মুক্ত স্বদেশে ফিরলেন মহানায়ক

যেভাবে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে সামরিক জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেই রাতে তাকে আটক রাখা হয় তৎকালীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, বর্তমান শহীদ আনোয়ার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে। পরদিন তাকে নেয়া হয় ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে, সেখান থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করাচি নেয়া হয়। করাচি বিমানবন্দরে পেছনে দাঁড়ানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার সামনের আসনে বসা বঙ্গবন্ধুর ছবি পরদিন সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। করাচি থেকে কঠোর গোপনীয়তায় বঙ্গবন্ধুকে নেয়া হয় লাহোরের ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর শহরের কারাগারে। বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়েছিল নিঃসঙ্গ সেলে, গরমে তেতে উঠা সেই কারাকক্ষে কোন পাখাও ছিল না। পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুর আটক থাকার প্রথম স্বীকৃতি মেলে ১৯ জুলাই ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ প্রকাশিত ছোট্ট খবরে। এরপর ৮ আগস্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সানডে টাইমস-এর সংবাদদাতা রালফ শ’কে জানান, পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শ্রেণীর কারাগারে আটক শেখ মুজিব জীবিত ও সুস্থ আছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া আরও বলেন, আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কী হবে, সে বিষয়ে তিনি ওয়াদা করে কিছু বলতে পারেন না। এর কয়েক দিন আগে ১ আগস্ট পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ ইরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে বড় আকারে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ইরানি সংবাদদাতা আমির তাহিরি রাওয়ালপিন্ডির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার ঢাকা সফরের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড। সেই সময়ের কষ্টকর অভিজ্ঞতার সামান্য ছায়াপাত মেলে বঙ্গবন্ধুর কারাগারে লেখা ডায়েরিতে, কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, ‘লেখাপড়া করতে ইচ্ছা হয় না। সময়ও কাটে না, জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয় যাকে ইংরেজিতে বলে সলিটারি কনফাইনমেন্ট তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।’ বঙ্গবন্ধুর বিচারে সরকারের দিক থেকে প্রবীণ আইনজীবী একে ব্রোহিকে অভিযুক্তের (বঙ্গবন্ধু) পক্ষে মামলা পরিচালনায় নিয়োগ দেয়া হয়। আদালতের কার্যক্রমের শুরুতে ১২ দফা অভিযোগনামা পড়ে শোনানো হয়। এরমধ্যে ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযোগ। ছয়টি অপরাধের জন্য শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। আদালতে ইয়াহিয়া খানের ২৬ মার্চ প্রদত্ত ভাষণের টেপ বাজিয়ে শোনানো হয়। সেই বক্তব্য শোনার পর বঙ্গবন্ধু আদালতের কোন কার্যক্রমে অংশ নেয়া এবং তার পক্ষে কৌঁসুলি নিয়োগে অস্বীকৃতি জানান। ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোন দাম নেই, দেখলাম এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র। তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এ বিচারের রায় অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালত গঠন করেছেন তিনি।’ গোটা বিচারকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কার্যত আদালতের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে ছিলেন। আদালতকক্ষে যা কিছু ঘটেছে, তা তিনি নিস্পৃহতা দিয়ে বরণ করেছিলেন, বিচারপ্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থন তো দূরের কথা, কোন কার্যক্রমেই অংশ নেননি। এ ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদী প্রত্যাখ্যানের লড়াইয়ের আরেক প্রকাশ। পরদিন ৪ ডিসেম্বর সামরিক আদালত বিচারের রায় ঘোষণা করে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। আদালতের কার্যক্রম শেষে তাকে নেয়া হয় মিয়ানওয়ালি জেলে। সেখানে দণ্ডাদেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হতে থাকে। যে সেলে তিনি ছিলেন, তার পাশে কবরও খোঁড়া হয়।

