শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী

গত বছর ১৮ মার্চ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক নেমেছিল ৩ হাজার ৬০৩ পয়েন্টে। বর্তমানে সেই সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ হাজারের ওপর। যে লেনদেন এক সময় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল, সেই লেনদেন এখন দুই হাজার কোটি টাকার ওপর। অর্থাৎ এক সময় তলানিতে থাকা শেয়ারবাজার এখন উপরে উঠছে। পূঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সেচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) যোগ্য নেতৃত্বে শেয়ারবাজারে সুদিন ফিরছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে বর্তমান কমিশনের ওপর। তবে অবশ্যই সতর্কও থাকতে হবে। কেউ কারসাজি করলে আইনের আওতায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক বাজার বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের উভয় শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন এখন দুই হাজার কোটি টাকার বেশি হচ্ছে প্রতিদিন। একই সঙ্গে বাড়ছে সূচকের গতি। গতকাল লেনদেনে দেখা যায়, ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫ হাজার ৬০৯ দশমিক ৭০ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএসইতে ডিএসইএক্স সূচকটি ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ৪০৫৬ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপর বিগত ৮ বছরের মধ্যে সূচকটি গত রোববার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান হয়। ওইদিন ডিএসইএক্স বেড়েছে ২১৭ পয়েন্ট। এর আগে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্থাৎ ২৩২ পয়েন্ট উত্থান হয়েছিল। এর আগের বছরের ৯ আগস্ট তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৮০ পয়েন্ট, ১৬ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ সর্বোচ্চ ১৬৯ পয়েন্ট, ১৬ আগস্ট পঞ্চম সর্বোচ্চ ১৫৬ পয়েন্ট এবং ২০১৫ সালের ১০ মে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ১৫৫ পয়েন্ট বেড়েছিল।

অন্য সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক, ডিএসই-৩০ সূচক এবং নতুন চালু হওয়া সিডিএসইটি সূচক যথাক্রমে ১২৭৮ দশমিক ৬৭ পয়েন্টে, ২০৫৮ দশমিক ৮৬ পয়েন্টে এবং ১১৮০ দশমিক ৫২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। যে ডিএসইএক্স সূচক এক সময় তলানিতে নেমে ৩ হাজার ৬০৩ তে অবস্থান করছিল সেটি বর্তমানে ৫ হাজার ৬০৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এছাড়া উভয় শেয়ারবাজারে টাকার পরিমাণে লেনদেনও বেড়েছে। গতকাল ডিএসইতে ২ হাজার ৫৪৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে যা ডিএসইতে ১০ বছর ২৯ দিন বা ২ হাজার ৩৮৯ কার্যদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ডিএসইতে ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর গতকালের চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছিল। ওইদিন ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৭১০ কোটি টাকার। এর পরের ১০ বছরের মধ্যে গতকালের লেনদেন সর্বোচ্চ। অর্থাৎ সূচকের সঙ্গে লেনদেনও বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান তালে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকার মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, নতুন নতুন কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে, যেমন রবি, ওয়ালটন ইত্যাদি, এতে মার্কেট বড় হচ্ছে। এটা একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বাজারে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকে টাকা রাখা বা সঞ্চয়পত্র কিনে রাখলে এখন কম মুনাফা পাওয়া যায়। তাই শেয়ারবাজারে টাকা রাখাকে লাভজন মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। তৃতীয়ত, নতুন কমিশন এসে অনেকগুলো ইতিবাচক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে যা শেয়ারবাজারের জন্য ভালো। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে।’

এই উত্থান শেয়ারবাজারের জন্য হুমকি কিনা জানতে চাইলে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘শেয়ারের দাম অনেক নিচে ছিল। তাই এই উত্থানকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড- ভালোই যাচ্ছে। সেই কারণেও শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো হচ্ছে। তাছাড়া নতুন কমিশন হয়েছে, তারা মার্কেটের জন্য কিছু অ্যাকশন নিয়েছে যেগুলো খুবই ইতিবাচক। আমি মনে করি, উত্থান ঠিক আছে তবে একদিনে যেন বড় মাত্রায় উত্থান না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’

শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে ইতিবাচক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের প্রচেষ্টাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক দরপতনের কারণে পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারী আস্থার সংকট ছিল চরমে। তবে এ ধারাবাহিক পতন রোধে চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস (প্রতিটি শেয়ারের বেধে দেয়া সর্বনি¤œ দর) বেধে দেয়া হয়। এটা করা হয়েছিল শেয়ারের দাম যেন আর না কমে। আর দাম না কমলে সূচক নিচে নামতে পারবে না।

