ফাইজারের সীমিত সংখ্যক টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাড়ে ৩ লাখ মানুষের জন্য ৭ লাখ ডোজ

বাংলাদেশ ‘কোভ্যাক্স’ সুবিধার আওতায় ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র সীমিত সংখ্যক করোনার টিকা পাচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষের জন্য ‘ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা দেবে ‘কোভাক্স’, যা ফ্রন্টলাইনের (সম্মুখসারির) স্বাস্থ্যকর্মীদের দেয়া হবে। বাংলাদেশ ফাইজারের এই টিকা ক্রয় করতে যাচ্ছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে। আজকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা বাংলাদেশের কেনা উচিত বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হলে সাড়ে তিন লাখ মানুষের জন্য সাত লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা কিনতে পারবে বাংলাদেশ।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও), বিশ্বের অপেক্ষাকৃত স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে স্বল্পমূল্যে টিকা দেয়ার লক্ষ্যে গ্যাভি (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) এবং সংক্রামক রোগের টিকা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সংস্থার (সিইপিআই) নেতৃত্বে করোনার টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের বৈশ্বিক উদ্যোগে কোভ্যাক্স গড়ে উঠেছে।

‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটির (কোভ্যাক্স) সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আট কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) কেনার চুক্তি করেছে, যেসব টিকা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে। এসব টিকা সাধারণ রেফ্রিজারেটরেই সংরক্ষণ করা যায়।

কিন্তু ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। তা না হলে টিকার গুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফাইজারের টিকা প্রয়োগের জন্য যে সুই-সিরিঞ্জ দরকার হয়, তা প্রচলিত সুই-সিরিঞ্জের চেয়ে আলাদা।

বাংলাদেশ ‘ফাইজার’র টিকা কেনার ‘অফার’ পেয়েছে কীনা এবং তা পেলে কিনবে কীনা- জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রফেসর ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘ফাইজারের পক্ষ্য থেকে আমাদের অফার করা হয়নি, কোভাক্স’র পক্ষ্য থেকে অফার করা হয়েছে। কোভ্যাক্স দেশের মোট সংখ্যার পয়েন্ট ২৫ শতাংশকে মানুষকে অর্থাৎ যারা ফ্রন্টালাইনের স্বাস্থ্যকর্মী বা এই দায়িত্বপালন করছেন তাদের জন্য ‘ফাইজার’র টিকা দেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।’

ফাইজার-বায়োএনটেক’র টিকা দেশে সংরক্ষণের সক্ষমতা বা ব্যবস্থাপনা রয়েছে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা সীমিত সংখ্যাক টিকা দিচ্ছে, তা সংরক্ষণের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। এজন্য নতুন কিছু করতে হবে না। এই টিকা কেনা যায়, আমরা এ সংক্রান্ত কাগজপত্র সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এক্সফ্লোর (উপস্থাপন) করছি।’

জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি ফাইজার যৌথভাবে করোনার টিকা উদ্ভাবন করেছে, যার বাণিজ্যিক নাম ‘কমিরনাটি’। যুক্তরাজ্য প্রথম এই টিকার অনুমোদন দেয়। ডব্লিওএইচও টিকাটি মানবদেহে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে এ টিকার প্রয়োগ চলছে।

ফাইজারের টিকা বাংলাদেশের কেনা উচিত কীনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ড. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘এটি নেয়া উচিত। প্রয়োজনে সক্ষমতা কিছুটা বাড়াতে হবে। কারণ ফাইজার পরবর্তী যে জেনারেশনটা আনতে যাচ্ছে যেখানে এখন যে তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণ করতে হয়, যেখানে এই তাপমাত্রার প্রয়োজন হবে না। প্লাস ২ থেকে ২৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখা যাবে। সুতরাং আমার মনে হয়, ফাইজারের টিকা নেয়া উচিত। তা না হলে পরবর্তীতে আমরা বঞ্চিত হতে পারি।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে জানান, ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গতকালও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ফাইজারের টিকা কেনার ব্যাপারে সরকার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সহায়তা চাইবে। আজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে টিকা বিষয়ে একটি সভা হওয়ার কথা, সেখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশ কোভ্যাক্স সুবিধায় ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা ফেব্রুয়ারির প্রথমেই পেতে পারে। বাংলাদেশ এই টিকা নিতে চায় কিনা তা ১৮ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে হবে। গতকাল পর্যন্ত ফাইজারের টিকা কিনতে নীতিগতভাবে সম্মত স্বাস্থ্য অধিদফতর।

