মুক্তিযুদ্ধোত্তর দিনাজপুর ট্র্যাজেডি

আজহারুল আজাদ জুয়েল

১৯৭১ সালে দিনাজপুর জেলা শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ভারতীয় সৈনিকদের একটি ক্যাম্প করা হয়েছিল দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। অপরদিকে মহারাজা স্কুলের বিশাল ভবন ও বিরাট চত্বরে গড়ে তোলা হয়েছিল মুক্তি বাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের নেতৃতে ছিলেন লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত)। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি এ ক্যাম্পেই সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ দুর্ঘটনা, যাতে অর্ধসহস্র বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। আর আহত? তার সংখ্যাও ছিল অগণিত। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর এত বড় ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের কোথাও আর ঘটেনি।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি। কী হয়েছিল সেদিন? সেদিনের ঘটনায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তত ৪ জন এখনো বেঁচে রয়েছেন; যাদের সাথে আমার (লেখকের) দেখা হয়েছিল ঢাকায়। ২০১৭ সালে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আহত মো. তোজাম্মেল হক, মো. আক্কাস আলী, অনীল কুমার রায় ও সুধীর চন্দ্র রায়ের। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির সেই ভয়াবহ ঘটনা কীভাবে ঘটল এবং সেই বিস্ফোরণে আহত হয়েও কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, সেই বেদনাবিধুর ঘটনা তাদের বয়ানে এ নিবন্ধে তুলে ধরা হলো-

মো. তোজাম্মেল হক

আমি ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর দিনাজপুরের নিউটাউনে ৬ মাসের মোজাহিদ ট্রেনিং নিয়েছিলাম। দুর্ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলা সিনেমা দেখার পরিকল্পনা ছিল। তাই সিনেমা দেখার জন্য ক্যাম্প থেকে টোকেন নেয়ার আবেদন করেছিলাম। টোকেনের আবেদন করে ক্যাম্পে আমার রুমে ফিরে এসে বিশ্রাম নেয়ার সময় হঠাৎ বাঁশির শব্দ, রিপোর্ট করতে হবে। আমরা দ্রুত মাঠের মধ্যে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। প্রত্যেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে এক, দুই, তিন বলে নিজের অবস্থান বা উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলাম। আমরা যখন আমাদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছিলাম, তখন মাঠের মধ্যে একটি ট্রাক থেকে অস্ত্র আনলোড করা হচ্ছিল। ট্রাকটি এসেছিল হিলি থেকে। এর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের মাইন ছিল। মাইনগুলো ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে পুরো ক্যাম্পে ধ্বংসের তুফান শুরু হয়। শব্দের সাথে সাথে চাকাত চাকাত আলোর কয়েকটা ঝলক দেখতে পাই। এরপর আর কিছু মনে নাই।

মো. আক্কাস আলী

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে আমার বসবাস ছিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার পিত্রালয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে আমি দিনাজপুরে এসে ভাইদের সাথে বসবাস করতে থাকি এবং সাধারণ মানুষের সাথে মিশে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

৬ জানুয়ারিও সকাল বেলা প্যারেড করি। ৬ জানুয়ারি বিকাল বেলা ঘোড়াঘাট থেকে উদ্ধার হওয়া দুই ট্রাক অস্ত্র ক্যাম্পের মাঠে আনা হয়েছিল। মাগরিবের নামাজ পড়তে আমি ওজু করতে যাই। মহারাজা স্কুল মাঠে এখন যেখানে মসজিদ রয়েছে, তখন সেখানেই একটি টিনের মসজিদ ছিল। আমি মসজিদের পাশে ওজু করার জন্য যখন বসেছি, ঠিক তখনি বিকট শব্দে পুরো মিলিশিয়া ক্যাম্প বিস্ফোরিত হলো। বিস্ফোরণের সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।

এ ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পর রাত ১২টার দিকে আমার চেতনা ফিরে আসে। চেতনা ফেরার পর নিজেকে দিনাজপুর সদর হাসপাতালে দেখতে পাই। তখনো পুরো শরীরে ধুলো-বালির আস্তরণ ছিল। সেই সাথে সারা শরীরে তীব্র ব্যথা হচ্ছিল। কিন্তু কেন আমার এ অবস্থা স্মরণে আসছিল না। আমি লোকজনকে জিজ্ঞাসা করি, কী ব্যাপার, কী হয়েছে, কেন আমি এখানে? লোকজন তখন জানান যে, মিলিশিয়া ক্যাম্পের অস্ত্রগুদাম বিস্ফোরিত হয়েছে। ক্যাম্পে আমি মাটির স্তূপে চাপা পড়েছিলাম। আমার মাথা ছাড়া পুরো শরীর মাটির তলে চাপা পড়েছিল। আমার সেন্স ছিল না। তারপরও গলার ভেতর থেকে এক ধরনের গোঙানির আওয়াজ হচ্ছিল। সেই আওয়াজ পেয়ে লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

