প্রসঙ্গ : ব্যাংক লুটেরার দল

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস

প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা থাকে। বড়দের বড় আর ছোটদের ছোট এই যা তফাৎ। অভিজ্ঞতাগুলো ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা চাকরি জীবনের হতে পারে। যারা চাকরি-বাকরি করেন তাদের চাকরি জীবনের অনেক অনেক অভিজ্ঞতা থাকারই কথা। কারণ দিনের বেশিরভাগ সময়ই চাকরিস্থলে তাদের কাটাতে হয়। যতই ছোট হই, অতি সাধারণ হই আমার জীবনটাও এর ব্যতিক্রম নয়।

আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রিয় গানের কলি- ‘অতীত দিনের স্মৃতি কেউ ভুলে না কেউ ভুলে’ গানে গানে সুরে সুরে এখনও উচ্চারণ করি কিন্তু সব স্মৃতি কি মনে থাকে? থাকে না। স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যায়। হারিয়ে যায়। কিছু কিছু থেকে যায় স্মৃতিপটে, সিলেট তথা সুনামগঞ্জের রাজনীতির আকাশে তিন উজ্জ্বল তারকার সঙ্গে। কিছু কিছু স্মৃতি, কিছু কথা আজও ভুলি নাই।

(এক) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দিরাইয়ে জনতা ব্যাংকের নতুন শাখা। সেখানে আমি নতুন ম্যানেজার। তুখুর রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তখন এমপি। দুষ্টুমী করলে তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো আদর করতেন। সম্পর্কটা ছিল অনেকটা বিশ্ব কবির ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে গো’ এর মতোই। দিরাই বাজারে তখন এক ভদ্রলোক গাঁজার ব্যবসা করতেন। উনি বায়না ধরলেন উনাকে ৩০ হাজার টাকা লোন দিতে হবে। আইনি জটিলতায় লোন দিতে পারছিলাম না। সেনবাবু দিরাই এলেই এই গাঁজার ব্যবসায়ী মহোদয় সপরিবারে উনাকে ঘিরে ধরতেন লোনের জন্য আমাকে চাপ দিতে। একদিন তো সেনদার চিঠি নিয়ে ব্যাংকে হাজির। চিঠিতে লিখা ছিল- ‘Brother, Please help her’। সেনদা তখন দিরাই ডাকবাংলায় অবস্থান করছিলেন। অর্থাৎ সেনদার কাছে গাঁজার ব্যবসায়ী তার স্ত্রীকে নিয়ে গেছিলেন এবং ‘her’ বলতে তার স্ত্রীকেই বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু চিঠিা নিয়ে এসেছিলেন গাঁজা ব্যবসায়ী নিজে। সুযোগ পেয়ে গেলাম। চিঠি নিয়ে সোজা ডাকবাংলায় নেতার কাছে চলে গেলাম। তখন তিনি খাওয়ার টেবিলে। সব প্রটোকল ভেঙে গিয়ে বললাম চিঠিতে লিখা ‘her’; কিন্তু গেলেন তো একজন ‘him’। তিনি বললেন, কোনভাবে লোনটা দেয়া যায় না। আমি বললাম যায়; কিন্তু আপনি কি সাক্ষী হবেন। এ কি বলিস। না হলে যে আমার চাকরি যাবে। তিনি খুবই স্নেহভরে আমাকে বললেন, তাহলে উপায়? উপায় একটা আছে; কিন্তু আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবে এবং সেটা হলো আপনি শুধু বলবেন- ম্যানেজারের কাছে, যাও এবং ওই ভদ্রলোক ব্যবসায়ী আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবেন না। আমি গাঁজার বিপরীতে লোন প্রার্থী ভদ্রলোককে এসে বললাম- গাঁজার ব্যবসাতে লোন দেবার আইন নাই; কিন্তু এমপি মহোদয় ঢাকায় গিয়েই গাঁজাতে লোন দেয়া যায় কিনা সংসদে আলোচনা করবেন এবং তা তো অবশ্যই পত্রপত্রিকায় উঠবে। খবর রাখবেন। খবরটি পত্রিকায় উঠলেই নিয়ে আসবেন। সুখের বিষয় হলোÑ অবৈধভাবে লোনপ্রার্থী সেই গাঁজা ব্যবসায়ী পত্রিকা নিয়ে আর কোনদিন ব্যাংকে আসেননি। সেই স্মৃতির কথা আজ বলছি এ কারণে যে, সেদিন এমপি মহোদয় যদি চাপ সৃষ্টি করতেন তাহলে যে কোন পন্থায় আমাকে সেই ৩০ হাজার টাকার লোনটি দিতে হতো এবং একপর্যায়ে অবশ্যই তা খেলাপি ঋণে পরিণত হতো; কিন্তু আমার পরম শ্রদ্ধেয় সেনদা সেদিন তা করেননি এবং সে কারণেই আমি আজও সেই ছোট্ট ঘটনাটি গভীর শ্রদ্ধাঋদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি।

