রাসায়নিকের আগুনে প্রাণহানির দায়

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

প্রায় ৪০০ বছরের রাজধানী পুরান ঢাকার রয়েছে দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। পুরান ঢাকায় বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রয়েছে, দেশ এবং দেশের বাইরে যা সুপরিচিত। পুরান ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় শত বছর ধরে নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনকারী ছোট-বড় শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সময়ের প্রয়োজনে এর সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। দেশব্যাপী উন্নত শিল্পের প্রসার ও বিকাশের পরেও পুরান ঢাকার ওই সব ব্যবসার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। আবার এসব কারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কেমিক্যালের গুদাম। অথচ রাসায়নিক দ্রব্য মজুতের ব্যাপারে অদ্যাবধি তেমন কোন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

পরিসংখ্যান বলছে, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক ও প্লাস্টিক কারখানা এবং গুদাম রয়েছে। এসব গোডাউনে নানা প্লাস্টিক সামগ্রী ও ড্রামভর্তি রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ এবং ফসফরাস জাতীয় দ্রব্য রয়েছে। এছাড়া মিডফোর্ড এলাকায় রয়েছে অসংখ্য পাইকারি ওষুধ ও কেমিক্যালের বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেখানেও মজুত রয়েছে নানা প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য যার অনেকটাই দাহ্য পদার্থ ও বিস্ফোরক। এসব মজুতের জন্য অগ্নিকাণ্ড নিরোধক তেমন কোন গুদাম বা স্টোরেজ নাই। পুরান ঢাকার অনেক বাড়ির মালিক বেশি ভাড়ার লোভে বাসার নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থ মজুতের জন্য ভাড়া দেন। অনেক ভবনেই মানা হয় না বিল্ডিং কোড, নেই তাতে রাজউকের অনুমতি। এমনকি কারখানা ও গুদামের বেশিরভাগেরই পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস বা ডিডিসি’র ছাড়পত্র নেই। অনেক গুদামে মজুত থাকে বিপুল পরিমাণ প্ল­াস্টিক, জুতার সোল তৈরির এডহেসিভ ও পেস্টিং সলিউশনÑ যার সবই দাহ্য পদার্থ। অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনা, অসাবধানতার ছাপ স্পষ্ট সর্বত্র। বিশেষজ্ঞের মতে, এরমধ্যে বেশকিছু কেমিক্যালের একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে।

বিগত কয়েক বছরে পুরনো ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনে অন্তত ২ শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাসায়নিক কারখানায় ও গুদামে আগুন লেগে বারবার, জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে মানুষ। বিনষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ। কত স্বপ্ন পুড়ে ছাই হচ্ছে। চরম অনিশ্চয়তার মাঝে আজও কাটছে লাখো মানুষের জীবন। অতি সম্প্রতি পুরান ঢাকার উর্দু রোডের নোয়াখালী ভবনে চতুর্থবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আবার নতুন করে এলাকাবাসীকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। প্রায় ৩০টির মতো কারখানা সংবলিত এই ভবনে প্লাস্টিকের কাঁচামাল মজুত ছিল। এবারের অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও বিপুল কাঁচামালসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভবনটি। ২০১০ সালের ৩ জুনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৩০ লাখের অধিক মানুষের বসতি পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে সংঘটিত স্মরণকালের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয় এলাকার ১১টি ভবন, কেড়ে নেয় ১২৪টি তরতাজা প্রাণ। আহত হন ২০০ জনের বেশি মানুষ। একটি ভবনের গ্যাস সিলিন্ডারের চুলা থেকে নিচতলার গোডাউনে রক্ষিত ড্রামভর্তি বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মিথাইল ক্লোরাইডে আগুন লাগে। পরে তা পার্শ্ববর্তী ভবনগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দাহ্য কেমিক্যালের তীব্র আগুন, পর্যাপ্ত আধুনিক অগ্নিনির্বাপক সাজসরঞ্জাম এবং পানির অপ্রতুলতা, গাদাগাদি গড়ে ওঠা ভবনের মাঝে সরুগলিতে যানবাহন চলাচলে প্রতিকূলতায় বাড়ে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা। কিছুকাল পরে সেই পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনে অগ্নিদগ্ধ হয় প্রাণ হারান ৭৯ জন। গুরুতর আহত ৪১, পুড়ে ছাই ৫টি ভবন। ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টের বস্তাভর্তি ১১ ধরনের কেমিক্যালে লাগা আগুনের লেলিহান শিখায় পুরো এলাকা হয় ভস্মীভূত। লালবাগের পোস্তার আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময় ঈদের ছুটি না থাকলে সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ তৈরি কারখানায় সেদিন প্রাণহানি চুড়িহাট্টা বা নিমতলীকেও ছাড়িয়ে যেতে পারতো।

নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের তালিকায় থিনার-বি, থিনার-সি, এসিটেট, ইথানল, ইথাইল এসিটেট, টলুইন, প্রোপাইলিন এলকোহল, প্রোপাইলিন গ্লাইকলসহ ২০টি দাহ্য পদার্থকে চিহ্নিত করে। তখন পুরনো ঢাকার সব ধরনের রাসায়নিক কারখানা স্থাপন, রাসায়নিক পদার্থের মজুত ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নিমতলী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হয়। আদালত অভিযান চালিয়ে ১০৪টি মামলা করে ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে। গঠিত দুটি কমিটি পুরান ঢাকায় ৮০০টি উচ্চমাত্রার বিপজ্জনক রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানার তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো নারয়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সুপারিশের পাশাপাশি টাস্কফোর্স গঠন করার পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ওই সময়ে আবাসিক ভবনের নিচে মজুতকৃত কিছু কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ উদ্ধার ও মিডফোর্ডের ৪টি গুদাম সিলগালা করে দেয়া হয়েছিল।

পুরান ঢাকার অগ্নিদুর্ঘটনা রোধকল্পে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সময় বেধে ব্যবসায়ীদের সব রাসায়নিক দোকান ও গুদাম অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কামরাঙ্গীর চর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে কেরানীগঞ্জে ২০ একর জমির ওপর রাসায়নিক পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তব রূপ নেয়নি। এই পল্লীতে ১৭টি ভবনে ১০৭৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিমুক্তভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সম্ভাবনা ছিল। রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী লাল-হলুদ বিপদ সংকেতযুক্ত সাইনবোর্ড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করাসহ হোল্ডিংয়ে লোকজন বসবাস নিষিদ্ধ ঘোষণারও সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েকশ’ রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বর মধ্যে এসব কারখানা টঙ্গী ও পোস্তগোলায় সরিয়ে নেয়ার কাজ শেষ হবে কিনা তা অনিশ্চিত।

পুরান ঢাকার একের পর এক অগ্নিকাণ্ডকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া সঙ্গত নয়। এসব অগ্নিকাণ্ড কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগও নয়। কতিপয় অপরিণামদর্শী মানুষের লোভের কারণে বারবার অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পুরান ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সেখানকার সব দাহ্য কেমিক্যালের দোকান, গোডাউন দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক কারখানা বা গুদাম যেখানেই স্থাপিত হোক রাসায়নিক দ্রব্য মজুতের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ফায়ার লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা অত্যাবশ্যক। গুদাম নির্মাণের নকশায় অবশ্যই রাজউকের অনুমোদন থাকা চাই। আগুন নেহায়েত যদি লেগেই যায় সেজন্য অগ্নিকাণ্ডকে দ্রুত মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ফায়ার-হাইড্রেন্ট বসানো প্রয়োজন। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে ডিডিসি, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মহলের সম্মিলিত কার্যকর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রমকে সক্রিয় ও গতিশীল করতে পর্যাপ্তসংখ্যক আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি দিয়ে দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে দমকল বাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পুরান ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনের নিরাপত্তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে দ্রুততম সময়ে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরে কারখানা মালিক ও রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে হবে। অন্যথায় এসব অপ্রত্যাশিত, অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ভার সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে।

২৬ ডিসেম্বর, ২০২০

[লেখক : কলামিস্ট]

বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ , ১৬ পৌষ ১৪২৭, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

রাসায়নিকের আগুনে প্রাণহানির দায়

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

প্রায় ৪০০ বছরের রাজধানী পুরান ঢাকার রয়েছে দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। পুরান ঢাকায় বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রয়েছে, দেশ এবং দেশের বাইরে যা সুপরিচিত। পুরান ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় শত বছর ধরে নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনকারী ছোট-বড় শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সময়ের প্রয়োজনে এর সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। দেশব্যাপী উন্নত শিল্পের প্রসার ও বিকাশের পরেও পুরান ঢাকার ওই সব ব্যবসার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। আবার এসব কারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কেমিক্যালের গুদাম। অথচ রাসায়নিক দ্রব্য মজুতের ব্যাপারে অদ্যাবধি তেমন কোন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

পরিসংখ্যান বলছে, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক ও প্লাস্টিক কারখানা এবং গুদাম রয়েছে। এসব গোডাউনে নানা প্লাস্টিক সামগ্রী ও ড্রামভর্তি রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ এবং ফসফরাস জাতীয় দ্রব্য রয়েছে। এছাড়া মিডফোর্ড এলাকায় রয়েছে অসংখ্য পাইকারি ওষুধ ও কেমিক্যালের বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেখানেও মজুত রয়েছে নানা প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য যার অনেকটাই দাহ্য পদার্থ ও বিস্ফোরক। এসব মজুতের জন্য অগ্নিকাণ্ড নিরোধক তেমন কোন গুদাম বা স্টোরেজ নাই। পুরান ঢাকার অনেক বাড়ির মালিক বেশি ভাড়ার লোভে বাসার নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থ মজুতের জন্য ভাড়া দেন। অনেক ভবনেই মানা হয় না বিল্ডিং কোড, নেই তাতে রাজউকের অনুমতি। এমনকি কারখানা ও গুদামের বেশিরভাগেরই পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস বা ডিডিসি’র ছাড়পত্র নেই। অনেক গুদামে মজুত থাকে বিপুল পরিমাণ প্ল­াস্টিক, জুতার সোল তৈরির এডহেসিভ ও পেস্টিং সলিউশনÑ যার সবই দাহ্য পদার্থ। অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনা, অসাবধানতার ছাপ স্পষ্ট সর্বত্র। বিশেষজ্ঞের মতে, এরমধ্যে বেশকিছু কেমিক্যালের একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে।

বিগত কয়েক বছরে পুরনো ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনে অন্তত ২ শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাসায়নিক কারখানায় ও গুদামে আগুন লেগে বারবার, জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে মানুষ। বিনষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ। কত স্বপ্ন পুড়ে ছাই হচ্ছে। চরম অনিশ্চয়তার মাঝে আজও কাটছে লাখো মানুষের জীবন। অতি সম্প্রতি পুরান ঢাকার উর্দু রোডের নোয়াখালী ভবনে চতুর্থবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আবার নতুন করে এলাকাবাসীকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। প্রায় ৩০টির মতো কারখানা সংবলিত এই ভবনে প্লাস্টিকের কাঁচামাল মজুত ছিল। এবারের অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও বিপুল কাঁচামালসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভবনটি। ২০১০ সালের ৩ জুনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৩০ লাখের অধিক মানুষের বসতি পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে সংঘটিত স্মরণকালের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয় এলাকার ১১টি ভবন, কেড়ে নেয় ১২৪টি তরতাজা প্রাণ। আহত হন ২০০ জনের বেশি মানুষ। একটি ভবনের গ্যাস সিলিন্ডারের চুলা থেকে নিচতলার গোডাউনে রক্ষিত ড্রামভর্তি বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মিথাইল ক্লোরাইডে আগুন লাগে। পরে তা পার্শ্ববর্তী ভবনগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দাহ্য কেমিক্যালের তীব্র আগুন, পর্যাপ্ত আধুনিক অগ্নিনির্বাপক সাজসরঞ্জাম এবং পানির অপ্রতুলতা, গাদাগাদি গড়ে ওঠা ভবনের মাঝে সরুগলিতে যানবাহন চলাচলে প্রতিকূলতায় বাড়ে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা। কিছুকাল পরে সেই পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনে অগ্নিদগ্ধ হয় প্রাণ হারান ৭৯ জন। গুরুতর আহত ৪১, পুড়ে ছাই ৫টি ভবন। ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টের বস্তাভর্তি ১১ ধরনের কেমিক্যালে লাগা আগুনের লেলিহান শিখায় পুরো এলাকা হয় ভস্মীভূত। লালবাগের পোস্তার আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময় ঈদের ছুটি না থাকলে সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ তৈরি কারখানায় সেদিন প্রাণহানি চুড়িহাট্টা বা নিমতলীকেও ছাড়িয়ে যেতে পারতো।

নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের তালিকায় থিনার-বি, থিনার-সি, এসিটেট, ইথানল, ইথাইল এসিটেট, টলুইন, প্রোপাইলিন এলকোহল, প্রোপাইলিন গ্লাইকলসহ ২০টি দাহ্য পদার্থকে চিহ্নিত করে। তখন পুরনো ঢাকার সব ধরনের রাসায়নিক কারখানা স্থাপন, রাসায়নিক পদার্থের মজুত ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নিমতলী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হয়। আদালত অভিযান চালিয়ে ১০৪টি মামলা করে ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে। গঠিত দুটি কমিটি পুরান ঢাকায় ৮০০টি উচ্চমাত্রার বিপজ্জনক রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানার তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো নারয়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সুপারিশের পাশাপাশি টাস্কফোর্স গঠন করার পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ওই সময়ে আবাসিক ভবনের নিচে মজুতকৃত কিছু কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ উদ্ধার ও মিডফোর্ডের ৪টি গুদাম সিলগালা করে দেয়া হয়েছিল।

পুরান ঢাকার অগ্নিদুর্ঘটনা রোধকল্পে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সময় বেধে ব্যবসায়ীদের সব রাসায়নিক দোকান ও গুদাম অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কামরাঙ্গীর চর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে কেরানীগঞ্জে ২০ একর জমির ওপর রাসায়নিক পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তব রূপ নেয়নি। এই পল্লীতে ১৭টি ভবনে ১০৭৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিমুক্তভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সম্ভাবনা ছিল। রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী লাল-হলুদ বিপদ সংকেতযুক্ত সাইনবোর্ড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করাসহ হোল্ডিংয়ে লোকজন বসবাস নিষিদ্ধ ঘোষণারও সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েকশ’ রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বর মধ্যে এসব কারখানা টঙ্গী ও পোস্তগোলায় সরিয়ে নেয়ার কাজ শেষ হবে কিনা তা অনিশ্চিত।

পুরান ঢাকার একের পর এক অগ্নিকাণ্ডকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া সঙ্গত নয়। এসব অগ্নিকাণ্ড কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগও নয়। কতিপয় অপরিণামদর্শী মানুষের লোভের কারণে বারবার অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পুরান ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সেখানকার সব দাহ্য কেমিক্যালের দোকান, গোডাউন দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক কারখানা বা গুদাম যেখানেই স্থাপিত হোক রাসায়নিক দ্রব্য মজুতের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ফায়ার লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা অত্যাবশ্যক। গুদাম নির্মাণের নকশায় অবশ্যই রাজউকের অনুমোদন থাকা চাই। আগুন নেহায়েত যদি লেগেই যায় সেজন্য অগ্নিকাণ্ডকে দ্রুত মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ফায়ার-হাইড্রেন্ট বসানো প্রয়োজন। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে ডিডিসি, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মহলের সম্মিলিত কার্যকর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রমকে সক্রিয় ও গতিশীল করতে পর্যাপ্তসংখ্যক আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি দিয়ে দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে দমকল বাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পুরান ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনের নিরাপত্তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে দ্রুততম সময়ে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরে কারখানা মালিক ও রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে হবে। অন্যথায় এসব অপ্রত্যাশিত, অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ভার সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে।

২৬ ডিসেম্বর, ২০২০

[লেখক : কলামিস্ট]