সাপ কি পোষ মানে?

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

সাপ নিয়ে কত না প্রবাদ প্রচলন গ্রাম-বাংলায় প্রচলিত আছে। তবে প্রবাদ বাক্য না নিয়ে সত্যিকার ঘটনাকে উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শুরু করলাম। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার সাপের ওস্তাদ ছিলেন জুলহাস নামে এক ব্যক্তি। জুলহাস গর্তের ভেতর লুকানো থাকা সাপ ধরা এবং সেই সাপকে পোষ মানানোর বিষয়ে ছিল একজন প্রাজ্ঞ সর্পবিদ। জুলহাসের সাপ বিষয়ক বিদ্যার জ্ঞানের বিষয়টি ওই অঞ্চলের সবার জানা। এক সময় সাপের ওস্তাদ হিসেবে এলাকায় প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করে। সাপ নিয়ে এক ঘরে বাস করার কৌশলও তিনি জানতেন। সাপকে নিজ সন্তানসম লালন করছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল যে, তিনি মারা গেছেন সাপের কামড়ে।

কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো মৌলবাদী চেতনার পাকিস্তানপন্থিরা কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শে একীভূত হবে না। বাংলা জনপদের মূল সংস্কৃতির সাথে এদের মানায় না। অপরদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এ জনপদের সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়েছিল। দেশে ভাগ হয়ে যে পাকিস্তান জন্ম নেয় তার আর্দশটি ছিল বাংলা জনপদের সংস্কৃতির চিরায়ত ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ বিপরীত ধারার চেতনার ধারকদের কোনোদিনই বাংলার ঐতিহ্য ধারণকারী সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে একীভূত করা যাবে না।

২০০৮ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন। ২০০৮ সালের পর থেকে যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রাকাশ্যে কমতে থাকে। সেই সময় জামায়াতের নবসংস্করণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে হেফাজতে ইসলামের। হেফাজতে ইসলাম একটি মৌলবাদী সংগঠন। হেফাজত বাংলা জনপদে মৌলবাদী শিক্ষা কওমির প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশে বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম পালন করে। তাই নানা কায়দায় স্বাধীনতাবিরোধী আদর্শের এ সংগঠনটি মুসলমানদের মনস্তাত্মিক জায়গাটি দখল করার জন্য ধর্মকে সুকৌশলে কাজে লাগায়। তারা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারের নৈকট্য লাভ করে। সরকার কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেয়। তাই পেয়ে যায় কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে-ই-হাদিস ডিগ্রি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সমমানের মর্যাদা।

কওমি শিক্ষাকে প্রাচীনতম শিক্ষা হিসেবে হেফাজতের নেতারা দাবি করে থাকেন। বিষয়টি কিন্তু সঠিক না, কারণ বাংলা জনপদের ইসলামিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাটি তেমন প্রাচীন নয়। কওমি শিক্ষার উৎপত্তি হলো ভারতে। ১৮৮৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে, আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মাদ্রাসাটির মাধ্যমে উপমহাদেশে কওমি শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে কওমি মাদ্রাসা বহুল প্রচলিত। উপমহাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেও এখন কওমি মাদ্রাসার প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে এ শিক্ষার ইতিহাস তেমন পুরনো নয়। ব্রিটিশ শাসনামলে কওমি শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশকে দ্বি-জাতি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। উপমহাদেশে কওমি শিক্ষা শুরু হওয়ার আগে এ অঞ্চলে মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন ছিল। সহজেই অনুমেয় যে কওমি শিক্ষাটির প্রচলন ঘটানো হয়েছিল সামাজিক বৈরিতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। গণজাগরণ মঞ্চ দেশকে এবং জাতিকে এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল যে, ১৯৭৫ সালের পর উত্থিত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্বে ঐক্যবদ্ধভাবে আবার লড়তে হবে। কারণ ’৭৫-এর পরবর্তী সময়গুলোতে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের শেকড় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অনেক গভীরে প্রোথিত করে ফেলেছে। তাই এ মৌলবাদী অপশক্তিকে উপড়ে না ফেলতে পারলে মুক্তিযুদ্বের চেতনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সেই সময় জাগরণ মঞ্চের আহ্বানে জাতি সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু নানা চক্রান্তের ব্যুহজাল সৃষ্টি হয় গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে। গণজাগরণ মঞ্চকে প্রতিহত করতে গা-ঢাকা দেয়া জামায়াতিরাই জন্ম দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটিকে। হেফাজত নামক মৌলবাদী কওমিগোষ্ঠী জাগরণ মঞ্চের তরুণদের নাস্তিক হিসেবে আখ্যা দেয়। দেশের কিছু রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতকে সমর্থন করে। ফলে হেফাজতের রাজনৈতিক শক্তি বেড়ে যায়।

