পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প

২৫ বছরেও ক্ষতিগ্রস্ত মূল অধিবাসীরা পায়নি প্রতিশ্রুত প্লট

রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। ১৯৯৫ সালে ৬ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করে রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (রাজউক)। প্রকল্পের প্লট দেয়া অঙ্গীকার ভিত্তিতে ঢাকার খিলক্ষেত, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের প্রায় ৩ হাজার ৫০০ মূল অধিবাসীদের কাছ থেকে এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু ২৫ বছরেও প্লট বুঝে পায়নি ক্ষতিগ্রস্ত এই মূল আধিবাসীরা। রাজউকের প্লটের আবেদন করে কোন অগ্রগতি নেই বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

এ পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৭ শতাংশ। তিনবার সময় বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুনে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে তা সম্ভব হবে না। তাই আরও দেড় থেকে ২ বছর সময় বড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে প্রকল্প সূত্র জানায়।

প্লট বরাদ্দে গতি নেই

মূল অধিবাসীদের

গাজীপুরের পাড়াবর্থা গ্রামের মূল অধিবাসী মো. মঞ্জুরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য কালীগঞ্জের পাড়াবর্থা মৌজা থেকে আমাদের ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০০১ সালে জমি বুঝে নেয় রাজউক। এই জমির বিনিময় মূল্য অধিবাসীর ৫ কাঠা প্লট বরাদ্দের কথা ছিল। ‘এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে একটি আবেদন করি। কিন্তু তখন সবাই আবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পুনরায় ২০১৮ সালে আবার আবেদন করা হয়।’ কিন্তু প্লট বরাদ্দে তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানান তিনি।

গাজীপুরের কালীগঞ্জের মূল অধিবাসী সিদাম চন্দ্র ধর। স্ত্রী, দুই ছেলে ও নাতিসহ পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে কালীগঞ্জের পাড়াবর্থা গ্রামে বসবাস করেন তিনি। ২০০৯ সালে কালীগঞ্জের পাড়াবর্র্থা মৌজা থেকে তাদের ৫ বিঘা জমি পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমির বিনিময়ে ৫ কাঠার একটি প্লট দেয়ার কথা ছিল। এই প্লটের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করা হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নেই।

সিদাম চন্দ্র ধরের বড় ছেলে রাজিব চন্দ্র ধর সংবাদকে বলেন, ‘আমার আব্বার নামে ২০১৮ সালের ৫ কাঠা প্লটের জন্য একটি আবেদন করি। আবেদনপত্রে গাজীপুর জেলা প্রশাসন থেকে অ্যাওয়ার্ডপত্র যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্লটের তেমন অগ্রগতি নেই।’

এদিকে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ নিয়ে রাজউক ও গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করে মূল অধিবাসীরা। কারসাজি করে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে অধিবাসীদের ফাইল গায়েব করে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার প্লট অন্য লোকদের কাছে বিক্রির পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

লিখিত বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে শেখ রেজা আহমেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জের দাউদপুর ও রূপগঞ্জে ২১টি মৌজায় প্রায় ৪৫৮৬ একর ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রায় ১৫৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। মূল জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ বিতরণের জন্য গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। সে অনুযায়ী ক্ষতিগ্রদের ফাইল রাজউক ও জেলা প্রশাসনে সংরক্ষণ করা হয়। এরমধ্যে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ নিলেও অন্যরা প্রথমে নিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে তারা ক্ষতিপূরণ নেয়ার জন্য যোগাযোগ করতে গিয়ে জানতে পারেন প্রায় ৬০০ জনের ফাইল গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে গায়েব হয়ে গেছে। যেগুলো রয়েছে তার মধ্যে কিছু ফাইলে ওই অসাধু কর্মকর্তারা কাঁটা-ছেড়া করে নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে। এতে প্রায় ৮০০ প্লট দুর্নীতিবাজ ওই সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। যার মূল্য প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। অধিকার বঞ্চিত পূর্বাচলের মূল অধিবাসীদের ব্যানারে এই এক সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষতিগ্রস্ত মূল অধিবাসীরা। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মো. সাইফুল ইসলাম ভুইয়া, মো. শামীম মিয়া, মো. রুবেল হোসেন, মো. খোরশেদ আলম প্রমুখ।