অনীল কুমার রায়

আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজারামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ভারতের কাটলা ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সকালে দিনাজপুরে আসার পর আমি মহারাজা স্কুলের মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে যোগ দেই। তখন তো জানতাম না যে, সকালে যোগ দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ভয়ঙ্করতম পরিস্থিতির শিকার হতে হবে! আমি আমার গ্রুপ কমান্ডারের সাথে আলোচনা করে সকালে ক্যাম্পে যোগ দিয়ে নাম-ধাম তালিকাভুক্ত করিয়ে দুপুর বেলা শহর দেখতে বের হই। দুপুরের খাওয়া সারি হোটেলে। এরপর সন্ধ্যার আগে আবার ক্যাম্পে ফিরে যাই। ক্যাম্পে এসে বিকালের খাওয়া করি। খাওয়ার পর বাঁশি বাজিয়ে আমাদের রোল কল করা হয়। এরপর লাইনে দাঁড়াতে বলা হয়। আমি স্কুল ভবনের সামনে প্রথম লাইনে পূর্বমুখী হয়ে লাইনে দাঁড়াই। ওই সময় প্রায় ৩-৪শ’ মুক্তিযোদ্ধা সেখানে ছিলেন।

এ সময় দুটো বিকট আওয়াজ হলো। সাথে সাথে অগ্নিকুণ্ডলী, ধুম্রকুণ্ডলী, ধুলিকুণ্ডলী এমনভাবে আমাকে আক্রমণ করল যে, চোখ মেলে তাকানোর অবস্থা ছিল না। চোখ বন্ধ অবস্থায় অনুভব করলাম যে, আমার মাথায় ভীষণ জোরে কেউ যেন আঘাত করল। আমার ধারণা- এ অবস্থা ছিল ১৫-২০ মিনিট। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমার বোধ হয়েছিল, পাকিস্তানি সৈন্যরা বোধহয় আমাদের ওপর হামলা করেছে। তাই জীবন রক্ষার জন্য দৌড় দিলাম। আর দৌড় দিতে গিয়েই ধপাস করে পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে বুঝলাম যে, আমার পা ভেঙে গেছে, পায়ের ভাঙা অংশ ও ক্ষত দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে।

অবশেষে ঘণ্টাখানেক পর লোকজন এসে আমাকে উদ্ধার করলেন। যখন উদ্ধার করা হলো, তখনো চেতনায় ছিলাম। আমাকে উদ্ধার করে দিনাজপুর সদর হাসপাতালের ফ্লোরে এনে রাখা হলো। চিকিৎসা হওয়ার পরেও ব্লিডিং চলছিল। অবস্থার অবনতিতে আমাকে এবং আরো ২০-২৫ জন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ওই রাতেই রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো। রংপুরে এক মাস চিকিৎসা হয়েছে। এই এক মাস আমার জীবনের কঠিন সময় গেছে। এই এক মাসের একদিনেও ঘুমাতে পারিনি। জ¦লন্ত অগ্নির মতো প্রতিটি রাত কেটেছিল নির্ঘুম অবস্থায়।

সুধীর চন্দ্র রায়

১৯৭১ সালে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। ৬ জানুয়ারি সকাল ১০-১১টার দিকে আমি ও অনীল ক্যাম্পে যোগ দেই। সেখানে সারাদিন অবস্থান করি। বিকাল ৪টায় আমাদের খাবার দেয়া হয়। খাওয়া শেষ হলে আমাদের বিশ্রাম নিতে বলা হয়। আমরা স্কুলে একটি ঘরে বিশ্রাম নেই। বিকাল পৌনে ৬টার দিকে হুইসেল বাজানো হয়। হুইসেলের শব্দে আমরা আবার ঘর থেকে বের হয়ে আসি। তখন আমাদের নির্দেশ দেয়া হলে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়াই। লাইন তখনো কমপ্লিট হয় নাই। আর তখনি সেই ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু হয়। হঠাৎ মাইন বিস্ফোরণে ক্যাম্পের পুরো অস্ত্রভাণ্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় মিলিশিয়া ক্যাম্প। বিস্ফোরণের সাথে সাথে আমার চেতনা লোপ পেয়েছিল। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেকে উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। পুরো শরীর তখন রক্তাক্ত। বাম পা, বাম পাঁজরসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়েছে বুঝতে পারি। আমার আশপাশে যারা ছিলেন তাদেরও একই রকম বস্ত্রবিহীন ও রক্তাক্ত দেখতে পাই।

[লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক]

a.azadjewel@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২১ , ২৩ পৌষ ১৪২৭, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