৬ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ কোভ্যাক্স উদ্যোগের ১৯২টি সদস্যদেশকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ বা ফেব্রুয়ারিতে কোভ্যাক্স-এর উদ্যোগে স্বল্পসংখ্যক টিকা দেয়া হবে। এই টিকা পেতে কিছু শর্ত মানতে হবে বাংলাদেশকে। এই টিকা ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে, জাতীয় করোনা টিকা পরিকল্পনায় একাধিক ধরনের টিকা ব্যবহারের ইচ্ছার প্রকাশ থাকতে হবে, ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফাইজারের টিকার অনুমোদন করাতে হবে এবং এর সঙ্গে ফাইজারের দায়মুক্তির একটি ব্যবস্থা থাকতে হবে।

চিঠিতে গ্যাভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেথ বার্কলি বলেছেন, ফাইজার এবং যেসব দেশ ফাইজারের টিকা সংগ্রহ করেছে, তাদের সঙ্গে কোভ্যাক্স টিকার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছে। তার ভিত্তিতে কোভ্যাক্স জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বা ফেব্রুয়ারিতে সদস্যদেশগুলোকে টিকা দিতে পারবে।

ওই চিঠিতে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলা হয়েছে, ১৮ জানুয়ারির মধ্যে সদস্যদেশগুলোকে আগ্রহের বিষয়টি কোভ্যাক্সকে জানাতে হবে। ১৯ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ বা গ্যাভিসংশ্লিষ্ট দেশের আগ্রহপত্র ও অবকাঠামো পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং ২৯ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম ঢেউয়ের টিকা বিতরণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে এবং সদস্যদেশগুলোকে জানিয়ে দেবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), আইইডিসিআর’ ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় টিকা সংক্ষণ করার মতো রেফ্রিজারেটর আছে।

টিকা নিতে অ্যাপসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন

করোনা ভ্যাকসিন নিতে হলে প্রত্যেককে অ্যাপসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রফেসর মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

তিনি গতকাল স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘অ্যাপসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করেই প্রত্যেককে ভ্যাকসিন নিতে হবে। করোনা ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য অ্যাপস তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে।’

অ্যাপসের মাধ্যমে ভ্যাকসিন গ্রহণের সময় পরবর্তীতে জানিয়ে দেয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে ভ্যাকসিন পেতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। প্রথম ধাপে ফেব্রুয়ারিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে অক্সফোর্ডের করোনা ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।

ফাইজার বিনামূল্যে টিকা দিবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন বলেছেন, আমাদের দেশকে অনেকেই ভ্যাকসিন দিতে চাচ্ছে। চায়না, রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্যাকসিন দিতে চাচ্ছে। ভ্যাকসিনের জন্য আমরা সব দরজা খুলে রেখেছি। ফাইজার কোম্পানি থেকে বিনামূল্যে কিছু ভ্যাকসিন দিতে চাচ্ছে। এই ভ্যাকসিন আমরা গ্রহণ করব।

টিকা এলে প্রথমে সম্মুখসারির যোদ্ধাদের আগে দেয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।

গতকাল মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার শুভ্র সেন্টারে শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

জাহিদ মালেক বলেন, আমরা আশা করছি, চলতি মাসের শেষে অথবা সামনের মাসের প্রথম দিকেই বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পেয়ে যাবে। ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের কোন অভাব হবে না। আমাদের দেশে করোনার কোন ওয়েভ নাই, আমরা কোন দ্বিতীয় ওয়েব দেখতে পাইনি উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ আগের তুলনায় কমে গেছে। সংক্রমণের হার এখন সাড়ে পাঁচ শতাংশ, সুস্থতার হার ৯০ শতাংশ এবং মৃত্যুর হারও কমে গেছে। তিনি বলেন, যেভাবে আমেরিকাতে প্রত্যেকদিন চার হাজার লোক মারা যায়, পুরো বিশ্বে প্রায় ১০ হাজারের অধিক লোক মারা যায়, সেখানে আমাদের দেশে এখন মৃত্যুহার খুবই অল্প। দেশে গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন লোক মারা যাচ্ছে।’

করোনায় দেশে একটি লোকের মৃত্যুও কাম্য নয় জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা সবাই মাস্ক ব্যবহার করি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি এবং প্রত্যেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখি। যার ফলে বাংলাদেশ ভালো আছে। এছাড়া অর্থনীতিও ভালো আছে। পৃথিবীর সব দেশ যেখানে মাইনাসে চলে গেছে সেখানে আমাদের অর্থনীতি প্লাসে আছে। করোনার সময় কেউ না খেয়ে থাকে নাই, কেউ গৃহহীন হয় নাই। সবাই ভালো আছে, আমরা এই অবস্থায় রাখতে চাই। অনুষ্ঠানে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস, পুলিশ সুপার রিফাত রহমান শামীম, জেলা জজ কোর্টের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুুস সালাম, সাটুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ ফটোসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য শেষে মন্ত্রী মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া উপজেলার দেড় হাজার দুস্থ মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণ করেন।