এ প্রসঙ্গে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদকে বলেন, ‘আজও সূচক সাড়ে ৫ হাজারের ওপরে আছে। আজ সূচক কমেছে কিছুটা। এটা স্বাভাবিক গতি। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সাবধান হতে হবে। কারণ কিছু শেয়ারের দাম কোন কারণ ছাড়াই বাড়ছে। সেগুলো প্রতি নজর দেয়া দরকার কমিশনের। বর্তমানে ব্যাংকের টাকার সুদ কম হওয়ায় শেয়ারবাজারের দিকে ঝুঁকছে বিনিয়োগকারীরা। একে বাজারে নতুন বিনিয়োগ ঢুকছে। আর তার চেয়ে বড় কারণ হলো, বর্তমান কমিশনের ওপর আস্থা বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের। কমিশনের ইতিবাচক পদক্ষেপ বাজার ভালো করেছে। শেয়ার মার্কেট এক সময় অনেক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। সেখান থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে।’

তবে যখন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয় তখন প্রথমে তাকে সাধুবাদ জানানো হয় বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু তার কিছুদিন পরই ফেøার প্রাইস তুলে দেয়ার জন্য একটি মহল থেকে আহ্বান জানানো হয়। তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার কথা বিবেচনায় বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ফ্লোর প্রাইস তুলেননি। এছাড়া চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পরপরই পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানো উদ্যোগ নেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের মাধ্যমে বিনিয়োগে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

একইভাবে পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে আরেকটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। তা হলো, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ নিশ্চিতকরণ। এটি না মানলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। হয়েছেও তাই। শেষ পর্যন্ত ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে বাধ্য হয়েছে পরিচালকরা। এই সিদ্ধান্ত ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর নেয়া হয়েছিল কিন্তু তা ছিল কাগজে-কলমে। এখন তা বাস্তবায়ন করছে বর্তমান কমিশন। এতে বর্তমান কমিশন ও শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থা বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্তি ঠেকানো। ইতোমধ্যেই বর্তমান কমিশন সেই রাস্তাও বন্ধ করেছে। পুঁজিবাজারে আসার অপেক্ষায় থাকা একাধিক দুর্বল কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন অনেকগুলো ভালো আইপিও বাজারে নিয়ে এসেছেন। ২০২০ সালে আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) মাধ্যমে বাজার থেকে ৩৩৩ কোটি টাকা নিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি। গত বছর আইপিও অনুমোদন পেয়েছে ১৫ কোম্পানি। গত বছর ২৩ জুন ইলেকট্রনিকস জায়ান্ট ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের মাধ্যমে আইপিও দেয়া শুরু করে শিবলীর নেতৃত্বাধীন কমিশন। এরপর তারা ৬ মাসে আরও ১৪টি কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়েছে।

এছাড়া বন্ড, রাইট শেয়ার এবং প্রাইভেট প্লেসমেন্টসহ সব মিলে সংগৃহীত হয়েছে ৮ হাজার ৭১৭ টাকা। আগের বছর আইপিরও মাধ্যমে ৪২৪ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছিল। এছাড়া ওই সময়ে রাইট শেয়ার, বন্ড ও প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়েছিল ২৬ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। নতুন সুকুক বন্ড নামের আরেকটি বন্ড আসতে যাচ্ছে শেয়ারবাজারে।

এই প্রসঙ্গে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো হচ্ছে। একটা স্বচ্ছ মার্কেট বিনিয়োগকারীদের উপহার দেয়ায় আমাদের প্রত্যাশা। এজন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এটা অব্যাহত থাকবে। আশা করি, নতুন বছর শেয়ারবাজার আরও ভালো করবে। এ সময় দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে প্রাইমারি মার্কেট, বন্ড ও সুকুক আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। এ খাতগুলোতে অনেক বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। তবে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিদেশি বিনিয়োগকে আমরা সেভাবে উৎসাহিত করছি না। আর চলতি বছরের শেষের দিকে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে কমোডিটি ও ফিউচার চালু করার। সব মিলিয়ে নতুন বছর ভালো যাবে। ’

শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানকে অনেকে আশঙ্কাজনক হিসেবে মনে করছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বাজারের লেনদেনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজও (গতকাল দুপুর ২টা) ২৬শ’ কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়েছে। তাই এই উত্থানকে আশঙ্কাজনক মনে করার কারণ নেই।’

বুধবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২১ , ২২ পৌষ ১৪২৭, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী

রেজাউল করিম

গত বছর ১৮ মার্চ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক নেমেছিল ৩ হাজার ৬০৩ পয়েন্টে। বর্তমানে সেই সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ হাজারের ওপর। যে লেনদেন এক সময় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল, সেই লেনদেন এখন দুই হাজার কোটি টাকার ওপর। অর্থাৎ এক সময় তলানিতে থাকা শেয়ারবাজার এখন উপরে উঠছে। পূঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সেচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) যোগ্য নেতৃত্বে শেয়ারবাজারে সুদিন ফিরছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে বর্তমান কমিশনের ওপর। তবে অবশ্যই সতর্কও থাকতে হবে। কেউ কারসাজি করলে আইনের আওতায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক বাজার বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের উভয় শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন এখন দুই হাজার কোটি টাকার বেশি হচ্ছে প্রতিদিন। একই সঙ্গে বাড়ছে সূচকের গতি। গতকাল লেনদেনে দেখা যায়, ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫ হাজার ৬০৯ দশমিক ৭০ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএসইতে ডিএসইএক্স সূচকটি ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ৪০৫৬ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপর বিগত ৮ বছরের মধ্যে সূচকটি গত রোববার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান হয়। ওইদিন ডিএসইএক্স বেড়েছে ২১৭ পয়েন্ট। এর আগে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্থাৎ ২৩২ পয়েন্ট উত্থান হয়েছিল। এর আগের বছরের ৯ আগস্ট তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৮০ পয়েন্ট, ১৬ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ সর্বোচ্চ ১৬৯ পয়েন্ট, ১৬ আগস্ট পঞ্চম সর্বোচ্চ ১৫৬ পয়েন্ট এবং ২০১৫ সালের ১০ মে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ১৫৫ পয়েন্ট বেড়েছিল।

অন্য সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক, ডিএসই-৩০ সূচক এবং নতুন চালু হওয়া সিডিএসইটি সূচক যথাক্রমে ১২৭৮ দশমিক ৬৭ পয়েন্টে, ২০৫৮ দশমিক ৮৬ পয়েন্টে এবং ১১৮০ দশমিক ৫২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। যে ডিএসইএক্স সূচক এক সময় তলানিতে নেমে ৩ হাজার ৬০৩ তে অবস্থান করছিল সেটি বর্তমানে ৫ হাজার ৬০৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এছাড়া উভয় শেয়ারবাজারে টাকার পরিমাণে লেনদেনও বেড়েছে। গতকাল ডিএসইতে ২ হাজার ৫৪৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে যা ডিএসইতে ১০ বছর ২৯ দিন বা ২ হাজার ৩৮৯ কার্যদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ডিএসইতে ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর গতকালের চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছিল। ওইদিন ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৭১০ কোটি টাকার। এর পরের ১০ বছরের মধ্যে গতকালের লেনদেন সর্বোচ্চ। অর্থাৎ সূচকের সঙ্গে লেনদেনও বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান তালে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকার মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, নতুন নতুন কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে, যেমন রবি, ওয়ালটন ইত্যাদি, এতে মার্কেট বড় হচ্ছে। এটা একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বাজারে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকে টাকা রাখা বা সঞ্চয়পত্র কিনে রাখলে এখন কম মুনাফা পাওয়া যায়। তাই শেয়ারবাজারে টাকা রাখাকে লাভজন মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। তৃতীয়ত, নতুন কমিশন এসে অনেকগুলো ইতিবাচক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে যা শেয়ারবাজারের জন্য ভালো। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে।’

এই উত্থান শেয়ারবাজারের জন্য হুমকি কিনা জানতে চাইলে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘শেয়ারের দাম অনেক নিচে ছিল। তাই এই উত্থানকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড- ভালোই যাচ্ছে। সেই কারণেও শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো হচ্ছে। তাছাড়া নতুন কমিশন হয়েছে, তারা মার্কেটের জন্য কিছু অ্যাকশন নিয়েছে যেগুলো খুবই ইতিবাচক। আমি মনে করি, উত্থান ঠিক আছে তবে একদিনে যেন বড় মাত্রায় উত্থান না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’

শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে ইতিবাচক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের প্রচেষ্টাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক দরপতনের কারণে পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারী আস্থার সংকট ছিল চরমে। তবে এ ধারাবাহিক পতন রোধে চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস (প্রতিটি শেয়ারের বেধে দেয়া সর্বনি¤œ দর) বেধে দেয়া হয়। এটা করা হয়েছিল শেয়ারের দাম যেন আর না কমে। আর দাম না কমলে সূচক নিচে নামতে পারবে না।

