২০০ পরিবারের জীবিকার মাধ্যম গোলের রস

পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর, নেয়ামতপুর ও তাহেরপুরের ২০০ পরিবারের জীবন-জীবিকার উৎস প্রাকৃতিক সম্পদ গোল গাছের রস। প্রতি বছর এই মৌসুমে গাছিরা রস সংগ্রহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ম্যানগ্রোভ জাতীয় গোলগাছ এখন স্থানীয়দের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে বেশ পরিচিত গোল গাছ।

গোলগাছ ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের পাম জাতীয় একটি গাছ। নামে গোলগাছ হলেও এ গাছটির পাতা গোল নয়। প্রকৃতভাবে গাছটির পাতা নারিকেল গাছের পাতার মতো লম্বা। কাদামাটি থেকে অনেক শাখা আর পাতা সোজা আকাশ পানে উঠে। বেশ ঘনত্বে লবণ পানির শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠে এ গাছ। উপকূলীয় জনজীবনের সঙ্গে মিশে আছে এ গোল গাছ। যুগ যুগ ধরে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছে উপকূলীয় অঞ্চলে। লবণ পানির শক্তিতে বেড়ে উঠা গাছ থেকে বের হওয়া এক অদ্ভুত সুমিষ্ট রস। খেজুর রসের চেয়ে অনেক ঘনত্ব।

গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৬ ফোঁটা খেজুর রসে যেখানে ১ ফোঁটা গুড় হয় সেখানে ৮ ফোঁটা গোল রসে ১ ফোঁটা গুড় হয়। এ গাছের উচ্চতা প্রায় ১৫ থেকে ১৮ ফুটের বেশি। আষাঢ় মাসে গোলপাতা গাছে ফল আসার পর পৌষ মাসে ফলসহ কাঁধি মাটিচাপা দিয়ে নুইয়ে রাখতে হয়। অগ্রহায়ণের শুরু থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত কাঁধির ডাণ্ডিতে পা দিয়ে মৃদু ম্যাসেজ করতে হয়। ১৫ দিন পর ফলের থোকা কেটে নিতে হয় ডাণ্ডিটা রেখে। ডাণ্ডির মাথা কাটার ৩ দিন পর্যন্ত শুকাতে হয়।

এরপর প্রতিদিন বিকেলে ডাণ্ডির মাথা সামান্য কেটে গোল গাছের চটি দিয়েই বেধে রেখে রস সংগ্রহ করে গাছিরা। এভাবে অগ্রহায়ণের ১৫ থেকে চৈত্রের ১৫ তারিখ পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি ডাণ্ডি থেকে প্রতিদিন ৩০০-৫০০ গ্রামের মতো রস সংগ্রহ করা হয়। এক একজন চাষির ২০০-২৫০টি ডাণ্ডি রাখে কাটার জন্য। এক একজন চাষি ১২০-১৫০ কেজি রস সংগ্রহ করে প্রতিদিন। এই রস থেকে ১৫-২০ কেজি গুড় তৈরি করে। এক কেজি গুড়ের বাজারমূল্য এখন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। দিনে কম বেশি ১৫০০-২০০ টাকা আয় করতে পারেন।

এখন চলছে গোল গাছের রস সংগ্রহের মৌসুম। শীত উপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে ঘর থেকে বেরিয়ে গোলের রস সংগ্রহের ব্যস্ত থাকে গোল গাছিরা। দম ফালানোর ফুরসত নেই। বাড়ির আঙিনায় চুলায় জাল দিয়ে চলছে রস দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। আর সেই গুড় কলাপাড়া বাজারসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করছেন চাষিরা। গোল চাষে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয় না। সহজলভ্য এবং ব্যয় কম হওয়ায় চাষাবাদ অত্যন্ত লাভজনক। গোলগাছ চাষে রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। এছাড়া গোলের গুড় কৃমিনাশক বলে অনেকে মনে করছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনের আগে লাগানো এই গোলগাছ। এ জনপদের সর্বত্র রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনসহ নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরের ছাউনি হিসেবে গোলপাতা ব্যবহার করে। এছাড়া শীত মৌসুমে গোলবাগানের মালিকরা এর রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করে থাকেন। রস দিয়ে সুস্বাদু পায়েস তৈরি করা হয়। সংশ্লিষ্ট কৃষকের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, উপকূলীয় এলাকায় যেসব গোলগাছের বাগান রয়েছে, তা প্রকৃতির দান। এই গাছের সব কিছুই কাজে ব্যবহৃত হয়। আমরা রস পাই, ঘরের বেড়া ও ছাউনি দিতে পারি। মাঝরা দিয়ে দড়ি বানানো, লাকড়ি বানানোসহ নানাবিধ কাজে লাগাই।

কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের গোলচাষি খগেন বিশ্বাস (৫০) বলেন, আমার বাবা ব্রিটিশ পিরিয়ডের সময় এই দেশে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেন। তখন গোলগাছ থেকে রস কিভাবে তৈরি করতেন তা আমাদের শিখিয়ে গেছেন। এখন আমার ছেলে, মেয়েকে রস থেকে গুড় করা শিখিয়েছি। আমি গাছ থেকে রস এনে দেই বাকি কাজটা পরিবারের সবাই করে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অখিল মজুমদারের স্ত্রী সুবর্ণা তাফালে গোলের মুথা ও পাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ঢোঙ্গায় রস দিয়ে গুড় তৈরি করছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বিয়ের পর থেকেই আমার শাশুড়িকে দেখি প্রতি বছর এই সময় রস জ্বাল দিতে। আবার তা দিয়ে গুড় তৈরি করতে। শাশুড়ি রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করার নিয়ম আমাকে শিখিয়েছেন। এখন আমি রস দিয়ে গুড় তৈরি করতে পারি।

গোলচাষি নির্মল চন্দ্র বলেন, ‘এখন বাজারে গিয়ে গুড় বিক্রি করতে হয় না। অনেক খুচরা বিক্রেতা বাড়িতে এসেই গুড় নিয়ে যান। প্রতি কেজি ১৫০ টাকায় বিক্রি করি। আর আমাদের দেশের লোক বিদেশে গুড় নিয়ে যায়। এই গুর এক বছরের নষ্ট হয় না।’

ক্রেতা মোবারক বলেন, ‘অন্য গুড়ের চেয়ে আলাদা স্বাদযুক্ত, সাশ্রয়ী হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকে বলে গোলের গুড়ের ব্যাপক চাহিদা।’

উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মন্নান বলেন, ‘গোল গাছে পরিচর্ষা করতে তেমন কোন খরচ নেই। গুড় উৎপাদন ছাড়াও রয়েছে এ গাছের বহুবিধ ব্যবহার। এ অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদা থাকার ফলে চাষিরা লাভবান হচ্ছে।’

image
আরও খবর
বিদ্রোহী প্রার্থীদের সতর্ক করল আ’লীগ
’৭১-এ গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার তাগিদ বাংলাদেশের
সরকারি অর্থের অপচয় : সিইসির বিরুদ্ধে তদন্ত দাবি ১০ আইনজীবীর
দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহনের বাড়ি দখলের চেষ্টায় নেপথ্যে কে?
এসএমপির সব থানার ওসিকে একযোগে বদলির নতুন রেকর্ড
বোরো মৌসুমের সেচ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে
অপরিকল্পিত ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে সহযোগিতা চান মন্ত্রী
রাজাকারদের উত্তরাধিকারের আ’লীগের মনোনয়ন না দেয়ার দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের
উপাচার্যের দীর্ঘ অনুপস্থিতি ও দুর্নীতির প্রতিবাদে উপ-উপাচার্যকে অবরুদ্ধ
একটি স্কুলে আয়া নিয়োগে ১০ লাখ টাকা!
চলন্ত ট্রেন থেকে ছুড়ে নবজাতক হত্যা
করোনা আক্রান্ত রোগীদের বন্ধু ওসি মহসিন

শুক্রবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২১ , ২৪ পৌষ ১৪২৭, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

২০০ পরিবারের জীবিকার মাধ্যম গোলের রস

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)

image

পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর, নেয়ামতপুর ও তাহেরপুরের ২০০ পরিবারের জীবন-জীবিকার উৎস প্রাকৃতিক সম্পদ গোল গাছের রস। প্রতি বছর এই মৌসুমে গাছিরা রস সংগ্রহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ম্যানগ্রোভ জাতীয় গোলগাছ এখন স্থানীয়দের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে বেশ পরিচিত গোল গাছ।

গোলগাছ ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের পাম জাতীয় একটি গাছ। নামে গোলগাছ হলেও এ গাছটির পাতা গোল নয়। প্রকৃতভাবে গাছটির পাতা নারিকেল গাছের পাতার মতো লম্বা। কাদামাটি থেকে অনেক শাখা আর পাতা সোজা আকাশ পানে উঠে। বেশ ঘনত্বে লবণ পানির শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠে এ গাছ। উপকূলীয় জনজীবনের সঙ্গে মিশে আছে এ গোল গাছ। যুগ যুগ ধরে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছে উপকূলীয় অঞ্চলে। লবণ পানির শক্তিতে বেড়ে উঠা গাছ থেকে বের হওয়া এক অদ্ভুত সুমিষ্ট রস। খেজুর রসের চেয়ে অনেক ঘনত্ব।

গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৬ ফোঁটা খেজুর রসে যেখানে ১ ফোঁটা গুড় হয় সেখানে ৮ ফোঁটা গোল রসে ১ ফোঁটা গুড় হয়। এ গাছের উচ্চতা প্রায় ১৫ থেকে ১৮ ফুটের বেশি। আষাঢ় মাসে গোলপাতা গাছে ফল আসার পর পৌষ মাসে ফলসহ কাঁধি মাটিচাপা দিয়ে নুইয়ে রাখতে হয়। অগ্রহায়ণের শুরু থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত কাঁধির ডাণ্ডিতে পা দিয়ে মৃদু ম্যাসেজ করতে হয়। ১৫ দিন পর ফলের থোকা কেটে নিতে হয় ডাণ্ডিটা রেখে। ডাণ্ডির মাথা কাটার ৩ দিন পর্যন্ত শুকাতে হয়।