দুই: তখন আমি জনতা বাংক সুনামগঞ্জ প্রধান শাখার ম্যানেজার। একদিন এক ভদ্রলোক চেম্বারে এসে বললেন তাকে ছয়টি ট্রাক কিনতে লোন দিতে হবে। এবং তিনি এও জানালেন যে তাকে নাকি মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ পাঠিয়েছেন। প্রথমে একটু ঘাবরে গেলাম। তারপর জানতে চাইলাম পৌরসভার ভেতর তার কোন সম্পত্তি আছে কিনা। ভদ্রলোক জানালেন গ্রামে নাকি তার ১০/১২ হাল জমি রয়েছে। আর যায় কোথায়! মোক্ষম সুযোগ। আগের ঘটনার সঙ্গে মিলে গেল। ভদ্রলোককে বললাম পৌরসভার বাইরে সহজামানত হিসাবে কোন জমি নেবার কোন আইন নাই। ভদ্রলোক বললেন মন্ত্রী মহোদয় তো আমাকে পাঠিয়েছেন, তাহলে কি করব। উনাকে বললাম সংসদে হয়তো এমন আইন পাস হবে যে গ্রামের কৃষি জমিও সহজামানত হিসেবে নেয়া যাবে। ভদ্রলোক অনেকটা রাগান্বিত হয়েই চলে গেলেন। আমিও অনেক দুশ্চিন্তায়ই পড়লাম। কিন্তু না। সিলেটের তথা সারা বাংলাদেশের কৃতী সন্তান সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ আমার মতো এক গরিবের সন্তান ব্যাংক কর্মচারীর ঘুম হারাম করেননি। ট্রাক লোনের জন্য টেলিফোন করেননি। বেঁচে গেলাম। খেলাপি ঋণের বোঝা আমার মাথায় আর বইতে হয়নি। তাই তো কৃতজ্ঞচিত্তে আজও সেই স্মৃতি রোমন্থন করেই চলছি।

তিন-জনতা ব্যাংক সুনামগঞ্জ প্রধান শাখারই ঘটনা জনাব আসপিয়া সাহেব বিএনপির জনপ্রিয় নেতা। তখন ৩০ হাজার টাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে দেবার ডেলিগেশন পাওয়ার শাখা ম্যানেজারের হাতেই ছিল। সুনামগঞ্জের অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকেই এ রকম লোন দেয়া হয়েছিল। একজন কর্মীর মাধ্যমে আসপিয়া সাহেব এক ভদ্রলোককে ৩০ হাজার টাকার লোন দিতে বলেন। আমি লোন দিয়েছিলাম। দেখা গেল এক-দু’মাস লোনের কিস্তির টাকা পরিশোধ করার পরই আর কিস্তি দেয়া বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ লোনটি খেলাপি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। এক মিটিংয়ের সুবাদে ইউএনও অফিসে এমপি সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে উনাকে ঘটনাটি বলি। পরদিন খবর পেলাম কর্মীদের মাধ্যমে তিনি ঋণগ্রহীতাকে ঋণ পরিশোধের কথা বলেন এবং যথরীতি ঋণটি পরিশোধ করা হয়। এখানে প্রশ্ন হলোÑ এমপি সাহেব এতো ছোট একটি ঘটনাকে এক গুরুত্ব না দিলেও পারতেন। কিন্তু এতে লাভ হয়েছে ব্যাংকের তথা দেশের। দেশের ‘খেলাপি’ নামক এক অপসংস্কৃতির হাত থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টাকাও রক্ষা পেয়েছে।