মুক্তিযুদ্ধোত্তর দিনাজপুর ট্র্যাজেডি

আজহারুল আজাদ জুয়েল

১৯৭১ সালে দিনাজপুর জেলা শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ভারতীয় সৈনিকদের একটি ক্যাম্প করা হয়েছিল দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। অপরদিকে মহারাজা স্কুলের বিশাল ভবন ও বিরাট চত্বরে গড়ে তোলা হয়েছিল মুক্তি বাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের নেতৃতে ছিলেন লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত)। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি এ ক্যাম্পেই সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ দুর্ঘটনা, যাতে অর্ধসহস্র বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। আর আহত? তার সংখ্যাও ছিল অগণিত। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর এত বড় ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের কোথাও আর ঘটেনি।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি। কী হয়েছিল সেদিন? সেদিনের ঘটনায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তত ৪ জন এখনো বেঁচে রয়েছেন; যাদের সাথে আমার (লেখকের) দেখা হয়েছিল ঢাকায়। ২০১৭ সালে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আহত মো. তোজাম্মেল হক, মো. আক্কাস আলী, অনীল কুমার রায় ও সুধীর চন্দ্র রায়ের। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির সেই ভয়াবহ ঘটনা কীভাবে ঘটল এবং সেই বিস্ফোরণে আহত হয়েও কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, সেই বেদনাবিধুর ঘটনা তাদের বয়ানে এ নিবন্ধে তুলে ধরা হলো-

মো. তোজাম্মেল হক

আমি ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর দিনাজপুরের নিউটাউনে ৬ মাসের মোজাহিদ ট্রেনিং নিয়েছিলাম। দুর্ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলা সিনেমা দেখার পরিকল্পনা ছিল। তাই সিনেমা দেখার জন্য ক্যাম্প থেকে টোকেন নেয়ার আবেদন করেছিলাম। টোকেনের আবেদন করে ক্যাম্পে আমার রুমে ফিরে এসে বিশ্রাম নেয়ার সময় হঠাৎ বাঁশির শব্দ, রিপোর্ট করতে হবে। আমরা দ্রুত মাঠের মধ্যে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। প্রত্যেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে এক, দুই, তিন বলে নিজের অবস্থান বা উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলাম। আমরা যখন আমাদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছিলাম, তখন মাঠের মধ্যে একটি ট্রাক থেকে অস্ত্র আনলোড করা হচ্ছিল। ট্রাকটি এসেছিল হিলি থেকে। এর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের মাইন ছিল। মাইনগুলো ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে পুরো ক্যাম্পে ধ্বংসের তুফান শুরু হয়। শব্দের সাথে সাথে চাকাত চাকাত আলোর কয়েকটা ঝলক দেখতে পাই। এরপর আর কিছু মনে নাই।

মো. আক্কাস আলী

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে আমার বসবাস ছিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার পিত্রালয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে আমি দিনাজপুরে এসে ভাইদের সাথে বসবাস করতে থাকি এবং সাধারণ মানুষের সাথে মিশে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

৬ জানুয়ারিও সকাল বেলা প্যারেড করি। ৬ জানুয়ারি বিকাল বেলা ঘোড়াঘাট থেকে উদ্ধার হওয়া দুই ট্রাক অস্ত্র ক্যাম্পের মাঠে আনা হয়েছিল। মাগরিবের নামাজ পড়তে আমি ওজু করতে যাই। মহারাজা স্কুল মাঠে এখন যেখানে মসজিদ রয়েছে, তখন সেখানেই একটি টিনের মসজিদ ছিল। আমি মসজিদের পাশে ওজু করার জন্য যখন বসেছি, ঠিক তখনি বিকট শব্দে পুরো মিলিশিয়া ক্যাম্প বিস্ফোরিত হলো। বিস্ফোরণের সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।

এ ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পর রাত ১২টার দিকে আমার চেতনা ফিরে আসে। চেতনা ফেরার পর নিজেকে দিনাজপুর সদর হাসপাতালে দেখতে পাই। তখনো পুরো শরীরে ধুলো-বালির আস্তরণ ছিল। সেই সাথে সারা শরীরে তীব্র ব্যথা হচ্ছিল। কিন্তু কেন আমার এ অবস্থা স্মরণে আসছিল না। আমি লোকজনকে জিজ্ঞাসা করি, কী ব্যাপার, কী হয়েছে, কেন আমি এখানে? লোকজন তখন জানান যে, মিলিশিয়া ক্যাম্পের অস্ত্রগুদাম বিস্ফোরিত হয়েছে। ক্যাম্পে আমি মাটির স্তূপে চাপা পড়েছিলাম। আমার মাথা ছাড়া পুরো শরীর মাটির তলে চাপা পড়েছিল। আমার সেন্স ছিল না। তারপরও গলার ভেতর থেকে এক ধরনের গোঙানির আওয়াজ হচ্ছিল। সেই আওয়াজ পেয়ে লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