এদিকে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের কয়েকটি সামরিক বিমানঘাঁটি আক্রমণ করলে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রেসকোর্সে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক পরাজয়ের পর ২৪ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রশ্ন করেন, তাকেও বন্দী করা হয়েছে কিনা। জবাবে ভুট্টো বলেন, তিনি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। কিভাবে তুমি প্রেসিডেন্ট হও, যেখানে তোমার চেয়ে নির্বাচনে আমি দ্বিগুণ আসন পেয়েছি, হেসে জানতে চান বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো উত্তর দেন, তুমি যদি চাও তাহলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারো। দৃঢ়কণ্ঠে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, ‘না, আমি চাই না। তবে যত দ্রুত সম্ভব আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।’

বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো জানান, এজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি নেবেন, তবে তার জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে। সে সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, কয়েক মাস আগে তার বিচারে যেসব আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন তাদের কথোপকথনে তিনি জানতে পেরেছেন ড. কামাল হোসেনও বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে বন্দী। এরপর বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ড. কামাল হোসেনকেও শিহালাতে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ও ড. কামালকে বলা হয়েছিল, পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে তারা লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন, বিশেষভাবে ৭ জানুয়ারি রাতে এটি হবে বলে জানানো হয়েছিল। আরও জানানো হয়, লন্ডনে যাওয়ার আগে তাদের সৌজন্যে প্রেসিডেন্টের অতিথি ভবনে ভুট্টো নৈশভোজের আয়োজন করতে চান। ভুট্টো আসেন এবং কুশলাদি বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, ‘তুমি যদি আমাদের কথা শুনতে তবে রক্তপাত এড়ানো যেতো এবং পরবর্তীতে যা কিছু ঘটেছে তাও। কিন্তু তুমি নির্মম সশস্ত্র হামলা চালিয়েছ। দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তাছাড়া আর কিভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে তা আমি জানি না।’ ভুট্টো বারবার বঙ্গবন্ধুকে তার অনুরোধ পুনর্বিবেচনার কথা জানালে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার পর তিনি এর উত্তর দেবেন।

তারপরই ভুট্টো এক অনাকাক্সিক্ষত প্রস্তাব রাখেন। তিনি জানান, ইরানের শাহ পাকিস্তান সফরে আসছেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। আর এ কারণে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা পরদিন সকাল পর্যন্ত পেছাতে পারে। এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, রাতেই তাদের যাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং জানান ইরানের শাহের সঙ্গে দেখা করার কোন ইচ্ছা তার নেই। আর যদি নির্ধারিত সময়ে লন্ডন যাত্রার ব্যবস্থা ভুট্টো না করতে পারেন, তাহলে যতদ্রুত সম্ভব তাদের কারাগারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষোভ বুঝতে পেরে ভুট্টো জানান, নৈশভোজের পরেই করাচি থেকে তাদের যাত্রার নির্দেশ দেয়া হবে।

বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে এরপর বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত এগিয়ে দেন ভুট্টো। তাদের বলা হয়, যাত্রা সম্পর্কে এখনই কিছু জানানো হবে না, যখন লন্ডন থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে থাকবে উড়োজাহাজ তখন ঘোষণা দেয়া হবে। যখন তারা লন্ডনের কাছাকাছি পৌঁছাবেন, তখন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে একটি বার্তা পাঠানো হবে, যাতে থাকবে বঙ্গবন্ধু সকাল সাতটার দিকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন।

৯ জানুয়ারি ১৯৭২, ভোর ছয়টা। লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছালেন বঙ্গবন্ধু। তাকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিলেন ইয়ান। আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন।

সেদিন যা বলেছিলেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন গিয়ে প্রথম মুক্তভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তার লন্ডন পৌঁছার পর ক্লারিজেস হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। জনাকীর্ণ এই সংবাদ সম্মেলনে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের লড়াইয়ের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। পাকিস্তানের কারাগারের কনডেম সেলে আমি যখন ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন বাংলাদেশের জনগণ আমাকে তাদের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছে। আমি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতাকামী সব রাষ্ট্র যারা আমাদের সমর্থন দিয়েছে তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষত ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বাধীনতাকামী জনগণ যারা আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন তাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এখন আমি বাংলাদেশকে অতিসত্বর স্বীকৃতি দিতে এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন জানাতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানাই।’ ২ মিনিটের লিখিত বক্তব্য শেষ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

প্রশ্ন : আপনি ঢাকার পরিবর্তে কেন লন্ডনে এলেন?

