করোনার নতুন সংস্করণ ও টিকা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

ব্রিটেনে রূপান্তরিত নতুন ধরন এবং অধিক সংক্রামক করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। ব্রিটিশ গবেষকরা নতুন যে ভাইরাসের বিস্তার দেখছেন সেটিকে তারা নতুন ধরনের ভাইরাস বলে শনাক্ত করছেন। এ করোনাভাইরাস আগের করোনাভাইরাসের তুলনায় প্রায় সত্তর শতাংশ বেশি হারে ছড়াচ্ছে। এ ভাইরাসের ভয়ে মানুষ একদিকে যুক্তরাজ্য ছাড়ার চেষ্টা করছে অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের সাথে বিভিন্ন দেশ বিমান চলাচল বিচ্ছিন্ন করছে। তবে ব্রিটেন ছেড়ে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না, কারণ এ ভাইরাসের অস্তিত্ব ইতোমধ্যে ব্রিটেন ছাড়াও ইতালি, দক্ষিণ আফ্রিকা, আইসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্কেও পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের মতো হুবহু না হলেও প্রায় অনুরূপ একটি রূপান্তরিত ভাইরাস বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে। কারো কারো ধারণা ভাইরাসটি স্পেন থেকে ব্রিটেনে এসেছে। ক্রিসমাসের উৎসবে মানুষের চলাফেরা ও সামাজিক সম্মিলনের বিধিনিষেধ শিথিল করার পরিকল্পনা বাতিল করে পশ্চিমা বিশ্ব পুনরায় নতুন করে কঠোর লকডাউন আরোপ করা শুরু করেছে।

করোনাভাইরাসটি প্রাকৃতিকভাবেই নিয়মিত মিউটেশন বা রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে বলে গবেষকেরা এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে উল্লেখ করেছিলেন। কারণ সব ভাইরাসেরই মিউটেশন বা রূপান্তর হয়। রূপান্তরের ফলে ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ও আচরণের পরিবর্তন হয়; চীনে উহানে এ ভাইরাসের আবির্ভাবের পর হতে এখন পর্যন্ত বহুবার তার রূপান্তর হয়েছে। রূপান্তরিত যে কোন ভাইরাস আগের ভাইরাসের চাইতে ভয়ঙ্কর অথবা নিষ্ক্রিয় হতে পারে। ভাইরাসটি নিজের স্বার্থেই নিজেকে পরিবর্তন করে, অপরিচিত সাজে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ভ্যাকসিন বা শরীরের ভেতরের প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে। যথাযথ গবেষণা এখনো না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, করোনার এ রূপান্তরিত ভাইরাস আগেরটির চেয়ে অধিক প্রাণঘাতী নয়। তবে এ নতুন রূপের করোনাভাইরাসটি তরুণ জনগোষ্ঠীকে বেশি সংক্রমিত করছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এক বছরের মধ্যে কার্যকরী ভ্যাকসিনের আবিষ্কার ও প্রয়োগ বিশ্বকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। চিকিৎসা জগতে এত দ্রুততম সময়ে আর কখনো কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। ইতোমধ্যে এ ভাইরাসে বিশ্বে প্রায় ৮ কোটি লোক আক্রান্ত এবং ১৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বজুড়ে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা মানবদেহে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ভয়-ভীতি ছাড়াই সাধারণ মানুষ যাতে টিকা গ্রহণে উৎসাহিত হয় সেজন্য বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে টিকা নিতে শুরু করেছেন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ব্রিটেনের ৯০ বছর বয়সী মার্গারেট কিনান সর্বপ্রথম ভ্যাকসিন নিয়েছেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, বাহরাইন, কুয়েত, সৌদি আরব, মেক্সিকো, চিলি, কোস্টারিকা, সার্বিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ গণহারে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে গত রোববার থেকে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও নতুন বছরের শুরুতে টিকার কার্যক্রম শুরু হবে।

সব দেশ কিন্তু একই কোম্পানির টিকা ব্যবহার করছে না। কয়েকটি ভ্যাকসিন গণহারে প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে আরও অসংখ্য ভ্যাকসিন বিভিন্ন পর্যায়ে ট্রায়ালে রয়েছে। আমেরিকার ফাইজার এবং জার্মানির বায়োএনটেক কোস্পানির ভ্যাকসিন ডিসেম্বরের ৮ তারিখ থেকে গণহারে ব্রিটেনে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ফাইজার এবং মডার্নার আবিষ্কৃত টিকার গণহারে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক মডার্নার কাছ থেকে মার্কিন সরকার ২০ কোটি ডোজ টিকা কিনছে।

