দেশের অপুষ্টি দূরীকরণে বারির যুগান্তকারী উদ্ভাবন

আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুর ডালের জাত

মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. শাহিনুজ্জামান, মো. আকতার-উজ-জামান, ড. মো. ওমর আলী, রইছউদ্দিন চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ হোসেন এবং ড. আশুতোষ সরকার

ডাল ফসল বাংলাদেশে আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস। ডাল ফসল উচ্চ আমিষ এবং অতি প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিডসমৃদ্ধ হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের নিত্যকার খাদ্যে পুষ্টি সরবরাহ করে আসছে। ডাল ফসলসমূহের মধ্যে জমির পরিমাণ ও উৎপাদনের ভিত্তিতে মসুর ডাল বাংলাদেশে ৩য় স্থানে অবস্থান করলেও ব্যবহার ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে ১ম স্থান অধিকার করে আছে। মসুর ডাল জটিল কার্বোহাইড্রেট, ফলিক অ্যাসিড, পটাসিয়াম, ভিটামিন এবং খনিজ, যেমন- ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, দস্তা, সেলেনিয়াম এবং আয়রন, কম ফ্যাটযুক্ত-উচ্চ ফাইবারসমৃদ্ধ উদ্ভিজ্জ আমিষের উৎস। মসুরের ভূষি গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে খুবই উপাদেয়, বিশেষ করে পশু মোটাতাজাকরণ ও দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক। বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে বিশেষত: যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা জেলাসমূহে একমাত্র রবি মৌসুমেই মসুর ডাল চাষ হয়ে থাকে এবং এটি বাংলাদেশের বিদ্যমান ফসল ধারায় খুব সহজেই খাপ খায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৭-১৮ রবি মৌসুমে প্রায় ১.৮৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে মসুর চাষ হয়েছে এবং উৎপাদন প্রায় ২.৩৮ লক্ষ টন এবং হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১.২৬ টন।

অনুপুষ্টি (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) জনিত অপুষ্টিতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ভুগছে যার মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশিরভাগ নারী এবং প্রাক-স্কুল শিশু রয়েছে। বাংলাদেশেও অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা অপুষ্টিতে ভুগছে। দেশের প্রায় দুই মিলিয়ন শিশুর মধ্যে মাঝারি তীব্র অপুষ্টি রয়েছে এবং মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিজনিত কারণে প্রায় ৪,৫০,০০০ শিশু ভুগছে। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে ৫২% শিশু রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। জিংক ও আয়রন মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় গৌণ পুষ্টি উপাদান। আইসিডিডিআরবির এক জরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে ৪৩.৮% শিশু ও ৩৩% মহিলা আয়রনের অভাবজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে। অন্যদিকে এর অভাবে প্রায় ৪৪% শিশু ও ৫৭% নারী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। আয়রন মানবদেহের জন্য বিশেষত গর্ভবতী মহিলাদের এবং বাড়ন্ত শিশুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আয়রনের অভাবে রক্তস¦ল্পতাসহ কর্মদক্ষতা, দেহের বৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। জিঙ্ক আমাদের দেহের অনেক কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ যা আমাদের কোষীয়মূল কাঠামো, বিভিন্ন আমিষ, এনজাইম, হরমোন এবং হার্ট রেট এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। জিংক এর অভাবে বিভিন্ন রকম রোগ যেমন- ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতা, ক্ষুধামন্দা, চুলপড়া ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর ডাল গবেষণা কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক শুস্ক অঞ্চলভিত্তিক গবেষণা কেন্দ্র (ইকার্ডা) হারভেস্টপ্লাসের অর্থায়নে ‘উচ্চমাত্রার আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাত উন্নয়ন সম্পন্ন’ শিরোনামযুক্ত একটি প্রকল্পটি ২০১২ সাল হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত চলেছে। এই প্রকল্পের অধীনে উচ্চ ঘনত্বের আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুর জিনোটাইপ বিকাশের লক্ষ্যে বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছে যেমন সংকরায়ন, ফিলিয়াল প্রজন্মের অগ্রগতি, জি ´ ই পরীক্ষার জন্য বহুস্থানিক পরীক্ষা, কৃষকের অংশগ্রহণে বিভিন্ন জাত নির্বাচনের পরীক্ষা ইত্যাদির ফলস্বরূপ দুটি আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুর জাত ইতোমধ্যে ডাল গবেষণা কেন্দ্র থেকে অবমুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র প্রচলিত এবং অপ্রচলিত অঞ্চলে বিভিন্ন কৃষকদের মাঝে বায়োফর্টিফাইড মসুর বীজ বিতরণের জন্য প্রজনন এবং মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করেছে। উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে ডাল গবেষণা কেন্দ্র মসুর চাষকারী কৃষকদের আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাত ও উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণও দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আয়রন এবং জিংক এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে মহিলাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুর জাতের ওপর ফোল্ডার প্রকাশিত হয়েছে এবং তা বেশিরভাগ মসুর উৎপাদনকারী অঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল নিম্নে সন্নিবেশিত হলো:

