বিপর্যস্ত বছরে

বাংলাদেশ হারিয়েছে যেসব বিশিষ্টজন

সংবাদ ডেস্ক |

২০২০ সালটি ছিল করোনা মহামারীতে বিপর্যয়ের বছর। মৃত্যুর মিছিলও ছিল দীর্ঘ। বাংলাদেশ এই বছরে শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, ব্যবসা, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেককে হারিয়েছে।

http://print.thesangbad.net/images/2020/December/31Dec20/news/look-back-2020.jpg

আনিসুজ্জামান

কোভিড-১৯ মহামারীতে যখন ধুঁকছে জাতি, সেই সময় ১৪ মে চিরবিদায় নেন দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ‘বাতিঘর’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ৮৩ বছর বয়সী এই অধ্যাপক বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন, এর মধ্যে তারও করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদকে ভূষিত ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভারত সরকারের পদ্মভূষণ খেতাবও পান তিনি।

১৯৫২ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই আনিসুজ্জামান বাঙালির মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’ শিরোনামে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম পুস্তিকা রচনা করেন।

জামিলুর রেজা চৌধুরী

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই কোন না কোনভাবে যুক্ত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২৮ এপ্রিল চিরবিদায় নেন। ৭৭ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করা জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন।

বুয়েট থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০০১ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। মৃত্যুর সময় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন।

কামাল লোহানী

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারে যার কণ্ঠে বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের খবর প্রথম এসেছিল, সেই কামাল লোহানীর কণ্ঠ গত ২০ জুন করোনাভাইরাসে স্তব্ধ হয়ে যায়।

কামাল লোহানী একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক, রাজনৈতিক সংগ্রামের পরামর্শক।

ছেলেবেলায় বাঙালির ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পর বাঙালির প্রতিটি সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিশ্বাসী কামাল লোহানী ১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। একাত্তরে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি, যুদ্ধ শুরুর পর স্বাধীন বাংলা বেতারে যুক্ত হন। ১৯৬২ সালে কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। পরে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন তার রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন কামাল লোহানী। ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দুই দফা মহাপরিচালক ছিলেন।

দৈনিক আজাদ, সংবাদ, জনপদ, বঙ্গবার্তা, পূর্বদেশ, বাংলার বাণী, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে আসা কামাল লোহানী সাংবাদিকতার জন্য ২০১৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

খন্দকার মুনীরুজ্জামান

দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, কলামনিস্ট খন্দকার মুনীরুজ্জামান ৭৩ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ২৪ নভেম্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।

ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক একতায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী কলাম লেখক হিসেবে তিনি পরিচিতি পান। দীর্ঘদিন দৈনিক সংবাদে কাজ করেন তিনি। ২০১৯ সালে তিনি প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে মনোনীত হন।

আবুল হাসনাত

সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলমের সম্পাদক, কবি ও সাংবাদিক আবুল হাসনাত ৭৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১ নভেম্বর মারা যান।

ছায়ানটের কার্যকরী সংসদের সদস্য আবুল হাসনাত একসময় সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।

আবুল হাসনাত লিখতেন মাহমুদ আল জামান ছদ্ম নামে। ‘জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, ‘কোনো একদিন ভুবনডাঙায়’, ‘ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল’ আবুল হাসনাতের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তার প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর ও অন্যান্য ও জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য। শিশু ও কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়’, ‘টুকু ও সমুদ্রের গল্প’, ‘যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে’, ‘রানুর দুঃখ-ভালোবাসা’।

দীর্ঘ ২৪ বছর দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করা আবুল হাসনাত আমৃত্যু কালি ও কলমের সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। পাশাপাশি চিত্রকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘শিল্প ও শিল্পী’রও তিনি সম্পাদক ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলো মনোনীত হন।

মুর্তজা বশীর

বাংলাদেশের শিল্পকলার অন্যতম নক্ষত্র হিসেবে বিবেচিত মুর্তজা বশীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ আগস্ট চিরবিদায় নেন।

বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছোট সন্তান মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ অগাস্ট। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিবাদে মুর্তজা বশীর ছিলেন অগ্রভাগে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে অধ্যাপনার পাশাপাশি বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন তিনি।

লতিফুর রহমান

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান ৭৫ বছর বয়সে ১ জুলাই মারা যান।

ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক মান রক্ষার জন্য ২০১২ সালে অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।

দৈনিক প্রথম আলোর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন লতিফুর রহমান। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়াওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক তিনি। মিডিয়াস্টার এবিসি রেডিও এবং মিডিয়াওয়ার্ল্ড সাপ্তাহিক ২০০০ এরও মূল মালিক প্রতিষ্ঠান।