অনীল কুমার রায়

আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজারামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ভারতের কাটলা ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সকালে দিনাজপুরে আসার পর আমি মহারাজা স্কুলের মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে যোগ দেই। তখন তো জানতাম না যে, সকালে যোগ দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ভয়ঙ্করতম পরিস্থিতির শিকার হতে হবে! আমি আমার গ্রুপ কমান্ডারের সাথে আলোচনা করে সকালে ক্যাম্পে যোগ দিয়ে নাম-ধাম তালিকাভুক্ত করিয়ে দুপুর বেলা শহর দেখতে বের হই। দুপুরের খাওয়া সারি হোটেলে। এরপর সন্ধ্যার আগে আবার ক্যাম্পে ফিরে যাই। ক্যাম্পে এসে বিকালের খাওয়া করি। খাওয়ার পর বাঁশি বাজিয়ে আমাদের রোল কল করা হয়। এরপর লাইনে দাঁড়াতে বলা হয়। আমি স্কুল ভবনের সামনে প্রথম লাইনে পূর্বমুখী হয়ে লাইনে দাঁড়াই। ওই সময় প্রায় ৩-৪শ’ মুক্তিযোদ্ধা সেখানে ছিলেন।

এ সময় দুটো বিকট আওয়াজ হলো। সাথে সাথে অগ্নিকুণ্ডলী, ধুম্রকুণ্ডলী, ধুলিকুণ্ডলী এমনভাবে আমাকে আক্রমণ করল যে, চোখ মেলে তাকানোর অবস্থা ছিল না। চোখ বন্ধ অবস্থায় অনুভব করলাম যে, আমার মাথায় ভীষণ জোরে কেউ যেন আঘাত করল। আমার ধারণা- এ অবস্থা ছিল ১৫-২০ মিনিট। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমার বোধ হয়েছিল, পাকিস্তানি সৈন্যরা বোধহয় আমাদের ওপর হামলা করেছে। তাই জীবন রক্ষার জন্য দৌড় দিলাম। আর দৌড় দিতে গিয়েই ধপাস করে পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে বুঝলাম যে, আমার পা ভেঙে গেছে, পায়ের ভাঙা অংশ ও ক্ষত দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে।

অবশেষে ঘণ্টাখানেক পর লোকজন এসে আমাকে উদ্ধার করলেন। যখন উদ্ধার করা হলো, তখনো চেতনায় ছিলাম। আমাকে উদ্ধার করে দিনাজপুর সদর হাসপাতালের ফ্লোরে এনে রাখা হলো। চিকিৎসা হওয়ার পরেও ব্লিডিং চলছিল। অবস্থার অবনতিতে আমাকে এবং আরো ২০-২৫ জন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ওই রাতেই রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো। রংপুরে এক মাস চিকিৎসা হয়েছে। এই এক মাস আমার জীবনের কঠিন সময় গেছে। এই এক মাসের একদিনেও ঘুমাতে পারিনি। জ¦লন্ত অগ্নির মতো প্রতিটি রাত কেটেছিল নির্ঘুম অবস্থায়।

সুধীর চন্দ্র রায়

১৯৭১ সালে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। ৬ জানুয়ারি সকাল ১০-১১টার দিকে আমি ও অনীল ক্যাম্পে যোগ দেই। সেখানে সারাদিন অবস্থান করি। বিকাল ৪টায় আমাদের খাবার দেয়া হয়। খাওয়া শেষ হলে আমাদের বিশ্রাম নিতে বলা হয়। আমরা স্কুলে একটি ঘরে বিশ্রাম নেই। বিকাল পৌনে ৬টার দিকে হুইসেল বাজানো হয়। হুইসেলের শব্দে আমরা আবার ঘর থেকে বের হয়ে আসি। তখন আমাদের নির্দেশ দেয়া হলে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়াই। লাইন তখনো কমপ্লিট হয় নাই। আর তখনি সেই ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু হয়। হঠাৎ মাইন বিস্ফোরণে ক্যাম্পের পুরো অস্ত্রভাণ্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় মিলিশিয়া ক্যাম্প। বিস্ফোরণের সাথে সাথে আমার চেতনা লোপ পেয়েছিল। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেকে উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। পুরো শরীর তখন রক্তাক্ত। বাম পা, বাম পাঁজরসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়েছে বুঝতে পারি। আমার আশপাশে যারা ছিলেন তাদেরও একই রকম বস্ত্রবিহীন ও রক্তাক্ত দেখতে পাই।

[লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক]

a.azadjewel@gmail.com