সস্তার তৈজসপত্রে সংকটে মৃৎশিল্প-পাল সম্প্রদায়

এক সময়ের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাটির তৈজসপত্র নির্র্মাণকারী মৃৎশিল্পী পাল সম্প্রদায়ের আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় তাদের জীবনে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। বিজ্ঞানের আধুনিকায়ন ও উন্নত প্রযুক্তির তৈরি দীর্ঘস্থায়ী বাসনপত্র ও সামগ্রীর কাছে মাটির তৈরি ঠুনকো জিনিস এখন আর মানুষের নজরে লাগে না। তার পরও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিলের প্রয়োজন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি বলে এখনও পাল সম্প্রদায়ের অনেকে সাত পুরুষের আদি পেশা জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ধরে রেখেছেন। উপজেলার মল্লিকবাড়ী বাজার সংলগ্ন অনেক পুরোনো পালপাড়া। যেখানে দিনভর চলতো মাটিগুলে বাসনপত্র তৈরির কাজ। মাটি নরম করা, চাকা ঘুড়িয়ে এক খন্ড মাটিতে সুনিপুণ হাত বুলিয়ে তৈরি হতো নানা আকৃতির হাঁড়ি-পাতিল। সারাদিন রোদে শুকিয়ে পুইনঘরে কাঠখড় দিয়ে পুরে তৈরি হতো টনটনে হাঁড়ি-পাতিল ও নানা রকম বাসন-কোসন। হাটে বাজারে গ্রামে গঞ্জে সেসব বিক্রি করে তাদের ঘরে আসতো সংসার খরচের নগদ অর্থ।

গত সোমবার সরেজমিন মল্লিকবাড়ী পালপাড়ায় গেলে প্রদীপ পালের স্ত্রী অর্চনা পাল (৩৫) জানান, ১৬ বছর বয়সে শাঁখা সিঁদুর পরে স্বামী শ্বশুরের ভিটায় এসে কাঠের চাকা হাতে লয়ে সংসারের হাল ধরেছিলাম,খেলনা পুতুল,হাতি, ঘোড়া, ভাতের পেয়ালা, ভাতের ডহি, পানির হাঁড়ি কলস, পিঠার খোলা, খৈ ভাজার পাতিল, গরুর চাড়ি, ধান চাল রাহনের বড় ঝালা, মুটকি, আলো জ্বালানোর মাটির প্রদীপ কতকি বানাইছি, এত কাজ ছিল যে ভাত খাওয়ার সময় অইতোনা, ফইরারা ঘাটে নাও বাইন্দা বাড়ীততন পাতিল নিয়া যাইত নাও ভইরা।

তাদের তৈরি প্রতিটি দৈয়ের পাতিল আড়াই টাকায় বিক্রি হয় ফরিয়াদের কাছে। ফরিয়ারা নিয়ে পাঁচ টাকা করে বিক্রি করে মিষ্টির দোকানে। মাটি প্রস্তুত থাকলে সারাদিনে ১০০ পাতিল তৈরি করতে পারেন। তাদের দুই শিশু সন্তান রয়েছে সাগর পাল (৮) তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে আর মেয়ে ২ বছর বয়স। সামান্য আয় রোজগারে অতি কষ্টে সংসার চলে। তার উপর এনজিও হতে নেয়া ঋণের টাকার কিস্তি পরিশোধে হিমসিম খেতে হয় সারা মাস। টুরকিতে পাতিল ভরে মাথায় নিয়ে ময়াল করতে যাচ্ছিল স্বামী পরিত্যক্তা সন্ধ্যারানী পাল (৫৫)। নিজের তৈরি নয় পার্শ্ববর্তী কালিয়কৈর হতে মাটির বাসনপত্র কিনে এনে মল্লিকবাড়ী বাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। দিনে দুই থেকে আড়াইশ’ টাকা মুনাফা পান। স্বামী পরেশ পাল দ্বিতীয় বিয়ে করায় নিঃসন্তানী সন্ধ্যারানী স্বামীকে ত্যাগ করেন। তিনি জানান, চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ আসলে তাদের তৈরি খেলনা সামগ্রী, মাটির বিভিন্ন সাইজের পাতিলের ব্যাপক কাটতি হতো। এই এলাকায় পাল সম্প্রদায়ের ৩০/৪০টি পরিবার এখনও বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। এদের মধ্যে অনেকেই জীবিকার তাড়নায় কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে পেশা বদল করেছে। আবাহমান বাংলার গৃহস্থ পরিবারের নিত্যকর্মের সহায়ক চিরচেনা প্রাচীনতম ঐতিহ্যভরা মৃৎশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়াতে তারা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ , ১৫ পৌষ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

