ক্রান্তিকালের প্রতিবাদী মানুষ

মোহাম্মদ শাহজাহান

৩১ ডিসেম্বর দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, দেশ ও জাতির এক কঠিন সময়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনকারী বিচারপতি কেএম সোবহানের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাতির পিতাকে হত্যার পর জিয়া-এরশাদের স্বৈরশাসনকালে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি, মানবাধিকার, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গবন্ধুর কথা বলার জন্য বিচারপতি সোবহান রাজপথে নেমে আসেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর জিয়া-এরশাদ চক্র বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করে। তখন কোন পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ছবি পর্যন্ত ছাপা হতো না, এমনকি কোন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথা বিষয়ে কোন লেখা পর্যন্ত ছাপা হতো না। স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেকে তখন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত। বাঙালি জাতির সেই কঠিন দুঃসময়ে যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী সাহস করে বঙ্গবন্ধুর কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা শুরু করেন তাদের মধে প্রথম কাতারে ছিলেন বিচারপতি সোবহান। মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক বিচারপতি সোবহান খুবই স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। স্বৈরশাসকরা স্বাধীনচেতা মানুষ পছন্দ করে না। স্বৈরশাসক জিয়া ১৯৮০ সালে বিচারপতি সোবহানকে বিচারপতি পদ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রদূত বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ১৯৮২ সালের ১ জুন তাকে বিদেশ থেকে দেশে নিয়ে এসে মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পদ থেকে অপসারণ (চাকরিচ্যুত) করেন।

তিনি বলতেন ‘বঙ্গবন্ধু এ দেশ ও জাতির জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পর্বতসম অবদানের কাছে তার দুই-একটা ভুল কোন ব্যাপারই নয়।’ ওয়ান-ইলেভেনের সময় হেঁটে জেলফটকে গিয়ে ফুলের তোড়া দিয়ে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু কন্যাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ছিলেন তিনি। ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বঙ্গবন্ধু ভবনে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

বিচারপতি কাজী মাহবুবুস সোবহান ‘কেএম সোবহান’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। বহুগুণে গুণান্বিত এই মানুষটি দেশের জন্য, জাতির জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিভৃতচারী, নীতিবান, নিরহঙ্কারী, নির্ভীক, স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, বিনয়ী, চরিত্রবান, যুক্তিবাদী ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন পরিপূর্ণ মানুষ।

বিচারপতি সোবহান ছিলেন আমার পিতৃতুল্য একজন অভিভাবক। আশির দশকের শুরুতেই তার সাথে আমার পরিচয়। ১৯৮১ সাল থেকে মালিবাগ এলাকায় উনার বাসার আশপাশে বসবাস করার কারণে সময়ে-অসময়ে তার সাথে দেখা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এভাবে এক সময়ে মনের অজান্তেই তার পরিবারের সদস্য হয়ে গেলাম। যখনই মনে চাইতো তার বাসায় চলে যেতাম। যখন আমার নিজের ফোন ছিলো না, তখন যোগাযোগ না করেই তার বাসায় চলে গিয়েছি। টেলিফোন আসার পর যখনই তার সাথে দেখা করার কথা বলেছি, কোনোদিন না করেছেন বলে মনে পড়ছে না। বয়সে পিতৃসম হলেও অনেকটা বন্ধুর মতোই তার সাথে যে কোনো বিষয়ে কথা বলতাম। এমনিতেই তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তার ওপর প্রচুর লেখাপড়া করতেন। তার যে কত গুণ ছিল, যারা তার সাথে মিশেছেন শুধু তাদের পক্ষেই তা বলা সম্ভব। তিনি ছিলেন একেবারেই প্রচারবিমুখ। বিচারপতি সোবহান দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, মানবতার জন্য গভীর দরদ ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করে গেছেন। দেখা হলেই স্যার কেমন আছেন, জানতে চাইলে হাসতে হাসতেই বলতেন- ‘আমি খুব ভালো আছি।’ তিনি অসুস্থ বা শরীরটা ভালো যাচ্ছে না- এ ধরনের কথা কেউ কোনোদিন তার মুখে শুনেননি।

শেষ ১০-১২ বছর সভা-সমাবেশে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি লিখতেনও প্রচুর। ৪-৫টি লিডিং দৈনিকে তার লেখা ছাপা হতো। কোনো ম্যাগাজিন, স্মরণিকা বা স্যুভেনিরে তার কাছে লেখা চেয়ে কেউ বিমুখ হয়নি। তার এ কলামিস্ট হয়ে ওঠার কথা মনে হলে আমি নিজেও কিছুটা পুলকিত হই। কারণ তার এ লেখালেখি শুরু হয় আমার অনুরোধেই। ১৯৮৬ সালে সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা বের করার পর তাকে লেখার অনুরোধ জানাই। বাংলাবার্তার প্রতি সংখ্যায় ‘শিতিকণ্ঠ’ ছদ্মনামে অন্তত ১৫ বছর তিনি নিয়মিত কলাম লিখেছেন। ‘শিতিকণ্ঠ’ অর্থ আমি আজও জানি না। শেষের দিকে তিনি ‘জাতীয় কলামিস্ট’ হিসেবে পরিণত হন। বিভিন্ন সময়ে হাসতে হাসতে বলতেন- ‘শাহজাহান সাহেব, আপনিই আমাকে কলামিস্ট বানিয়েছেন।’ তার বাসায় গেলে নিজেই দরজায় এসে অতিথিকে রিসিভ করতেন। আসার সময় ঘর-বারান্দা আঙিনা পেরিয়ে প্রায় ৫০ হাত দূরে বাড়ির বড় গেট পর্যন্ত মেহমানকে এগিয়ে দিতেন। তাকে কেউ আগে সালাম দিতে পারতো না। ব্যক্তিগত সমস্যা, রাষ্ট্রের সমস্যা, রাজনীতি, লেখালেখি সব বিষয়ে তার সাথে আলোচনা হতো। যে কোনো কঠিন বিষয়ের ওপরও সমাধান তিনি খুব সহজভাবে দিতেন। গভীর সমুদ্রের মতো ছিলো তার জ্ঞানের গভীরতা।

বিচারপতি সোবহান খুবই সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি মৌলবাদ, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বলনে-কথনে-লিখনে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া-নিজামী গংয়ের নেতৃত্বাধীন ধর্মান্ধ জোট সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এ সময় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ওই জঘন্য অত্যাচার, নির্যাতন ও খুন-খারাবির বিরুদ্ধে দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলন হয়। তখন ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য কোনো লোক সাহস করে এগিয়ে আসেননি। বিচারপতি সোবহান ওই সম্মেলনের শুধু সভাপতিত্বই করেননি, কঠোর ভাষায় জোট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছিলেন। ওই সময়কার আরেক সাহসী নারীর কথা মনে পড়ছে। বিএনপি নেতৃত্বাদীন জোট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের ওই কঠিন দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বৈকালিক অধিবেশনে সম্ভবত লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছিলেন। তিনি সেদিন সাহসী কণ্ঠে জোরালো ভাষায় খালেদা জোট সরকারের খুন, ধর্ষণ, গ্রেফতার, নির্যাতনের কথা তুলে ধরে। তখনো বরাবরের মতো মালিবাগের বাসা থেকে হেঁটে হেঁটেই সম্মেলনে আসা-যাওয়া করতেন। আমিসহ আরো অনেকেই তার এভাবে একা একা উন্মুক্তভাবে চলাচলের প্রতিবাদ করলেও এটাকে তিনি তেমন পাত্তা দিতেন না। হামলা হতে পারে বলা হলে সহাস্যে জবাব দিতেন- ‘হামলা তো হতেই পারে কিন্তু তাই বলে তো ঘরে বসে থাকা যাবে না।’

বিচারপতি সোবহান বৃদ্ধ বয়সেও কর্মচঞ্চল মানুষ ছিলেন। শুধু ঢাকায় নয়, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীনতা বিষয়ে এবং ধর্মান্ধ অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজধানীর বাইরেও বহু সভা-সেমিনারে তিনি যোগদান করেছেন। মুক্তবুদ্ধির চর্চা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সামরিক স্বৈরশাসন ও সামাজিক অনাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশে নিরীহ আহমদীয়া সম্প্রদায়ের ওপর জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মৌলবাদী দোসরদের ধারাবাহিক হামলা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন।

হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ ও রাজপথের মিছিলে তিনি সামনের সারিতে থেকেছেন। হামলাকারীদের প্রতিবাদ করতে দেশের প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলেও তিনি যখন তখন ছুটে গেছেন। অসহায় নিরপরাধ ও এসবে আক্রান্ত মানুষের ভরসা ও সাহসের প্রতীক ছিলেন এই মানবতাবাদী পুরুষ।

দীর্ঘ দুই যুগে তার সাথে আমার অনেক স্মৃতি। তিনি বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতির সভাপতি থাকাকালে এ দেশের বহু ছেলেমেয়ে রাশিয়ার বৃত্তিতে ওই দেশে পড়েছে। তার বদন্যতায় আমার ছোটভাই শাহজামান রাশিয়ার বৃত্তি পেয়ে এমবিবিএস ডাক্তার হয়েছে। দেখা হলেই তিনি আমার স্ত্রী ও দুই কন্যার খোঁজখবর নিতেন। মেয়েদের ভালো ফলাফল শুনে বেশ কয়েকবার জ্যেষ্ঠপুত্র মিশেলকে দিয়ে আমাদের বাসায় বিশাল আকৃতির কেক পাঠিয়েছেন। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমাদের ছোট মেয়ে মিশুকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখেছি। তিনি শুধু আমার বা আমাদের পরিবারের অভিভাবক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র জাতির একজন অভিভাবক।

দেশের ক্রান্তিকালে যখন তার প্রয়োজন ছিল বেশি, ঠিক তখনই ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন। যে জাতি তার কৃতী সন্তানদের স্বীকৃতি দেয় না, সম্মান করে না, সে জাতি কখনো বড় হতে পারে না। দেশ ও জাতির প্রতি তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে মরণোত্তর কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা যেতে পারে। তার নামে রাজধানীতে একটি সড়কের নামকরণও করা যায়। মালিবাগ মোড় থেকে তার বাসা পর্যন্ত এই ছোট্ট পরিসরের রাস্তাটির নাম ‘বিচারপতি কেএম সোবহান সড়ক’ রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জমিদার ঘরের সন্তান এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন সিনিয়র বিচারপতি হয়ে জীবনের শেষ ২৫ বছর বলতে গেলে দেশ ও জাতির জন্য তিনি উৎসর্গ করে গেছেন। ক্ষণজন্মা, মৃত্যুঞ্জয়ী অসম সাহসী বিচারপতি সোবহানের পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

২৭ ডিসেম্বর ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ , ১৬ পৌষ ১৪২৭, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

বিচারপতি সোবহান

ক্রান্তিকালের প্রতিবাদী মানুষ

মোহাম্মদ শাহজাহান

৩১ ডিসেম্বর দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, দেশ ও জাতির এক কঠিন সময়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনকারী বিচারপতি কেএম সোবহানের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাতির পিতাকে হত্যার পর জিয়া-এরশাদের স্বৈরশাসনকালে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি, মানবাধিকার, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গবন্ধুর কথা বলার জন্য বিচারপতি সোবহান রাজপথে নেমে আসেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর জিয়া-এরশাদ চক্র বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করে। তখন কোন পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ছবি পর্যন্ত ছাপা হতো না, এমনকি কোন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথা বিষয়ে কোন লেখা পর্যন্ত ছাপা হতো না। স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেকে তখন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত। বাঙালি জাতির সেই কঠিন দুঃসময়ে যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী সাহস করে বঙ্গবন্ধুর কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা শুরু করেন তাদের মধে প্রথম কাতারে ছিলেন বিচারপতি সোবহান। মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক বিচারপতি সোবহান খুবই স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। স্বৈরশাসকরা স্বাধীনচেতা মানুষ পছন্দ করে না। স্বৈরশাসক জিয়া ১৯৮০ সালে বিচারপতি সোবহানকে বিচারপতি পদ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রদূত বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ১৯৮২ সালের ১ জুন তাকে বিদেশ থেকে দেশে নিয়ে এসে মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পদ থেকে অপসারণ (চাকরিচ্যুত) করেন।

তিনি বলতেন ‘বঙ্গবন্ধু এ দেশ ও জাতির জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পর্বতসম অবদানের কাছে তার দুই-একটা ভুল কোন ব্যাপারই নয়।’ ওয়ান-ইলেভেনের সময় হেঁটে জেলফটকে গিয়ে ফুলের তোড়া দিয়ে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু কন্যাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ছিলেন তিনি। ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বঙ্গবন্ধু ভবনে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