১৯৭৫ সালের পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কথিত মুক্তিযুদ্বের আর্দশের ওপর ভর দিয়ে যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধীরা উত্থান ঘটিয়েছিল নিজেদের। গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম রুখতে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীরা মুক্তমনের অসাম্প্রদায়িক লেখককে একের পর এক হত্যা করেছিল সেই সময়। জাগরণ মঞ্চের আন্দোলন প্রতিহত করতে রাজধানীর মতিঝিলে কওমিগোষ্ঠীর সংগঠন হেফাজত সমাবেশ করে। এ সমাবেশ থেকেই হেফাজত তার জঘন্য কার্যক্রম চালায়। হেফাজত দেশের সমসাময়িককালের নিষ্ঠুরতম ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ মে। ওই সময় সাভারে ঘটেছিল গার্মেন্ট দুর্ঘটনা। সাভার ট্র্যাজেডির সারি সারি লাশের স্তূপের ভারে জাতি যখন শোকে মুহ্যমান ঠিক সেই মুহূর্তে লাখো শোকাতুর মানুষের শোকানুভূতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠে চরম উগ্র মৌলবাদীগোষ্ঠী হেফাজত।

২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলাম যে বর্বরতা চালিয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। হেফাজতের সহিংস তাণ্ডবে ২৭ জন প্রাণ হারান। হেফাজতের তাণ্ডবে ভস্মীভূত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। হেফাজতের এ তাণ্ডব স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। হেফাজতের এ তাণ্ডবলীলা থেকে রেহাই পায়নি পবিত্র কোরআন শরীফ। হেফাজতের কর্মীরা পবিত্র কোরআন শরীফ বিক্রির দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয় আর শত শত পবিত্র কোরআন শরীফ ভস্মীভূত হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসে এরকম জঘন্যতম ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইহুদিরাও পবিত্র কোরআন শরীফে আগুন দিতে পারেনি। দৈনিক বাংলার মোড় থেকে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত শুধুমাত্র বায়তুল মোকাররমের ফুটপাথের ২৫৮টি দোকান সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে হেফাজতের কর্মীরা। ২০১৩ সালের এ নিষ্ঠুর হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলে গিয়ে কওমি শিক্ষাগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনা হলো।

কী লাভ হলো; এই কালসাপেরা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারাকে রপ্ত করতে পেরেছে? মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এরা আবার ফুঁসে উঠলো। কওমিগোষ্ঠীর হেফাজত এখন বাংলা জনপদের মূল সংস্কৃতি আবহটা ধ্বংস করতে আইএসের ন্যায় মাঠে নেমে পড়েছে। সুতরাং এদের প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যের প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। এ প্লাটফর্মটি গড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধের আর্দশবাদীদের দিয়েই, সদ্য যোগ দেয়াদের নিয়ে করলে হেফাজত লালন করাই হবে। কুষ্টিয়ায় জাতির পিতার ভাস্কর্যটি ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা রাতের অন্ধকারে। এরা কারা? এই কুষ্টিয়ায় দুই-এক বছর আগে জামায়াত-শিবিরের কিছু কর্মী জাতির পিতার গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের আর্দশের ধারায় যোগ দিচ্ছে; অপরদিকে মূল নেতারা এখন গা-ঢাকা দিয়ে আছে। হেফাজতসহ মৌলবাদীগোষ্ঠী হুমকি দিয়ে বলেছে- এ দেশে ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। অথচ পাকিস্তান আমলেও এই মৌলবাদী অপশক্তির ধারাটি বাংলা জনপদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলতে ভয় পেত। আজ স্বাধীন দেশে মৌলবাদীগোষ্ঠী প্রকাশ্যে বাংলা জনপদের সংস্কৃতির বিরোধিতা করছে? এরা এত সাহস পেল কোথায়? স্বাধীনতাবিরোধী আর্দশের বিশ্বাসীরা এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আচ্ছাদিত হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে পারে।

জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে তাদের কর্মীরা। প্রশাসন, মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলে জামায়াতের কর্মীরা ঢুকে পড়েছে, আর সুযোগ পেলেই তারা জামায়াতি আর্দশ বাস্তবায়নে চেষ্টা চালায়।

এক সময়ের শিবিরকর্মী ছিল এক ব্যক্তি। এক সময় এই ব্যক্তিটির হাতে নাজেহাল ও নির্যাতিত হয়েছে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির কর্মীরা। এখন এই ব্যক্তিই স্বাধীনতার পক্ষের একটি ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার কর্মী হিসেবে ময়মনসিংহে দায়িত্ব পালন করছে। ময়মনসিংহের গণমাধ্যম কর্মীদের সমাজে গড়ে তুলেছে নিজস্ব অবস্থান। ১৯৮৪ সালে ময়মনসিংহের ভালুকা কলেজে ছাত্রলীগের নবীনবরণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র হামলা চালায়। সেই হামলার মূল নিয়ন্ত্রক ছিল একজন কুখ্যাত রাজাকার। যে হামলাকারীরা ওই দিন কুখ্যাত রাজাকারের নির্দেশে ছাত্রলীগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানটি পণ্ড করে দিয়েছিল, তাদের অনেককেই এখন দেখা যায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে।

সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক সংগঠনে কর্মী বাড়ানোর সময় দেখা উচিত- আগত কর্মীরা কোথা থেকে এসেছে এবং অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস কী? তা না দেখলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক সংগঠনগুলোই একদিন আত্মঘাতের কবলে পতিত হবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ , ১৩ পৌষ ১৪২৭, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

সাপ কি পোষ মানে?

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

সাপ নিয়ে কত না প্রবাদ প্রচলন গ্রাম-বাংলায় প্রচলিত আছে। তবে প্রবাদ বাক্য না নিয়ে সত্যিকার ঘটনাকে উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শুরু করলাম। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার সাপের ওস্তাদ ছিলেন জুলহাস নামে এক ব্যক্তি। জুলহাস গর্তের ভেতর লুকানো থাকা সাপ ধরা এবং সেই সাপকে পোষ মানানোর বিষয়ে ছিল একজন প্রাজ্ঞ সর্পবিদ। জুলহাসের সাপ বিষয়ক বিদ্যার জ্ঞানের বিষয়টি ওই অঞ্চলের সবার জানা। এক সময় সাপের ওস্তাদ হিসেবে এলাকায় প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করে। সাপ নিয়ে এক ঘরে বাস করার কৌশলও তিনি জানতেন। সাপকে নিজ সন্তানসম লালন করছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল যে, তিনি মারা গেছেন সাপের কামড়ে।

কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো মৌলবাদী চেতনার পাকিস্তানপন্থিরা কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শে একীভূত হবে না। বাংলা জনপদের মূল সংস্কৃতির সাথে এদের মানায় না। অপরদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এ জনপদের সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়েছিল। দেশে ভাগ হয়ে যে পাকিস্তান জন্ম নেয় তার আর্দশটি ছিল বাংলা জনপদের সংস্কৃতির চিরায়ত ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ বিপরীত ধারার চেতনার ধারকদের কোনোদিনই বাংলার ঐতিহ্য ধারণকারী সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে একীভূত করা যাবে না।

