৫০তম বিজয় দিবস

মোস্তাফা জব্বার

২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ৫০তম বিজয় দিবস ছিল। বাংলা ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বে বাঙালির একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড পাবার ৫০তম মাহেন্দ্রক্ষণটি আমরা করোনার মাঝেও উৎসবে আনন্দে উদ্যাপন করেছি। আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে এবার বিজয় দিবসটি বহুমুখী, বহুমাত্রিক ও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা এর জন্মের ইতিহাস, ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা, ৭৫ থেকে ৯৬ এবং ২০০১-০৮ এর গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের ইতিহাস কম করে হলেও জানি। আমরা যারা ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে জীবনের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করি তারা যেমনি করে ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করার লড়াই করেছি তেমনি করে বিজয় অর্জনের ৪৯ বছর ধরে বাংলাদেশকে তার স্বমহিমায় সমৃদ্ধ, উন্নত, ক্ষুধা-দরিদ্রমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বিজয় এর ৫০তম দিন দেশবাসী অবশ্যই স্মরণ করতে পারেন যে বিজয় অর্জনের ২৫ দিনের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার প্রিয় স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন এবং ৭৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে পাকিস্তানি ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা বাংলাদেশকে হত্যা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ও জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করে। অনেকের কাছেই এটি স্পষ্ট নয় যে পঁচাত্তরের হত্যাযজ্ঞ শুধু একজন রাষ্ট্রপতি বা তার ৪ সহচরকে হত্যা করা হয় কেন। দুনিয়াতে এমন অনেক প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন।

কিন্তু তাদের হত্যা করাটি ছিল কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাটি তেমন ব্যক্তিগত হত্যাকাণ্ড ছিল না বলে তাকে সপরিবারে হত্যার পর ঘাতকরা জাতীয় চার নেতাকে জেলখানার ভেতরে প্রবেশ করে হত্যা করে। একটু স্মরণ করে দেখুন ৭৫ এর পর বাংলাদেশের জন্মের অঙ্গীকারকে পরিবর্তন করে আমাদের দেশটাকে পাকিস্তান বানানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। ২১টি বছর মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান জয় বাংলা নিষিদ্ধ রাখা থেকে রাষ্ট্রের মূল নীতিমালা লঙ্ঘন করে যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে পুনর্বাসন করা ও যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানো পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধী সব অপচেষ্টাই করা হয়েছে। সামরিক স্বৈরাচার থেকে শুরু করে হ্যাঁ-না ভোটের প্রহসন ও নির্বাচনের নামে সংসদীয় সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে পেছনে হাটানোর চেষ্টা অবিরাম করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হত্যা-নির্যাতন-বিনা বিচারে ফাঁসি ও বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার বন্ধ করার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা হয়। সেই ২১ বছরের উন্নতি-অগ্রগতির হিসাব এখানে তুলে ধরলে ও তার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৭৭ বছরের শাসনকালের অগ্রগতি তুলনা করলে পুরোটাই হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হবে।

বলা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর পর ৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে দেশের ২১ বছরের নোংরা আবর্জনা ফেলে দিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ায় হাত দেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে যোগ দিতে না পারা একটি লাঙল জোয়ালের দেশকে তিনি তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে শরিক করেন। বাস্তবতা হচ্ছে ৬৯ সালে শুরু হওয়া তৃতীয় শিল্প বিপ্লব বস্তুত দৃশ্যমান হতে থাকে আশির দশকের দিকে। আমি নিজে ৮৭ সালে কম্পিউটার দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করে ৬৯ সালে শুরু হওয়া তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে শরিক হই। শেখ হাসিনা নিজে সেই দশকেই নিজে ও তার দলকে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবে যুক্ত করেন। এটি অবিস্মরণীয় যে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে যোগ দিতে বাংলাদেশের পেছনে পড়াটা তিনি ২০০১ সালেল মাঝেই পূরণ করেন। ৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ৯৬-২০০১ সময়কালে তিনি তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে অংশ নেবার সব সক্ষমতা অর্জনের উপযোগী করেন। কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করা থেকে শুরু করে অনলাইন ইন্টারনেট ও মোবাইল প্রযুক্তির পাশাপাশি তিনি মানবসম্পদ তৈরি করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেন। এরপর আবার বাংলাদেশ একটি অন্ধকারের যুগে প্রবেশ করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে জোট সরকার কারচুপি করে বিজয়ী হয়ে জিয়া-এরশাদের মতোই দেশটাকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করে। তাদের মন্ত্রিসভায় ঘাতক হানাদারের দোসররা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে অংশগ্রহণ করে। এর অবসান হয় ২০০৮ সালে।

