অস্ট্রেলিয়ায় চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়ছে

অস্ট্রেলিয়া সরকারের একজন জুনিয়র উপদেষ্টা অ্যান্ড্রু চেন (ছদ্মনাম)। কয়েক মাস আগে তাকে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা দফতরে এক বৈঠকে যোগ দিতে হয়েছিল। অন্য কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে সেখানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে একজন নিরাপত্তাকর্মী শুধু তাকে থামিয়ে আলাদা করে অন্য জায়গায় ডেকে নিয়ে যায়।

বিবিসিকে সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন চীনা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক অ্যান্ড্রু চেন। তার ভাষায়, ‘লবিতে আমাকে একটি ছবি তুলতে বলা হলো। শুধু আমাকেই ছবি তুলতে বলা হলো। যে ককেশিয়ান সহকর্মী অমার সঙ্গে ছিলেন, তাকে কিছুই বলা হলো না।’ অস্বস্তি ও অপমানিত বোধ করলেও এ নিয়ে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তিনি তৈরি করতে চাননি। নির্দেশ মতো ছবি তুললেন। পরে অন্য সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন তাদের কখনও ঢোকার মুখে ছবি তুলতে হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা দফতর থেকে বিবিসিকে বলা হয়, ভবনের নিরাপত্তা প্রটোকলে ‘ব্যক্তির জাতিগত পরিচয়’ কখনোই বিবেচ্য বিষয় নয়। কিন্তু অ্যান্ড্রু চেনের গভীর সন্দেহ যে, তার বেলায় এ কথা একবারেই সত্যি ছিল না। চীনা বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের সংখ্যা কমপক্ষে ১২ লাখ। এ সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ। গত অক্টোবর মাসে, তাদের তিনজন- যারা সবাই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক- অভিবাসীদের নানা সমস্যা নিয়ে সিনেটে এক শুনানিতে সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে যান। কিন্তু শুনানি শুরু হওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে তাদের তিনজনকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) নিন্দা করতে বলা হয়। তারা যখন বলেন এই শুনানির সঙ্গে সিসিপির কী সম্পর্ক, সরকারি দলের সিনেটর এরিক অ্যাবেটজ বারবার তাদের বলেন, কেন নয়?

কেন চীনা বংশোদ্ভূতদের দিকে সন্দেহের তীর

অস্ট্রেলিয়ার এক নম্বর বাণিজ্য সহযোগী দেশ চীন। এই সহযোগিতা দুই দেশকেই সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্ট্রেলিয়া চীনকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগ (এএসআইও) ২০১৭ সালে প্রথম সতর্ক করে যে, চীন অষ্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করছে। ওই বছরই চীনা একজন রাজনৈতিক তহবিলদাতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ উঠলে একজন সিনেটর পদত্যাগ করেন।

২০১৮ সালে বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া নতুন একটি আইন পাস করে।

কয়েক মাস পরই নিরাপত্তা ঝুঁকির যুক্তি তুলে ধরে অস্ট্রেলিয়া তাদের ফাইভ-জি মোবাইল নেটওয়ার্কে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করে। অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে, রাজনৈতিক দলের সাইটে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কতগুলো বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পর পর বেশ কয়েকটি সাইবার হামলা হয়। যেগুলোর জন্য চীনকে সন্দেহ করা হয়। এছাড়া, হংকং পরিস্থিতি, জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি আচরণের ইস্যু এবং চীনে কয়েকজন অস্ট্রেলীয় নাগরিকের গ্রেফতারের ঘটনায় চীনবিরোধী মনোভাব দিন দিন আরও চাঙ্গা হয়েছে।

গত নভেম্বরে চীনা একজন কর্মকর্তা এমন একটি কাল্পনিক ছবি পোস্ট করেন যেখানে দেখা যায় একজন অস্ট্রেলীয় সেনা একটি আফগান শিশুকে ছুরি দিয়ে হত্যা করছে। এ ঘটনায় অস্ট্রেলিয়া চরম ক্ষেপে যায়। ওই মাসেই অস্ট্রেলিয়ার যাদুঘর বোর্ডের একজন চীনা বংশোদ্ভূত পরিচালককে বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধের আইনের আওতায় অভিযুক্ত করা হয়। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা হুমকি একটি জটিল ব্যাপার। এর জন্য শুধু চীনা-অস্ট্রেলিয়ানদের সন্দেহ করা হিতে বিপরীত হতে পারে।