এ প্রসঙ্গে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদকে বলেন, ‘আজও সূচক সাড়ে ৫ হাজারের ওপরে আছে। আজ সূচক কমেছে কিছুটা। এটা স্বাভাবিক গতি। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সাবধান হতে হবে। কারণ কিছু শেয়ারের দাম কোন কারণ ছাড়াই বাড়ছে। সেগুলো প্রতি নজর দেয়া দরকার কমিশনের। বর্তমানে ব্যাংকের টাকার সুদ কম হওয়ায় শেয়ারবাজারের দিকে ঝুঁকছে বিনিয়োগকারীরা। একে বাজারে নতুন বিনিয়োগ ঢুকছে। আর তার চেয়ে বড় কারণ হলো, বর্তমান কমিশনের ওপর আস্থা বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের। কমিশনের ইতিবাচক পদক্ষেপ বাজার ভালো করেছে। শেয়ার মার্কেট এক সময় অনেক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। সেখান থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে।’

তবে যখন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয় তখন প্রথমে তাকে সাধুবাদ জানানো হয় বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু তার কিছুদিন পরই ফেøার প্রাইস তুলে দেয়ার জন্য একটি মহল থেকে আহ্বান জানানো হয়। তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার কথা বিবেচনায় বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ফ্লোর প্রাইস তুলেননি। এছাড়া চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পরপরই পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানো উদ্যোগ নেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের মাধ্যমে বিনিয়োগে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

একইভাবে পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে আরেকটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। তা হলো, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ নিশ্চিতকরণ। এটি না মানলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। হয়েছেও তাই। শেষ পর্যন্ত ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে বাধ্য হয়েছে পরিচালকরা। এই সিদ্ধান্ত ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর নেয়া হয়েছিল কিন্তু তা ছিল কাগজে-কলমে। এখন তা বাস্তবায়ন করছে বর্তমান কমিশন। এতে বর্তমান কমিশন ও শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থা বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্তি ঠেকানো। ইতোমধ্যেই বর্তমান কমিশন সেই রাস্তাও বন্ধ করেছে। পুঁজিবাজারে আসার অপেক্ষায় থাকা একাধিক দুর্বল কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন অনেকগুলো ভালো আইপিও বাজারে নিয়ে এসেছেন। ২০২০ সালে আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) মাধ্যমে বাজার থেকে ৩৩৩ কোটি টাকা নিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি। গত বছর আইপিও অনুমোদন পেয়েছে ১৫ কোম্পানি। গত বছর ২৩ জুন ইলেকট্রনিকস জায়ান্ট ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের মাধ্যমে আইপিও দেয়া শুরু করে শিবলীর নেতৃত্বাধীন কমিশন। এরপর তারা ৬ মাসে আরও ১৪টি কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়েছে।

এছাড়া বন্ড, রাইট শেয়ার এবং প্রাইভেট প্লেসমেন্টসহ সব মিলে সংগৃহীত হয়েছে ৮ হাজার ৭১৭ টাকা। আগের বছর আইপিরও মাধ্যমে ৪২৪ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছিল। এছাড়া ওই সময়ে রাইট শেয়ার, বন্ড ও প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়েছিল ২৬ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। নতুন সুকুক বন্ড নামের আরেকটি বন্ড আসতে যাচ্ছে শেয়ারবাজারে।

এই প্রসঙ্গে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো হচ্ছে। একটা স্বচ্ছ মার্কেট বিনিয়োগকারীদের উপহার দেয়ায় আমাদের প্রত্যাশা। এজন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এটা অব্যাহত থাকবে। আশা করি, নতুন বছর শেয়ারবাজার আরও ভালো করবে। এ সময় দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে প্রাইমারি মার্কেট, বন্ড ও সুকুক আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। এ খাতগুলোতে অনেক বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। তবে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিদেশি বিনিয়োগকে আমরা সেভাবে উৎসাহিত করছি না। আর চলতি বছরের শেষের দিকে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে কমোডিটি ও ফিউচার চালু করার। সব মিলিয়ে নতুন বছর ভালো যাবে। ’

শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানকে অনেকে আশঙ্কাজনক হিসেবে মনে করছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বাজারের লেনদেনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজও (গতকাল দুপুর ২টা) ২৬শ’ কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়েছে। তাই এই উত্থানকে আশঙ্কাজনক মনে করার কারণ নেই।’