আয়রন এবং জিংকসমৃদ্ধ মসুরের জার্মপ্লাজম নির্বাচন: বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত মোট ১৭০টি মসুরের বিভিন্ন জেনোটাইপের বীজের আয়রন এবং জিংকের পরিমাণ বিশ্লেষণের জন্য উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরিত হয়েছিল। তন্মধ্যে সর্বাধিক আয়রন ৯০.৫৫ পিপিএম এবং ন্যূনতম ৫০.৭০ পিপিএম এবং সর্বাধিক জিংক ৬৮.৩৫ পিপিএম এবং ন্যূনতম ৪২.০০ পিপিএম রেকর্ড করা হয়েছে। ডাল গবেষণা কেন্দ্রে চলমান মসুর প্রজনন কর্মসূচিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এই জেনোটাইপে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কার্যক্রম অদ্যাবধি চলমান রয়েছে।

বায়োফর্টিফাইড আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুর জাতের অবমুক্তি : বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র হতে সর্বশেষ মুক্তায়িত আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাত (যেমন- বারি মসুর-৮ ও বারি মসুর-৯) যেখানে আয়রনের পরিমাণ ৭৫.৪ ও ৭৯.৬ পিপিএমএবং জিংকের পরিমাণ ৫৬.৬ ও ৬০.৩ পিপিএম পর্যন্ত রয়েছে যথাক্রমে যা ধানের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ বেশি। বারি মসুর-৮ এবং বারি মসুর-৯ জাত দুটি যথাক্রমে ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে অবমুক্ত হয়েছে। এছাড়া বারি মসুর-৪, বারি মসুর-৬ ও বারি মসুর-৭ জাতসমূহে আয়রনের পরিমাণ ৭৫.৪ থেকে ৮২.৬ পিপিএম এবং জিংকের পরিমাণ ৫২.২৪-৬৫.১৫ পিপিএম।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অবমুক্ত স্বল্পমেয়াদি আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাত : ডাল গবেষণা কেন্দ্র হতে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল মসুরের জাতসমূহের (যেমন : বারি মসুর-৬, বারি মসুর-৭ এবং বারি মসুর-৮) জীবনকাল দীর্ঘ হওয়ার কারণে (১১০-১২০ দিন) কৃষকগণ মসুরের পর বোরো ধান চাষ করতে পারেন না। বারি মসুর-৯ জাতটি বিশেষভাবে স্বল্পকালীন (৮৫-৯০ দিন) হওয়ায় আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী পতিত জমিতে এটি একটি অতিরিক্ত ফসল হিসেবে চাষ করে কৃষকগণ আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। ফলে দেশের একটি বিশাল পতিত জমি (আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী) চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হবে। স্বল্পমেয়াদি মসুর ডালের এ জাতটি সফলভাবে আমন-বোরো ধানের মধ্যবর্তী পতিত সময়ে চাষ করলে আমাদের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

কৃষক মাঠে স্থাপিত ব্লক প্রদর্শনীসমূহ: বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক বাংলাদেশের ১৫টি জেলায় (মসুরের প্রচলিত ও অপ্রচলিত অঞ্চল) আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের উন্নত জাত যেমন : বারি মসুর-৭ ও বারি মসুর-৮ ব্যবহার করে মোট ১০৪টি ব্লক প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জেলাগুলো হলো: কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, নাটোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর, পাবনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী যেখানে প্রায় প্রতি বছর দুটি পৃথক উপজেলায় উক্ত জাতগুলোকে জনপ্রিয়করণের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানী এবং সম্প্রসারণবিদগণ নিষ্ঠার সঙ্গে প্রদর্শনীগুলো বাস্তবায়ন করেছে। প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, মসুরের হেক্টর প্রতি ফলন ১,০০০ কেজি থেকে ২,২৪০ কেজি পর্যন্ত হয়েছে।

