প্রকৃতির বয়নশিল্পী

বাবুই পাখির দুর্দশার কাল

সাধন সরকার

এক-দুই দশক আগেও আবহমান গ্রাম-বাংলার পথে-প্রান্তরে প্রকৃতির বয়নশিল্পী বাবুই পাখির বাসা দেখা যেত। কিন্তু সভ্যতার বিবর্তন, যান্ত্রিকতার প্রসার আর অপরিকল্পিত গাছ কাটা তথা পাখির বাসস্থান ধ্বংস করার ফলে প্রকৃতির নিখুঁত স্থপতি, সামাজিক বন্ধনের দূত বাবুই পাখি ও তার বাসা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামগঞ্জ থেকে বাবুই পাখির আদর্শ ঠিকানা তালগাছ, সুপারিগাছ, খেজুরগাছ ও নারিকেল গাছ কমে যাওয়ার ফলে বিলুপ্ত হতে চলেছে এ পাখির শৈল্পিক কুঁড়েঘর। শৈল্পিকতায় ঠাসা বাবুই পাখির বাসার সৌন্দর্য চারপাশে অনাবিল মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। প্রথম দেখাতেই বাবুই পাখির বাসা যে কারও কাছে চিন্তার খোরাক জোগাবে। দৃষ্টিনন্দন ও মুগ্ধতা ছড়ানো বাবুই পাখির মজবুত বাসা প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও গাছ থেকে কখনও ছিঁড়ে পড়ে না!

সারা বিশ্বে প্রায় ১১৬ প্রজাতির বাবুই পাখি রয়েছে। তবে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখির দেখা মিলে- বাংলা বাবুই, দেশি বাবুই ও দাগি বাবুই। অনেকে বাবুই পাখিকে তাঁতি পাখিও বলে থাকে। এরা দল বেঁধে বসবাস করে থাকে। পুরুষ বাবুই পাখি স্ত্রী বাবুই পাখিদের প্রেরণায় নান্দনিক বাসা তৈরি করে। বেশিরভাগ পুরুষ প্রজাতির পাখি বেশ উজ্জ্বল রঙের হয়। তবে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রং পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বাসা বানানোর জন্য বাবুই পাখি খুব পরিশ্রম করে। বাবুই পাখি একটি বাসা তৈরিতে ১০ থেকে ১৩ দিন সময় নেয়। এরা দল বেঁধে কিচিরমিচির শব্দ করে ডাকাডাকি করে। মূলত বাবুই পাখি খাল-বিল, পুকুর-ডোবায় গোসল করে। ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসা প্রকৃতিতে এক নান্দনিক সৌন্দর্যের বাতাবরণ তৈরি করে। কাশবন ও ঝাউগাছের ফালি, ধানের পাতা, হোগলার পাতা, তাল-সুপারি-নারিকেল গাছের কচিপাতা, ছন ও খড়ের ফালি ইত্যাদি দিয়ে বাবুই পাখি নিপুণ শিল্পকর্মের বাসা তৈরি করে। ঠোঁট দিয়ে এমন সুন্দর কারুকাজ অন্য কোন পাখির ক্ষেত্রে খুব কম দেখা যায়। বাবুই পাখি সাধারণত বিভিন্ন ফলের বীজ, ধান, ভাত, ছোট ছোট উদ্ভিদের নরম পাতা, ঘাস, পোকা, বিভিন্ন ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে থাকে। কথিত আছে যে, রাতে বাসায় আলো জ্বালানোর জন্য বাবুই পাখি বাসায় জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে আসে এবং সকালে আবার ছেড়ে দেয়!

বাস্তবতা হলো পরিবেশ বিপর্যয় ও অসচেতনতার ফলে বাবুই পাখি ও তার বাসা বিলুপ্তির পথে। এক শ্রেণীর অসাধু পাখি শিকারী বাবুই পাখি শিকার করে বিক্রি করে দেয়। জলাভূমি কমে যাওয়া, ঝোপঝাড় উজাড় হওয়া, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার ও বনভূমি কমে যাওয়ার ফলে বাবুই পাখির অস্তিত সংকটাপন্ন। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি-পরিবেশে বিপর্যয় নেমে আসছে। দেশে দেশে দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি-পরিবেশবিনাশী কর্মকান্ড। পরিবেশের সৌন্দর্য রক্ষা ও ভারসাম্য বজায় রাখতে বাবুই পাখির গুরুত্ব রয়েছে। বনভূমি ও জলাভূমি রক্ষা করতে পারলে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা পাবে তেমনি বাবুই পাখির আবাসস্থলও সংরক্ষণ হবে। আশার কথা হচ্ছে পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে রাজশাহীতে বাগান মালিককে পাখির বাসার ভাড়া বাবদ অর্থ দেয়ার মতো ইতিবাচক ঘটনাও দেখা গেছে। বাবুই পাখি ও তার বাসার শৈল্পিক নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ প্রকৃতিপ্রেমী জনসাধারণকে এগিয়ে আসার মোক্ষম সময় এখনই।

[লেখক : সদস্য,

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)]

sadonsarker2005@gmail.com

শুক্রবার, ০১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ পৌষ ১৪২৭, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

