অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে মানব পাচার চক্র সক্রিয়

চাকরি প্রত্যাশীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নেয় বিপুল অর্থ 

অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে ৮ বছর ধরে দেশ থেকে মানব পাচার করছিল একটি চক্র। এ চক্রের সদস্যরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতো। ট্যুরিস্ট ভিসায় ভারতে নেয়ার পর নৌকায় করে শ্রীলঙ্কার গভীর জঙ্গলে নিয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের আটকে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতো বিপুল পরিমাণ অর্থ। চক্রটি এতোদিন ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাচারের শিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহসান হাবিবের করা মামলার তদন্তের সূত্র ধরে চক্রের ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গতকাল সিআইডির সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পাচারের শিকার ও পরে দেশে ফিরে আসা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আহসান হাবিবের মামলার সূত্র ধরে উত্তরার একটি অফিসে অভিযান চালায় সিআইডি। গ্রেফতার করা হয় হাবিবুর রহমান, মামুনুর রশিদ, জামাল হোসেন ও নাহিদুল ইসলাম পলাশ নামের ৪ জনকে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২৮টি পাসপোর্ট, বিভিন্ন দূতাবাস, ব্যাংক ও এজেন্সির ১৯টি সিলমোহর এবং কম্বোডিয়ার ১০টি জাল ভিসা উদ্ধার করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার হাতুরাবাড়ির বাসিন্দা বেকার যুবক আহসান হাবিবকে ইউরোপ অঞ্চলের দেশ মাল্টায় পাঠানোর জন্য একই এলাকার দালাল মামুন ১২ লাখ টাকা চুক্তি করে। ৮ লাখ টাকা নেয়ার পর উত্তরার একটি অনুমোদনহীন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে পাসপোর্ট করে ট্যুরিস্ট ভিসায় আহসান হাবিবকে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতের কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে ট্রেনে হায়দরাবাদে নেয়া হয়। সেখানে আহসান হাবিব আরও ২৫ জন বাংলাদেশিকে দেখতে পায়। যাদের প্রত্যেককে ইউরোপ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে পাঠানো জন্য বাংলাদেশ থেকে নেয়া হয়েছিল। পরে আহসান হাবিবকে একটি কক্ষে আটকে রেখে বাংলাদেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে চক্রের সদস্যরা ৪ লাখ টাকা আদায় করেন। এরপর সেখান থেকে ২৬ বাংলাদেশিকে নৌকাযোগে শ্রীলঙ্কার একটি জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া যায়। সেখানে প্রত্যেককে বেধরক মারধর করা হয়। পরে জঙ্গলে ফেলে রাখলে আহসান হাবিব কৌশলে পালিয়ে শ্রীলঙ্কার এক নাগরিকের কাছে আশ্রয় নেয়। এরপর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফিরে এসে মামলা করে।

আহসান হাবিবের তথ্য অনুযায়ী বেনাপোল নিয়ে যাওয়ার পর পর ভারতীয় এক দালাল চক্রের কাছে তাকে তুলে দেয়া হয়। ওই দালাল হায়দ্রাবাদে নিয়ে সেখানকার এক দালালের কাছে তুলে দেয়। হায়দ্রাবাদের দালাল নৌকাযোগে আহসান হাবিবসহ ২৬ জনকে শ্রীলঙ্কার এক দালাল চক্রের কাছে তুলে দেয়। শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে নিয়ে প্রত্যেককে নির্যাতন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এ চক্রের হোতা হাবিবুর রহমান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো। পরে সে অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তিদের টার্গেট করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহসান হাবিব ছাড়াও ৪ জন ভিকটিম পাওয়া গেছে তাদের থেকে ১২ থেকে ২৭ লাখ করে টাকা নিয়েছে চক্রটি।

এই চক্রে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের দালাল চক্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই চক্রটি ঘন ঘন অফিস ও মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করতো।

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, সেসব জঙ্গল থেকে কেউ কেউ কৌশলে পালিয়ে আসলেও অনেকেই তাদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতো।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া ভুক্তভোগীদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার হাতুড়াবাড়ি গ্রামের আহসান হাবীব বলেন, স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় বাড়িতে ফোন করে ৩৩ হাজার টাকা এনে দেশে ফিরে আসি। চক্রের প্রতারণার শিকার ইকবাল জানান, তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউরা। তিনি পার্শ্ববর্তী থানা এলাকার মামুনকে বাড়িঘর বিক্রি করে ১২ লাখ টাকা দিয়েছেন ৩ বছর আগে। কিন্তু যেতে পারেননি। একই কথা বলেন প্রতারণার শিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আল আমিন, মাল্টায় পাঠানোর কথা বলে তার কাছ থেকে ২৭ লাখ টাকা নিয়েছে চক্রটি।

এ প্রসঙ্গে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি, এই চক্রটি এ কাজে ছয় থেকে সাত বছর ধরে জড়িত। আরও তথ্য পেয়েছি, তারা ১০০ জনের মতো লোক পাচার করেছে।

