জেলেদের দাদন জালে জড়িয়ে বনজ সম্পদ লুটছে মহাজনরা

বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন সুরক্ষায় পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা ইতোমধ্যে অভায়রণ্যের আওতায় আসলেও কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধভাবে মৎস্য সম্পদ আহরণ। বনসংলগ্ন এলাকার এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি উপকূলীয় অঞ্চলের অসচ্ছল পরিবারদের টার্গেট করে প্রথমে তাদের লোভনীয় ব্যবসার লোভ দেখান। পরবর্তীতে, ওই সকল ব্যক্তিদের নানা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের মাঝে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা দ্বাদন ছড়িয়ে দেন। এভাবেই যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ নানা বনজ সম্পদ লুটছেন মহাজন নামধারী সঙ্গবদ্ধ একাধিক প্রভাবশালী চক্র। অভিযোগ রয়েছে, সুন্দরবন সুরক্ষায় নিয়োজিত এক শ্রেণীর অসাধু বন-কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রভাবশালী চক্রের সদস্যরা অসহায় জেলেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যুগ যুগ ধরে সুন্দরবনের নানা ধরনের সম্পদ লুটে বিলাশী জীবন যাপন করলেও ভাগ্যের উন্নয়ন হয় না অসহায় জেলেদের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষায় কয়েক দশক আগে পরীক্ষামূলকভাবে সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের কয়েকটি এলাকা অভায়রণ্য হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার। পর্যায়েক্রমে পূর্ব বনের শরণখোলা রেঞ্জের ৯০ ভাগ অংশে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে ইতোমধ্যে অভায়রণ্য এলাকার সকল প্রকার সম্পদ পেশাজীবীরা আর আহরণর করতে পারবেন না বলে এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহাজনরাসহ স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সুন্দরবন সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা কিছু অসাধু বনকর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে পাস (অনুমতি) নিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের দেড় থেকে দুই হাজার জেলে বনের শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্দা, কটকা, কচিখালী, শৌলা, মরাভোলা, জহরখালী, শাপলা, আড়াইবেকীসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ এলাকার মধ্যে প্রবেশ করে নানা ধরনের অবৈধ জাল ব্যবহারসহ বিষ প্রয়োগ করে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের নানা প্রজাতির শত শত মন মাছ লুণ্ঠন করে দেশের নানা প্রান্তে চালান করে দিচ্ছেন। অপরদিকে, আহরিত মাছ নিয়ে জেলেরা লোকালয়ে ফেরার পথে তা যাচাই-বাছাই করে দেখার দায়িত্ব বনরক্ষীদের থাকলেও রহস্যজনক কারণে তারা থাকছেন নিশ্চুপ। তবে, মাছ আহরণের বিষয় নিয়ে এক বনকর্মীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, লোকবল সঙ্কটের কারণে সুন্দরবনের নানা অপরাধ প্রবণতার শতভাগ লাগাম টানা যাচ্ছে না। এছাড়া জেলেদের মৎস্য আহরণের মাধ্যমে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয় তার চেয়ে নানা ক্ষেত্রে বনের অনেক ক্ষতি করেন জেলেরা। সুযোগ পেলেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন অধিকাংশ জেলে। বিভিন্ন সময় আমরা বহু অসাধু জেলেদের আটক করে কোর্টে চালান করি কিন্তু জেল থেকে ফিরে সে আবার অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পরে তারা। বনজ সম্পদ লুণ্ঠনকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বনরক্ষীদের পাশাপাশি (এসমার্ট) প্রেট্রোলিং টিম গঠন করা হয়েছে কিন্তু তাতেও খুব বেশি একটা উপকার হচ্ছে না । তার চেয়ে পুরোপুরি সকল পাসপামিট বন্ধ করে দেয়া উত্তম। একই শর্তে, বন সংলগ্ন শরণখোলা এলাকার এক জেলে বলেন, অনেক বছর আমি জঙ্গলে মাছ ধরি। বেশি-কম যা বিক্রি করি, তাতে মহাজনের দাদনের টাকা কোন বছরই পরিশোধ করতে পারি না। এ বিষয়ে সুন্দরবনসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধক্ষ্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. ফরিদ খান মিন্টু বলেন, বনরক্ষীরা তাদের দায়িত্ব পালনে অনেকটা উদ্বাসীন থাকায় বনের নিষিদ্ধ এলাকায় অবাধে মাছ শিকার করছেন প্রভাবশালীরা। অনেকক্ষেত্রে কেউ কেউ ম্যানেজ হয়ে অভায়রণ্য এলাকার মধ্যে জেলেদের মাছ আহরণের সুযোগ করে দিচ্ছেও বলে অভিযোগ রয়েছে । পাশাপাশি জেলেজের অপরাধের জন্য মহাজন ও বনবিভাগ উভয়ই দ্বায়ী বলে তিনি মন্তব্য করেন। পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীন জানান, মাসোয়ারার বিনিময় কাউকে অভারণ্যের মধ্যে মাছ আহরণের সুযোগ দেয়ার বিষয়টি গুজব। তবে, বন বিভাগের চোখ ফাঁকি অসাধু জেলেরা চুরি করে মাঝেমধ্যে মাছ ধরতে পারে। এছাড়া জেলেদের আহরিত সব মাছ সুন্দরবনের নয়।

মঙ্গলবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২১ , ২১ পৌষ ১৪২৭, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