সস্তার তৈজসপত্রে সংকটে মৃৎশিল্প-পাল সম্প্রদায়

আতাউর রহমান তরফদার, ভালুকা (ময়মনসিংহ)

image

এক সময়ের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাটির তৈজসপত্র নির্র্মাণকারী মৃৎশিল্পী পাল সম্প্রদায়ের আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় তাদের জীবনে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। বিজ্ঞানের আধুনিকায়ন ও উন্নত প্রযুক্তির তৈরি দীর্ঘস্থায়ী বাসনপত্র ও সামগ্রীর কাছে মাটির তৈরি ঠুনকো জিনিস এখন আর মানুষের নজরে লাগে না। তার পরও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিলের প্রয়োজন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি বলে এখনও পাল সম্প্রদায়ের অনেকে সাত পুরুষের আদি পেশা জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ধরে রেখেছেন। উপজেলার মল্লিকবাড়ী বাজার সংলগ্ন অনেক পুরোনো পালপাড়া। যেখানে দিনভর চলতো মাটিগুলে বাসনপত্র তৈরির কাজ। মাটি নরম করা, চাকা ঘুড়িয়ে এক খন্ড মাটিতে সুনিপুণ হাত বুলিয়ে তৈরি হতো নানা আকৃতির হাঁড়ি-পাতিল। সারাদিন রোদে শুকিয়ে পুইনঘরে কাঠখড় দিয়ে পুরে তৈরি হতো টনটনে হাঁড়ি-পাতিল ও নানা রকম বাসন-কোসন। হাটে বাজারে গ্রামে গঞ্জে সেসব বিক্রি করে তাদের ঘরে আসতো সংসার খরচের নগদ অর্থ।

গত সোমবার সরেজমিন মল্লিকবাড়ী পালপাড়ায় গেলে প্রদীপ পালের স্ত্রী অর্চনা পাল (৩৫) জানান, ১৬ বছর বয়সে শাঁখা সিঁদুর পরে স্বামী শ্বশুরের ভিটায় এসে কাঠের চাকা হাতে লয়ে সংসারের হাল ধরেছিলাম,খেলনা পুতুল,হাতি, ঘোড়া, ভাতের পেয়ালা, ভাতের ডহি, পানির হাঁড়ি কলস, পিঠার খোলা, খৈ ভাজার পাতিল, গরুর চাড়ি, ধান চাল রাহনের বড় ঝালা, মুটকি, আলো জ্বালানোর মাটির প্রদীপ কতকি বানাইছি, এত কাজ ছিল যে ভাত খাওয়ার সময় অইতোনা, ফইরারা ঘাটে নাও বাইন্দা বাড়ীততন পাতিল নিয়া যাইত নাও ভইরা।

তাদের তৈরি প্রতিটি দৈয়ের পাতিল আড়াই টাকায় বিক্রি হয় ফরিয়াদের কাছে। ফরিয়ারা নিয়ে পাঁচ টাকা করে বিক্রি করে মিষ্টির দোকানে। মাটি প্রস্তুত থাকলে সারাদিনে ১০০ পাতিল তৈরি করতে পারেন। তাদের দুই শিশু সন্তান রয়েছে সাগর পাল (৮) তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে আর মেয়ে ২ বছর বয়স। সামান্য আয় রোজগারে অতি কষ্টে সংসার চলে। তার উপর এনজিও হতে নেয়া ঋণের টাকার কিস্তি পরিশোধে হিমসিম খেতে হয় সারা মাস। টুরকিতে পাতিল ভরে মাথায় নিয়ে ময়াল করতে যাচ্ছিল স্বামী পরিত্যক্তা সন্ধ্যারানী পাল (৫৫)। নিজের তৈরি নয় পার্শ্ববর্তী কালিয়কৈর হতে মাটির বাসনপত্র কিনে এনে মল্লিকবাড়ী বাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। দিনে দুই থেকে আড়াইশ’ টাকা মুনাফা পান। স্বামী পরেশ পাল দ্বিতীয় বিয়ে করায় নিঃসন্তানী সন্ধ্যারানী স্বামীকে ত্যাগ করেন। তিনি জানান, চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ আসলে তাদের তৈরি খেলনা সামগ্রী, মাটির বিভিন্ন সাইজের পাতিলের ব্যাপক কাটতি হতো। এই এলাকায় পাল সম্প্রদায়ের ৩০/৪০টি পরিবার এখনও বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। এদের মধ্যে অনেকেই জীবিকার তাড়নায় কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে পেশা বদল করেছে। আবাহমান বাংলার গৃহস্থ পরিবারের নিত্যকর্মের সহায়ক চিরচেনা প্রাচীনতম ঐতিহ্যভরা মৃৎশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়াতে তারা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।