এন্ড্রু কিশোর

কয়েক দশক ধরে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে গানের জগতে আধিপত্য করে আসা এন্ড্রু কিশোরের জীবনের গল্প থেকে যায় ৬ জুলাই, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ৬৪ বছর বয়সেই পৃথিবীকে বিদায় জানাতে হয় তাকে।

জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে, সবাই তো ভালবাসা চায়, ভালবেসে গেলাম শুধু, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে, পড়ে না চোখের পলক- তার এমন অনেক গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

এন্ড্রু কিশোরের ‘জীবনের গল্প’ ফুরিয়ে গেল

মোহাম্মদ নাসিম

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ব্রেইন স্ট্রোকে ১৩ জুন চিরতরে বিদায় নেন। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে নাসিম ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে মনসুর আলী হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার পর আওয়ামী লীগে সক্রিয় হন তিনি।

১৯৮৬ সাল থেকে ছয় বার সিরাজগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নাসিম। ১৯৯১ সালের সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকারে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

শাহজাহান সিরাজ

মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা পর্বের সাক্ষী শাহজাহান সিরাজ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৭৭ বছর বয়সে ১৪ জুলাই মারা যান।

ছাত্রলীগ, জাসদ ও পরে বিএনপির নেতা হয়ে শাহজাহান সিরাজ মন্ত্রী হলেও একাত্তর সালে উত্তাল মার্চে ছাত্র সমাজের পক্ষে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী চার খলিফার একজন হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নাম লেখা থাকবে তার।

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে কিছু দিন কারাগারে থেকে মুক্তি পেলেও অসুস্থতার কারণে আর রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেননি শাহজাহান সিরাজ।

সাহারা খাতুন

দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়া সাহারা খাতুন ৯ জুলাই ৭৭ বছর বয়সে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে ওঠে আসা সাহারা খাতুন আইন পেশায় থেকেই আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন। বিয়ে-সংসারের প্রথাগত পথে না গিয়ে তিনি নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ আন্দোলন-সংগ্রাম ও দলের দুর্দিনে আজীবন মাঠে ছিলেন সক্রিয়।

এম এ হাসেম

পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এমএ হাসেম ৭৮ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ডিসেম্বর মারা যান।

ব্যবসায়ী হাসেম ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি, মুক্তি পেয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি।

শুক্রবার, ০১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ পৌষ ১৪২৭, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

বিপর্যস্ত বছরে

বাংলাদেশ হারিয়েছে যেসব বিশিষ্টজন

সংবাদ ডেস্ক |

image

২০২০ সালটি ছিল করোনা মহামারীতে বিপর্যয়ের বছর। মৃত্যুর মিছিলও ছিল দীর্ঘ। বাংলাদেশ এই বছরে শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, ব্যবসা, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেককে হারিয়েছে।

http://print.thesangbad.net/images/2020/December/31Dec20/news/look-back-2020.jpg

আনিসুজ্জামান

কোভিড-১৯ মহামারীতে যখন ধুঁকছে জাতি, সেই সময় ১৪ মে চিরবিদায় নেন দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ‘বাতিঘর’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ৮৩ বছর বয়সী এই অধ্যাপক বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন, এর মধ্যে তারও করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদকে ভূষিত ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভারত সরকারের পদ্মভূষণ খেতাবও পান তিনি।

১৯৫২ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই আনিসুজ্জামান বাঙালির মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’ শিরোনামে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম পুস্তিকা রচনা করেন।

জামিলুর রেজা চৌধুরী

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই কোন না কোনভাবে যুক্ত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২৮ এপ্রিল চিরবিদায় নেন। ৭৭ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করা জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন।

বুয়েট থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০০১ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। মৃত্যুর সময় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন।

কামাল লোহানী

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারে যার কণ্ঠে বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের খবর প্রথম এসেছিল, সেই কামাল লোহানীর কণ্ঠ গত ২০ জুন করোনাভাইরাসে স্তব্ধ হয়ে যায়।

কামাল লোহানী একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক, রাজনৈতিক সংগ্রামের পরামর্শক।

ছেলেবেলায় বাঙালির ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পর বাঙালির প্রতিটি সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিশ্বাসী কামাল লোহানী ১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। একাত্তরে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি, যুদ্ধ শুরুর পর স্বাধীন বাংলা বেতারে যুক্ত হন। ১৯৬২ সালে কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। পরে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন তার রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন কামাল লোহানী। ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দুই দফা মহাপরিচালক ছিলেন।

দৈনিক আজাদ, সংবাদ, জনপদ, বঙ্গবার্তা, পূর্বদেশ, বাংলার বাণী, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে আসা কামাল লোহানী সাংবাদিকতার জন্য ২০১৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