মাঠ দিবস : ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে মসুরের প্রদর্শনী ব্লকের পাশে মসুরের চাষের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উপরোল্লিখিত বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়েছে। উপরোক্ত বিভিন্ন জেলাসমূহে ডাল গবেষণা কেন্দ্র, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ ও সম্প্রসারণ অফিসের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রচলিত এবং অপ্রচলিত অঞ্চলে মোট ৩৮টি মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়েছিল এবং আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাতের আরও বেশি প্রচারের জন্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। উক্ত মাঠ দিবসসমূহে প্রায় ৩০০ জন মহিলাসহ মোট ২,৪৫০ কৃষক অংশ নিয়েছিলেন।

বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ : উক্ত প্রকল্পে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশ হিসেবে ডাল গবেষণা কেন্দ্রে প্রজনন এবং মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল। আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের উন্নত জাতসমূহ যেমন : বারি মসুর-৬, বারি মসুর-৭ এবং বারি মসুর-৮ ইত্যাদি কৃষকের মাঝে সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নে ডাল গবেষণা কেন্দ্রে প্রায় ১০.৫০ টন বীজ উৎপাদিত হয়। উক্ত বীজ ব্লক প্রদর্শনীতে ব্যবহারের পাশাপাশি বিএডিসি এবং অগ্রগামী কৃষকের মাঝে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ করা হয়েছে।

মসুরের আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ : উল্লিখিত ব্লক প্রদর্শনী বাস্তবায়িত বাংলাদেশের ১৫টি বিভিন্ন জেলায় মোট ৩৬টি বপনপূর্বক কৃষক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এসব প্রশিক্ষণ উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে। প্রতিটি ব্যাচে ৩০ জন করে এই কর্মসূচিতে মোট ১,০৮০ জন কৃষক-কৃষাণীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের উন্নত জাত, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন এবং উন্নত চাষাবাদ কলাকৌশলের গুরুত্ব নিয়ে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচিটি পরিচালিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আয়রন ও জিংকের প্রভাব সম্পর্কে মহিলা প্রশিক্ষণ : বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যেমন : পাবনা, রংপুর, নাটোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় মসুর ডাল সংগ্রহের আধুনিক প্রযুক্তি, মসুরের সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আয়রন ও জিংকের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা ও প্রতিকারবিষয়ক দিনব্যাপী মহিলাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ বাস্তবায়িত হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৫টি ব্যাচে মোট ৬০০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন- শিক্ষিকা, এনজিও কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মীসহ শিক্ষিতা ও সমাজের অগ্রগামী নারীগণ।

প্রকাশনা : উক্ত প্রকল্পের আওতায় বারি মসুর-৮ এবং বারি মসুর-৯ এর আধুনিক চাষাবাদ কলাকৌশলের ওপর ডাল গবেষণা কেন্দ্র হতে ২টি ফোল্ডার প্রকাশিত হয় এবং তা কৃষক, কৃষি-সংশ্লিষ্ট গবেষণাকর্মী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের নিকট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ করা হয়েছে।

উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাল গবেষণা কেন্দ্রের দুজন বিজ্ঞানী পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন এবং দুজন বিজ্ঞানী এমএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এছাড়া ৭৫ জন মাঠকর্মীকে (এসএএও ও বৈজ্ঞানিক সহকারী) সদ্য অবমুক্ত আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুর জাত এবং আয়রন এবং জিংক সম্পর্কিত স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যা এবং প্রতিকার সম্পর্কে ঈশ্বরদী, রংপুর ও যশোরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জমি ও উৎপাদন বৃদ্ধি : বাংলাদেশে মসুরের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ডাল গবেষণা কেন্দ্র নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে গত এক দশক যাবত গবেষণা-সম্প্রসারণ ও অগ্রগামী কৃষকদের যৌথ প্রচেষ্টার ফল হিসেবে সারা দেশে মসুর উৎপাদন জমির পরিমাণ ও মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১-১২ সালে বাংলাদেশ ১.৬৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১.৭৬ লক্ষ মেট্রিক টন ডাল উৎপাদন হয়েছিল এবং ২০১৭-১৮ সালে ১.৮৯ লক্ষ হেক্টর জমি থেকে ২.৩৮ লক্ষ মেট্রিক টন মসুর উৎপাদিত হয়েছে। ২০০০-০১ সালে মসুরের গড় ফলন ছিল ০.৭৯ টন যা ২০১৭-১৮-তে ১.২৬ টন/হেক্টর পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে। এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মসুরের উৎপাদনশীলতা প্রায় ৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে।