জেলেদের দাদন জালে জড়িয়ে বনজ সম্পদ লুটছে মহাজনরা

প্রতিনিধি, শরণখোলা (বাগেরহাট)

image

বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন সুরক্ষায় পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা ইতোমধ্যে অভায়রণ্যের আওতায় আসলেও কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধভাবে মৎস্য সম্পদ আহরণ। বনসংলগ্ন এলাকার এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি উপকূলীয় অঞ্চলের অসচ্ছল পরিবারদের টার্গেট করে প্রথমে তাদের লোভনীয় ব্যবসার লোভ দেখান। পরবর্তীতে, ওই সকল ব্যক্তিদের নানা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের মাঝে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা দ্বাদন ছড়িয়ে দেন। এভাবেই যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ নানা বনজ সম্পদ লুটছেন মহাজন নামধারী সঙ্গবদ্ধ একাধিক প্রভাবশালী চক্র। অভিযোগ রয়েছে, সুন্দরবন সুরক্ষায় নিয়োজিত এক শ্রেণীর অসাধু বন-কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রভাবশালী চক্রের সদস্যরা অসহায় জেলেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যুগ যুগ ধরে সুন্দরবনের নানা ধরনের সম্পদ লুটে বিলাশী জীবন যাপন করলেও ভাগ্যের উন্নয়ন হয় না অসহায় জেলেদের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষায় কয়েক দশক আগে পরীক্ষামূলকভাবে সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের কয়েকটি এলাকা অভায়রণ্য হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার। পর্যায়েক্রমে পূর্ব বনের শরণখোলা রেঞ্জের ৯০ ভাগ অংশে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে ইতোমধ্যে অভায়রণ্য এলাকার সকল প্রকার সম্পদ পেশাজীবীরা আর আহরণর করতে পারবেন না বলে এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহাজনরাসহ স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সুন্দরবন সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা কিছু অসাধু বনকর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে পাস (অনুমতি) নিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের দেড় থেকে দুই হাজার জেলে বনের শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্দা, কটকা, কচিখালী, শৌলা, মরাভোলা, জহরখালী, শাপলা, আড়াইবেকীসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ এলাকার মধ্যে প্রবেশ করে নানা ধরনের অবৈধ জাল ব্যবহারসহ বিষ প্রয়োগ করে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের নানা প্রজাতির শত শত মন মাছ লুণ্ঠন করে দেশের নানা প্রান্তে চালান করে দিচ্ছেন। অপরদিকে, আহরিত মাছ নিয়ে জেলেরা লোকালয়ে ফেরার পথে তা যাচাই-বাছাই করে দেখার দায়িত্ব বনরক্ষীদের থাকলেও রহস্যজনক কারণে তারা থাকছেন নিশ্চুপ। তবে, মাছ আহরণের বিষয় নিয়ে এক বনকর্মীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, লোকবল সঙ্কটের কারণে সুন্দরবনের নানা অপরাধ প্রবণতার শতভাগ লাগাম টানা যাচ্ছে না। এছাড়া জেলেদের মৎস্য আহরণের মাধ্যমে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয় তার চেয়ে নানা ক্ষেত্রে বনের অনেক ক্ষতি করেন জেলেরা। সুযোগ পেলেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন অধিকাংশ জেলে। বিভিন্ন সময় আমরা বহু অসাধু জেলেদের আটক করে কোর্টে চালান করি কিন্তু জেল থেকে ফিরে সে আবার অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পরে তারা। বনজ সম্পদ লুণ্ঠনকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বনরক্ষীদের পাশাপাশি (এসমার্ট) প্রেট্রোলিং টিম গঠন করা হয়েছে কিন্তু তাতেও খুব বেশি একটা উপকার হচ্ছে না । তার চেয়ে পুরোপুরি সকল পাসপামিট বন্ধ করে দেয়া উত্তম। একই শর্তে, বন সংলগ্ন শরণখোলা এলাকার এক জেলে বলেন, অনেক বছর আমি জঙ্গলে মাছ ধরি। বেশি-কম যা বিক্রি করি, তাতে মহাজনের দাদনের টাকা কোন বছরই পরিশোধ করতে পারি না। এ বিষয়ে সুন্দরবনসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধক্ষ্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. ফরিদ খান মিন্টু বলেন, বনরক্ষীরা তাদের দায়িত্ব পালনে অনেকটা উদ্বাসীন থাকায় বনের নিষিদ্ধ এলাকায় অবাধে মাছ শিকার করছেন প্রভাবশালীরা। অনেকক্ষেত্রে কেউ কেউ ম্যানেজ হয়ে অভায়রণ্য এলাকার মধ্যে জেলেদের মাছ আহরণের সুযোগ করে দিচ্ছেও বলে অভিযোগ রয়েছে । পাশাপাশি জেলেজের অপরাধের জন্য মহাজন ও বনবিভাগ উভয়ই দ্বায়ী বলে তিনি মন্তব্য করেন। পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীন জানান, মাসোয়ারার বিনিময় কাউকে অভারণ্যের মধ্যে মাছ আহরণের সুযোগ দেয়ার বিষয়টি গুজব। তবে, বন বিভাগের চোখ ফাঁকি অসাধু জেলেরা চুরি করে মাঝেমধ্যে মাছ ধরতে পারে। এছাড়া জেলেদের আহরিত সব মাছ সুন্দরবনের নয়।