ফাইজারের টিকাটির কার্যকারিতা অক্ষুণœ রাখতে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা অপরিহার্য। আমাদের মতো গরিব ও উষ্ণপ্রধান দেশের সর্বত্র এ টিকা সংরক্ষণ ও বহন করা কঠিন। রাশিয়ার টিকা স্পুটনিক-ভি রাশিয়া ছাড়াও আর্জেন্টিনায় প্রয়োগ শুরু হয়েছে। চীনের উদ্ভাবিত টিকা নিজেদের দেশ ছাড়াও উত্তর কোরিয়ায় প্রয়োগ হচ্ছে। পরীক্ষার সব স্তর সম্পন্ন না করায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের তালিকায় এ দুই দেশের টিকাকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যে টিকা ওষুধ প্রস্তুতকারক অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে দেয়া হয়েছে, তা বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটেও উৎপাদিত হবে এবং তাদের সাথে বাংলাদেশের বেক্সিমকোর চুক্তির ফলে ৩ কোটি ডোজ বাংলাদেশ শীঘ্রই পাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশ আরও ১ কোটি ৯০ লাখ ডোজ পাবে বলে আশা করছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা শীঘ্রই পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এ টিকা ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখলে কার্যকর থাকে বিধায় সংরক্ষণ ও পরিবহনে আমাদের জন্য কিছুটা সহজতর হবে। আবিষ্কৃত যে কোন টিকাই দেয়া হোক না কেন, প্রত্যেককে দুই ডোজ করে নিতে হবে।

মরণঘাতী এ করোনাভাইরাস রোধে যেসব ভ্যাকসিন বাজারে এসেছে তা নিয়ে মুসলমানেরা হারাম-হালালের প্রশ্ন তুলেছেন। ভ্যাকসিন তৈরিতে যে কোলেস্টেরল বা চর্বি ব্যবহার করা হয় তা শূকরের হলে ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হারাম হয়ে যাবে। শূকরের চর্বি না হয়ে হালাল পশুর চর্বি হলেও সঠিকভাবে জবাই না করার কারণে তা হারাম হয়ে যাবে। ওষুধ প্রস্তুতকারক ফাইজার ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছে যে, ভ্যাকসিনে পশুজাত দ্রব্য বা কোষ ব্যবহার করা হয়নি। তবে মজুদ ও সরবরাহ সুবিধার জন্য চর্বিজাত জেলোটিন ব্যবহার করা হয়। শূকরের চর্বির জেলোটিন হারাম না হালাল তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। অধিকাংশ আলেম মনে করেন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে শরীরে পুশ করা ভ্যাকসিনে শূকরের চর্বি থাকলেও তা জায়েজ। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার আলেমেরা এক সময় তা মানতে নারাজ ছিলেন; জেলোটিন থাকায় হাম ও রুবেলার টিকাকে ইন্দোনেশিয়ার আলেম সমাজ এক সময় হারাম ঘোষণা করে; এর ফলে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পরে ওলামা কাউন্সিল তাদের ফতোয়া পাল্টে একই টিকা হালাল ঘোষণা করে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল; সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা ছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে বিরাজমান ভীতিজনক অবস্থা। করোনা রোগীর সংস্পর্শে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় প্রথমদিকে ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে পলায়নবৃত্তি মনোভাব কাজ করছিল। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য বিভাগের মহামারী মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও ছিল না; জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে করণীয় সম্পর্কেও হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। দুইশ’ টাকা ঘুষ দিয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন না হয়েই অনেকে বিমানবন্দর পার হওয়ার মুখরোচক গল্পও তখন শোনা গিয়েছিল। এখন ভয়-ভীতি কেটে গেছে, চিকিৎসা প্রদানেও আন্তরিকতা বেড়েছে। এখন স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা সরঞ্জাম ও রোগ পরীক্ষার ল্যাবের সংখ্যা বেড়েছে। সাধারণ জনগণও ক্রমান্বয়ে সাহসী হয়ে উঠছেন।

করোনাভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর দেশে নামকরা বহু লোককে আমরা হারিয়েছি। আমিও সম্প্রতি চেক রিপাবলিকে বসবাসকারী আমার ঘনিষ্ঠজন পাকিস্তান আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন ভাইকে হারিয়েছি। আমরা হয়তো আরও অনেককে হারাব, কারণ ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হলেও বিশ্বের সাড়ে সাতশ’ কোটি লোককে টিকা দিয়ে শেষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই আমাদের আরও অনেকদিন সতর্ক থাকতে হবে এবং ভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য সতর্কতার নিয়মকানুন কঠোরভাবে পালন করতে হবে। আমাদের মতো গরিব ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করা প্রায় অসম্ভব; তবে মাস্ক পরাটা জরুরি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২১ , ১৯ পৌষ ১৪২৭, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