কৃষকরা আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের নতুন জাত চাষাবাদে বর্তমানে অধিক আগ্রহী : বাংলাদেশের মসুর চাষকারী অঞ্চলের কৃষকরা আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো চাষাবাদের জন্য বর্তমানে খুবই আগ্রহী। সাম্প্রতিক জরিপের ফলস্বরূপ দেশের মসুর চাষের ৮৫ শতাংশ জমি ডাল গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত বিভিন্ন মসুর ডালের জাতের আওতাভুক্ত। বিশেষত মসুর চাষকারী অঞ্চলসমূহে বারি মসুর-৮, বারি মসুর-৭ এবং বারি মসুর-৬ জাতের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এসব অঞ্চলে বর্তমানে কৃষকরা তাদের নিজস্ব উৎপাদিত বীজ ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করছে এবং নিজ উদ্যোগে তা বিপণন করছে।

মসুর চাষে ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধান কল্পে, জাতির অপুষ্টিজনিত সমস্যা কমাতে এবং বিভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত মসুর চাষকারী অঞ্চলে আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুর ডাল সম্পর্কে আরও সচেতনতা তৈরির জন্য গবেষণা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম আরও বেশি বেগবান করতে হবে। আন্তর্জাতিক ডাল গবেষণা কেন্দ্র, ইকার্ডা এবং হারভেস্টপ্লাসের সহায়তায় আবারও উক্ত প্রকল্পের মতো অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র পরবর্তী পর্যায়ে যুক্ত হলে এ জাতীয় কর্মকান্ডসমূহ বাস্তবায়ন করতে অধিকতর সফলকাম হবে।

লেখকবৃন্দ : প্রথম ছয়জন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী,

সর্বশেষ জন ইকার্ডা, নয়াদিল্লি, ভারতের বিজ্ঞানী।

রবিবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২১ , ১৯ পৌষ ১৪২৭, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

দেশের অপুষ্টি দূরীকরণে বারির যুগান্তকারী উদ্ভাবন

আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুর ডালের জাত

মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. শাহিনুজ্জামান, মো. আকতার-উজ-জামান, ড. মো. ওমর আলী, রইছউদ্দিন চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ হোসেন এবং ড. আশুতোষ সরকার

image

ডাল ফসল বাংলাদেশে আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস। ডাল ফসল উচ্চ আমিষ এবং অতি প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিডসমৃদ্ধ হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের নিত্যকার খাদ্যে পুষ্টি সরবরাহ করে আসছে। ডাল ফসলসমূহের মধ্যে জমির পরিমাণ ও উৎপাদনের ভিত্তিতে মসুর ডাল বাংলাদেশে ৩য় স্থানে অবস্থান করলেও ব্যবহার ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে ১ম স্থান অধিকার করে আছে। মসুর ডাল জটিল কার্বোহাইড্রেট, ফলিক অ্যাসিড, পটাসিয়াম, ভিটামিন এবং খনিজ, যেমন- ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, দস্তা, সেলেনিয়াম এবং আয়রন, কম ফ্যাটযুক্ত-উচ্চ ফাইবারসমৃদ্ধ উদ্ভিজ্জ আমিষের উৎস। মসুরের ভূষি গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে খুবই উপাদেয়, বিশেষ করে পশু মোটাতাজাকরণ ও দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক। বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে বিশেষত: যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা জেলাসমূহে একমাত্র রবি মৌসুমেই মসুর ডাল চাষ হয়ে থাকে এবং এটি বাংলাদেশের বিদ্যমান ফসল ধারায় খুব সহজেই খাপ খায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৭-১৮ রবি মৌসুমে প্রায় ১.৮৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে মসুর চাষ হয়েছে এবং উৎপাদন প্রায় ২.৩৮ লক্ষ টন এবং হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১.২৬ টন।