এখন অবসর জীবনে ঘরে বসে পত্রিকার পাতা উল্টানো-পাল্টানো ছাড়া তেমন কাজ করার ক্ষমতা নেই। ফেলে আসা জীবনের অনেক স্মৃতি, অনেক কথাই মনে পড়ে। সেই স্মৃতিগুলো কাউকে বলার সুযোগ নেই। কিন্তু বলতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। সাধ জাগে। কিন্তু সাধ্য কোথায় কে-ই বা তা শুনতে চায়। এমন কথা শোনা কারই বা এত প্রয়োজন? তবু কেন জানি কবি গুরুর সেই গানের কলি ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ’।

সেই ‘হৃদয়ের কথা’ তো একেক জনের একেক রকম। জনতা ব্যাংক তথা বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতের একেকালের একে নগণ্য সদস্য হিসেবে আমার হৃদয়ের ও তো অনেক কথা থাকবে এবং আছে। সেটি তো অবশ্যই সেই কলঙ্কিত অবিশপ্ত শব্দটি-খেলাপি ঋণ। এই খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতের হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা বলে শেষ করার নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব সমাজে ও এ খাত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে।

এরই প্রমাণ হিসেবে ১০.১১.২০২০ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ সম্পর্কিত লজ্জাজনক শিরোনাম দেখতে হয়। যেমন- ‘আইএমএফের সুপারিশ ব্যাংক লুটেরাদের নিষিদ্ধ করুন; দুর্বল বা দেউলিয়াত্বের পথে যাওয়া ব্যাংক বিলুপ্ত করতে হবে, খেলাপিদের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসা বন্ধ করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করতে হবে।’ আমাদের সরকারের আমন্ত্রণে সুশাসন জর্জের নেতৃত্বে আইএমএফের ছয় সদস্যের একটি দল গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আসেন। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসা বাণিজ্য করা কোন অপরাধ নয়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবসায়ীদের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা ব্যাংকের দায়িত্বও বটে। তবে এর কিছু নিয়মকানুন রয়েছে এবং নিয়মকানুন পরিপালন করা ঋণগ্রহীতাদেরও অবশ্যই পালনীয়। এটা আমরা মানি না বলেই যত ঝামেলা-বিপর্যয়। এই নিয়মের আসল কথাই হলো- ঋণের ব্যাপারে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করে দেশের ঋণপ্রবাহের গতি সচল রেখে ব্যবসা উন্নয়ন করতে সাহায্য করাই সবার দায়িত্ব। এই নিয়মকানুন এরে প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এক শ্রেণীর ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ওদের কুকর্মের জন্যই আজ বিদেশিরা এ দেশে এসে আমাদের লুটেরা বলছেন। লুট করলে তো লুটেরা বলবেই।

আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা আইএমএফের প্রতিনিধি তাদের মন্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নেন বড় ঋণগ্রহীতারা, আর্থিক খাতের সিদ্ধান্ত নেন প্রভাবশালীরা। এই খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের তারা ‘ব্যাংক লুটেরা’ বলে অভিহিত করেন। আইএমএফ আরও বলেছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ লুকানো হয়, কমিয়ে দেখানো হয়। প্রকৃত খেলাপি আরও বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য ও একেই রকম। অর্থনীতিবিদ মির্জা আজিজুর ইসলাম বলেন, ‘ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাচ্ছেন। আইএমএফ বলেছে- ব্যাংকিং খাতে যেসব সমস্যা রয়েছে তার মূলে মূলত প্রভাবশালীরা।’ এখন প্রশ্ন হলো- এই প্রভাবশালীরা কারা! নিবন্ধের শুরুতে যে তিনজন সম্মানীত ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হলো তারা কি সত্যিকার অর্থেই প্রভাবশালী নন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করলেই এবং তা উদাহরণ হিসেবে নিলেই অনেক সমস্যার সমাধান মিলবে।

আর বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা। অবশ্যই স্বাধীনতার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে ব্যাংক লুটেরারা অবশ্যই সতর্ক হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে যে, স্বাধীনতা পাওয়ার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন। নয় কি?