করোনার নতুন সংস্করণ ও টিকা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

ব্রিটেনে রূপান্তরিত নতুন ধরন এবং অধিক সংক্রামক করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। ব্রিটিশ গবেষকরা নতুন যে ভাইরাসের বিস্তার দেখছেন সেটিকে তারা নতুন ধরনের ভাইরাস বলে শনাক্ত করছেন। এ করোনাভাইরাস আগের করোনাভাইরাসের তুলনায় প্রায় সত্তর শতাংশ বেশি হারে ছড়াচ্ছে। এ ভাইরাসের ভয়ে মানুষ একদিকে যুক্তরাজ্য ছাড়ার চেষ্টা করছে অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের সাথে বিভিন্ন দেশ বিমান চলাচল বিচ্ছিন্ন করছে। তবে ব্রিটেন ছেড়ে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না, কারণ এ ভাইরাসের অস্তিত্ব ইতোমধ্যে ব্রিটেন ছাড়াও ইতালি, দক্ষিণ আফ্রিকা, আইসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্কেও পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের মতো হুবহু না হলেও প্রায় অনুরূপ একটি রূপান্তরিত ভাইরাস বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে। কারো কারো ধারণা ভাইরাসটি স্পেন থেকে ব্রিটেনে এসেছে। ক্রিসমাসের উৎসবে মানুষের চলাফেরা ও সামাজিক সম্মিলনের বিধিনিষেধ শিথিল করার পরিকল্পনা বাতিল করে পশ্চিমা বিশ্ব পুনরায় নতুন করে কঠোর লকডাউন আরোপ করা শুরু করেছে।

করোনাভাইরাসটি প্রাকৃতিকভাবেই নিয়মিত মিউটেশন বা রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে বলে গবেষকেরা এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে উল্লেখ করেছিলেন। কারণ সব ভাইরাসেরই মিউটেশন বা রূপান্তর হয়। রূপান্তরের ফলে ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ও আচরণের পরিবর্তন হয়; চীনে উহানে এ ভাইরাসের আবির্ভাবের পর হতে এখন পর্যন্ত বহুবার তার রূপান্তর হয়েছে। রূপান্তরিত যে কোন ভাইরাস আগের ভাইরাসের চাইতে ভয়ঙ্কর অথবা নিষ্ক্রিয় হতে পারে। ভাইরাসটি নিজের স্বার্থেই নিজেকে পরিবর্তন করে, অপরিচিত সাজে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ভ্যাকসিন বা শরীরের ভেতরের প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে। যথাযথ গবেষণা এখনো না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, করোনার এ রূপান্তরিত ভাইরাস আগেরটির চেয়ে অধিক প্রাণঘাতী নয়। তবে এ নতুন রূপের করোনাভাইরাসটি তরুণ জনগোষ্ঠীকে বেশি সংক্রমিত করছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এক বছরের মধ্যে কার্যকরী ভ্যাকসিনের আবিষ্কার ও প্রয়োগ বিশ্বকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। চিকিৎসা জগতে এত দ্রুততম সময়ে আর কখনো কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। ইতোমধ্যে এ ভাইরাসে বিশ্বে প্রায় ৮ কোটি লোক আক্রান্ত এবং ১৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বজুড়ে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা মানবদেহে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ভয়-ভীতি ছাড়াই সাধারণ মানুষ যাতে টিকা গ্রহণে উৎসাহিত হয় সেজন্য বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে টিকা নিতে শুরু করেছেন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ব্রিটেনের ৯০ বছর বয়সী মার্গারেট কিনান সর্বপ্রথম ভ্যাকসিন নিয়েছেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, বাহরাইন, কুয়েত, সৌদি আরব, মেক্সিকো, চিলি, কোস্টারিকা, সার্বিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ গণহারে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে গত রোববার থেকে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও নতুন বছরের শুরুতে টিকার কার্যক্রম শুরু হবে।

সব দেশ কিন্তু একই কোম্পানির টিকা ব্যবহার করছে না। কয়েকটি ভ্যাকসিন গণহারে প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে আরও অসংখ্য ভ্যাকসিন বিভিন্ন পর্যায়ে ট্রায়ালে রয়েছে। আমেরিকার ফাইজার এবং জার্মানির বায়োএনটেক কোস্পানির ভ্যাকসিন ডিসেম্বরের ৮ তারিখ থেকে গণহারে ব্রিটেনে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ফাইজার এবং মডার্নার আবিষ্কৃত টিকার গণহারে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক মডার্নার কাছ থেকে মার্কিন সরকার ২০ কোটি ডোজ টিকা কিনছে।

ফাইজারের টিকাটির কার্যকারিতা অক্ষুণœ রাখতে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা অপরিহার্য। আমাদের মতো গরিব ও উষ্ণপ্রধান দেশের সর্বত্র এ টিকা সংরক্ষণ ও বহন করা কঠিন। রাশিয়ার টিকা স্পুটনিক-ভি রাশিয়া ছাড়াও আর্জেন্টিনায় প্রয়োগ শুরু হয়েছে। চীনের উদ্ভাবিত টিকা নিজেদের দেশ ছাড়াও উত্তর কোরিয়ায় প্রয়োগ হচ্ছে। পরীক্ষার সব স্তর সম্পন্ন না করায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের তালিকায় এ দুই দেশের টিকাকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যে টিকা ওষুধ প্রস্তুতকারক অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে দেয়া হয়েছে, তা বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটেও উৎপাদিত হবে এবং তাদের সাথে বাংলাদেশের বেক্সিমকোর চুক্তির ফলে ৩ কোটি ডোজ বাংলাদেশ শীঘ্রই পাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশ আরও ১ কোটি ৯০ লাখ ডোজ পাবে বলে আশা করছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা শীঘ্রই পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এ টিকা ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখলে কার্যকর থাকে বিধায় সংরক্ষণ ও পরিবহনে আমাদের জন্য কিছুটা সহজতর হবে। আবিষ্কৃত যে কোন টিকাই দেয়া হোক না কেন, প্রত্যেককে দুই ডোজ করে নিতে হবে।

মরণঘাতী এ করোনাভাইরাস রোধে যেসব ভ্যাকসিন বাজারে এসেছে তা নিয়ে মুসলমানেরা হারাম-হালালের প্রশ্ন তুলেছেন। ভ্যাকসিন তৈরিতে যে কোলেস্টেরল বা চর্বি ব্যবহার করা হয় তা শূকরের হলে ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হারাম হয়ে যাবে। শূকরের চর্বি না হয়ে হালাল পশুর চর্বি হলেও সঠিকভাবে জবাই না করার কারণে তা হারাম হয়ে যাবে। ওষুধ প্রস্তুতকারক ফাইজার ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছে যে, ভ্যাকসিনে পশুজাত দ্রব্য বা কোষ ব্যবহার করা হয়নি। তবে মজুদ ও সরবরাহ সুবিধার জন্য চর্বিজাত জেলোটিন ব্যবহার করা হয়। শূকরের চর্বির জেলোটিন হারাম না হালাল তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। অধিকাংশ আলেম মনে করেন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে শরীরে পুশ করা ভ্যাকসিনে শূকরের চর্বি থাকলেও তা জায়েজ। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার আলেমেরা এক সময় তা মানতে নারাজ ছিলেন; জেলোটিন থাকায় হাম ও রুবেলার টিকাকে ইন্দোনেশিয়ার আলেম সমাজ এক সময় হারাম ঘোষণা করে; এর ফলে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পরে ওলামা কাউন্সিল তাদের ফতোয়া পাল্টে একই টিকা হালাল ঘোষণা করে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল; সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা ছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে বিরাজমান ভীতিজনক অবস্থা। করোনা রোগীর সংস্পর্শে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় প্রথমদিকে ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে পলায়নবৃত্তি মনোভাব কাজ করছিল। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য বিভাগের মহামারী মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও ছিল না; জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে করণীয় সম্পর্কেও হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। দুইশ’ টাকা ঘুষ দিয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন না হয়েই অনেকে বিমানবন্দর পার হওয়ার মুখরোচক গল্পও তখন শোনা গিয়েছিল। এখন ভয়-ভীতি কেটে গেছে, চিকিৎসা প্রদানেও আন্তরিকতা বেড়েছে। এখন স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা সরঞ্জাম ও রোগ পরীক্ষার ল্যাবের সংখ্যা বেড়েছে। সাধারণ জনগণও ক্রমান্বয়ে সাহসী হয়ে উঠছেন।

করোনাভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর দেশে নামকরা বহু লোককে আমরা হারিয়েছি। আমিও সম্প্রতি চেক রিপাবলিকে বসবাসকারী আমার ঘনিষ্ঠজন পাকিস্তান আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন ভাইকে হারিয়েছি। আমরা হয়তো আরও অনেককে হারাব, কারণ ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হলেও বিশ্বের সাড়ে সাতশ’ কোটি লোককে টিকা দিয়ে শেষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই আমাদের আরও অনেকদিন সতর্ক থাকতে হবে এবং ভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য সতর্কতার নিয়মকানুন কঠোরভাবে পালন করতে হবে। আমাদের মতো গরিব ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করা প্রায় অসম্ভব; তবে মাস্ক পরাটা জরুরি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com