অনুপুষ্টি (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) জনিত অপুষ্টিতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ভুগছে যার মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশিরভাগ নারী এবং প্রাক-স্কুল শিশু রয়েছে। বাংলাদেশেও অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা অপুষ্টিতে ভুগছে। দেশের প্রায় দুই মিলিয়ন শিশুর মধ্যে মাঝারি তীব্র অপুষ্টি রয়েছে এবং মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিজনিত কারণে প্রায় ৪,৫০,০০০ শিশু ভুগছে। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে ৫২% শিশু রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। জিংক ও আয়রন মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় গৌণ পুষ্টি উপাদান। আইসিডিডিআরবির এক জরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে ৪৩.৮% শিশু ও ৩৩% মহিলা আয়রনের অভাবজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে। অন্যদিকে এর অভাবে প্রায় ৪৪% শিশু ও ৫৭% নারী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। আয়রন মানবদেহের জন্য বিশেষত গর্ভবতী মহিলাদের এবং বাড়ন্ত শিশুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আয়রনের অভাবে রক্তস¦ল্পতাসহ কর্মদক্ষতা, দেহের বৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। জিঙ্ক আমাদের দেহের অনেক কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ যা আমাদের কোষীয়মূল কাঠামো, বিভিন্ন আমিষ, এনজাইম, হরমোন এবং হার্ট রেট এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। জিংক এর অভাবে বিভিন্ন রকম রোগ যেমন- ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতা, ক্ষুধামন্দা, চুলপড়া ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর ডাল গবেষণা কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক শুস্ক অঞ্চলভিত্তিক গবেষণা কেন্দ্র (ইকার্ডা) হারভেস্টপ্লাসের অর্থায়নে ‘উচ্চমাত্রার আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাত উন্নয়ন সম্পন্ন’ শিরোনামযুক্ত একটি প্রকল্পটি ২০১২ সাল হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত চলেছে। এই প্রকল্পের অধীনে উচ্চ ঘনত্বের আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুর জিনোটাইপ বিকাশের লক্ষ্যে বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছে যেমন সংকরায়ন, ফিলিয়াল প্রজন্মের অগ্রগতি, জি ´ ই পরীক্ষার জন্য বহুস্থানিক পরীক্ষা, কৃষকের অংশগ্রহণে বিভিন্ন জাত নির্বাচনের পরীক্ষা ইত্যাদির ফলস্বরূপ দুটি আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুর জাত ইতোমধ্যে ডাল গবেষণা কেন্দ্র থেকে অবমুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র প্রচলিত এবং অপ্রচলিত অঞ্চলে বিভিন্ন কৃষকদের মাঝে বায়োফর্টিফাইড মসুর বীজ বিতরণের জন্য প্রজনন এবং মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করেছে। উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে ডাল গবেষণা কেন্দ্র মসুর চাষকারী কৃষকদের আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাত ও উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণও দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আয়রন এবং জিংক এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে মহিলাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। আয়রন এবং জিংক সমৃদ্ধ মসুর জাতের ওপর ফোল্ডার প্রকাশিত হয়েছে এবং তা বেশিরভাগ মসুর উৎপাদনকারী অঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল নিম্নে সন্নিবেশিত হলো:

আয়রন এবং জিংকসমৃদ্ধ মসুরের জার্মপ্লাজম নির্বাচন: বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত মোট ১৭০টি মসুরের বিভিন্ন জেনোটাইপের বীজের আয়রন এবং জিংকের পরিমাণ বিশ্লেষণের জন্য উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরিত হয়েছিল। তন্মধ্যে সর্বাধিক আয়রন ৯০.৫৫ পিপিএম এবং ন্যূনতম ৫০.৭০ পিপিএম এবং সর্বাধিক জিংক ৬৮.৩৫ পিপিএম এবং ন্যূনতম ৪২.০০ পিপিএম রেকর্ড করা হয়েছে। ডাল গবেষণা কেন্দ্রে চলমান মসুর প্রজনন কর্মসূচিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এই জেনোটাইপে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কার্যক্রম অদ্যাবধি চলমান রয়েছে।