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট, সাবেক ব্যাংকার]

শনিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২১ , ১৮ পৌষ ১৪২৭, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

প্রসঙ্গ : ব্যাংক লুটেরার দল

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস

প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা থাকে। বড়দের বড় আর ছোটদের ছোট এই যা তফাৎ। অভিজ্ঞতাগুলো ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা চাকরি জীবনের হতে পারে। যারা চাকরি-বাকরি করেন তাদের চাকরি জীবনের অনেক অনেক অভিজ্ঞতা থাকারই কথা। কারণ দিনের বেশিরভাগ সময়ই চাকরিস্থলে তাদের কাটাতে হয়। যতই ছোট হই, অতি সাধারণ হই আমার জীবনটাও এর ব্যতিক্রম নয়।

আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রিয় গানের কলি- ‘অতীত দিনের স্মৃতি কেউ ভুলে না কেউ ভুলে’ গানে গানে সুরে সুরে এখনও উচ্চারণ করি কিন্তু সব স্মৃতি কি মনে থাকে? থাকে না। স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যায়। হারিয়ে যায়। কিছু কিছু থেকে যায় স্মৃতিপটে, সিলেট তথা সুনামগঞ্জের রাজনীতির আকাশে তিন উজ্জ্বল তারকার সঙ্গে। কিছু কিছু স্মৃতি, কিছু কথা আজও ভুলি নাই।

(এক) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দিরাইয়ে জনতা ব্যাংকের নতুন শাখা। সেখানে আমি নতুন ম্যানেজার। তুখুর রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তখন এমপি। দুষ্টুমী করলে তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো আদর করতেন। সম্পর্কটা ছিল অনেকটা বিশ্ব কবির ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে গো’ এর মতোই। দিরাই বাজারে তখন এক ভদ্রলোক গাঁজার ব্যবসা করতেন। উনি বায়না ধরলেন উনাকে ৩০ হাজার টাকা লোন দিতে হবে। আইনি জটিলতায় লোন দিতে পারছিলাম না। সেনবাবু দিরাই এলেই এই গাঁজার ব্যবসায়ী মহোদয় সপরিবারে উনাকে ঘিরে ধরতেন লোনের জন্য আমাকে চাপ দিতে। একদিন তো সেনদার চিঠি নিয়ে ব্যাংকে হাজির। চিঠিতে লিখা ছিল- ‘Brother, Please help her’। সেনদা তখন দিরাই ডাকবাংলায় অবস্থান করছিলেন। অর্থাৎ সেনদার কাছে গাঁজার ব্যবসায়ী তার স্ত্রীকে নিয়ে গেছিলেন এবং ‘her’ বলতে তার স্ত্রীকেই বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু চিঠিা নিয়ে এসেছিলেন গাঁজা ব্যবসায়ী নিজে। সুযোগ পেয়ে গেলাম। চিঠি নিয়ে সোজা ডাকবাংলায় নেতার কাছে চলে গেলাম। তখন তিনি খাওয়ার টেবিলে। সব প্রটোকল ভেঙে গিয়ে বললাম চিঠিতে লিখা ‘her’; কিন্তু গেলেন তো একজন ‘him’। তিনি বললেন, কোনভাবে লোনটা দেয়া যায় না। আমি বললাম যায়; কিন্তু আপনি কি সাক্ষী হবেন। এ কি বলিস। না হলে যে আমার চাকরি যাবে। তিনি খুবই স্নেহভরে আমাকে বললেন, তাহলে উপায়? উপায় একটা আছে; কিন্তু আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবে এবং সেটা হলো আপনি শুধু বলবেন- ম্যানেজারের কাছে, যাও এবং ওই ভদ্রলোক ব্যবসায়ী আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবেন না। আমি গাঁজার বিপরীতে লোন প্রার্থী ভদ্রলোককে এসে বললাম- গাঁজার ব্যবসাতে লোন দেবার আইন নাই; কিন্তু এমপি মহোদয় ঢাকায় গিয়েই গাঁজাতে লোন দেয়া যায় কিনা সংসদে আলোচনা করবেন এবং তা তো অবশ্যই পত্রপত্রিকায় উঠবে। খবর রাখবেন। খবরটি পত্রিকায় উঠলেই নিয়ে আসবেন। সুখের বিষয় হলোÑ অবৈধভাবে লোনপ্রার্থী সেই গাঁজা ব্যবসায়ী পত্রিকা নিয়ে আর কোনদিন ব্যাংকে আসেননি। সেই স্মৃতির কথা আজ বলছি এ কারণে যে, সেদিন এমপি মহোদয় যদি চাপ সৃষ্টি করতেন তাহলে যে কোন পন্থায় আমাকে সেই ৩০ হাজার টাকার লোনটি দিতে হতো এবং একপর্যায়ে অবশ্যই তা খেলাপি ঋণে পরিণত হতো; কিন্তু আমার পরম শ্রদ্ধেয় সেনদা সেদিন তা করেননি এবং সে কারণেই আমি আজও সেই ছোট্ট ঘটনাটি গভীর শ্রদ্ধাঋদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি।

