যেভাবে রূপ বদলাচ্ছে করোনা

মো. শফিকুর রহমান

সম্প্রতি করোনার স্পাইক প্রোটিনের গঠনে পরিবর্তন আসার ফলে সৃষ্ট নতুন ধরনের (ভেরিয়েন্ট) করোনার সংক্রমণের হার যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে দ্রুত বাড়ছে এবং এ স্পাইক প্রোটিন অ্যান্টিজেনকে টার্গেট করেই করোনার টিকা তৈরি করা হয়েছে বলেই সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। করোনার বাহিরের আবরণে ১২৭৩টি এমাইনো এসিড সমন্বয়ে গঠিত মোট ৭৮টি স্পাইক রয়েছে, যা ২৬টি কার্যকর ইউনিট হিসেবে মানবদেহে ত্বকের কোষ প্রাচীরের সঙ্গে ভাইরাসটির সুদৃঢ় বন্ধন শেষে কোষের ভেতর প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে করোনা রূপ পরিবর্তন করে অসংখ্য নতুন ধরন সৃষ্টির মাধ্যমে সংক্রমণেও ভিন্নতা এনেছে। সাধারণত মিউটেশনের মাধ্যমে এমাইনো এসিডের পরিবর্তনের ফলে এরূপ নতুন ধরন সৃষ্টি হয়ে থাকে। আবার করোনার স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো এসিডে পরিবর্তন ঘটলে যে নতুন মিউটেন্ট ধরন সৃষ্টি হবে, তা শুধুমাত্র করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর হারকেই প্রভাবিত করবে। লন্ডন ও দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডে করোনার ধরন পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট একটি নতুন মিউটেন্ট ধরনকে ভিওসি-০২০১২/০১ বা ভিইউয়াই-২০২১১২/০১ নামে শনাক্ত করা হয়েছে, যা পূর্বের তুলনায় ৭০% বেশি সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম বলেই সম্প্রতি মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাজ্যে এ নতুন ধরনের করোনাতে পরিবর্তন এনেছে ৪টি ডিলেশন মিউটেশনসহ মোট ১৭টি মিউটেশন, যার মধ্যে স্পাইক প্রোটিনেই ৬টি এমাইনো এসিডের পরিবর্তন ও ২টি স্থানে (৬৯-৭০ পজিশনে) স্পাইক ডিলেশন পাওয়া গেছে। এছাড়া এ নতুন ধরনটিতে অন্য ৬টি মিউটেশন ঘটলেও কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি।

সম্প্রতি করোনার ধরন পরিবর্তন, দ্রুত ছড়ানো, আক্রমণের তীব্রতা এবং বর্তমান টিকাগুলোর নতুন ধরনের মিউটেন্টের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। তবে মিউটেশনের ফলে সৃষ্ট ভাইরাস শুধু অধিক আক্রমণমূলক হবে এমনটিও নয়, এটি তার মূল ভাইরাসের মতো বা আরও দুর্বল প্রকৃতির হতে পারে, অথবা রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। প্রকাশিত গবেষণা তথ্য অনুসারে, করোনার নতুন ধরন ভিওসি ০২০১২/০১ এর স্পাইকে প্রাপ্ত মিউটেশনগুলোর মধ্যে এন৫০১ওয়াই মিউটেশন ভাইরাসটিকে আমদের ত্বকের কোষের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে বলেই সংক্রমণের হার ৭০% বেড়েছে।

এছাড়া স্পাইকের পি৬৮১এইচ মিউটেশনটিও আমাদের দেহের ফুসফুসের এপিথেলিয়াল কোষে ভাইরাসের প্রবেশ ও ছড়ানোর ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হতে পারে বলে ধারণা। যদিও করোনার এ নতুন ধরনটি সহজেই দ্রুত ছড়ায়, তবুও অসুস্থতার হার বা মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে করোনাভাইরাসের এ নতুন ধরনটি অবশ্যই একটি অধিক সংক্রমণশীল মিউটেন্ট; যা ওই ভাইরাসের আক্রমণের তীব্রতা প্রতিহত করতে অক্ষম এমন কোন দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এবং পরবর্তীতে ওই রোগীর দেহ ভাইরাসটির মিউটেন্ট তৈরির জন্য একটি উপযুক্ত প্রজনন স্থানে পরিণত হয়েছিল। অথবা দীর্ঘস্থায়ী করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আংশিক কার্যকর কোন চিকিৎসা মিউটেন্ট তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। করোনার স্পাইকটি আমাদের দেহের ত্বকের কোষগুলোর পৃষ্ঠের সঙ্গে প্রথম সংযুক্ত হয় বলে এর যেকোন পরিবর্তন ভাইরাসটিকে কোষের ভেতর প্রবেশের জন্য সহজ করে তুলবে।