গবেষণা সংস্থা অস্ট্রেলিয়া স্ট্রাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের মাইকেল শুব্রিজ বিবিসিকে বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সার্বভৌমত্বের প্রতি যে হুমকি, স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতি যে হুমকি তা চীনা-অস্ট্রেলিয়ান জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে হয়তো আসছেই না, বরং এই হুমকি আসছে সেই সব ব্যক্তিদের কাছ থেকে যারা রাজনীতি, ব্যবসা ও গবেষণার ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখেন।’

তিনি বলেন, ‘বেইজিংয়ের নজর ওইসব ব্যক্তিদের ওপর। চীনের সমালোচনা রোধে এবং চীনের পক্ষে কথা বলতে এই মানুষগুলোর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে তারা।’ মিস ইয়ুন জ্যাং এবং তার মতো অন্যদের ভয়, অস্ট্রেলিয়া- বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া, চীন রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ চীনা-অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের কাল্পনিক যোগসাজশ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। সিনেটের তদন্তের শুনানিতে তিনি বলেন, ‘জাতিগত পরিচিতির চেয়ে নজর দেয়া উচিত মানুষ কী করছে তার ওপর।’

সরকারি চাকরিতে চীনাদের সংকট

শুধু জাতিগত পরিচিতির কারণে সন্দেহের শিকার হওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে ভালো টের পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ার সরকারি চাকরিতে। বিশেষ করে যেসব জায়গায় জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ হয়। অনেক চীনা-অস্ট্রেলিয়ান সরকারি আমলা বলেছেন, তাদের ব্যাপারে সরকারের ভেতর সন্দেহ বাড়ছে।

সরকারি নীতিনির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত চীনা বংশোদ্ভূত একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে চীনের ব্যাপারে উদ্বেগ তৈরি হওয়ার যৌক্তিক অনেক কারণ রয়েছে।’ এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তিনি চীনা সাইবার হামলার প্রসঙ্গ টানেন।

তার ভাষায়, ‘কিন্তু চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিকদের নিয়ে যেভাবে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, যেমন কে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হওয়ার যোগ্য, কার বিরুদ্ধে আরও নিরাপত্তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন- এগুলো সত্যিই খুব খারাপ।’

নতুন যারা সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন বা নিচু পদে কাজ করেন, তারা বলছেন দেশপ্রেম প্রমাণের জন্য তারা চাপ বোধ করছেন এবং নীতিনির্ধারণী কোনও পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের খুবই সতর্ক থাকতে হচ্ছে কারণ তারা ভয় পাচ্ছেন তাদের কথার নানা অর্থ করা হতে পারে।

অ্যান্ড্রু চেন বিবিসিকে বলেন, ‘আমি যদি ককেশিয়ান অস্ট্রেলিয়ান হতাম তাহলে অনেক খোলাখুলি কথা বলতে পারতাম। কিন্তু আপনি যদি জাতিগত চীনা হন, তাহলে মানুষ ধরেই নেবে আপনি চীনের দালাল। এদেশে এখন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

যে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা বিবিসি-র সঙ্গে কথা বলেছেন তারা ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাদের অনেকে বলেছেন, সহকর্মীরা এখন তাদের অতীতের কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন করেন। যেসব কর্মকা-কে এক সময় বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে দেখা হতো, সেগুলোকেই এখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। যেমন- চীন সরকার পরিচালিত কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটে চীনা ভাষা শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা বংশোদ্ভূতদের কোনও ফোরামে সংশ্লিষ্ট হওয়া বা স্রেফ পারিবারিক কারণে বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে চীনে যাওয়া।

তারা আরও বলছেন যে, চাকরিতে চীনা-অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র দিতে বিলম্ব করা হচ্ছে। তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর অন্যদের চেয়ে বেশি করা হচ্ছে।

চীনা বংশোদ্ভূত একজন সিনিয়র উপদেষ্টা বিবিসিকে বলেন, আমার একজন সাবেক সহকর্মী তিন বছর আগে সরকারি চাকরিতে ঢোকে- কিন্তু এখনও সে নিরাপত্তা ছাড়পত্র পায়নি। কিন্তু এটি পেতে ছয় মাসের বেশি লাগে না।

চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিকরা বলছেন, এই ধরনের বিলম্ব চাকরিতে তাদের ক্যারিয়ারে বাধা তৈরি করছে। এমনকি অনেকে সরকারি চাকরিতে ঢুকতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ রকম দুজন সরকারি চাকরিজীবী বলেছেন, নিরাপত্তা ছাড়পত্র না আসায় কাজের জায়গায় কিছু দায়িত্ব থেকে তাদের সরে আসতে হয়েছে।

প্রতিরক্ষা বিভাগ চীনা-অস্ট্রেলিয়ানদের ছাড়পত্র নিয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। তবে একজন মুখপাত্র বলেছেন, নিরাপত্তা ছাড়পত্র কতগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যদি কোন আবেদনকারী কখনও বিদেশে বসবাস করে থাকেন তাহলে তার দেয়া প্রমাণাদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই করতে হয়।

গবেষক শুব্রিজ বলেন, কোন সরকারি কর্মকর্তা যদি এমন দেশে যান- যেমন রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়া, যেখান থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া কঠিন- তাহলে নিরাপত্তা ছাড়পত্র পেতে সময় লাগে।

তিনি বলেন, যেসব অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের চীনে পরিবার রয়েছে, বন্ধু রয়েছে বা চীনের সঙ্গে অন্য কোন সম্পর্ক রয়েছে তাদের ব্যাপারে সরকার বিশেষ সতর্ক। কারণ সরকার মনে করে এসব মানুষের ওপর চাপ তৈরি করা চীনের জন্য সহজ।

গবেষক শুব্রিজ বলেন, মানুষকে এভাবে ব্যবহার করার রেকর্ড চীনা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। তবে চীনে বসবাসের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন লোকজনকে চাকরি না দেয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। একজন সরকারি আমলা বিবিসিকে বলেন, ধরুন আপনি চীনা নীতি সম্পর্কিত কোনও টিমে কাজ করেন। স্বাভাবিকভাবে আপনি এমন কিছু লোক চাইবেন যারা চীনা বংশোদ্ভূত। এখন চীনের ভেতরের খবর রাখে এমন লোক যদি নিরাপত্তা ছাড়পত্র না পায়, তাহলে আপনার টিমে সত্যিকারের বিশেষজ্ঞ পাবেন না।

অস্ট্রেলিয়ান মূল্যবোধের অগ্নিপরীক্ষা

চীনা বংশোদ্ভূত কিছু মানুষকে চীন সরকার তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে- এমন আশঙ্কা পুরোপুরি নাকচ করছেন না চীনা-অস্ট্রেলিয়ান সমাজকর্মী জেসন ইয়াট-সেন লি। কিন্তু তিনি বলেন, অনেক মানুষ সেই ফাঁদে পা দেবেন কিনা তা নির্ভর করে তিনি নিজেকে কতটা অস্ট্রেলিয়ান রাষ্ট্র এবং সমাজের অংশ মনে করেন তার ওপর। তিনি বলেন, চীন-অস্ট্রেলিয়ার বিরোধ আমাদের মূল্যবোধ এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর আমাদের আস্থার জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা।

সরকারি নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগ অনেকদিন ধরেই সতর্ক করছে চীনা সম্প্রদায় যেন নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ না করে। কারণ চীনের ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য এরাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে। শুব্রিজ বলেন, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেন এমন ভাষা ব্যবহার না করেন যেটা সমাজের ঐক্যের পরিপন্থী। তেমন আচরণ চীনা সরকারের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার সমান হবে।

লি মনে করেন, মূল সমস্যা আস্থা। তার ভাষায়, ‘অস্ট্রেলিয়ানরা কি তাদের চীনা-অস্ট্রেলিয়ান সহকর্মী, প্রতিবেশী বা বন্ধুদের বিশ্বাস করেন? যে সমাজে তারা বাস করছেন তার ওপর চীনা অস্ট্রেলিয়ানদের কি এই আস্থা রয়েছে যে, তারা সমান সুযোগ পাবেন এবং আইন তার প্রতি বৈষম্য করবে না?’ তিনি বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের পাঁচ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বিশ্বাস না করি, তাহলে তা হবে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম বিরোধী এবং সেটা বিদেশি কোন রাষ্ট্রের চেয়ে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনবে।’

বিবিসি।

বুধবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২১ , ২২ পৌষ ১৪২৭, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