দুই: তখন আমি জনতা বাংক সুনামগঞ্জ প্রধান শাখার ম্যানেজার। একদিন এক ভদ্রলোক চেম্বারে এসে বললেন তাকে ছয়টি ট্রাক কিনতে লোন দিতে হবে। এবং তিনি এও জানালেন যে তাকে নাকি মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ পাঠিয়েছেন। প্রথমে একটু ঘাবরে গেলাম। তারপর জানতে চাইলাম পৌরসভার ভেতর তার কোন সম্পত্তি আছে কিনা। ভদ্রলোক জানালেন গ্রামে নাকি তার ১০/১২ হাল জমি রয়েছে। আর যায় কোথায়! মোক্ষম সুযোগ। আগের ঘটনার সঙ্গে মিলে গেল। ভদ্রলোককে বললাম পৌরসভার বাইরে সহজামানত হিসাবে কোন জমি নেবার কোন আইন নাই। ভদ্রলোক বললেন মন্ত্রী মহোদয় তো আমাকে পাঠিয়েছেন, তাহলে কি করব। উনাকে বললাম সংসদে হয়তো এমন আইন পাস হবে যে গ্রামের কৃষি জমিও সহজামানত হিসেবে নেয়া যাবে। ভদ্রলোক অনেকটা রাগান্বিত হয়েই চলে গেলেন। আমিও অনেক দুশ্চিন্তায়ই পড়লাম। কিন্তু না। সিলেটের তথা সারা বাংলাদেশের কৃতী সন্তান সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ আমার মতো এক গরিবের সন্তান ব্যাংক কর্মচারীর ঘুম হারাম করেননি। ট্রাক লোনের জন্য টেলিফোন করেননি। বেঁচে গেলাম। খেলাপি ঋণের বোঝা আমার মাথায় আর বইতে হয়নি। তাই তো কৃতজ্ঞচিত্তে আজও সেই স্মৃতি রোমন্থন করেই চলছি।

তিন-জনতা ব্যাংক সুনামগঞ্জ প্রধান শাখারই ঘটনা জনাব আসপিয়া সাহেব বিএনপির জনপ্রিয় নেতা। তখন ৩০ হাজার টাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে দেবার ডেলিগেশন পাওয়ার শাখা ম্যানেজারের হাতেই ছিল। সুনামগঞ্জের অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকেই এ রকম লোন দেয়া হয়েছিল। একজন কর্মীর মাধ্যমে আসপিয়া সাহেব এক ভদ্রলোককে ৩০ হাজার টাকার লোন দিতে বলেন। আমি লোন দিয়েছিলাম। দেখা গেল এক-দু’মাস লোনের কিস্তির টাকা পরিশোধ করার পরই আর কিস্তি দেয়া বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ লোনটি খেলাপি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। এক মিটিংয়ের সুবাদে ইউএনও অফিসে এমপি সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে উনাকে ঘটনাটি বলি। পরদিন খবর পেলাম কর্মীদের মাধ্যমে তিনি ঋণগ্রহীতাকে ঋণ পরিশোধের কথা বলেন এবং যথরীতি ঋণটি পরিশোধ করা হয়। এখানে প্রশ্ন হলোÑ এমপি সাহেব এতো ছোট একটি ঘটনাকে এক গুরুত্ব না দিলেও পারতেন। কিন্তু এতে লাভ হয়েছে ব্যাংকের তথা দেশের। দেশের ‘খেলাপি’ নামক এক অপসংস্কৃতির হাত থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টাকাও রক্ষা পেয়েছে।