শুক্রবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২১ , ২৪ পৌষ ১৪২৭, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে মানব পাচার চক্র সক্রিয়

চাকরি প্রত্যাশীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নেয় বিপুল অর্থ 

অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে ৮ বছর ধরে দেশ থেকে মানব পাচার করছিল একটি চক্র। এ চক্রের সদস্যরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতো। ট্যুরিস্ট ভিসায় ভারতে নেয়ার পর নৌকায় করে শ্রীলঙ্কার গভীর জঙ্গলে নিয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের আটকে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতো বিপুল পরিমাণ অর্থ। চক্রটি এতোদিন ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাচারের শিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহসান হাবিবের করা মামলার তদন্তের সূত্র ধরে চক্রের ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গতকাল সিআইডির সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পাচারের শিকার ও পরে দেশে ফিরে আসা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আহসান হাবিবের মামলার সূত্র ধরে উত্তরার একটি অফিসে অভিযান চালায় সিআইডি। গ্রেফতার করা হয় হাবিবুর রহমান, মামুনুর রশিদ, জামাল হোসেন ও নাহিদুল ইসলাম পলাশ নামের ৪ জনকে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২৮টি পাসপোর্ট, বিভিন্ন দূতাবাস, ব্যাংক ও এজেন্সির ১৯টি সিলমোহর এবং কম্বোডিয়ার ১০টি জাল ভিসা উদ্ধার করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার হাতুরাবাড়ির বাসিন্দা বেকার যুবক আহসান হাবিবকে ইউরোপ অঞ্চলের দেশ মাল্টায় পাঠানোর জন্য একই এলাকার দালাল মামুন ১২ লাখ টাকা চুক্তি করে। ৮ লাখ টাকা নেয়ার পর উত্তরার একটি অনুমোদনহীন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে পাসপোর্ট করে ট্যুরিস্ট ভিসায় আহসান হাবিবকে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতের কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে ট্রেনে হায়দরাবাদে নেয়া হয়। সেখানে আহসান হাবিব আরও ২৫ জন বাংলাদেশিকে দেখতে পায়। যাদের প্রত্যেককে ইউরোপ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে পাঠানো জন্য বাংলাদেশ থেকে নেয়া হয়েছিল। পরে আহসান হাবিবকে একটি কক্ষে আটকে রেখে বাংলাদেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে চক্রের সদস্যরা ৪ লাখ টাকা আদায় করেন। এরপর সেখান থেকে ২৬ বাংলাদেশিকে নৌকাযোগে শ্রীলঙ্কার একটি জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া যায়। সেখানে প্রত্যেককে বেধরক মারধর করা হয়। পরে জঙ্গলে ফেলে রাখলে আহসান হাবিব কৌশলে পালিয়ে শ্রীলঙ্কার এক নাগরিকের কাছে আশ্রয় নেয়। এরপর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফিরে এসে মামলা করে।

আহসান হাবিবের তথ্য অনুযায়ী বেনাপোল নিয়ে যাওয়ার পর পর ভারতীয় এক দালাল চক্রের কাছে তাকে তুলে দেয়া হয়। ওই দালাল হায়দ্রাবাদে নিয়ে সেখানকার এক দালালের কাছে তুলে দেয়। হায়দ্রাবাদের দালাল নৌকাযোগে আহসান হাবিবসহ ২৬ জনকে শ্রীলঙ্কার এক দালাল চক্রের কাছে তুলে দেয়। শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে নিয়ে প্রত্যেককে নির্যাতন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এ চক্রের হোতা হাবিবুর রহমান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো। পরে সে অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তিদের টার্গেট করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহসান হাবিব ছাড়াও ৪ জন ভিকটিম পাওয়া গেছে তাদের থেকে ১২ থেকে ২৭ লাখ করে টাকা নিয়েছে চক্রটি।

এই চক্রে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের দালাল চক্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই চক্রটি ঘন ঘন অফিস ও মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করতো।

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, সেসব জঙ্গল থেকে কেউ কেউ কৌশলে পালিয়ে আসলেও অনেকেই তাদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতো।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া ভুক্তভোগীদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার হাতুড়াবাড়ি গ্রামের আহসান হাবীব বলেন, স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় বাড়িতে ফোন করে ৩৩ হাজার টাকা এনে দেশে ফিরে আসি। চক্রের প্রতারণার শিকার ইকবাল জানান, তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউরা। তিনি পার্শ্ববর্তী থানা এলাকার মামুনকে বাড়িঘর বিক্রি করে ১২ লাখ টাকা দিয়েছেন ৩ বছর আগে। কিন্তু যেতে পারেননি। একই কথা বলেন প্রতারণার শিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আল আমিন, মাল্টায় পাঠানোর কথা বলে তার কাছ থেকে ২৭ লাখ টাকা নিয়েছে চক্রটি।

এ প্রসঙ্গে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি, এই চক্রটি এ কাজে ছয় থেকে সাত বছর ধরে জড়িত। আরও তথ্য পেয়েছি, তারা ১০০ জনের মতো লোক পাচার করেছে।