প্রকৃতির বয়নশিল্পী

বাবুই পাখির দুর্দশার কাল

সাধন সরকার

image

এক-দুই দশক আগেও আবহমান গ্রাম-বাংলার পথে-প্রান্তরে প্রকৃতির বয়নশিল্পী বাবুই পাখির বাসা দেখা যেত। কিন্তু সভ্যতার বিবর্তন, যান্ত্রিকতার প্রসার আর অপরিকল্পিত গাছ কাটা তথা পাখির বাসস্থান ধ্বংস করার ফলে প্রকৃতির নিখুঁত স্থপতি, সামাজিক বন্ধনের দূত বাবুই পাখি ও তার বাসা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামগঞ্জ থেকে বাবুই পাখির আদর্শ ঠিকানা তালগাছ, সুপারিগাছ, খেজুরগাছ ও নারিকেল গাছ কমে যাওয়ার ফলে বিলুপ্ত হতে চলেছে এ পাখির শৈল্পিক কুঁড়েঘর। শৈল্পিকতায় ঠাসা বাবুই পাখির বাসার সৌন্দর্য চারপাশে অনাবিল মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। প্রথম দেখাতেই বাবুই পাখির বাসা যে কারও কাছে চিন্তার খোরাক জোগাবে। দৃষ্টিনন্দন ও মুগ্ধতা ছড়ানো বাবুই পাখির মজবুত বাসা প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও গাছ থেকে কখনও ছিঁড়ে পড়ে না!

সারা বিশ্বে প্রায় ১১৬ প্রজাতির বাবুই পাখি রয়েছে। তবে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখির দেখা মিলে- বাংলা বাবুই, দেশি বাবুই ও দাগি বাবুই। অনেকে বাবুই পাখিকে তাঁতি পাখিও বলে থাকে। এরা দল বেঁধে বসবাস করে থাকে। পুরুষ বাবুই পাখি স্ত্রী বাবুই পাখিদের প্রেরণায় নান্দনিক বাসা তৈরি করে। বেশিরভাগ পুরুষ প্রজাতির পাখি বেশ উজ্জ্বল রঙের হয়। তবে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রং পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বাসা বানানোর জন্য বাবুই পাখি খুব পরিশ্রম করে। বাবুই পাখি একটি বাসা তৈরিতে ১০ থেকে ১৩ দিন সময় নেয়। এরা দল বেঁধে কিচিরমিচির শব্দ করে ডাকাডাকি করে। মূলত বাবুই পাখি খাল-বিল, পুকুর-ডোবায় গোসল করে। ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসা প্রকৃতিতে এক নান্দনিক সৌন্দর্যের বাতাবরণ তৈরি করে। কাশবন ও ঝাউগাছের ফালি, ধানের পাতা, হোগলার পাতা, তাল-সুপারি-নারিকেল গাছের কচিপাতা, ছন ও খড়ের ফালি ইত্যাদি দিয়ে বাবুই পাখি নিপুণ শিল্পকর্মের বাসা তৈরি করে। ঠোঁট দিয়ে এমন সুন্দর কারুকাজ অন্য কোন পাখির ক্ষেত্রে খুব কম দেখা যায়। বাবুই পাখি সাধারণত বিভিন্ন ফলের বীজ, ধান, ভাত, ছোট ছোট উদ্ভিদের নরম পাতা, ঘাস, পোকা, বিভিন্ন ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে থাকে। কথিত আছে যে, রাতে বাসায় আলো জ্বালানোর জন্য বাবুই পাখি বাসায় জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে আসে এবং সকালে আবার ছেড়ে দেয়!

বাস্তবতা হলো পরিবেশ বিপর্যয় ও অসচেতনতার ফলে বাবুই পাখি ও তার বাসা বিলুপ্তির পথে। এক শ্রেণীর অসাধু পাখি শিকারী বাবুই পাখি শিকার করে বিক্রি করে দেয়। জলাভূমি কমে যাওয়া, ঝোপঝাড় উজাড় হওয়া, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার ও বনভূমি কমে যাওয়ার ফলে বাবুই পাখির অস্তিত সংকটাপন্ন। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি-পরিবেশে বিপর্যয় নেমে আসছে। দেশে দেশে দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি-পরিবেশবিনাশী কর্মকান্ড। পরিবেশের সৌন্দর্য রক্ষা ও ভারসাম্য বজায় রাখতে বাবুই পাখির গুরুত্ব রয়েছে। বনভূমি ও জলাভূমি রক্ষা করতে পারলে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা পাবে তেমনি বাবুই পাখির আবাসস্থলও সংরক্ষণ হবে। আশার কথা হচ্ছে পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে রাজশাহীতে বাগান মালিককে পাখির বাসার ভাড়া বাবদ অর্থ দেয়ার মতো ইতিবাচক ঘটনাও দেখা গেছে। বাবুই পাখি ও তার বাসার শৈল্পিক নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ প্রকৃতিপ্রেমী জনসাধারণকে এগিয়ে আসার মোক্ষম সময় এখনই।

[লেখক : সদস্য,

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)]

sadonsarker2005@gmail.com