অস্ট্রেলিয়ায় চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়ছে

image

অস্ট্রেলিয়া সরকারের একজন জুনিয়র উপদেষ্টা অ্যান্ড্রু চেন (ছদ্মনাম)। কয়েক মাস আগে তাকে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা দফতরে এক বৈঠকে যোগ দিতে হয়েছিল। অন্য কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে সেখানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে একজন নিরাপত্তাকর্মী শুধু তাকে থামিয়ে আলাদা করে অন্য জায়গায় ডেকে নিয়ে যায়।

বিবিসিকে সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন চীনা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক অ্যান্ড্রু চেন। তার ভাষায়, ‘লবিতে আমাকে একটি ছবি তুলতে বলা হলো। শুধু আমাকেই ছবি তুলতে বলা হলো। যে ককেশিয়ান সহকর্মী অমার সঙ্গে ছিলেন, তাকে কিছুই বলা হলো না।’ অস্বস্তি ও অপমানিত বোধ করলেও এ নিয়ে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তিনি তৈরি করতে চাননি। নির্দেশ মতো ছবি তুললেন। পরে অন্য সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন তাদের কখনও ঢোকার মুখে ছবি তুলতে হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা দফতর থেকে বিবিসিকে বলা হয়, ভবনের নিরাপত্তা প্রটোকলে ‘ব্যক্তির জাতিগত পরিচয়’ কখনোই বিবেচ্য বিষয় নয়। কিন্তু অ্যান্ড্রু চেনের গভীর সন্দেহ যে, তার বেলায় এ কথা একবারেই সত্যি ছিল না। চীনা বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের সংখ্যা কমপক্ষে ১২ লাখ। এ সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ। গত অক্টোবর মাসে, তাদের তিনজন- যারা সবাই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক- অভিবাসীদের নানা সমস্যা নিয়ে সিনেটে এক শুনানিতে সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে যান। কিন্তু শুনানি শুরু হওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে তাদের তিনজনকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) নিন্দা করতে বলা হয়। তারা যখন বলেন এই শুনানির সঙ্গে সিসিপির কী সম্পর্ক, সরকারি দলের সিনেটর এরিক অ্যাবেটজ বারবার তাদের বলেন, কেন নয়?

কেন চীনা বংশোদ্ভূতদের দিকে সন্দেহের তীর

অস্ট্রেলিয়ার এক নম্বর বাণিজ্য সহযোগী দেশ চীন। এই সহযোগিতা দুই দেশকেই সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্ট্রেলিয়া চীনকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগ (এএসআইও) ২০১৭ সালে প্রথম সতর্ক করে যে, চীন অষ্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করছে। ওই বছরই চীনা একজন রাজনৈতিক তহবিলদাতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ উঠলে একজন সিনেটর পদত্যাগ করেন।

২০১৮ সালে বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া নতুন একটি আইন পাস করে।

কয়েক মাস পরই নিরাপত্তা ঝুঁকির যুক্তি তুলে ধরে অস্ট্রেলিয়া তাদের ফাইভ-জি মোবাইল নেটওয়ার্কে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করে। অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে, রাজনৈতিক দলের সাইটে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কতগুলো বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পর পর বেশ কয়েকটি সাইবার হামলা হয়। যেগুলোর জন্য চীনকে সন্দেহ করা হয়। এছাড়া, হংকং পরিস্থিতি, জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি আচরণের ইস্যু এবং চীনে কয়েকজন অস্ট্রেলীয় নাগরিকের গ্রেফতারের ঘটনায় চীনবিরোধী মনোভাব দিন দিন আরও চাঙ্গা হয়েছে।

গত নভেম্বরে চীনা একজন কর্মকর্তা এমন একটি কাল্পনিক ছবি পোস্ট করেন যেখানে দেখা যায় একজন অস্ট্রেলীয় সেনা একটি আফগান শিশুকে ছুরি দিয়ে হত্যা করছে। এ ঘটনায় অস্ট্রেলিয়া চরম ক্ষেপে যায়। ওই মাসেই অস্ট্রেলিয়ার যাদুঘর বোর্ডের একজন চীনা বংশোদ্ভূত পরিচালককে বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধের আইনের আওতায় অভিযুক্ত করা হয়। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা হুমকি একটি জটিল ব্যাপার। এর জন্য শুধু চীনা-অস্ট্রেলিয়ানদের সন্দেহ করা হিতে বিপরীত হতে পারে।

