোর কারখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। চীনের বিপ্লবী নেতা সান ইয়াত সেনের কাছ থেকে কিছু হাল্কা অস্ত্র পাওয়া গেলেও তা সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান ও জাপান ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে থাকায় ভারতবর্ষের বিপ্লবীরা ইংরেজ বিতাড়নে জার্মানির সহায়তার অনুসন্ধান করতে থাকে। ভারত সফররত জার্মান যুবরাজের কাছ থেকে যতীন্দ্রনাথ অস্ত্র ও অর্থ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন; জার্মান সম্রাট কাইজারের সঙ্গেও ভারতের বিপ্লবীদের একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বিশ্ব যুদ্ধের মিত্র বাহিনীর কঠোর পাহারা ও তল্লাশির কারণে জার্মান থেকে পাঠানো অস্ত্রের জাহাজ ভারতবর্ষে বিপ্লবীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সমুদ্রে অস্ত্র ভর্তি জাহাজের খবর পেয়ে ভারতবর্ষের ইংরেজ সরকার সতর্ক হয়ে যায় এবং বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান জোরদার করে। দেশি কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় বিপ্লবীদের গোপন আস্তানাগুলোর হদিস পেতে পুলিশের বেশি বেগ পেতে হয়নি। এই অবস্থায়ও সারা ভারতে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে একযোগে বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলে জাতীয় অভ্যুথানের জন্য প্রস্তুতি নিতে দেশীয় সেনাদের গোপনে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন যতীন; কিন্তু অভ্যুত্থানের নির্ধারিত তারিখের চার দিন আগে সব পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে ব্রিটিশ সেনা দেশীয় সেনা ও পুলিশদের নিরস্ত্র করে বিপ্লব ঠেকিয়ে দেয়। যতীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন, পালিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেয়ে যুদ্ধ করে মরা ভালো। উড়িষ্যার বালেশ্বরে পরিখার আড়ালে হাতে মাউজার পিস্তল নিয়ে বাঘা যতীনের নেতৃত্বে মাত্র পাঁচজন বিপ্লবী অসংখ্য ইংরেজ পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে যান। লড়াই চলাকালীন ভিখারির ছদ্মবেশে দারোগা চিন্তামণি সাধু ইংরেজ সেনাদের যতীন ও তার সঙ্গীদের অবস্থান অবহিত না করলে হয়তো তারা পিছু হটে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতেন।

কুষ্টিয়ায় বাঘা যতীনের বাস্তুভিটায় গড়ে তোলা কলেজটি ২০১৬ সনে বাঘা যতীনের নামে নামকরণ করা হয়। এই কলেজের গেটে থাকা বাঘা যতীনের ভাস্কর্য সম্প্রতি ভাঙচুর করা হয়েছে মধ্যরাতে। এ ভাঙচুরের মূল পরিকল্পনাকারী কয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনিসুর রহমান আনিসসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলেজ কমিটির সঙ্গে আনিসের বিরোধ থাকায় তাদের ফাঁসাতে এই অপকর্ম করা হয়েছে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার কাহিনী নতুন নয়। নিজের মাথা নিজে ফাটিয়ে বিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা সাজানোর কাহিনীও দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এমন একটি ঘটনার বর্ণনা দেখতে পাই। টুঙ্গিপাড়ায় শেখ বাড়ির পাশেই ছিলো কাজী বাড়ি। দুই বংশের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন থাকলেও আধিপত্যের রেষারেষি লেগেই ছিল। শেখদের আধিপত্য খর্ব করতে কাজীরা জমিদার রাণী রাসমণির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেও শেখদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না; পরিশেষে বৃদ্ধ সেরাজতুল্লা কাজীকে গলা টিপে হত্যা করে মরদেহ তার সন্তানেরা শেখ বাড়ির গরুর ঘরের চালের ওপর রেখে পুলিশে সংবাদ দিলে পুলিশ এসে শেখ বাড়ির সব পুরুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বিনা অপরাধে অন্যকে ফাঁসানোর প্রচেষ্টা ১৫ থেকে ২০ বছর আগে আমাদের পরিবারের সঙ্গেও ঘটেছিল; আমার ভাতিজা শিমুলকে নামিয়ে দিয়ে ডাকাতদল তার গাড়িটি নিয়ে চলে গেলে সে ফেনী থানায় মামলা করতে গিয়ে শুনে যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্দেশনায় বিরোধী দলের কিছু লোকের নাম এই ডাকাতি মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত না হলে ডাকাতির মামলা নেয়া হবে না। ভাতিজা মামলা না করেই দ্রুত থানা থেকে প্রস্থান করে। মাদক আর পিস্তল গছিয়ে দিয়ে হয়রানি করার গল্প তো অহরহ শোনা যায়। রাজনীতির মাঠে এমন অপকর্মের কারণে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে সাধারণ জনগণ। রাজনীতি পরিশুদ্ধ না হলে ভাস্কর্য গড়ে ইতিহাস শেখানো যাবে না, পুলিশ প্রহরা ও সিসি ক্যামেরার নজরদারি কোন কাজে আসবে না। পুলিশ প্রহরায় ভাস্কর্য রক্ষার বিষয়টি জাতির জন্য অপমানজনকও।

কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এমএন রায় বাঘা যতীনকে লেনিনের সঙ্গে তুলনা করে লেনিনের চেয়ে বাঘা যতীনই শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বাঘা যতীনের আত্মত্যাগে ভারতবর্ষে অগণিত বাঘা যতীনের জন্ম হয়েছিল বলেই ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে ব্রিটিশ পুলিশ চার্লস টেগার্ট বলেছিলেন, ‘বাঘা যতীন যদি ইংরেজ হতেন, তাহলে ইংরেজরা ট্রাফালগার স্কোয়্যারে নেলসনের পাশে তার স্ট্যাচু বানিয়ে দিতেন’। হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় পিপাসার্ত যতীন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার চার্লস টেগার্টের দেয়া পানি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আমি যার রক্ত দেখতে চেয়েছিলাম, তার দেয়া জলে আমার তেষ্টা মেটাতে চাই না’। যে যতীনের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে সেই যতীনের ঘুষিতে এক সময় অনেক ইংরেজের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরেছে। এক হাতে কয়টা লোককে শায়েস্তা করতে পারেন, ইংরেজ শাসকের এমন প্রশ্নের উত্তরে বাঘা যতীন বলেছিলেন, ‘ভালো মানুষ হলে একটাও নয়; দুর্বৃত্ত হলে যতগুলি খুশি সামলাতে পারব’। তাই যতীনের প্রাণহীন জড় ভাস্কর্য ভেঙে মর্দানি দেখানোর মধ্যে কোন বাহাদুরী নেই। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের লেখাপড়া নেই বলেই বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙার জন্য মধ্যরাতে তস্কর সেজেছে; যার ভাস্কর্য ভেঙেছে তিনি যুবক বয়সে শুধু বাঘের সঙ্গে লড়াই করে জিতেননি, নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাঘের মতোই যুদ্ধ করেছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য। জাতির জন্য লজ্জার বিষয় হলো, ছ্যাঁচড়া দুর্বৃত্তের জ্ঞানের অভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের বিপ্লবী এই বাঙালির ভাস্কর্যও অক্ষত রাখা গেল না।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com