গাজীপুরের কালীগঞ্জের অধিবাসী শেখ রেজা আহমেদ সংবাদকে বলেন, বড়কাউ মৌজার ১৮ শতাংশ জমি ২০০০ সালে পূর্বাচলের প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর বিনিময়ে ৩/৫ কাঠা একটি প্লট দেয়ার কথাছিল। ‘সার্কুলার ঘোষণার পর ২০১৮ সালে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্লটের জন্য আবেদেন করি কিন্তু এখনও কোন অগ্রগতি নেই।’ এছাড়া গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কারসাজিতে এই প্লট বরাদ্দ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক সংবাদকে বলেন, ‘পূর্বাচল প্রকল্পের প্লট বরাদ্দের জন্য মূল অধিবাসীদের মধ্য থেকে ৩ হাজার ৫০০টি আবেদন গ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে বাছাই-বাচাই করে ১৪৫৩ জনের একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর তাদের প্লট বরাদ্দ দেয়া হবে। যাদের সঠিক কাগজপত্র ছিল না যাচাই-বাচাই করে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে।’

২৫ বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৭ শতাংশ

পূর্বাচল নতুন শহরের জন্য মোট ৬ হাজার ১৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে রাজউক। এই জমির ৪ হাজার ৫০০ একর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায়, ১ হাজার ৫০০ একর গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানায় এবং বাকি ১৫০ একর খিলক্ষেত থানায়। ৬ বার মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২১ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত প্রকল্পের এক তৃতীয়াংশের ভূমি উন্নয়নের কাজও হয়নি। পাঁচবার নকশা পরিবর্তন ও ৩ বার মেয়াদ বাড়িয়ে রাজউক প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে তাও সম্ভব্য হবে না। আরও দেড় থেকে ২ বছর মেয়াদ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রকল্পের মোট ২৬ হাজার প্লটের মধ্যে ১১ হাজার প্লট এখনও তৈরিই হয়নি। যে ১৫ হাজার প্লট রাজউক এখন পর্যন্ত ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করেছে, সেগুলোও পূর্ণাঙ্গ নয়। রাস্তাঘাট হয়নি। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ কবে পাওয়া যাবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। হস্তান্তর করা অনেক প্লটই এখনও খানা-খন্দে ভরা। শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় দফায় আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২০ সাল জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। তৃতীয় দফায় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।

ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন টাউনশিপ গড়ে তুলে ঢাকার ওপর আবাসন চাপ কমানোর লক্ষ্যে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পে বিভিন্ন আকারের ২৬ হাজার প্লট তৈরি করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ৪২৩টি, ডিপ্লোম্যাটিক ৬৩টি, বাণিজ্যিক ১ হাজার ৩০টি, প্রশাসনিক ৪৭৩টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৬৬টি। এ প্রকল্পের প্লটগুলোর মধ্যে ৩ কাঠার প্লট রয়েছে ১০ হাজার ১২টি, ৫ কাঠার প্লট রয়েছে ১ হাজার ৩৬১টি, সাড়ে ৭ কাঠার প্লট রয়েছে ২ হাজার ৬১৮টি, ১০ কাঠার প্লট রয়েছে ২ হাজার ২৫টি। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ হাজার ৩১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সংশোধিত প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৭৮২ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা সম্পূর্ণ রাজউকের নিজস্ব অর্থ।

এ বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক সংবাদকে বলেন, ‘প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো। এ পর্যন্ত ৬৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ অনেকটা পিছিয়ে গেছে। আশা করছি আরও দেড় থেকে দুই বছর সময়ের মধ্যে পুরো প্লট হস্তান্তর করা হবে।’

প্রকল্প এলাকায় ৯৬ তলা আইকনিক টাওয়ারের গতি নেই

২০১৭ সালে মূল নকশা সংশোধন করে ১৯ নম্বর সেক্টরে ১১৪ একর জমির ওপর বাণিজ্যিক শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেয় রাজউক। এই শহরে হওয়ার কথা ৪৬৫ মিটার উচ্চতার ৯৬ তলা আইকনিক টাওয়ার, ৭১ তলা স্বাধীনতা টাওয়ার ও ৫২ তলা ভাষা টাওয়ারসহ ৪১টি গগণচুম্বী ভবন। এসব বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. শামীম জেড বসুনিয়ার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি কমিটি কাজ করছে। এর আগে এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি মারা যাওয়ার পর কমিটির কাজের গতি কিছুটা কমে গেছে।

এ বিষয়ে পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক সংবাদকে বলেন, ‘আইকনিক টাওয়ার নির্মাণে প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. শামীম জেড বসুনিয়ার নেতৃত্বে পরামর্শক কমিটি কাজ করছে। আগামী সপ্তাহে এই কমিটির একটি মিটিং আছে। সেই মিটিংয়ের পর বুঝা যাবে কিভাবে টাওয়ার নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে।’

বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ , ১৬ পৌষ ১৪২৭, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প

২৫ বছরেও ক্ষতিগ্রস্ত মূল অধিবাসীরা পায়নি প্রতিশ্রুত প্লট

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। ১৯৯৫ সালে ৬ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করে রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (রাজউক)। প্রকল্পের প্লট দেয়া অঙ্গীকার ভিত্তিতে ঢাকার খিলক্ষেত, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের প্রায় ৩ হাজার ৫০০ মূল অধিবাসীদের কাছ থেকে এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু ২৫ বছরেও প্লট বুঝে পায়নি ক্ষতিগ্রস্ত এই মূল আধিবাসীরা। রাজউকের প্লটের আবেদন করে কোন অগ্রগতি নেই বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

এ পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৭ শতাংশ। তিনবার সময় বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুনে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে তা সম্ভব হবে না। তাই আরও দেড় থেকে ২ বছর সময় বড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে প্রকল্প সূত্র জানায়।

প্লট বরাদ্দে গতি নেই

মূল অধিবাসীদের

গাজীপুরের পাড়াবর্থা গ্রামের মূল অধিবাসী মো. মঞ্জুরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য কালীগঞ্জের পাড়াবর্থা মৌজা থেকে আমাদের ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০০১ সালে জমি বুঝে নেয় রাজউক। এই জমির বিনিময় মূল্য অধিবাসীর ৫ কাঠা প্লট বরাদ্দের কথা ছিল। ‘এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে একটি আবেদন করি। কিন্তু তখন সবাই আবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পুনরায় ২০১৮ সালে আবার আবেদন করা হয়।’ কিন্তু প্লট বরাদ্দে তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানান তিনি।

গাজীপুরের কালীগঞ্জের মূল অধিবাসী সিদাম চন্দ্র ধর। স্ত্রী, দুই ছেলে ও নাতিসহ পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে কালীগঞ্জের পাড়াবর্থা গ্রামে বসবাস করেন তিনি। ২০০৯ সালে কালীগঞ্জের পাড়াবর্র্থা মৌজা থেকে তাদের ৫ বিঘা জমি পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমির বিনিময়ে ৫ কাঠার একটি প্লট দেয়ার কথা ছিল। এই প্লটের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করা হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নেই।

সিদাম চন্দ্র ধরের বড় ছেলে রাজিব চন্দ্র ধর সংবাদকে বলেন, ‘আমার আব্বার নামে ২০১৮ সালের ৫ কাঠা প্লটের জন্য একটি আবেদন করি। আবেদনপত্রে গাজীপুর জেলা প্রশাসন থেকে অ্যাওয়ার্ডপত্র যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্লটের তেমন অগ্রগতি নেই।’

এদিকে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ নিয়ে রাজউক ও গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করে মূল অধিবাসীরা। কারসাজি করে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে অধিবাসীদের ফাইল গায়েব করে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার প্লট অন্য লোকদের কাছে বিক্রির পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

লিখিত বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে শেখ রেজা আহমেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জের দাউদপুর ও রূপগঞ্জে ২১টি মৌজায় প্রায় ৪৫৮৬ একর ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রায় ১৫৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। মূল জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ বিতরণের জন্য গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। সে অনুযায়ী ক্ষতিগ্রদের ফাইল রাজউক ও জেলা প্রশাসনে সংরক্ষণ করা হয়। এরমধ্যে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ নিলেও অন্যরা প্রথমে নিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে তারা ক্ষতিপূরণ নেয়ার জন্য যোগাযোগ করতে গিয়ে জানতে পারেন প্রায় ৬০০ জনের ফাইল গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে গায়েব হয়ে গেছে। যেগুলো রয়েছে তার মধ্যে কিছু ফাইলে ওই অসাধু কর্মকর্তারা কাঁটা-ছেড়া করে নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে। এতে প্রায় ৮০০ প্লট দুর্নীতিবাজ ওই সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। যার মূল্য প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। অধিকার বঞ্চিত পূর্বাচলের মূল অধিবাসীদের ব্যানারে এই এক সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষতিগ্রস্ত মূল অধিবাসীরা। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মো. সাইফুল ইসলাম ভুইয়া, মো. শামীম মিয়া, মো. রুবেল হোসেন, মো. খোরশেদ আলম প্রমুখ।