গবেষণা সংস্থা অস্ট্রেলিয়া স্ট্রাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের মাইকেল শুব্রিজ বিবিসিকে বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সার্বভৌমত্বের প্রতি যে হুমকি, স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতি যে হুমকি তা চীনা-অস্ট্রেলিয়ান জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে হয়তো আসছেই না, বরং এই হুমকি আসছে সেই সব ব্যক্তিদের কাছ থেকে যারা রাজনীতি, ব্যবসা ও গবেষণার ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখেন।’

তিনি বলেন, ‘বেইজিংয়ের নজর ওইসব ব্যক্তিদের ওপর। চীনের সমালোচনা রোধে এবং চীনের পক্ষে কথা বলতে এই মানুষগুলোর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে তারা।’ মিস ইয়ুন জ্যাং এবং তার মতো অন্যদের ভয়, অস্ট্রেলিয়া- বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া, চীন রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ চীনা-অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের কাল্পনিক যোগসাজশ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। সিনেটের তদন্তের শুনানিতে তিনি বলেন, ‘জাতিগত পরিচিতির চেয়ে নজর দেয়া উচিত মানুষ কী করছে তার ওপর।’

সরকারি চাকরিতে চীনাদের সংকট

শুধু জাতিগত পরিচিতির কারণে সন্দেহের শিকার হওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে ভালো টের পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ার সরকারি চাকরিতে। বিশেষ করে যেসব জায়গায় জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ হয়। অনেক চীনা-অস্ট্রেলিয়ান সরকারি আমলা বলেছেন, তাদের ব্যাপারে সরকারের ভেতর সন্দেহ বাড়ছে।

সরকারি নীতিনির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত চীনা বংশোদ্ভূত একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে চীনের ব্যাপারে উদ্বেগ তৈরি হওয়ার যৌক্তিক অনেক কারণ রয়েছে।’ এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তিনি চীনা সাইবার হামলার প্রসঙ্গ টানেন।

তার ভাষায়, ‘কিন্তু চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিকদের নিয়ে যেভাবে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, যেমন কে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হওয়ার যোগ্য, কার বিরুদ্ধে আরও নিরাপত্তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন- এগুলো সত্যিই খুব খারাপ।’

নতুন যারা সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন বা নিচু পদে কাজ করেন, তারা বলছেন দেশপ্রেম প্রমাণের জন্য তারা চাপ বোধ করছেন এবং নীতিনির্ধারণী কোনও পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের খুবই সতর্ক থাকতে হচ্ছে কারণ তারা ভয় পাচ্ছেন তাদের কথার নানা অর্থ করা হতে পারে।

অ্যান্ড্রু চেন বিবিসিকে বলেন, ‘আমি যদি ককেশিয়ান অস্ট্রেলিয়ান হতাম তাহলে অনেক খোলাখুলি কথা বলতে পারতাম। কিন্তু আপনি যদি জাতিগত চীনা হন, তাহলে মানুষ ধরেই নেবে আপনি চীনের দালাল। এদেশে এখন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

যে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা বিবিসি-র সঙ্গে কথা বলেছেন তারা ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাদের অনেকে বলেছেন, সহকর্মীরা এখন তাদের অতীতের কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন করেন। যেসব কর্মকা-কে এক সময় বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে দেখা হতো, সেগুলোকেই এখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। যেমন- চীন সরকার পরিচালিত কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটে চীনা ভাষা শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা বংশোদ্ভূতদের কোনও ফোরামে সংশ্লিষ্ট হওয়া বা স্রেফ পারিবারিক কারণে বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে চীনে যাওয়া।

তারা আরও বলছেন যে, চাকরিতে চীনা-অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র দিতে বিলম্ব করা হচ্ছে। তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর অন্যদের চেয়ে বেশি করা হচ্ছে।

চীনা বংশোদ্ভূত একজন সিনিয়র উপদেষ্টা বিবিসিকে বলেন, আমার একজন সাবেক সহকর্মী তিন বছর আগে সরকারি চাকরিতে ঢোকে- কিন্তু এখনও সে নিরাপত্তা ছাড়পত্র পায়নি। কিন্তু এটি পেতে ছয় মাসের বেশি লাগে না।

চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিকরা বলছেন, এই ধরনের বিলম্ব চাকরিতে তাদের ক্যারিয়ারে বাধা তৈরি করছে। এমনকি অনেকে সরকারি চাকরিতে ঢুকতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ রকম দুজন সরকারি চাকরিজীবী বলেছেন, নিরাপত্তা ছাড়পত্র না আসায় কাজের জায়গায় কিছু দায়িত্ব থেকে তাদের সরে আসতে হয়েছে।

প্রতিরক্ষা বিভাগ চীনা-অস্ট্রেলিয়ানদের ছাড়পত্র নিয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। তবে একজন মুখপাত্র বলেছেন, নিরাপত্তা ছাড়পত্র কতগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যদি কোন আবেদনকারী কখনও বিদেশে বসবাস করে থাকেন তাহলে তার দেয়া প্রমাণাদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই করতে হয়।

গবেষক শুব্রিজ বলেন, কোন সরকারি কর্মকর্তা যদি এমন দেশে যান- যেমন রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়া, যেখান থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া কঠিন- তাহলে নিরাপত্তা ছাড়পত্র পেতে সময় লাগে।

তিনি বলেন, যেসব অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের চীনে পরিবার রয়েছে, বন্ধু রয়েছে বা চীনের সঙ্গে অন্য কোন সম্পর্ক রয়েছে তাদের ব্যাপারে সরকার বিশেষ সতর্ক। কারণ সরকার মনে করে এসব মানুষের ওপর চাপ তৈরি করা চীনের জন্য সহজ।

গবেষক শুব্রিজ বলেন, মানুষকে এভাবে ব্যবহার করার রেকর্ড চীনা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। তবে চীনে বসবাসের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন লোকজনকে চাকরি না দেয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। একজন সরকারি আমলা বিবিসিকে বলেন, ধরুন আপনি চীনা নীতি সম্পর্কিত কোনও টিমে কাজ করেন। স্বাভাবিকভাবে আপনি এমন কিছু লোক চাইবেন যারা চীনা বংশোদ্ভূত। এখন চীনের ভেতরের খবর রাখে এমন লোক যদি নিরাপত্তা ছাড়পত্র না পায়, তাহলে আপনার টিমে সত্যিকারের বিশেষজ্ঞ পাবেন না।

অস্ট্রেলিয়ান মূল্যবোধের অগ্নিপরীক্ষা

চীনা বংশোদ্ভূত কিছু মানুষকে চীন সরকার তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে- এমন আশঙ্কা পুরোপুরি নাকচ করছেন না চীনা-অস্ট্রেলিয়ান সমাজকর্মী জেসন ইয়াট-সেন লি। কিন্তু তিনি বলেন, অনেক মানুষ সেই ফাঁদে পা দেবেন কিনা তা নির্ভর করে তিনি নিজেকে কতটা অস্ট্রেলিয়ান রাষ্ট্র এবং সমাজের অংশ মনে করেন তার ওপর। তিনি বলেন, চীন-অস্ট্রেলিয়ার বিরোধ আমাদের মূল্যবোধ এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর আমাদের আস্থার জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা।

সরকারি নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগ অনেকদিন ধরেই সতর্ক করছে চীনা সম্প্রদায় যেন নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ না করে। কারণ চীনের ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য এরাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে। শুব্রিজ বলেন, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেন এমন ভাষা ব্যবহার না করেন যেটা সমাজের ঐক্যের পরিপন্থী। তেমন আচরণ চীনা সরকারের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার সমান হবে।

লি মনে করেন, মূল সমস্যা আস্থা। তার ভাষায়, ‘অস্ট্রেলিয়ানরা কি তাদের চীনা-অস্ট্রেলিয়ান সহকর্মী, প্রতিবেশী বা বন্ধুদের বিশ্বাস করেন? যে সমাজে তারা বাস করছেন তার ওপর চীনা অস্ট্রেলিয়ানদের কি এই আস্থা রয়েছে যে, তারা সমান সুযোগ পাবেন এবং আইন তার প্রতি বৈষম্য করবে না?’ তিনি বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের পাঁচ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বিশ্বাস না করি, তাহলে তা হবে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম বিরোধী এবং সেটা বিদেশি কোন রাষ্ট্রের চেয়ে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনবে।’

বিবিসি।