২০০৮ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন। ২০০৮ সালের পর থেকে যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রাকাশ্যে কমতে থাকে। সেই সময় জামায়াতের নবসংস্করণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে হেফাজতে ইসলামের। হেফাজতে ইসলাম একটি মৌলবাদী সংগঠন। হেফাজত বাংলা জনপদে মৌলবাদী শিক্ষা কওমির প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশে বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম পালন করে। তাই নানা কায়দায় স্বাধীনতাবিরোধী আদর্শের এ সংগঠনটি মুসলমানদের মনস্তাত্মিক জায়গাটি দখল করার জন্য ধর্মকে সুকৌশলে কাজে লাগায়। তারা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারের নৈকট্য লাভ করে। সরকার কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেয়। তাই পেয়ে যায় কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে-ই-হাদিস ডিগ্রি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সমমানের মর্যাদা।

কওমি শিক্ষাকে প্রাচীনতম শিক্ষা হিসেবে হেফাজতের নেতারা দাবি করে থাকেন। বিষয়টি কিন্তু সঠিক না, কারণ বাংলা জনপদের ইসলামিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাটি তেমন প্রাচীন নয়। কওমি শিক্ষার উৎপত্তি হলো ভারতে। ১৮৮৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে, আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মাদ্রাসাটির মাধ্যমে উপমহাদেশে কওমি শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে কওমি মাদ্রাসা বহুল প্রচলিত। উপমহাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেও এখন কওমি মাদ্রাসার প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে এ শিক্ষার ইতিহাস তেমন পুরনো নয়। ব্রিটিশ শাসনামলে কওমি শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশকে দ্বি-জাতি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। উপমহাদেশে কওমি শিক্ষা শুরু হওয়ার আগে এ অঞ্চলে মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন ছিল। সহজেই অনুমেয় যে কওমি শিক্ষাটির প্রচলন ঘটানো হয়েছিল সামাজিক বৈরিতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। গণজাগরণ মঞ্চ দেশকে এবং জাতিকে এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল যে, ১৯৭৫ সালের পর উত্থিত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্বে ঐক্যবদ্ধভাবে আবার লড়তে হবে। কারণ ’৭৫-এর পরবর্তী সময়গুলোতে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের শেকড় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অনেক গভীরে প্রোথিত করে ফেলেছে। তাই এ মৌলবাদী অপশক্তিকে উপড়ে না ফেলতে পারলে মুক্তিযুদ্বের চেতনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সেই সময় জাগরণ মঞ্চের আহ্বানে জাতি সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু নানা চক্রান্তের ব্যুহজাল সৃষ্টি হয় গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে। গণজাগরণ মঞ্চকে প্রতিহত করতে গা-ঢাকা দেয়া জামায়াতিরাই জন্ম দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটিকে। হেফাজত নামক মৌলবাদী কওমিগোষ্ঠী জাগরণ মঞ্চের তরুণদের নাস্তিক হিসেবে আখ্যা দেয়। দেশের কিছু রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতকে সমর্থন করে। ফলে হেফাজতের রাজনৈতিক শক্তি বেড়ে যায়।

১৯৭৫ সালের পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কথিত মুক্তিযুদ্বের আর্দশের ওপর ভর দিয়ে যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধীরা উত্থান ঘটিয়েছিল নিজেদের। গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম রুখতে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীরা মুক্তমনের অসাম্প্রদায়িক লেখককে একের পর এক হত্যা করেছিল সেই সময়। জাগরণ মঞ্চের আন্দোলন প্রতিহত করতে রাজধানীর মতিঝিলে কওমিগোষ্ঠীর সংগঠন হেফাজত সমাবেশ করে। এ সমাবেশ থেকেই হেফাজত তার জঘন্য কার্যক্রম চালায়। হেফাজত দেশের সমসাময়িককালের নিষ্ঠুরতম ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ মে। ওই সময় সাভারে ঘটেছিল গার্মেন্ট দুর্ঘটনা। সাভার ট্র্যাজেডির সারি সারি লাশের স্তূপের ভারে জাতি যখন শোকে মুহ্যমান ঠিক সেই মুহূর্তে লাখো শোকাতুর মানুষের শোকানুভূতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠে চরম উগ্র মৌলবাদীগোষ্ঠী হেফাজত।