রবিবার, ১০ জানুয়ারী ২০২১ , ২৬ পৌষ ১৪২৭, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

ফাইজারের সীমিত সংখ্যক টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাড়ে ৩ লাখ মানুষের জন্য ৭ লাখ ডোজ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

বাংলাদেশ ‘কোভ্যাক্স’ সুবিধার আওতায় ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র সীমিত সংখ্যক করোনার টিকা পাচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষের জন্য ‘ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা দেবে ‘কোভাক্স’, যা ফ্রন্টলাইনের (সম্মুখসারির) স্বাস্থ্যকর্মীদের দেয়া হবে। বাংলাদেশ ফাইজারের এই টিকা ক্রয় করতে যাচ্ছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে। আজকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা বাংলাদেশের কেনা উচিত বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হলে সাড়ে তিন লাখ মানুষের জন্য সাত লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা কিনতে পারবে বাংলাদেশ।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও), বিশ্বের অপেক্ষাকৃত স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে স্বল্পমূল্যে টিকা দেয়ার লক্ষ্যে গ্যাভি (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) এবং সংক্রামক রোগের টিকা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সংস্থার (সিইপিআই) নেতৃত্বে করোনার টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের বৈশ্বিক উদ্যোগে কোভ্যাক্স গড়ে উঠেছে।

‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটির (কোভ্যাক্স) সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আট কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) কেনার চুক্তি করেছে, যেসব টিকা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে। এসব টিকা সাধারণ রেফ্রিজারেটরেই সংরক্ষণ করা যায়।

কিন্তু ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। তা না হলে টিকার গুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফাইজারের টিকা প্রয়োগের জন্য যে সুই-সিরিঞ্জ দরকার হয়, তা প্রচলিত সুই-সিরিঞ্জের চেয়ে আলাদা।

বাংলাদেশ ‘ফাইজার’র টিকা কেনার ‘অফার’ পেয়েছে কীনা এবং তা পেলে কিনবে কীনা- জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রফেসর ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘ফাইজারের পক্ষ্য থেকে আমাদের অফার করা হয়নি, কোভাক্স’র পক্ষ্য থেকে অফার করা হয়েছে। কোভ্যাক্স দেশের মোট সংখ্যার পয়েন্ট ২৫ শতাংশকে মানুষকে অর্থাৎ যারা ফ্রন্টালাইনের স্বাস্থ্যকর্মী বা এই দায়িত্বপালন করছেন তাদের জন্য ‘ফাইজার’র টিকা দেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।’

ফাইজার-বায়োএনটেক’র টিকা দেশে সংরক্ষণের সক্ষমতা বা ব্যবস্থাপনা রয়েছে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা সীমিত সংখ্যাক টিকা দিচ্ছে, তা সংরক্ষণের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। এজন্য নতুন কিছু করতে হবে না। এই টিকা কেনা যায়, আমরা এ সংক্রান্ত কাগজপত্র সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এক্সফ্লোর (উপস্থাপন) করছি।’

জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি ফাইজার যৌথভাবে করোনার টিকা উদ্ভাবন করেছে, যার বাণিজ্যিক নাম ‘কমিরনাটি’। যুক্তরাজ্য প্রথম এই টিকার অনুমোদন দেয়। ডব্লিওএইচও টিকাটি মানবদেহে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে এ টিকার প্রয়োগ চলছে।

ফাইজারের টিকা বাংলাদেশের কেনা উচিত কীনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ড. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘এটি নেয়া উচিত। প্রয়োজনে সক্ষমতা কিছুটা বাড়াতে হবে। কারণ ফাইজার পরবর্তী যে জেনারেশনটা আনতে যাচ্ছে যেখানে এখন যে তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণ করতে হয়, যেখানে এই তাপমাত্রার প্রয়োজন হবে না। প্লাস ২ থেকে ২৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখা যাবে। সুতরাং আমার মনে হয়, ফাইজারের টিকা নেয়া উচিত। তা না হলে পরবর্তীতে আমরা বঞ্চিত হতে পারি।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে জানান, ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গতকালও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ফাইজারের টিকা কেনার ব্যাপারে সরকার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সহায়তা চাইবে। আজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে টিকা বিষয়ে একটি সভা হওয়ার কথা, সেখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশ কোভ্যাক্স সুবিধায় ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা ফেব্রুয়ারির প্রথমেই পেতে পারে। বাংলাদেশ এই টিকা নিতে চায় কিনা তা ১৮ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে হবে। গতকাল পর্যন্ত ফাইজারের টিকা কিনতে নীতিগতভাবে সম্মত স্বাস্থ্য অধিদফতর।

