অস্তিত্ব সংকটে কালোমুখো হনুমান

সামসুজ্জামান

বিভিন্ন কারণে যশোর জেলার কেশবপুরে এবং চুয়াডাঙ্গায় বিরল প্রজাতির কালোমুখো হনুমান আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। অনেকে এই হনুমানকে ‘চশমা চোখা’ বলে থাকে। কারণ এদের কালো চোখ দেখলে মনে হয় চোখে সানগ্লাস পরা আছে। খাদ্যের অন্বেষণেই এরা এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। অথচ হনুমান মূলত সংঘবদ্ধ প্রাণী হিসেবে পরিচিত। এরা এতটাই সংঘবদ্ধ যে, এদের একজনকে কেউ আঘাত করলে দলবদ্ধভাবে এরা তার প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। এর প্রমাণও রয়েছে। একবার একটি বাচ্চা হনুমান যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক লাফদিয়ে পার হতে গিয়ে দ্রুতগামী বাসের নিচে পড়ে মৃত্যু হয়। মুহূর্তের মধ্যে শতাধিক হনুমান মৃত হনুমানকে ঘিরে রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকার-ইঙ্গিতে হত্যাকারীর বিচারের আশ্বাসের পর সেই অবরোধ উঠিয়ে নেয়।

এছাড়া ব্রহ্মকাটী গ্রামের এক ব্যক্তি তার বেগুনের ক্ষেত হনুমানের উপদ্রব থেকে রক্ষা করার জন্য তারের বেড়া বিদ্যুতায়িত করে রাখে। বিদ্যুতায়িত হয়ে একটি বাচ্চা হনুমান মারা যায়। পরদিন রাতে দলবদ্ধভাবে হনুমানের দল গিয়ে পুরো ক্ষেতের সব বেগুন গাছ উপড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। খাদ্যাভাব ছাড়াও নগরায়ণের কারণে বন জঙ্গলের বিলুপ্তিও এদের খাদ্য সংকটের আরেক কারণ। হনুমান সাধারণত ফলমূল খেয়েই জীবন ধারণ করে থাকে। কিন্তু এখন তারা বাধ্য হয়ে বাড়িঘর এবং বাজারের দোকান থেকে রুটি, বিস্কুট, কলা এমনকি পথচারীর হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে ক্ষুণি বৃত্তি নিবারণ করছে।

৮৪-৮৫ সালের জরিপে কেশবপুর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা, ব্র?হ্মকাটী, সুজাপুর, ভোগতী, রামচন্দ্রপুর এলাকায় সহস্রাধিক হনুমানের বিচরন ছিল। বর্তমানে সে সংখ্যা একশোর মধ্যে সীমিত হয়ে গেছে। জরিপে বিশ্বে ভারতের উড়িশ্যা এবং বাংলাদেশর কেশবপুর ও চুয়াডাঙ্গায় এই বিরল প্রজাতির হনুমানের অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান। আফ্রিকা এবং আমাজানের বিস্তীর্ণ অরণ্যেও এই হনুমান পাওয়া যায় না। হিন্দু সম্প্রদায় রামভক্ত হনুমান হিসাবে এই প্রজাতিকেই চি?িহ্নত করেছে।

ভারত সরকার অবশ্য উড়িষ্যার কালোমুখো হনুমানগুলোকে যতœআত্তি করে রাখে। ভারত এবং বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের কোথাও কালোমুখো বা চশমা চোখা হনুমানের দেখা মেলে না।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সরকারের হাতিসম একটি দপ্তরও আছে। কিন্তু তা শুধু কেতাবেই, গোয়লে নেই। এই দপ্তরটি হয়তো এদের কোন খবরও রাখে না। অথচ সরকার বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে পুশছে এই হাতির পাল। সরকারের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনও এই প্রজাতিটির ব্যাপারে নিষ্ঠুর আচরণ করছে। এক্ষেত্রে তদারকিরও কোন ব্যবস্থা নেই সরকারের পক্ষ থেকে।

এক সময় গাছে ক্ষেতে প্রচুর খাবার ছিল হনুমানের। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এসব খাবারের দিক থেকে। বন বিভাগের মাধ্যমে সরকারিভাবে অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহ করা হয় এদের মাঝে। বর্তমানে প্রতিদিন ৪০ কেজি কলা আড়াই কেজি বাদাম এবং আড়াই কেজি পাউরুটি দেয়া হচ্ছে এই শতাধিক হনুমানকে।

এই প্রজাতি রক্ষায় এখন সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন অভয়ারণ্য। যেখানে এরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারবে। আর এ ব্যবস্থা না হলে অচিরেই কালোমুখ বিরল প্রজাতির হনুমানের বিলুপ্তি ঘটবে।

বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২১ , ২৩ পৌষ ১৪২৭, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

অস্তিত্ব সংকটে কালোমুখো হনুমান

সামসুজ্জামান

বিভিন্ন কারণে যশোর জেলার কেশবপুরে এবং চুয়াডাঙ্গায় বিরল প্রজাতির কালোমুখো হনুমান আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। অনেকে এই হনুমানকে ‘চশমা চোখা’ বলে থাকে। কারণ এদের কালো চোখ দেখলে মনে হয় চোখে সানগ্লাস পরা আছে। খাদ্যের অন্বেষণেই এরা এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। অথচ হনুমান মূলত সংঘবদ্ধ প্রাণী হিসেবে পরিচিত। এরা এতটাই সংঘবদ্ধ যে, এদের একজনকে কেউ আঘাত করলে দলবদ্ধভাবে এরা তার প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। এর প্রমাণও রয়েছে। একবার একটি বাচ্চা হনুমান যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক লাফদিয়ে পার হতে গিয়ে দ্রুতগামী বাসের নিচে পড়ে মৃত্যু হয়। মুহূর্তের মধ্যে শতাধিক হনুমান মৃত হনুমানকে ঘিরে রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকার-ইঙ্গিতে হত্যাকারীর বিচারের আশ্বাসের পর সেই অবরোধ উঠিয়ে নেয়।

এছাড়া ব্রহ্মকাটী গ্রামের এক ব্যক্তি তার বেগুনের ক্ষেত হনুমানের উপদ্রব থেকে রক্ষা করার জন্য তারের বেড়া বিদ্যুতায়িত করে রাখে। বিদ্যুতায়িত হয়ে একটি বাচ্চা হনুমান মারা যায়। পরদিন রাতে দলবদ্ধভাবে হনুমানের দল গিয়ে পুরো ক্ষেতের সব বেগুন গাছ উপড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। খাদ্যাভাব ছাড়াও নগরায়ণের কারণে বন জঙ্গলের বিলুপ্তিও এদের খাদ্য সংকটের আরেক কারণ। হনুমান সাধারণত ফলমূল খেয়েই জীবন ধারণ করে থাকে। কিন্তু এখন তারা বাধ্য হয়ে বাড়িঘর এবং বাজারের দোকান থেকে রুটি, বিস্কুট, কলা এমনকি পথচারীর হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে ক্ষুণি বৃত্তি নিবারণ করছে।

৮৪-৮৫ সালের জরিপে কেশবপুর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা, ব্র?হ্মকাটী, সুজাপুর, ভোগতী, রামচন্দ্রপুর এলাকায় সহস্রাধিক হনুমানের বিচরন ছিল। বর্তমানে সে সংখ্যা একশোর মধ্যে সীমিত হয়ে গেছে। জরিপে বিশ্বে ভারতের উড়িশ্যা এবং বাংলাদেশর কেশবপুর ও চুয়াডাঙ্গায় এই বিরল প্রজাতির হনুমানের অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান। আফ্রিকা এবং আমাজানের বিস্তীর্ণ অরণ্যেও এই হনুমান পাওয়া যায় না। হিন্দু সম্প্রদায় রামভক্ত হনুমান হিসাবে এই প্রজাতিকেই চি?িহ্নত করেছে।

ভারত সরকার অবশ্য উড়িষ্যার কালোমুখো হনুমানগুলোকে যতœআত্তি করে রাখে। ভারত এবং বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের কোথাও কালোমুখো বা চশমা চোখা হনুমানের দেখা মেলে না।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সরকারের হাতিসম একটি দপ্তরও আছে। কিন্তু তা শুধু কেতাবেই, গোয়লে নেই। এই দপ্তরটি হয়তো এদের কোন খবরও রাখে না। অথচ সরকার বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে পুশছে এই হাতির পাল। সরকারের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনও এই প্রজাতিটির ব্যাপারে নিষ্ঠুর আচরণ করছে। এক্ষেত্রে তদারকিরও কোন ব্যবস্থা নেই সরকারের পক্ষ থেকে।

এক সময় গাছে ক্ষেতে প্রচুর খাবার ছিল হনুমানের। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এসব খাবারের দিক থেকে। বন বিভাগের মাধ্যমে সরকারিভাবে অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহ করা হয় এদের মাঝে। বর্তমানে প্রতিদিন ৪০ কেজি কলা আড়াই কেজি বাদাম এবং আড়াই কেজি পাউরুটি দেয়া হচ্ছে এই শতাধিক হনুমানকে।

এই প্রজাতি রক্ষায় এখন সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন অভয়ারণ্য। যেখানে এরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারবে। আর এ ব্যবস্থা না হলে অচিরেই কালোমুখ বিরল প্রজাতির হনুমানের বিলুপ্তি ঘটবে।