২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলাম যে বর্বরতা চালিয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। হেফাজতের সহিংস তাণ্ডবে ২৭ জন প্রাণ হারান। হেফাজতের তাণ্ডবে ভস্মীভূত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। হেফাজতের এ তাণ্ডব স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। হেফাজতের এ তাণ্ডবলীলা থেকে রেহাই পায়নি পবিত্র কোরআন শরীফ। হেফাজতের কর্মীরা পবিত্র কোরআন শরীফ বিক্রির দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয় আর শত শত পবিত্র কোরআন শরীফ ভস্মীভূত হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসে এরকম জঘন্যতম ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইহুদিরাও পবিত্র কোরআন শরীফে আগুন দিতে পারেনি। দৈনিক বাংলার মোড় থেকে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত শুধুমাত্র বায়তুল মোকাররমের ফুটপাথের ২৫৮টি দোকান সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে হেফাজতের কর্মীরা। ২০১৩ সালের এ নিষ্ঠুর হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলে গিয়ে কওমি শিক্ষাগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনা হলো।

কী লাভ হলো; এই কালসাপেরা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারাকে রপ্ত করতে পেরেছে? মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এরা আবার ফুঁসে উঠলো। কওমিগোষ্ঠীর হেফাজত এখন বাংলা জনপদের মূল সংস্কৃতি আবহটা ধ্বংস করতে আইএসের ন্যায় মাঠে নেমে পড়েছে। সুতরাং এদের প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যের প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। এ প্লাটফর্মটি গড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধের আর্দশবাদীদের দিয়েই, সদ্য যোগ দেয়াদের নিয়ে করলে হেফাজত লালন করাই হবে। কুষ্টিয়ায় জাতির পিতার ভাস্কর্যটি ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা রাতের অন্ধকারে। এরা কারা? এই কুষ্টিয়ায় দুই-এক বছর আগে জামায়াত-শিবিরের কিছু কর্মী জাতির পিতার গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের আর্দশের ধারায় যোগ দিচ্ছে; অপরদিকে মূল নেতারা এখন গা-ঢাকা দিয়ে আছে। হেফাজতসহ মৌলবাদীগোষ্ঠী হুমকি দিয়ে বলেছে- এ দেশে ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। অথচ পাকিস্তান আমলেও এই মৌলবাদী অপশক্তির ধারাটি বাংলা জনপদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলতে ভয় পেত। আজ স্বাধীন দেশে মৌলবাদীগোষ্ঠী প্রকাশ্যে বাংলা জনপদের সংস্কৃতির বিরোধিতা করছে? এরা এত সাহস পেল কোথায়? স্বাধীনতাবিরোধী আর্দশের বিশ্বাসীরা এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আচ্ছাদিত হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে পারে।

জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে তাদের কর্মীরা। প্রশাসন, মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলে জামায়াতের কর্মীরা ঢুকে পড়েছে, আর সুযোগ পেলেই তারা জামায়াতি আর্দশ বাস্তবায়নে চেষ্টা চালায়।

এক সময়ের শিবিরকর্মী ছিল এক ব্যক্তি। এক সময় এই ব্যক্তিটির হাতে নাজেহাল ও নির্যাতিত হয়েছে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির কর্মীরা। এখন এই ব্যক্তিই স্বাধীনতার পক্ষের একটি ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার কর্মী হিসেবে ময়মনসিংহে দায়িত্ব পালন করছে। ময়মনসিংহের গণমাধ্যম কর্মীদের সমাজে গড়ে তুলেছে নিজস্ব অবস্থান। ১৯৮৪ সালে ময়মনসিংহের ভালুকা কলেজে ছাত্রলীগের নবীনবরণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র হামলা চালায়। সেই হামলার মূল নিয়ন্ত্রক ছিল একজন কুখ্যাত রাজাকার। যে হামলাকারীরা ওই দিন কুখ্যাত রাজাকারের নির্দেশে ছাত্রলীগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানটি পণ্ড করে দিয়েছিল, তাদের অনেককেই এখন দেখা যায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে।

সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক সংগঠনে কর্মী বাড়ানোর সময় দেখা উচিত- আগত কর্মীরা কোথা থেকে এসেছে এবং অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস কী? তা না দেখলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক সংগঠনগুলোই একদিন আত্মঘাতের কবলে পতিত হবে।

[লেখক : কলামিস্ট]