এখন অবসর জীবনে ঘরে বসে পত্রিকার পাতা উল্টানো-পাল্টানো ছাড়া তেমন কাজ করার ক্ষমতা নেই। ফেলে আসা জীবনের অনেক স্মৃতি, অনেক কথাই মনে পড়ে। সেই স্মৃতিগুলো কাউকে বলার সুযোগ নেই। কিন্তু বলতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। সাধ জাগে। কিন্তু সাধ্য কোথায় কে-ই বা তা শুনতে চায়। এমন কথা শোনা কারই বা এত প্রয়োজন? তবু কেন জানি কবি গুরুর সেই গানের কলি ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ’।

সেই ‘হৃদয়ের কথা’ তো একেক জনের একেক রকম। জনতা ব্যাংক তথা বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতের একেকালের একে নগণ্য সদস্য হিসেবে আমার হৃদয়ের ও তো অনেক কথা থাকবে এবং আছে। সেটি তো অবশ্যই সেই কলঙ্কিত অবিশপ্ত শব্দটি-খেলাপি ঋণ। এই খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতের হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা বলে শেষ করার নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব সমাজে ও এ খাত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে।

এরই প্রমাণ হিসেবে ১০.১১.২০২০ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ সম্পর্কিত লজ্জাজনক শিরোনাম দেখতে হয়। যেমন- ‘আইএমএফের সুপারিশ ব্যাংক লুটেরাদের নিষিদ্ধ করুন; দুর্বল বা দেউলিয়াত্বের পথে যাওয়া ব্যাংক বিলুপ্ত করতে হবে, খেলাপিদের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসা বন্ধ করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করতে হবে।’ আমাদের সরকারের আমন্ত্রণে সুশাসন জর্জের নেতৃত্বে আইএমএফের ছয় সদস্যের একটি দল গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আসেন। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসা বাণিজ্য করা কোন অপরাধ নয়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবসায়ীদের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা ব্যাংকের দায়িত্বও বটে। তবে এর কিছু নিয়মকানুন রয়েছে এবং নিয়মকানুন পরিপালন করা ঋণগ্রহীতাদেরও অবশ্যই পালনীয়। এটা আমরা মানি না বলেই যত ঝামেলা-বিপর্যয়। এই নিয়মের আসল কথাই হলো- ঋণের ব্যাপারে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করে দেশের ঋণপ্রবাহের গতি সচল রেখে ব্যবসা উন্নয়ন করতে সাহায্য করাই সবার দায়িত্ব। এই নিয়মকানুন এরে প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এক শ্রেণীর ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ওদের কুকর্মের জন্যই আজ বিদেশিরা এ দেশে এসে আমাদের লুটেরা বলছেন। লুট করলে তো লুটেরা বলবেই।

আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা আইএমএফের প্রতিনিধি তাদের মন্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নেন বড় ঋণগ্রহীতারা, আর্থিক খাতের সিদ্ধান্ত নেন প্রভাবশালীরা। এই খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের তারা ‘ব্যাংক লুটেরা’ বলে অভিহিত করেন। আইএমএফ আরও বলেছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ লুকানো হয়, কমিয়ে দেখানো হয়। প্রকৃত খেলাপি আরও বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য ও একেই রকম। অর্থনীতিবিদ মির্জা আজিজুর ইসলাম বলেন, ‘ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাচ্ছেন। আইএমএফ বলেছে- ব্যাংকিং খাতে যেসব সমস্যা রয়েছে তার মূলে মূলত প্রভাবশালীরা।’ এখন প্রশ্ন হলো- এই প্রভাবশালীরা কারা! নিবন্ধের শুরুতে যে তিনজন সম্মানীত ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হলো তারা কি সত্যিকার অর্থেই প্রভাবশালী নন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করলেই এবং তা উদাহরণ হিসেবে নিলেই অনেক সমস্যার সমাধান মিলবে।

আর বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা। অবশ্যই স্বাধীনতার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে ব্যাংক লুটেরারা অবশ্যই সতর্ক হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে যে, স্বাধীনতা পাওয়ার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন। নয় কি?

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট, সাবেক ব্যাংকার]