গাজীপুরের কালীগঞ্জের অধিবাসী শেখ রেজা আহমেদ সংবাদকে বলেন, বড়কাউ মৌজার ১৮ শতাংশ জমি ২০০০ সালে পূর্বাচলের প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর বিনিময়ে ৩/৫ কাঠা একটি প্লট দেয়ার কথাছিল। ‘সার্কুলার ঘোষণার পর ২০১৮ সালে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্লটের জন্য আবেদেন করি কিন্তু এখনও কোন অগ্রগতি নেই।’ এছাড়া গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কারসাজিতে এই প্লট বরাদ্দ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক সংবাদকে বলেন, ‘পূর্বাচল প্রকল্পের প্লট বরাদ্দের জন্য মূল অধিবাসীদের মধ্য থেকে ৩ হাজার ৫০০টি আবেদন গ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে বাছাই-বাচাই করে ১৪৫৩ জনের একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর তাদের প্লট বরাদ্দ দেয়া হবে। যাদের সঠিক কাগজপত্র ছিল না যাচাই-বাচাই করে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে।’

২৫ বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৭ শতাংশ

পূর্বাচল নতুন শহরের জন্য মোট ৬ হাজার ১৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে রাজউক। এই জমির ৪ হাজার ৫০০ একর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায়, ১ হাজার ৫০০ একর গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানায় এবং বাকি ১৫০ একর খিলক্ষেত থানায়। ৬ বার মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২১ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত প্রকল্পের এক তৃতীয়াংশের ভূমি উন্নয়নের কাজও হয়নি। পাঁচবার নকশা পরিবর্তন ও ৩ বার মেয়াদ বাড়িয়ে রাজউক প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে তাও সম্ভব্য হবে না। আরও দেড় থেকে ২ বছর মেয়াদ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রকল্পের মোট ২৬ হাজার প্লটের মধ্যে ১১ হাজার প্লট এখনও তৈরিই হয়নি। যে ১৫ হাজার প্লট রাজউক এখন পর্যন্ত ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করেছে, সেগুলোও পূর্ণাঙ্গ নয়। রাস্তাঘাট হয়নি। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ কবে পাওয়া যাবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। হস্তান্তর করা অনেক প্লটই এখনও খানা-খন্দে ভরা। শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় দফায় আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২০ সাল জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। তৃতীয় দফায় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।

ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন টাউনশিপ গড়ে তুলে ঢাকার ওপর আবাসন চাপ কমানোর লক্ষ্যে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পে বিভিন্ন আকারের ২৬ হাজার প্লট তৈরি করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ৪২৩টি, ডিপ্লোম্যাটিক ৬৩টি, বাণিজ্যিক ১ হাজার ৩০টি, প্রশাসনিক ৪৭৩টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৬৬টি। এ প্রকল্পের প্লটগুলোর মধ্যে ৩ কাঠার প্লট রয়েছে ১০ হাজার ১২টি, ৫ কাঠার প্লট রয়েছে ১ হাজার ৩৬১টি, সাড়ে ৭ কাঠার প্লট রয়েছে ২ হাজার ৬১৮টি, ১০ কাঠার প্লট রয়েছে ২ হাজার ২৫টি। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ হাজার ৩১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সংশোধিত প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৭৮২ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা সম্পূর্ণ রাজউকের নিজস্ব অর্থ।

এ বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক সংবাদকে বলেন, ‘প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো। এ পর্যন্ত ৬৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ অনেকটা পিছিয়ে গেছে। আশা করছি আরও দেড় থেকে দুই বছর সময়ের মধ্যে পুরো প্লট হস্তান্তর করা হবে।’

প্রকল্প এলাকায় ৯৬ তলা আইকনিক টাওয়ারের গতি নেই

২০১৭ সালে মূল নকশা সংশোধন করে ১৯ নম্বর সেক্টরে ১১৪ একর জমির ওপর বাণিজ্যিক শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেয় রাজউক। এই শহরে হওয়ার কথা ৪৬৫ মিটার উচ্চতার ৯৬ তলা আইকনিক টাওয়ার, ৭১ তলা স্বাধীনতা টাওয়ার ও ৫২ তলা ভাষা টাওয়ারসহ ৪১টি গগণচুম্বী ভবন। এসব বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. শামীম জেড বসুনিয়ার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি কমিটি কাজ করছে। এর আগে এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি মারা যাওয়ার পর কমিটির কাজের গতি কিছুটা কমে গেছে।

এ বিষয়ে পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক সংবাদকে বলেন, ‘আইকনিক টাওয়ার নির্মাণে প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. শামীম জেড বসুনিয়ার নেতৃত্বে পরামর্শক কমিটি কাজ করছে। আগামী সপ্তাহে এই কমিটির একটি মিটিং আছে। সেই মিটিংয়ের পর বুঝা যাবে কিভাবে টাওয়ার নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে।’