স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশনগুলো ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ডসহ অন্যান্য টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগায়। এর কারণ এসব টিকা শুধুমাত্র করোনার স্পাইক প্রোটিন অ্যান্টিজেনকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য মানবদেহে প্রয়োজনীয় এন্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম, যাতে ভাইরাসটি মানবদেহের কোষের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করতে না পারে। টিকাটি করোনার স্পাইককে আক্রমণ করতে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং এর ফলে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে না। তাছাড়া এসব টিকার মাধ্যমে সৃষ্ট এন্টিবডি আমাদের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করোনার স্পাইকগুলোর একাধিক অংশকে আক্রমণ করতে শেখায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফাইজার-বায়োএনটেক টিকাটির কথা, যা করোনার স্পাইকের মোট ১২৭৩টি এমাইনো এসিডের মধ্যে ১২৭০টি এমাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং ব্রিটেনে শনাক্ত নতুন ধরনের করোনার স্পাইকে মাত্র ১৭টি এমাইনো এসিডে পরিবর্তন এসেছে।

করোনার স্পাইক প্রোটিনে সামান্য পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এসব নতুন ধরনের করোনার বিরুদ্ধে টিকাগুলো সাময়িক সময়ের জন্য হলেও কাজ করবে। আর যদি স্পাইক প্রোটিনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, তবে এসব টিকা অবশ্যই স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তিত এমাইনো এসিড সিকোয়েন্সের সঙ্গে মিল রেখে আপডেট করতে হবে। কজেই করোনার রূপ পরিবর্তনের খবরে আতঙ্কিত না হয়ে টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে করোনার বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

শুক্রবার, ০১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ পৌষ ১৪২৭, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

যেভাবে রূপ বদলাচ্ছে করোনা

মো. শফিকুর রহমান

image

সম্প্রতি করোনার স্পাইক প্রোটিনের গঠনে পরিবর্তন আসার ফলে সৃষ্ট নতুন ধরনের (ভেরিয়েন্ট) করোনার সংক্রমণের হার যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে দ্রুত বাড়ছে এবং এ স্পাইক প্রোটিন অ্যান্টিজেনকে টার্গেট করেই করোনার টিকা তৈরি করা হয়েছে বলেই সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। করোনার বাহিরের আবরণে ১২৭৩টি এমাইনো এসিড সমন্বয়ে গঠিত মোট ৭৮টি স্পাইক রয়েছে, যা ২৬টি কার্যকর ইউনিট হিসেবে মানবদেহে ত্বকের কোষ প্রাচীরের সঙ্গে ভাইরাসটির সুদৃঢ় বন্ধন শেষে কোষের ভেতর প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে করোনা রূপ পরিবর্তন করে অসংখ্য নতুন ধরন সৃষ্টির মাধ্যমে সংক্রমণেও ভিন্নতা এনেছে। সাধারণত মিউটেশনের মাধ্যমে এমাইনো এসিডের পরিবর্তনের ফলে এরূপ নতুন ধরন সৃষ্টি হয়ে থাকে। আবার করোনার স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো এসিডে পরিবর্তন ঘটলে যে নতুন মিউটেন্ট ধরন সৃষ্টি হবে, তা শুধুমাত্র করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর হারকেই প্রভাবিত করবে। লন্ডন ও দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডে করোনার ধরন পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট একটি নতুন মিউটেন্ট ধরনকে ভিওসি-০২০১২/০১ বা ভিইউয়াই-২০২১১২/০১ নামে শনাক্ত করা হয়েছে, যা পূর্বের তুলনায় ৭০% বেশি সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম বলেই সম্প্রতি মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাজ্যে এ নতুন ধরনের করোনাতে পরিবর্তন এনেছে ৪টি ডিলেশন মিউটেশনসহ মোট ১৭টি মিউটেশন, যার মধ্যে স্পাইক প্রোটিনেই ৬টি এমাইনো এসিডের পরিবর্তন ও ২টি স্থানে (৬৯-৭০ পজিশনে) স্পাইক ডিলেশন পাওয়া গেছে। এছাড়া এ নতুন ধরনটিতে অন্য ৬টি মিউটেশন ঘটলেও কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি।

সম্প্রতি করোনার ধরন পরিবর্তন, দ্রুত ছড়ানো, আক্রমণের তীব্রতা এবং বর্তমান টিকাগুলোর নতুন ধরনের মিউটেন্টের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। তবে মিউটেশনের ফলে সৃষ্ট ভাইরাস শুধু অধিক আক্রমণমূলক হবে এমনটিও নয়, এটি তার মূল ভাইরাসের মতো বা আরও দুর্বল প্রকৃতির হতে পারে, অথবা রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। প্রকাশিত গবেষণা তথ্য অনুসারে, করোনার নতুন ধরন ভিওসি ০২০১২/০১ এর স্পাইকে প্রাপ্ত মিউটেশনগুলোর মধ্যে এন৫০১ওয়াই মিউটেশন ভাইরাসটিকে আমদের ত্বকের কোষের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে বলেই সংক্রমণের হার ৭০% বেড়েছে।

এছাড়া স্পাইকের পি৬৮১এইচ মিউটেশনটিও আমাদের দেহের ফুসফুসের এপিথেলিয়াল কোষে ভাইরাসের প্রবেশ ও ছড়ানোর ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হতে পারে বলে ধারণা। যদিও করোনার এ নতুন ধরনটি সহজেই দ্রুত ছড়ায়, তবুও অসুস্থতার হার বা মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে করোনাভাইরাসের এ নতুন ধরনটি অবশ্যই একটি অধিক সংক্রমণশীল মিউটেন্ট; যা ওই ভাইরাসের আক্রমণের তীব্রতা প্রতিহত করতে অক্ষম এমন কোন দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এবং পরবর্তীতে ওই রোগীর দেহ ভাইরাসটির মিউটেন্ট তৈরির জন্য একটি উপযুক্ত প্রজনন স্থানে পরিণত হয়েছিল। অথবা দীর্ঘস্থায়ী করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আংশিক কার্যকর কোন চিকিৎসা মিউটেন্ট তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। করোনার স্পাইকটি আমাদের দেহের ত্বকের কোষগুলোর পৃষ্ঠের সঙ্গে প্রথম সংযুক্ত হয় বলে এর যেকোন পরিবর্তন ভাইরাসটিকে কোষের ভেতর প্রবেশের জন্য সহজ করে তুলবে।

স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশনগুলো ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ডসহ অন্যান্য টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগায়। এর কারণ এসব টিকা শুধুমাত্র করোনার স্পাইক প্রোটিন অ্যান্টিজেনকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য মানবদেহে প্রয়োজনীয় এন্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম, যাতে ভাইরাসটি মানবদেহের কোষের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করতে না পারে। টিকাটি করোনার স্পাইককে আক্রমণ করতে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং এর ফলে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে না। তাছাড়া এসব টিকার মাধ্যমে সৃষ্ট এন্টিবডি আমাদের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করোনার স্পাইকগুলোর একাধিক অংশকে আক্রমণ করতে শেখায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফাইজার-বায়োএনটেক টিকাটির কথা, যা করোনার স্পাইকের মোট ১২৭৩টি এমাইনো এসিডের মধ্যে ১২৭০টি এমাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং ব্রিটেনে শনাক্ত নতুন ধরনের করোনার স্পাইকে মাত্র ১৭টি এমাইনো এসিডে পরিবর্তন এসেছে।

করোনার স্পাইক প্রোটিনে সামান্য পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এসব নতুন ধরনের করোনার বিরুদ্ধে টিকাগুলো সাময়িক সময়ের জন্য হলেও কাজ করবে। আর যদি স্পাইক প্রোটিনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, তবে এসব টিকা অবশ্যই স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তিত এমাইনো এসিড সিকোয়েন্সের সঙ্গে মিল রেখে আপডেট করতে হবে। কজেই করোনার রূপ পরিবর্তনের খবরে আতঙ্কিত না হয়ে টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে করোনার বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]