ঘুরেফিরে সংবাদকর্মীরাই হামলার লক্ষ্য হন কেন

আবু জাফর

একটা সময় ছিল যখন মানুষ ছিল জনবিচ্ছিন্ন, কুয়োর ব্যাঙের মতো নিজ গ্রাম বড়জোর স্বদেশই ছিল তার চেনা জগতের মধ্যে। তবে যারা এ বিচ্ছিন্নের জাল ছিন্ন করে পুরো বিশ্বের সব কিছু সবার কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছে তাদের সামনের সারিতেই সংবাদকর্মীদের অবস্থান। আছে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া। এগুলোর মাধ্যমেই ইতিহাসের পরতে পরতে বিভিন্ন সংবাদ সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। বিংশ শতাব্দীর অনেকেই ব্যস্ত কীভাবে মঙ্গল গ্রহে জায়গা রাখা যায়। কেউবা চাঁদের দেশে ঘুরতে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর; কিন্তু পাশের ফ্লাটে যে একটা বৃদ্ধ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে বা পাড়ার অসহায় মেয়েটাকে হিংস্র হায়েনার দল গণধর্ষণ করছেÑ তার খবর রাখে কে? একমাত্র সংবাদকর্মীরা শত বাধা পেরিয়ে ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেন জাতির সামনে। যে গ্রহে সংবাদকর্মীদের এত অবদান এত প্রয়োজনীয়তা, সেই সংবাদকর্মীরাই হন নানামুখী নিপীড়নের শিকার।

তবে বিংশ শতাব্দীর এই প্রান্তে এসে সংবাদকর্মী যেন পুরো বিশ্বেই চোখের বালি হয়ে উঠেছে। এমনকি উন্নত দেশগুলোতে যে সংবাদকর্মীরা খুব স্বাধীন তাও বলা যাবে না। কেননা গত কয়েক মাস আগে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনের সময় কয়েক ডজন সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকার নামে বেসরকারি একটি সংস্থা জানিয়েছে, সাংবাদিকদের ওপর এমন ৯০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। সিএনএনের সাংবাদিক ও ক্রুদের গ্রেফতারও করা হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, সম্প্রতি চীন এবং উত্তর কোরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের সংবাদকর্মীদের ওপর বিরূপ আচরণে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।

গেল কয়েক বছর আগে ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রায় ৪০ জনেরও অধিক সংবাদকর্মী আহত হয়েছেন। বেসরকারি ‘আর্টিকেল ১৯’ সংস্থায় এ তথ্য উঠে এসেছিল। সেই বছরেই সিরাজগঞ্জে সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল ছবি তোলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান? রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স থেকে প্রকাশিত প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বালাদেশের অবস্থান ১৪৬তম? প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান ১৩৮তম ও নেপালের অবস্থান ১০৬তম? পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ১৩৯ ও ১৩১তম? অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে রয়েছে বাংলাদেশ?

তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কথা নতুন করে সামনে আসছে। মূলত তারা তাদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে। অনেকেই মনে করছেন প্রভাবশালীদের অপকর্ম যেন কখনো প্রকাশিত না হয়, সেই পথটি নিশ্চিত করতেই সাংবাদিকদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার করা হয়। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ততদিন পর্যন্ত সম্ভব হবে না, যতদিন সাংবাদিকরা হেনস্তার শিকার হয়? তবে আইনগত নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশে সাংবাদিকতা চর্চায়ও পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিক-অভিনেতা, শিল্পী-ডাক্তার সবাই চান তাদের ঘিরে আলাপ-আলোচনা হোক। পত্রপত্রিকার পাতায় ও টেলিভিশনের পর্দায় তাদের বিষয় নিয়ে কথা চলুক। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যম চায় এমন খবর যা শ্রোতা, পাঠক বা দর্শকের মন খুশি করে। তবে এ দুটি থেকে বের হয়েই কাজ করা উচিত বলে মনে হয়। আর তাতেই রক্ষা পাবে সমস্ত অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি।

গত ১০ ডিসেম্বর কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দুলালপুর বাজারে দুর্বৃত্তদের হামলায় তিন সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। স্থানীয় উপনির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে দুলালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে তারা হামলার শিকার হন। এমন হতে থাকলে বিশ্ব হয়তো আর পাবে না যুক্তরাষ্ট্রের মার্গারেট ব্রুক হোয়াইট, ইংল্যান্ডের রবার্ট ফিস্ক আর ইরানের শিফা গার্দির মতো সাংবাদিককে। আর সাইমন ড্রিং ও কিশোর পারেখর মতো সাংবাদিকরা জীবনবাজি রেখে আর কোন দেশে যুদ্ধ সংবাদ নিতে উদ্বুদ্ধ হবেন না। তাই সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কোন বিকল্প নেই।

সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ , ১৩ পৌষ ১৪২৭, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

ঘুরেফিরে সংবাদকর্মীরাই হামলার লক্ষ্য হন কেন

আবু জাফর

একটা সময় ছিল যখন মানুষ ছিল জনবিচ্ছিন্ন, কুয়োর ব্যাঙের মতো নিজ গ্রাম বড়জোর স্বদেশই ছিল তার চেনা জগতের মধ্যে। তবে যারা এ বিচ্ছিন্নের জাল ছিন্ন করে পুরো বিশ্বের সব কিছু সবার কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছে তাদের সামনের সারিতেই সংবাদকর্মীদের অবস্থান। আছে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া। এগুলোর মাধ্যমেই ইতিহাসের পরতে পরতে বিভিন্ন সংবাদ সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। বিংশ শতাব্দীর অনেকেই ব্যস্ত কীভাবে মঙ্গল গ্রহে জায়গা রাখা যায়। কেউবা চাঁদের দেশে ঘুরতে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর; কিন্তু পাশের ফ্লাটে যে একটা বৃদ্ধ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে বা পাড়ার অসহায় মেয়েটাকে হিংস্র হায়েনার দল গণধর্ষণ করছেÑ তার খবর রাখে কে? একমাত্র সংবাদকর্মীরা শত বাধা পেরিয়ে ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেন জাতির সামনে। যে গ্রহে সংবাদকর্মীদের এত অবদান এত প্রয়োজনীয়তা, সেই সংবাদকর্মীরাই হন নানামুখী নিপীড়নের শিকার।

তবে বিংশ শতাব্দীর এই প্রান্তে এসে সংবাদকর্মী যেন পুরো বিশ্বেই চোখের বালি হয়ে উঠেছে। এমনকি উন্নত দেশগুলোতে যে সংবাদকর্মীরা খুব স্বাধীন তাও বলা যাবে না। কেননা গত কয়েক মাস আগে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনের সময় কয়েক ডজন সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকার নামে বেসরকারি একটি সংস্থা জানিয়েছে, সাংবাদিকদের ওপর এমন ৯০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। সিএনএনের সাংবাদিক ও ক্রুদের গ্রেফতারও করা হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, সম্প্রতি চীন এবং উত্তর কোরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের সংবাদকর্মীদের ওপর বিরূপ আচরণে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।

গেল কয়েক বছর আগে ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রায় ৪০ জনেরও অধিক সংবাদকর্মী আহত হয়েছেন। বেসরকারি ‘আর্টিকেল ১৯’ সংস্থায় এ তথ্য উঠে এসেছিল। সেই বছরেই সিরাজগঞ্জে সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল ছবি তোলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান? রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স থেকে প্রকাশিত প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বালাদেশের অবস্থান ১৪৬তম? প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান ১৩৮তম ও নেপালের অবস্থান ১০৬তম? পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ১৩৯ ও ১৩১তম? অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে রয়েছে বাংলাদেশ?

তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কথা নতুন করে সামনে আসছে। মূলত তারা তাদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে। অনেকেই মনে করছেন প্রভাবশালীদের অপকর্ম যেন কখনো প্রকাশিত না হয়, সেই পথটি নিশ্চিত করতেই সাংবাদিকদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার করা হয়। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ততদিন পর্যন্ত সম্ভব হবে না, যতদিন সাংবাদিকরা হেনস্তার শিকার হয়? তবে আইনগত নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশে সাংবাদিকতা চর্চায়ও পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিক-অভিনেতা, শিল্পী-ডাক্তার সবাই চান তাদের ঘিরে আলাপ-আলোচনা হোক। পত্রপত্রিকার পাতায় ও টেলিভিশনের পর্দায় তাদের বিষয় নিয়ে কথা চলুক। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যম চায় এমন খবর যা শ্রোতা, পাঠক বা দর্শকের মন খুশি করে। তবে এ দুটি থেকে বের হয়েই কাজ করা উচিত বলে মনে হয়। আর তাতেই রক্ষা পাবে সমস্ত অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি।

গত ১০ ডিসেম্বর কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দুলালপুর বাজারে দুর্বৃত্তদের হামলায় তিন সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। স্থানীয় উপনির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে দুলালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে তারা হামলার শিকার হন। এমন হতে থাকলে বিশ্ব হয়তো আর পাবে না যুক্তরাষ্ট্রের মার্গারেট ব্রুক হোয়াইট, ইংল্যান্ডের রবার্ট ফিস্ক আর ইরানের শিফা গার্দির মতো সাংবাদিককে। আর সাইমন ড্রিং ও কিশোর পারেখর মতো সাংবাদিকরা জীবনবাজি রেখে আর কোন দেশে যুদ্ধ সংবাদ নিতে উদ্বুদ্ধ হবেন না। তাই সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কোন বিকল্প নেই।