খন্দকার মুনীরুজ্জামান

দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, কলামনিস্ট খন্দকার মুনীরুজ্জামান ৭৩ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ২৪ নভেম্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।

ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক একতায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী কলাম লেখক হিসেবে তিনি পরিচিতি পান। দীর্ঘদিন দৈনিক সংবাদে কাজ করেন তিনি। ২০১৯ সালে তিনি প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে মনোনীত হন।

আবুল হাসনাত

সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলমের সম্পাদক, কবি ও সাংবাদিক আবুল হাসনাত ৭৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১ নভেম্বর মারা যান।

ছায়ানটের কার্যকরী সংসদের সদস্য আবুল হাসনাত একসময় সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।

আবুল হাসনাত লিখতেন মাহমুদ আল জামান ছদ্ম নামে। ‘জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, ‘কোনো একদিন ভুবনডাঙায়’, ‘ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল’ আবুল হাসনাতের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তার প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর ও অন্যান্য ও জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য। শিশু ও কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়’, ‘টুকু ও সমুদ্রের গল্প’, ‘যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে’, ‘রানুর দুঃখ-ভালোবাসা’।

দীর্ঘ ২৪ বছর দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করা আবুল হাসনাত আমৃত্যু কালি ও কলমের সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। পাশাপাশি চিত্রকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘শিল্প ও শিল্পী’রও তিনি সম্পাদক ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলো মনোনীত হন।

মুর্তজা বশীর

বাংলাদেশের শিল্পকলার অন্যতম নক্ষত্র হিসেবে বিবেচিত মুর্তজা বশীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ আগস্ট চিরবিদায় নেন।

বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছোট সন্তান মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ অগাস্ট। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিবাদে মুর্তজা বশীর ছিলেন অগ্রভাগে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে অধ্যাপনার পাশাপাশি বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন তিনি।

লতিফুর রহমান

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান ৭৫ বছর বয়সে ১ জুলাই মারা যান।

ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক মান রক্ষার জন্য ২০১২ সালে অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।

দৈনিক প্রথম আলোর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন লতিফুর রহমান। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়াওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক তিনি। মিডিয়াস্টার এবিসি রেডিও এবং মিডিয়াওয়ার্ল্ড সাপ্তাহিক ২০০০ এরও মূল মালিক প্রতিষ্ঠান।

এন্ড্রু কিশোর

কয়েক দশক ধরে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে গানের জগতে আধিপত্য করে আসা এন্ড্রু কিশোরের জীবনের গল্প থেকে যায় ৬ জুলাই, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ৬৪ বছর বয়সেই পৃথিবীকে বিদায় জানাতে হয় তাকে।

জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে, সবাই তো ভালবাসা চায়, ভালবেসে গেলাম শুধু, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে, পড়ে না চোখের পলক- তার এমন অনেক গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

এন্ড্রু কিশোরের ‘জীবনের গল্প’ ফুরিয়ে গেল

মোহাম্মদ নাসিম

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ব্রেইন স্ট্রোকে ১৩ জুন চিরতরে বিদায় নেন। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে নাসিম ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে মনসুর আলী হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার পর আওয়ামী লীগে সক্রিয় হন তিনি।

১৯৮৬ সাল থেকে ছয় বার সিরাজগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নাসিম। ১৯৯১ সালের সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকারে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

শাহজাহান সিরাজ

মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা পর্বের সাক্ষী শাহজাহান সিরাজ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৭৭ বছর বয়সে ১৪ জুলাই মারা যান।

ছাত্রলীগ, জাসদ ও পরে বিএনপির নেতা হয়ে শাহজাহান সিরাজ মন্ত্রী হলেও একাত্তর সালে উত্তাল মার্চে ছাত্র সমাজের পক্ষে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী চার খলিফার একজন হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নাম লেখা থাকবে তার।

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে কিছু দিন কারাগারে থেকে মুক্তি পেলেও অসুস্থতার কারণে আর রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেননি শাহজাহান সিরাজ।

সাহারা খাতুন

দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়া সাহারা খাতুন ৯ জুলাই ৭৭ বছর বয়সে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে ওঠে আসা সাহারা খাতুন আইন পেশায় থেকেই আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন। বিয়ে-সংসারের প্রথাগত পথে না গিয়ে তিনি নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ আন্দোলন-সংগ্রাম ও দলের দুর্দিনে আজীবন মাঠে ছিলেন সক্রিয়।

এম এ হাসেম

পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এমএ হাসেম ৭৮ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ডিসেম্বর মারা যান।

ব্যবসায়ী হাসেম ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি, মুক্তি পেয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি।