যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবক ‘সুবল ভাই’ জীবন সায়াহ্নে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান

একদা মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতাদর্শের সরলপ্রাণ মানুষ গফরগাঁওয়ের সবার প্রিয় সুবল ভাই। নেতার মতো ছিল আটপৌরে জীবন তার। একজন দরদি সমাজসেবক হিসেবে মানুষ তাকে চিনে। যুবক বয়সে ভাসানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নাম লেখান তার দলে। সেই থেকে প্রিয় পোশাক পাঞ্জাবি, লুঙ্গি আর টুপি। এখনো এমন পোশাকেই দেখা মেলে প্রিয় সুবল ভাইকে। প্রিয় নেতার মৃত্যুর পরও হননি আদর্শচ্যুত। সদা হাসিখুশী এই মানুষটির বয়স হয়েছে আটাশি। এতদূর এসে রোগে-শোকে অনেকটাই কাবু হয়েছেন। বার্ধক্যজনিত নানান রোগ বাসা বেঁধেছে এই দেহটিতে। সেই সাথে রয়েছে জীবনের চরম অর্থকষ্ট। তবুও প্রিয় সুবল ভাই এখনো ছুটে যান মানুষের বিপদে। স্বাধীনতা উত্তরকালে মহামারী কলেরা রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন মেহনতির মানুষের জীবনে। তার অবদান রয়েছে সংস্কৃতি অঙ্গনেরও। অসাধারণ একজন অভিনেতার খেতাবও রয়েছে তার ঝুলিতে। তার অভিনীত নাটক ও যাত্রাপালার সংখ্যা হাজারের ওপরে। চাচা মীর ওয়াজেদ আলী অভিনয় করতেন কলকাতার স্টার থিয়েটারে। লিখেছেন গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুনসহ নানা লোক গান। লেখক ও কবি মুহাম্মদ ফারুক মোনায়েম সালেহীন তার সম্পর্কে বলেন, সুবল ভাই কবিতার সেই তালেব মাস্টারের মতো, ‘আমি যেন সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে, কিন্তু নিজের জীবনই অন্ধকারমালা’।

এই মানুষটির জন্ম গফরগাঁওয়ের সালটিয়া ইউনিয়নের রৌহা গ্রামে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মানুষ ছিলেন বাবা মীর নূর হোসেন। তার পুরো নাম মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল। ভালবেসে সবাই তাকে সুবলদা বলে ডাকেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটির জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সনদ। আবেদন করেও পাননি তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধার তকমা। মোনায়েম সালেহীন স্বগোক্তি করে বলেন, নয়মাস মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা ট্রেনিং নিয়ে রণাঙ্গনে পাক বাহিনীর সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, শুধু তারাই বীর মুক্তিযোদ্ধা! যারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, শব্দ সৈনিক, বিভিন্ন ক্যাম্পে যারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করে জীবন বাঁচিয়েছেন, তারা সকলেই ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত সৈনিক। শুধু পাননি এই সাদামাটা সুবল ভাই। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে গফরগাঁও বাজারে বোমা হালায় হতাহতদের উদ্ধার ও দাফন শেষে হালুয়াঘাট হয়ে ভারতের মেঘালয়ে চলে যান। পরে ভারতীয় রেডক্রসে মেডিকেল প্রশিক্ষণ নিয়ে স্থানীয় ওয়ারেঙ্কা ক্যাম্পে স্মরনার্থী শিবিরের চিকিৎসা ক্যাম্পে সেবায় নিয়োজিত হন। সেখানে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেন গফরগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য আবুল হাশেম(সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী ও তিয়াত্তরের প্রথম জাতীয় সংসদ সদস্য), বৃহত্তর ময়মসিংহের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ভাটির শার্দুল বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ প্রমুখকে।

এ দুজনই জীবিত,তবে আবুল হাশেম বয়সের কারণে স্মৃতিভ্রষ্ট। এ প্রসঙ্গে মীর মোনায়েম সালেহীন বলেন, জীবনের শেষ ইচ্ছা, এই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে মৃত্যুর পর যেন বাংলাদেশের পতাকায় আচ্ছাদিত হয়ে অন্তিম শয়ানে যেতে পারি। সেই জন্যে আমি চাই রাষ্ট্রপতির একটি সাক্ষাত। তিনিই একমাত্র আমাকে শনাক্ত করতে পারেন মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মরণার্থী শিবিরের ক্যাম্পে থাকা একজন সেবক হিসেবে।

আজন্ম বিপ্লবী এই মানুষটিকে ভালবাসার প্রতিদান হিসেবে সালটিয়া ইউনিয়নের জনগণ ২০০২ সালে তাকে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন।

শুক্রবার, ০১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ পৌষ ১৪২৭, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবক ‘সুবল ভাই’ জীবন সায়াহ্নে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান

রোবেল মাহমুদ, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ

একদা মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতাদর্শের সরলপ্রাণ মানুষ গফরগাঁওয়ের সবার প্রিয় সুবল ভাই। নেতার মতো ছিল আটপৌরে জীবন তার। একজন দরদি সমাজসেবক হিসেবে মানুষ তাকে চিনে। যুবক বয়সে ভাসানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নাম লেখান তার দলে। সেই থেকে প্রিয় পোশাক পাঞ্জাবি, লুঙ্গি আর টুপি। এখনো এমন পোশাকেই দেখা মেলে প্রিয় সুবল ভাইকে। প্রিয় নেতার মৃত্যুর পরও হননি আদর্শচ্যুত। সদা হাসিখুশী এই মানুষটির বয়স হয়েছে আটাশি। এতদূর এসে রোগে-শোকে অনেকটাই কাবু হয়েছেন। বার্ধক্যজনিত নানান রোগ বাসা বেঁধেছে এই দেহটিতে। সেই সাথে রয়েছে জীবনের চরম অর্থকষ্ট। তবুও প্রিয় সুবল ভাই এখনো ছুটে যান মানুষের বিপদে। স্বাধীনতা উত্তরকালে মহামারী কলেরা রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন মেহনতির মানুষের জীবনে। তার অবদান রয়েছে সংস্কৃতি অঙ্গনেরও। অসাধারণ একজন অভিনেতার খেতাবও রয়েছে তার ঝুলিতে। তার অভিনীত নাটক ও যাত্রাপালার সংখ্যা হাজারের ওপরে। চাচা মীর ওয়াজেদ আলী অভিনয় করতেন কলকাতার স্টার থিয়েটারে। লিখেছেন গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুনসহ নানা লোক গান। লেখক ও কবি মুহাম্মদ ফারুক মোনায়েম সালেহীন তার সম্পর্কে বলেন, সুবল ভাই কবিতার সেই তালেব মাস্টারের মতো, ‘আমি যেন সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে, কিন্তু নিজের জীবনই অন্ধকারমালা’।

এই মানুষটির জন্ম গফরগাঁওয়ের সালটিয়া ইউনিয়নের রৌহা গ্রামে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মানুষ ছিলেন বাবা মীর নূর হোসেন। তার পুরো নাম মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল। ভালবেসে সবাই তাকে সুবলদা বলে ডাকেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটির জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সনদ। আবেদন করেও পাননি তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধার তকমা। মোনায়েম সালেহীন স্বগোক্তি করে বলেন, নয়মাস মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা ট্রেনিং নিয়ে রণাঙ্গনে পাক বাহিনীর সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, শুধু তারাই বীর মুক্তিযোদ্ধা! যারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, শব্দ সৈনিক, বিভিন্ন ক্যাম্পে যারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করে জীবন বাঁচিয়েছেন, তারা সকলেই ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত সৈনিক। শুধু পাননি এই সাদামাটা সুবল ভাই। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে গফরগাঁও বাজারে বোমা হালায় হতাহতদের উদ্ধার ও দাফন শেষে হালুয়াঘাট হয়ে ভারতের মেঘালয়ে চলে যান। পরে ভারতীয় রেডক্রসে মেডিকেল প্রশিক্ষণ নিয়ে স্থানীয় ওয়ারেঙ্কা ক্যাম্পে স্মরনার্থী শিবিরের চিকিৎসা ক্যাম্পে সেবায় নিয়োজিত হন। সেখানে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেন গফরগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য আবুল হাশেম(সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী ও তিয়াত্তরের প্রথম জাতীয় সংসদ সদস্য), বৃহত্তর ময়মসিংহের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ভাটির শার্দুল বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ প্রমুখকে।

এ দুজনই জীবিত,তবে আবুল হাশেম বয়সের কারণে স্মৃতিভ্রষ্ট। এ প্রসঙ্গে মীর মোনায়েম সালেহীন বলেন, জীবনের শেষ ইচ্ছা, এই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে মৃত্যুর পর যেন বাংলাদেশের পতাকায় আচ্ছাদিত হয়ে অন্তিম শয়ানে যেতে পারি। সেই জন্যে আমি চাই রাষ্ট্রপতির একটি সাক্ষাত। তিনিই একমাত্র আমাকে শনাক্ত করতে পারেন মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মরণার্থী শিবিরের ক্যাম্পে থাকা একজন সেবক হিসেবে।

আজন্ম বিপ্লবী এই মানুষটিকে ভালবাসার প্রতিদান হিসেবে সালটিয়া ইউনিয়নের জনগণ ২০০২ সালে তাকে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন।