জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, বিপর্যস্ততা ও ক্ষয়ক্ষতির অনুপাতে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়ার তাগিদ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। গতকাল সংস্থাটির আয়োজিত ‘করোনা ও বন্যা মোকাবিলায় ত্রাণ কর্মসূচি এবং কৃষি প্রণোদনা : সরকারি পরিষেবার কার্যকারিতা’ শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। সিপিডি ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় ‘গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ’ শীর্ষক চলমান প্রকল্পের আওতায় এ সংলাপটি আয়োজিত হয়। এ সংলাপটির সহযোগী আয়োজক ছিল মানব মুক্তি সংস্থা, সিরাজগঞ্জ এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ।

সংলাপে উঠে আসে, চলমান করোনাভাইরাস মহামারী ও বিধ্বংসী বন্যায় সিরাজগঞ্জের মতো তুলনামূলকভাবে বেশি দুর্যোগপ্রবণ চর এলাকায় ত্রাণ ও কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি পরিষেবার কার্যকারিতা বাড়ানো দরকার। সেজন্য বিশদ ডাটাবেজ তৈরিসহ ত্রাণ বিতরণ সম্পর্কিত অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্যের প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। একইসঙ্গে ত্রাণসহ অন্য সরকারি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার পরিবর্তে সামগ্রিক বিপন্নতা মূল মাপকাঠি হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। করোনার অভিঘাত বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় সুদূরপ্রসারী চিহ্ন রেখে যাবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই দুর্যোগ পূর্ব-বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে আরও সংকটময় এবং এসডিজির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কোভিড অতিমারীর প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক বিধ্বংসী বন্যা সিরাজগঞ্জের মতো তুলনামূলকভাবে বেশি দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাগুলোর পরিস্থিতি আরও সংকটময় করেছে। সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মুনতাসির কামাল মূল প্রতিবেদনে এই আঙ্গিকগুলো তুলে ধরেন। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলায় করোনা ও বন্যা মোকাবিলায় গৃহীত সরকারি ত্রাণ এবং কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির কার্যকারিতার একটি প্রাথমিক মূল্যায়নও উপস্থাপন করেন।

সংলাপে আরও বলা হয়, করোনা ও বন্যা মোকাবিলায় ত্রাণ এবং কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রণোদনা সহায়তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ত্রাণসেবা সম্পর্কিত ‘হটলাইন’ নাম্বারসহ (যেমন : ৩৩৩) প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন অভিনব যেসব উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে সে সম্পর্কে স্থানীয় পর্যায়ের সুবিধাভোগীরা এখনও যথেষ্ট সচেতন নন। সুবিধাভোগী নির্বাচন অনেক ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। সামগ্রিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এবং উপজেলা/ইউনিয়নভিত্তিক বরাদ্দের বিভাজনের মধ্যে অধিকতর সমন্বয়ের জায়গা আছে। সুবিধাভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি বিশদ ডাটাবেসের অভাব সরকারি পর্যায় থেকে বারংবার উল্লিখিত হয়েছে।

এ মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সিপিডি সুপারিশ করে, সঠিক চাহিদা নিরূপন এবং সে অনুযায়ী বরাদ্দ নির্ধারণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ের দারিদ্র্যের হার, জনঘনত্বের হার, বেকারত্বের হার ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে আর্থসামাজিক সূচকসমৃদ্ধ একটি বিশদ ডাটাবেজ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। ত্রাণসেবা সংক্রান্ত প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ (যেমন : হটলাইন/নির্ধারিত মোবাইল নাম্বার) সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া যেন সরকারি কৃষি প্রণোদনাসমূহ দুর্যোগে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে পৌঁছায় তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সুপারিশ রাখা হয়।

সংসদ সদস্য ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। তিনি ত্রাণ ও প্রণোদনা সরবরাহে অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করে বলেন, অনিয়মের যেসমস্ত অভিযোগ এসেছিল সে ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তিনি ত্রাণ সরবরাহে সংসদ সদস্যদের আরও প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে মত দেন এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সংলাপের আরেক সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় বলেন, করোনা মোকাবিলায় ও ত্রাণ বিতরণে স্থানীয় প্রশাসন অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে কাজ করেছে, যদিও কিছু অপ্রতুলতা রয়েছে। তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চল যেহেতু একটি দুর্যোগপূর্ণ এলাকা, প্রণোদনা বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন। কৃষিকার্ড হালনাগাদ করা এবং তা ডিজিটাল করার ওপরে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। এছাড়া তুলনামূলক বেশি দুর্গম চর এলাকার কৃষকদের যাতে যথাসময়ে কৃষি প্রণোদনার সার ও বীজ সরবরাহ করা যায় সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।

চৌহালী ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে প্রায় ১২০ জন কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের (সিবিও) সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এই সংলাপে যোগ দেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ ও মন্তব্য উপস্থাপন করেন। তাদের বক্তব্যে ত্রাণ সহায়তার অপ্রতুলতা এবং সমসাময়িক ত্রাণ বিতরণ করার বিষয়গুলো উঠে আসে। তারা তাদের তৃণমূল অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই ২৫০০ টাকা নগদ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এছাড়া সিরাজগঞ্জ এলাকায় দুর্বল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার দরুণ সেখানকার স্থানীয় জনগণ বিভিন্ন সরকারি হটলাইন পরিষেবার যথাযথ সুফল লাভ করতে পারেনি।

সংলাপে মানব মুক্তি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. হাবিবুল্লাহ বাহার বলেন, গবেষণা প্রতিবেদনটি খুবই সময়োপযোগী ও কার্যকর হয়েছে। দরিদ্রতার ভিত্তিতে ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যার অনুপাতে যদি সহায়তা বরাদ্দ দেয়া হয়, তাহলে তা খুবই যৌক্তিক হবে। এছাড়া তিনি প্রস্তাব করেন, কৃষিঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন জামিনদার হিসেবে কাজ করতে পারে। দরিদ্র পরিবারের তালিকা ও ডাটাবেজ তৈরিতে বিভিন্ন মানবিক সাহায্য প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অনুষ্ঠানটি শেষ করেন। এ সংলাপে সিবিও প্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, উন্নয়নকর্মী, এনজিও প্রতিনিধি, ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তা, সমাজকর্মী, পেশাজীবী এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ সিরাজগঞ্জ জেলার নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।