বায়োফর্টিফাইড আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুর জাতের অবমুক্তি : বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র হতে সর্বশেষ মুক্তায়িত আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাত (যেমন- বারি মসুর-৮ ও বারি মসুর-৯) যেখানে আয়রনের পরিমাণ ৭৫.৪ ও ৭৯.৬ পিপিএমএবং জিংকের পরিমাণ ৫৬.৬ ও ৬০.৩ পিপিএম পর্যন্ত রয়েছে যথাক্রমে যা ধানের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ বেশি। বারি মসুর-৮ এবং বারি মসুর-৯ জাত দুটি যথাক্রমে ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে অবমুক্ত হয়েছে। এছাড়া বারি মসুর-৪, বারি মসুর-৬ ও বারি মসুর-৭ জাতসমূহে আয়রনের পরিমাণ ৭৫.৪ থেকে ৮২.৬ পিপিএম এবং জিংকের পরিমাণ ৫২.২৪-৬৫.১৫ পিপিএম।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অবমুক্ত স্বল্পমেয়াদি আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাত : ডাল গবেষণা কেন্দ্র হতে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল মসুরের জাতসমূহের (যেমন : বারি মসুর-৬, বারি মসুর-৭ এবং বারি মসুর-৮) জীবনকাল দীর্ঘ হওয়ার কারণে (১১০-১২০ দিন) কৃষকগণ মসুরের পর বোরো ধান চাষ করতে পারেন না। বারি মসুর-৯ জাতটি বিশেষভাবে স্বল্পকালীন (৮৫-৯০ দিন) হওয়ায় আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী পতিত জমিতে এটি একটি অতিরিক্ত ফসল হিসেবে চাষ করে কৃষকগণ আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। ফলে দেশের একটি বিশাল পতিত জমি (আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী) চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হবে। স্বল্পমেয়াদি মসুর ডালের এ জাতটি সফলভাবে আমন-বোরো ধানের মধ্যবর্তী পতিত সময়ে চাষ করলে আমাদের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

কৃষক মাঠে স্থাপিত ব্লক প্রদর্শনীসমূহ: বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক বাংলাদেশের ১৫টি জেলায় (মসুরের প্রচলিত ও অপ্রচলিত অঞ্চল) আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের উন্নত জাত যেমন : বারি মসুর-৭ ও বারি মসুর-৮ ব্যবহার করে মোট ১০৪টি ব্লক প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জেলাগুলো হলো: কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, নাটোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর, পাবনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী যেখানে প্রায় প্রতি বছর দুটি পৃথক উপজেলায় উক্ত জাতগুলোকে জনপ্রিয়করণের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানী এবং সম্প্রসারণবিদগণ নিষ্ঠার সঙ্গে প্রদর্শনীগুলো বাস্তবায়ন করেছে। প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, মসুরের হেক্টর প্রতি ফলন ১,০০০ কেজি থেকে ২,২৪০ কেজি পর্যন্ত হয়েছে।

মাঠ দিবস : ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে মসুরের প্রদর্শনী ব্লকের পাশে মসুরের চাষের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উপরোল্লিখিত বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়েছে। উপরোক্ত বিভিন্ন জেলাসমূহে ডাল গবেষণা কেন্দ্র, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ ও সম্প্রসারণ অফিসের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রচলিত এবং অপ্রচলিত অঞ্চলে মোট ৩৮টি মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়েছিল এবং আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জাতের আরও বেশি প্রচারের জন্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। উক্ত মাঠ দিবসসমূহে প্রায় ৩০০ জন মহিলাসহ মোট ২,৪৫০ কৃষক অংশ নিয়েছিলেন।

বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ : উক্ত প্রকল্পে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশ হিসেবে ডাল গবেষণা কেন্দ্রে প্রজনন এবং মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল। আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের উন্নত জাতসমূহ যেমন : বারি মসুর-৬, বারি মসুর-৭ এবং বারি মসুর-৮ ইত্যাদি কৃষকের মাঝে সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নে ডাল গবেষণা কেন্দ্রে প্রায় ১০.৫০ টন বীজ উৎপাদিত হয়। উক্ত বীজ ব্লক প্রদর্শনীতে ব্যবহারের পাশাপাশি বিএডিসি এবং অগ্রগামী কৃষকের মাঝে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ করা হয়েছে।

মসুরের আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ : উল্লিখিত ব্লক প্রদর্শনী বাস্তবায়িত বাংলাদেশের ১৫টি বিভিন্ন জেলায় মোট ৩৬টি বপনপূর্বক কৃষক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এসব প্রশিক্ষণ উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে। প্রতিটি ব্যাচে ৩০ জন করে এই কর্মসূচিতে মোট ১,০৮০ জন কৃষক-কৃষাণীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের উন্নত জাত, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন এবং উন্নত চাষাবাদ কলাকৌশলের গুরুত্ব নিয়ে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচিটি পরিচালিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আয়রন ও জিংকের প্রভাব সম্পর্কে মহিলা প্রশিক্ষণ : বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যেমন : পাবনা, রংপুর, নাটোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় মসুর ডাল সংগ্রহের আধুনিক প্রযুক্তি, মসুরের সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আয়রন ও জিংকের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা ও প্রতিকারবিষয়ক দিনব্যাপী মহিলাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ বাস্তবায়িত হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৫টি ব্যাচে মোট ৬০০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন- শিক্ষিকা, এনজিও কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মীসহ শিক্ষিতা ও সমাজের অগ্রগামী নারীগণ।

প্রকাশনা : উক্ত প্রকল্পের আওতায় বারি মসুর-৮ এবং বারি মসুর-৯ এর আধুনিক চাষাবাদ কলাকৌশলের ওপর ডাল গবেষণা কেন্দ্র হতে ২টি ফোল্ডার প্রকাশিত হয় এবং তা কৃষক, কৃষি-সংশ্লিষ্ট গবেষণাকর্মী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের নিকট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ করা হয়েছে।

উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : উক্ত প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাল গবেষণা কেন্দ্রের দুজন বিজ্ঞানী পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন এবং দুজন বিজ্ঞানী এমএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এছাড়া ৭৫ জন মাঠকর্মীকে (এসএএও ও বৈজ্ঞানিক সহকারী) সদ্য অবমুক্ত আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুর জাত এবং আয়রন এবং জিংক সম্পর্কিত স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যা এবং প্রতিকার সম্পর্কে ঈশ্বরদী, রংপুর ও যশোরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের জমি ও উৎপাদন বৃদ্ধি : বাংলাদেশে মসুরের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ডাল গবেষণা কেন্দ্র নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে গত এক দশক যাবত গবেষণা-সম্প্রসারণ ও অগ্রগামী কৃষকদের যৌথ প্রচেষ্টার ফল হিসেবে সারা দেশে মসুর উৎপাদন জমির পরিমাণ ও মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১-১২ সালে বাংলাদেশ ১.৬৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১.৭৬ লক্ষ মেট্রিক টন ডাল উৎপাদন হয়েছিল এবং ২০১৭-১৮ সালে ১.৮৯ লক্ষ হেক্টর জমি থেকে ২.৩৮ লক্ষ মেট্রিক টন মসুর উৎপাদিত হয়েছে। ২০০০-০১ সালে মসুরের গড় ফলন ছিল ০.৭৯ টন যা ২০১৭-১৮-তে ১.২৬ টন/হেক্টর পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে। এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মসুরের উৎপাদনশীলতা প্রায় ৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে।

কৃষকরা আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুরের নতুন জাত চাষাবাদে বর্তমানে অধিক আগ্রহী : বাংলাদেশের মসুর চাষকারী অঞ্চলের কৃষকরা আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো চাষাবাদের জন্য বর্তমানে খুবই আগ্রহী। সাম্প্রতিক জরিপের ফলস্বরূপ দেশের মসুর চাষের ৮৫ শতাংশ জমি ডাল গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত বিভিন্ন মসুর ডালের জাতের আওতাভুক্ত। বিশেষত মসুর চাষকারী অঞ্চলসমূহে বারি মসুর-৮, বারি মসুর-৭ এবং বারি মসুর-৬ জাতের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এসব অঞ্চলে বর্তমানে কৃষকরা তাদের নিজস্ব উৎপাদিত বীজ ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করছে এবং নিজ উদ্যোগে তা বিপণন করছে।

মসুর চাষে ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধান কল্পে, জাতির অপুষ্টিজনিত সমস্যা কমাতে এবং বিভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত মসুর চাষকারী অঞ্চলে আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ মসুর ডাল সম্পর্কে আরও সচেতনতা তৈরির জন্য গবেষণা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম আরও বেশি বেগবান করতে হবে। আন্তর্জাতিক ডাল গবেষণা কেন্দ্র, ইকার্ডা এবং হারভেস্টপ্লাসের সহায়তায় আবারও উক্ত প্রকল্পের মতো অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্র পরবর্তী পর্যায়ে যুক্ত হলে এ জাতীয় কর্মকান্ডসমূহ বাস্তবায়ন করতে অধিকতর সফলকাম হবে।

লেখকবৃন্দ : প্রথম ছয়জন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী,

সর্বশেষ জন ইকার্ডা, নয়াদিল্লি, ভারতের বিজ্ঞানী।