বিচারপতি কাজী মাহবুবুস সোবহান ‘কেএম সোবহান’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। বহুগুণে গুণান্বিত এই মানুষটি দেশের জন্য, জাতির জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিভৃতচারী, নীতিবান, নিরহঙ্কারী, নির্ভীক, স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, বিনয়ী, চরিত্রবান, যুক্তিবাদী ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন পরিপূর্ণ মানুষ।

বিচারপতি সোবহান ছিলেন আমার পিতৃতুল্য একজন অভিভাবক। আশির দশকের শুরুতেই তার সাথে আমার পরিচয়। ১৯৮১ সাল থেকে মালিবাগ এলাকায় উনার বাসার আশপাশে বসবাস করার কারণে সময়ে-অসময়ে তার সাথে দেখা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এভাবে এক সময়ে মনের অজান্তেই তার পরিবারের সদস্য হয়ে গেলাম। যখনই মনে চাইতো তার বাসায় চলে যেতাম। যখন আমার নিজের ফোন ছিলো না, তখন যোগাযোগ না করেই তার বাসায় চলে গিয়েছি। টেলিফোন আসার পর যখনই তার সাথে দেখা করার কথা বলেছি, কোনোদিন না করেছেন বলে মনে পড়ছে না। বয়সে পিতৃসম হলেও অনেকটা বন্ধুর মতোই তার সাথে যে কোনো বিষয়ে কথা বলতাম। এমনিতেই তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তার ওপর প্রচুর লেখাপড়া করতেন। তার যে কত গুণ ছিল, যারা তার সাথে মিশেছেন শুধু তাদের পক্ষেই তা বলা সম্ভব। তিনি ছিলেন একেবারেই প্রচারবিমুখ। বিচারপতি সোবহান দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, মানবতার জন্য গভীর দরদ ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করে গেছেন। দেখা হলেই স্যার কেমন আছেন, জানতে চাইলে হাসতে হাসতেই বলতেন- ‘আমি খুব ভালো আছি।’ তিনি অসুস্থ বা শরীরটা ভালো যাচ্ছে না- এ ধরনের কথা কেউ কোনোদিন তার মুখে শুনেননি।

শেষ ১০-১২ বছর সভা-সমাবেশে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি লিখতেনও প্রচুর। ৪-৫টি লিডিং দৈনিকে তার লেখা ছাপা হতো। কোনো ম্যাগাজিন, স্মরণিকা বা স্যুভেনিরে তার কাছে লেখা চেয়ে কেউ বিমুখ হয়নি। তার এ কলামিস্ট হয়ে ওঠার কথা মনে হলে আমি নিজেও কিছুটা পুলকিত হই। কারণ তার এ লেখালেখি শুরু হয় আমার অনুরোধেই। ১৯৮৬ সালে সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা বের করার পর তাকে লেখার অনুরোধ জানাই। বাংলাবার্তার প্রতি সংখ্যায় ‘শিতিকণ্ঠ’ ছদ্মনামে অন্তত ১৫ বছর তিনি নিয়মিত কলাম লিখেছেন। ‘শিতিকণ্ঠ’ অর্থ আমি আজও জানি না। শেষের দিকে তিনি ‘জাতীয় কলামিস্ট’ হিসেবে পরিণত হন। বিভিন্ন সময়ে হাসতে হাসতে বলতেন- ‘শাহজাহান সাহেব, আপনিই আমাকে কলামিস্ট বানিয়েছেন।’ তার বাসায় গেলে নিজেই দরজায় এসে অতিথিকে রিসিভ করতেন। আসার সময় ঘর-বারান্দা আঙিনা পেরিয়ে প্রায় ৫০ হাত দূরে বাড়ির বড় গেট পর্যন্ত মেহমানকে এগিয়ে দিতেন। তাকে কেউ আগে সালাম দিতে পারতো না। ব্যক্তিগত সমস্যা, রাষ্ট্রের সমস্যা, রাজনীতি, লেখালেখি সব বিষয়ে তার সাথে আলোচনা হতো। যে কোনো কঠিন বিষয়ের ওপরও সমাধান তিনি খুব সহজভাবে দিতেন। গভীর সমুদ্রের মতো ছিলো তার জ্ঞানের গভীরতা।