এই দেশের ডিজিটাল যাত্রা কার্যত ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২১ সালে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত করানোর অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। বিগত এক যুগে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের প্রস্তুতি পর্ব সমাপ্ত করেছে। পুরো সরকার, আর্থসামাজিক অবস্থা, শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ এমন কোন বিষয় নেই যেখানে এই প্রস্তুতির ছোঁয়া লাগেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার নেতৃত্বে এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি চলাকালেও হানাদার বাহিনীর দোসর একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা দেশটিকে পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত থেকে সরে আসেনি। তারা এখনও বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা এই দেশটাকে তার জন্মের ঠিকানা থেকে সরিয়ে একটি জঙ্গি, মৌবাদী, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানাতে চায়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা, বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙা, নারীদের প্রতি কুৎসিৎ বাক্য বর্ষর ও আধুনিক বাংলাদেশের সব অর্জনকে পশ্চাদমুখী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সম্প্রতি এই কুচক্রীদের সম্পর্কে মাননীয় পধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে তার বক্তব্য তুলে ধরেন।

“একাত্তরের জামায়াতে ইসলামের মতো করে এখন হেফাজতে ইসলাম নতুন রাজাকার হয়ে উঠছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙে স্বাধীনতার চেতনার ওপর হামলা করা হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনার ওপর যারা হামলা করবে তাদের রাজাকারদের মতো বিচার করা হবে।

সজীব ওয়াজেদ জয় মৌলবাদী শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারদের বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলা হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

শনিবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে চতুর্থ ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উপলক্ষে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ১২ বছর’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে সমাপনী বক্তব্যে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।

সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে তারা সাহস করেছে জাতির পিতার মূর্তি ভাঙার। তাদের এই সাহস জাতির জনকের মূর্তির ওপর হামলা করাটা কী? এটা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ওপর হামলা। আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ওপর হামলা কারা করেছে, যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাদের আমরা কী বলি? তাদের আমরা কী ডাকি, তাদের আমরা রাজাকার ডাকি। একাত্তরে ছিল জামায়াত আর এখন হেফাজতও সেই নতুন রাজাকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার চেতনা আমরা কাউকে মুছে দিতে দেব না। স্বাধীনতার চেতনার ওপর যারা হামলা করবে তাদের রাজাকারদের মতো বিচার করা হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে তাদের বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলা হবে।

সজীব ওয়াজেদ বলেন, তারা হুমকি দিচ্ছে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানিয়ে দেবে আমরা কি সেটা চাই? আমরা আবার সেই একটি মান্ধ্যাতা আমলের দেশ হয়ে যাব? সেটা আমরা হতে দেব না। আওয়ামী লীগ সরকার যতদিন আছে আমরা সেটা হতে দেবনা। আমাদের তরুণ-তরুণীদের পক্ষে আমি বলতে চাই, এই মৌলবাদী শক্তিকে আমাদের মুছে ফেলতে হবে।

তারা যদি আফগানিস্তান এত পছন্দ করে তাদের বাংলাদেশ থেকে বের করে দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি, বাংলাদেশকে আধুনিক করেছি। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল করছি সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। রাজাকারদের মোকাবিলা আমরা করতে জানি।’

শুধু সজীব ওয়াজেদ জয় নন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাদারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাসান মাহমুদ, মাহবুবুল আলম হানিফসহ সব নেতৃবৃন্দ দৃঢ়তার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। সারা দেশে মুজিব ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে তুমুল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হয়েছে।

আমরা সজীব ওয়াজেদ জয় যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন তাকে শুধু দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করি না বরং আমরা মনে করি এই রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষকে ৫০তম বিজয় দিবসে শপথ নিতে হবে যে এই দেশটাকে আমরা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে তার জন্মের ঠিকানায় প্রতিষ্ঠা করব। বঙ্গবন্ধুর পথ ধরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশটাকে যে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে খুব সহজেই আমরা দেখতে পারি মৌলবাদী, জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িকতায় নিমজ্জিত পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ থেকে কতটা পেছনে। আমরা তাই বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের পথ ধরেই হাঁটব না, তিনি যে শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াই এর দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন সেই পথেই চলব।

আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা যে বঙ্গবন্ধুর পর আমরা একজন শেখ হাসিনা পেয়েছি। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কোথা থেকে কোথায় এসেছে এটি এখন আর কাউকে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না। তিনি আমাদের জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন। তার সেই ঘোষণা বাস্তবায়নে নিরলস নেতৃত্ব দিচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। আমাদের সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হবে।

৫০তম বিজয় দিবসে আমরা এই স্বপ্নটা দেখি যে সামনের বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা সারা বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় একটি দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।

ঢাকা। প্রথম লেখা, ১২ ডিসেম্বর ২০২০। সর্বশেষ আপডেট ১৯ ডিসেম্বর, ২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ , ১৪ পৌষ ১৪২৭, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