৬ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ কোভ্যাক্স উদ্যোগের ১৯২টি সদস্যদেশকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ বা ফেব্রুয়ারিতে কোভ্যাক্স-এর উদ্যোগে স্বল্পসংখ্যক টিকা দেয়া হবে। এই টিকা পেতে কিছু শর্ত মানতে হবে বাংলাদেশকে। এই টিকা ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে, জাতীয় করোনা টিকা পরিকল্পনায় একাধিক ধরনের টিকা ব্যবহারের ইচ্ছার প্রকাশ থাকতে হবে, ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফাইজারের টিকার অনুমোদন করাতে হবে এবং এর সঙ্গে ফাইজারের দায়মুক্তির একটি ব্যবস্থা থাকতে হবে।

চিঠিতে গ্যাভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেথ বার্কলি বলেছেন, ফাইজার এবং যেসব দেশ ফাইজারের টিকা সংগ্রহ করেছে, তাদের সঙ্গে কোভ্যাক্স টিকার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছে। তার ভিত্তিতে কোভ্যাক্স জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বা ফেব্রুয়ারিতে সদস্যদেশগুলোকে টিকা দিতে পারবে।

ওই চিঠিতে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলা হয়েছে, ১৮ জানুয়ারির মধ্যে সদস্যদেশগুলোকে আগ্রহের বিষয়টি কোভ্যাক্সকে জানাতে হবে। ১৯ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ বা গ্যাভিসংশ্লিষ্ট দেশের আগ্রহপত্র ও অবকাঠামো পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং ২৯ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম ঢেউয়ের টিকা বিতরণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে এবং সদস্যদেশগুলোকে জানিয়ে দেবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), আইইডিসিআর’ ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় টিকা সংক্ষণ করার মতো রেফ্রিজারেটর আছে।

টিকা নিতে অ্যাপসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন

করোনা ভ্যাকসিন নিতে হলে প্রত্যেককে অ্যাপসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রফেসর মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

তিনি গতকাল স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘অ্যাপসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করেই প্রত্যেককে ভ্যাকসিন নিতে হবে। করোনা ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য অ্যাপস তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে।’

অ্যাপসের মাধ্যমে ভ্যাকসিন গ্রহণের সময় পরবর্তীতে জানিয়ে দেয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে ভ্যাকসিন পেতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। প্রথম ধাপে ফেব্রুয়ারিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে অক্সফোর্ডের করোনা ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।

ফাইজার বিনামূল্যে টিকা দিবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন বলেছেন, আমাদের দেশকে অনেকেই ভ্যাকসিন দিতে চাচ্ছে। চায়না, রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্যাকসিন দিতে চাচ্ছে। ভ্যাকসিনের জন্য আমরা সব দরজা খুলে রেখেছি। ফাইজার কোম্পানি থেকে বিনামূল্যে কিছু ভ্যাকসিন দিতে চাচ্ছে। এই ভ্যাকসিন আমরা গ্রহণ করব।

টিকা এলে প্রথমে সম্মুখসারির যোদ্ধাদের আগে দেয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।

গতকাল মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার শুভ্র সেন্টারে শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

জাহিদ মালেক বলেন, আমরা আশা করছি, চলতি মাসের শেষে অথবা সামনের মাসের প্রথম দিকেই বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পেয়ে যাবে। ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের কোন অভাব হবে না। আমাদের দেশে করোনার কোন ওয়েভ নাই, আমরা কোন দ্বিতীয় ওয়েব দেখতে পাইনি উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ আগের তুলনায় কমে গেছে। সংক্রমণের হার এখন সাড়ে পাঁচ শতাংশ, সুস্থতার হার ৯০ শতাংশ এবং মৃত্যুর হারও কমে গেছে। তিনি বলেন, যেভাবে আমেরিকাতে প্রত্যেকদিন চার হাজার লোক মারা যায়, পুরো বিশ্বে প্রায় ১০ হাজারের অধিক লোক মারা যায়, সেখানে আমাদের দেশে এখন মৃত্যুহার খুবই অল্প। দেশে গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন লোক মারা যাচ্ছে।’

করোনায় দেশে একটি লোকের মৃত্যুও কাম্য নয় জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা সবাই মাস্ক ব্যবহার করি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি এবং প্রত্যেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখি। যার ফলে বাংলাদেশ ভালো আছে। এছাড়া অর্থনীতিও ভালো আছে। পৃথিবীর সব দেশ যেখানে মাইনাসে চলে গেছে সেখানে আমাদের অর্থনীতি প্লাসে আছে। করোনার সময় কেউ না খেয়ে থাকে নাই, কেউ গৃহহীন হয় নাই। সবাই ভালো আছে, আমরা এই অবস্থায় রাখতে চাই। অনুষ্ঠানে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস, পুলিশ সুপার রিফাত রহমান শামীম, জেলা জজ কোর্টের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুুস সালাম, সাটুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ ফটোসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য শেষে মন্ত্রী মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া উপজেলার দেড় হাজার দুস্থ মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণ করেন।