এরপর প্রতিদিন বিকেলে ডাণ্ডির মাথা সামান্য কেটে গোল গাছের চটি দিয়েই বেধে রেখে রস সংগ্রহ করে গাছিরা। এভাবে অগ্রহায়ণের ১৫ থেকে চৈত্রের ১৫ তারিখ পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি ডাণ্ডি থেকে প্রতিদিন ৩০০-৫০০ গ্রামের মতো রস সংগ্রহ করা হয়। এক একজন চাষির ২০০-২৫০টি ডাণ্ডি রাখে কাটার জন্য। এক একজন চাষি ১২০-১৫০ কেজি রস সংগ্রহ করে প্রতিদিন। এই রস থেকে ১৫-২০ কেজি গুড় তৈরি করে। এক কেজি গুড়ের বাজারমূল্য এখন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। দিনে কম বেশি ১৫০০-২০০ টাকা আয় করতে পারেন।

এখন চলছে গোল গাছের রস সংগ্রহের মৌসুম। শীত উপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে ঘর থেকে বেরিয়ে গোলের রস সংগ্রহের ব্যস্ত থাকে গোল গাছিরা। দম ফালানোর ফুরসত নেই। বাড়ির আঙিনায় চুলায় জাল দিয়ে চলছে রস দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। আর সেই গুড় কলাপাড়া বাজারসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করছেন চাষিরা। গোল চাষে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয় না। সহজলভ্য এবং ব্যয় কম হওয়ায় চাষাবাদ অত্যন্ত লাভজনক। গোলগাছ চাষে রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। এছাড়া গোলের গুড় কৃমিনাশক বলে অনেকে মনে করছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনের আগে লাগানো এই গোলগাছ। এ জনপদের সর্বত্র রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনসহ নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরের ছাউনি হিসেবে গোলপাতা ব্যবহার করে। এছাড়া শীত মৌসুমে গোলবাগানের মালিকরা এর রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করে থাকেন। রস দিয়ে সুস্বাদু পায়েস তৈরি করা হয়। সংশ্লিষ্ট কৃষকের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, উপকূলীয় এলাকায় যেসব গোলগাছের বাগান রয়েছে, তা প্রকৃতির দান। এই গাছের সব কিছুই কাজে ব্যবহৃত হয়। আমরা রস পাই, ঘরের বেড়া ও ছাউনি দিতে পারি। মাঝরা দিয়ে দড়ি বানানো, লাকড়ি বানানোসহ নানাবিধ কাজে লাগাই।

কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের গোলচাষি খগেন বিশ্বাস (৫০) বলেন, আমার বাবা ব্রিটিশ পিরিয়ডের সময় এই দেশে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেন। তখন গোলগাছ থেকে রস কিভাবে তৈরি করতেন তা আমাদের শিখিয়ে গেছেন। এখন আমার ছেলে, মেয়েকে রস থেকে গুড় করা শিখিয়েছি। আমি গাছ থেকে রস এনে দেই বাকি কাজটা পরিবারের সবাই করে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অখিল মজুমদারের স্ত্রী সুবর্ণা তাফালে গোলের মুথা ও পাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ঢোঙ্গায় রস দিয়ে গুড় তৈরি করছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বিয়ের পর থেকেই আমার শাশুড়িকে দেখি প্রতি বছর এই সময় রস জ্বাল দিতে। আবার তা দিয়ে গুড় তৈরি করতে। শাশুড়ি রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করার নিয়ম আমাকে শিখিয়েছেন। এখন আমি রস দিয়ে গুড় তৈরি করতে পারি।

গোলচাষি নির্মল চন্দ্র বলেন, ‘এখন বাজারে গিয়ে গুড় বিক্রি করতে হয় না। অনেক খুচরা বিক্রেতা বাড়িতে এসেই গুড় নিয়ে যান। প্রতি কেজি ১৫০ টাকায় বিক্রি করি। আর আমাদের দেশের লোক বিদেশে গুড় নিয়ে যায়। এই গুর এক বছরের নষ্ট হয় না।’

ক্রেতা মোবারক বলেন, ‘অন্য গুড়ের চেয়ে আলাদা স্বাদযুক্ত, সাশ্রয়ী হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকে বলে গোলের গুড়ের ব্যাপক চাহিদা।’

উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মন্নান বলেন, ‘গোল গাছে পরিচর্ষা করতে তেমন কোন খরচ নেই। গুড় উৎপাদন ছাড়াও রয়েছে এ গাছের বহুবিধ ব্যবহার। এ অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদা থাকার ফলে চাষিরা লাভবান হচ্ছে।’