৫০তম বিজয় দিবস

মোস্তাফা জব্বার

image

২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ৫০তম বিজয় দিবস ছিল। বাংলা ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বে বাঙালির একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড পাবার ৫০তম মাহেন্দ্রক্ষণটি আমরা করোনার মাঝেও উৎসবে আনন্দে উদ্যাপন করেছি। আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে এবার বিজয় দিবসটি বহুমুখী, বহুমাত্রিক ও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা এর জন্মের ইতিহাস, ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা, ৭৫ থেকে ৯৬ এবং ২০০১-০৮ এর গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের ইতিহাস কম করে হলেও জানি। আমরা যারা ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে জীবনের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করি তারা যেমনি করে ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করার লড়াই করেছি তেমনি করে বিজয় অর্জনের ৪৯ বছর ধরে বাংলাদেশকে তার স্বমহিমায় সমৃদ্ধ, উন্নত, ক্ষুধা-দরিদ্রমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বিজয় এর ৫০তম দিন দেশবাসী অবশ্যই স্মরণ করতে পারেন যে বিজয় অর্জনের ২৫ দিনের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার প্রিয় স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন এবং ৭৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে পাকিস্তানি ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা বাংলাদেশকে হত্যা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ও জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করে। অনেকের কাছেই এটি স্পষ্ট নয় যে পঁচাত্তরের হত্যাযজ্ঞ শুধু একজন রাষ্ট্রপতি বা তার ৪ সহচরকে হত্যা করা হয় কেন। দুনিয়াতে এমন অনেক প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন।

কিন্তু তাদের হত্যা করাটি ছিল কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাটি তেমন ব্যক্তিগত হত্যাকাণ্ড ছিল না বলে তাকে সপরিবারে হত্যার পর ঘাতকরা জাতীয় চার নেতাকে জেলখানার ভেতরে প্রবেশ করে হত্যা করে। একটু স্মরণ করে দেখুন ৭৫ এর পর বাংলাদেশের জন্মের অঙ্গীকারকে পরিবর্তন করে আমাদের দেশটাকে পাকিস্তান বানানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। ২১টি বছর মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান জয় বাংলা নিষিদ্ধ রাখা থেকে রাষ্ট্রের মূল নীতিমালা লঙ্ঘন করে যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে পুনর্বাসন করা ও যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানো পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধী সব অপচেষ্টাই করা হয়েছে। সামরিক স্বৈরাচার থেকে শুরু করে হ্যাঁ-না ভোটের প্রহসন ও নির্বাচনের নামে সংসদীয় সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে পেছনে হাটানোর চেষ্টা অবিরাম করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হত্যা-নির্যাতন-বিনা বিচারে ফাঁসি ও বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার বন্ধ করার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা হয়। সেই ২১ বছরের উন্নতি-অগ্রগতির হিসাব এখানে তুলে ধরলে ও তার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৭৭ বছরের শাসনকালের অগ্রগতি তুলনা করলে পুরোটাই হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হবে।

বলা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর পর ৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে দেশের ২১ বছরের নোংরা আবর্জনা ফেলে দিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ায় হাত দেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে যোগ দিতে না পারা একটি লাঙল জোয়ালের দেশকে তিনি তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে শরিক করেন। বাস্তবতা হচ্ছে ৬৯ সালে শুরু হওয়া তৃতীয় শিল্প বিপ্লব বস্তুত দৃশ্যমান হতে থাকে আশির দশকের দিকে। আমি নিজে ৮৭ সালে কম্পিউটার দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করে ৬৯ সালে শুরু হওয়া তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে শরিক হই। শেখ হাসিনা নিজে সেই দশকেই নিজে ও তার দলকে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবে যুক্ত করেন। এটি অবিস্মরণীয় যে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে যোগ দিতে বাংলাদেশের পেছনে পড়াটা তিনি ২০০১ সালেল মাঝেই পূরণ করেন। ৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ৯৬-২০০১ সময়কালে তিনি তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে অংশ নেবার সব সক্ষমতা অর্জনের উপযোগী করেন। কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করা থেকে শুরু করে অনলাইন ইন্টারনেট ও মোবাইল প্রযুক্তির পাশাপাশি তিনি মানবসম্পদ তৈরি করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেন। এরপর আবার বাংলাদেশ একটি অন্ধকারের যুগে প্রবেশ করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে জোট সরকার কারচুপি করে বিজয়ী হয়ে জিয়া-এরশাদের মতোই দেশটাকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করে। তাদের মন্ত্রিসভায় ঘাতক হানাদারের দোসররা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে অংশগ্রহণ করে। এর অবসান হয় ২০০৮ সালে।

এই দেশের ডিজিটাল যাত্রা কার্যত ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২১ সালে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত করানোর অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। বিগত এক যুগে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের প্রস্তুতি পর্ব সমাপ্ত করেছে। পুরো সরকার, আর্থসামাজিক অবস্থা, শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ এমন কোন বিষয় নেই যেখানে এই প্রস্তুতির ছোঁয়া লাগেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার নেতৃত্বে এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি চলাকালেও হানাদার বাহিনীর দোসর একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা দেশটিকে পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত থেকে সরে আসেনি। তারা এখনও বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা এই দেশটাকে তার জন্মের ঠিকানা থেকে সরিয়ে একটি জঙ্গি, মৌবাদী, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানাতে চায়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা, বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙা, নারীদের প্রতি কুৎসিৎ বাক্য বর্ষর ও আধুনিক বাংলাদেশের সব অর্জনকে পশ্চাদমুখী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সম্প্রতি এই কুচক্রীদের সম্পর্কে মাননীয় পধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে তার বক্তব্য তুলে ধরেন।

“একাত্তরের জামায়াতে ইসলামের মতো করে এখন হেফাজতে ইসলাম নতুন রাজাকার হয়ে উঠছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙে স্বাধীনতার চেতনার ওপর হামলা করা হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনার ওপর যারা হামলা করবে তাদের রাজাকারদের মতো বিচার করা হবে।

সজীব ওয়াজেদ জয় মৌলবাদী শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারদের বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলা হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

শনিবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে চতুর্থ ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উপলক্ষে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ১২ বছর’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে সমাপনী বক্তব্যে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।

সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে তারা সাহস করেছে জাতির পিতার মূর্তি ভাঙার। তাদের এই সাহস জাতির জনকের মূর্তির ওপর হামলা করাটা কী? এটা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ওপর হামলা। আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ওপর হামলা কারা করেছে, যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাদের আমরা কী বলি? তাদের আমরা কী ডাকি, তাদের আমরা রাজাকার ডাকি। একাত্তরে ছিল জামায়াত আর এখন হেফাজতও সেই নতুন রাজাকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার চেতনা আমরা কাউকে মুছে দিতে দেব না। স্বাধীনতার চেতনার ওপর যারা হামলা করবে তাদের রাজাকারদের মতো বিচার করা হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে তাদের বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলা হবে।

সজীব ওয়াজেদ বলেন, তারা হুমকি দিচ্ছে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানিয়ে দেবে আমরা কি সেটা চাই? আমরা আবার সেই একটি মান্ধ্যাতা আমলের দেশ হয়ে যাব? সেটা আমরা হতে দেব না। আওয়ামী লীগ সরকার যতদিন আছে আমরা সেটা হতে দেবনা। আমাদের তরুণ-তরুণীদের পক্ষে আমি বলতে চাই, এই মৌলবাদী শক্তিকে আমাদের মুছে ফেলতে হবে।

তারা যদি আফগানিস্তান এত পছন্দ করে তাদের বাংলাদেশ থেকে বের করে দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি, বাংলাদেশকে আধুনিক করেছি। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল করছি সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। রাজাকারদের মোকাবিলা আমরা করতে জানি।’

শুধু সজীব ওয়াজেদ জয় নন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাদারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাসান মাহমুদ, মাহবুবুল আলম হানিফসহ সব নেতৃবৃন্দ দৃঢ়তার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। সারা দেশে মুজিব ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে তুমুল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হয়েছে।

আমরা সজীব ওয়াজেদ জয় যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন তাকে শুধু দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করি না বরং আমরা মনে করি এই রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষকে ৫০তম বিজয় দিবসে শপথ নিতে হবে যে এই দেশটাকে আমরা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে তার জন্মের ঠিকানায় প্রতিষ্ঠা করব। বঙ্গবন্ধুর পথ ধরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশটাকে যে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে খুব সহজেই আমরা দেখতে পারি মৌলবাদী, জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িকতায় নিমজ্জিত পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ থেকে কতটা পেছনে। আমরা তাই বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের পথ ধরেই হাঁটব না, তিনি যে শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াই এর দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন সেই পথেই চলব।

আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা যে বঙ্গবন্ধুর পর আমরা একজন শেখ হাসিনা পেয়েছি। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কোথা থেকে কোথায় এসেছে এটি এখন আর কাউকে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না। তিনি আমাদের জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন। তার সেই ঘোষণা বাস্তবায়নে নিরলস নেতৃত্ব দিচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। আমাদের সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হবে।

৫০তম বিজয় দিবসে আমরা এই স্বপ্নটা দেখি যে সামনের বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা সারা বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় একটি দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।

ঢাকা। প্রথম লেখা, ১২ ডিসেম্বর ২০২০। সর্বশেষ আপডেট ১৯ ডিসেম্বর, ২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]