বিচারপতি সোবহান খুবই সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি মৌলবাদ, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বলনে-কথনে-লিখনে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া-নিজামী গংয়ের নেতৃত্বাধীন ধর্মান্ধ জোট সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এ সময় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ওই জঘন্য অত্যাচার, নির্যাতন ও খুন-খারাবির বিরুদ্ধে দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলন হয়। তখন ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য কোনো লোক সাহস করে এগিয়ে আসেননি। বিচারপতি সোবহান ওই সম্মেলনের শুধু সভাপতিত্বই করেননি, কঠোর ভাষায় জোট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছিলেন। ওই সময়কার আরেক সাহসী নারীর কথা মনে পড়ছে। বিএনপি নেতৃত্বাদীন জোট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের ওই কঠিন দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বৈকালিক অধিবেশনে সম্ভবত লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছিলেন। তিনি সেদিন সাহসী কণ্ঠে জোরালো ভাষায় খালেদা জোট সরকারের খুন, ধর্ষণ, গ্রেফতার, নির্যাতনের কথা তুলে ধরে। তখনো বরাবরের মতো মালিবাগের বাসা থেকে হেঁটে হেঁটেই সম্মেলনে আসা-যাওয়া করতেন। আমিসহ আরো অনেকেই তার এভাবে একা একা উন্মুক্তভাবে চলাচলের প্রতিবাদ করলেও এটাকে তিনি তেমন পাত্তা দিতেন না। হামলা হতে পারে বলা হলে সহাস্যে জবাব দিতেন- ‘হামলা তো হতেই পারে কিন্তু তাই বলে তো ঘরে বসে থাকা যাবে না।’

বিচারপতি সোবহান বৃদ্ধ বয়সেও কর্মচঞ্চল মানুষ ছিলেন। শুধু ঢাকায় নয়, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীনতা বিষয়ে এবং ধর্মান্ধ অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজধানীর বাইরেও বহু সভা-সেমিনারে তিনি যোগদান করেছেন। মুক্তবুদ্ধির চর্চা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সামরিক স্বৈরশাসন ও সামাজিক অনাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশে নিরীহ আহমদীয়া সম্প্রদায়ের ওপর জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মৌলবাদী দোসরদের ধারাবাহিক হামলা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন।

হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ ও রাজপথের মিছিলে তিনি সামনের সারিতে থেকেছেন। হামলাকারীদের প্রতিবাদ করতে দেশের প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলেও তিনি যখন তখন ছুটে গেছেন। অসহায় নিরপরাধ ও এসবে আক্রান্ত মানুষের ভরসা ও সাহসের প্রতীক ছিলেন এই মানবতাবাদী পুরুষ।

দীর্ঘ দুই যুগে তার সাথে আমার অনেক স্মৃতি। তিনি বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতির সভাপতি থাকাকালে এ দেশের বহু ছেলেমেয়ে রাশিয়ার বৃত্তিতে ওই দেশে পড়েছে। তার বদন্যতায় আমার ছোটভাই শাহজামান রাশিয়ার বৃত্তি পেয়ে এমবিবিএস ডাক্তার হয়েছে। দেখা হলেই তিনি আমার স্ত্রী ও দুই কন্যার খোঁজখবর নিতেন। মেয়েদের ভালো ফলাফল শুনে বেশ কয়েকবার জ্যেষ্ঠপুত্র মিশেলকে দিয়ে আমাদের বাসায় বিশাল আকৃতির কেক পাঠিয়েছেন। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমাদের ছোট মেয়ে মিশুকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখেছি। তিনি শুধু আমার বা আমাদের পরিবারের অভিভাবক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র জাতির একজন অভিভাবক।

দেশের ক্রান্তিকালে যখন তার প্রয়োজন ছিল বেশি, ঠিক তখনই ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন। যে জাতি তার কৃতী সন্তানদের স্বীকৃতি দেয় না, সম্মান করে না, সে জাতি কখনো বড় হতে পারে না। দেশ ও জাতির প্রতি তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে মরণোত্তর কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা যেতে পারে। তার নামে রাজধানীতে একটি সড়কের নামকরণও করা যায়। মালিবাগ মোড় থেকে তার বাসা পর্যন্ত এই ছোট্ট পরিসরের রাস্তাটির নাম ‘বিচারপতি কেএম সোবহান সড়ক’ রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জমিদার ঘরের সন্তান এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন সিনিয়র বিচারপতি হয়ে জীবনের শেষ ২৫ বছর বলতে গেলে দেশ ও জাতির জন্য তিনি উৎসর্গ করে গেছেন। ক্ষণজন্মা, মৃত্যুঞ্জয়ী অসম সাহসী বিচারপতি সোবহানের পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

২৭ ডিসেম্বর ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com