মুজিব : আমি বন্দী ছিলাম। এটি পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছে, আমার নয়। আমি এখানে কতক্ষণ থাকব তা জানি না। তবে লন্ডন ত্যাগের আগে আমি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করার আশা করছি।

প্রশ্ন : পাকিস্তানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে?

মুজিব : ভুট্টো আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনা করি। আমি তাকে বলেছি, আমার দেশের জনগণের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারব না।

প্রশ্ন : পাকিস্তানিদের নির্যাতনের ব্যাপারে তাদের আপনি কীভাবে অভিযুক্ত করবেন?

মুজিব : পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন অত্যাচার-নির্যাতনে রুদ্ধ করতে চেয়েছে, তারা প্রত্যেকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত। পাকিস্তান অত্যন্ত জঘন্য খেলা খেলছে। গণহত্যার দায়ে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। আজ যদি হিটলার বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিও লজ্জা পেতেন।

প্রশ্ন : যুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

মুজিব : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অবদানের জন্য আমার শুভেচ্ছা জানাই। শুভেচ্ছা জানাই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের প্রতি। আমি গোটা বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানাই। আশা করি আমরা শীঘ্রই জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত হব। আমি বিশ্বের অনেক মানুষের প্রতি আমার লাখ লাখ ক্ষুধার্ত, অনাহারি মানুষকে বাঁচানোর আবেদন জানাই। বাংলাদেশ কয়েকশ বছর ধরে শোষণ-বঞ্চনার শিকার। এজন্য ব্রিটেনও অনেকাংশে দায়ী। যদিও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার সুসম্পর্ক বিদ্যমান।

প্রশ্ন : আপনাকে জেলখানায় শারীরিকভাবে কোন প্রকার নির্যাতন বা খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে?

মুজিব : আমাকে রাখা হয়েছিল বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক জনমানবহীন কারাগারে। তাও সাধারণ কোন সেলে নয়, ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের সেলে। কোন দর্শনার্থী নেই, কোন চিঠি নেই, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। আমাকে নিয়ে বিচারের আনুষ্ঠানিকতা ছিল একজন বেসামরিক নাগরিকের কোর্ট মার্শালের মতো। আমি এখন মুক্ত মানব, কিন্তু বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি জানি না আমি মরব কি বাঁচব। কিন্তু এটা জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। ওই বিচারের প্রহসন যদি এখন চলে তাহলেও আমি মানসিকভাবে মরতে প্রস্তুত।

প্রশ্ন : ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যে সংঘাত তাতে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মুজিব : (কিছুক্ষণ চিন্তাক্লিষ্ট থেকে) আমি এখনও বন্দীদশায়। জানি না এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি যখন ঢাকায় ফিরে যাব, তখন আমার জনগণের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করতে হবে। এরই মধ্যে শেখ মুজিব অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যেতে আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারছি না। বাংলাদেশে জনগণের মতো এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা এবং স্বাধীনতার জন্য এত চরম মূল্য আর কোন জাতি দেয়নি। আমি আগামীকাল বা পরশু আমার দেশে ফিরে যাব। জয় বাংলা।’

সূত্র : দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ জানুয়ারি ১৯৭২।

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হলেন তার ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। কেমন ছিল ১৩ ঘণ্টার সেই সফরের অভিজ্ঞতা?

‘ইন্ডিয়া, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ লিবারেশন অ্যান্ড পাকিস্তান’ বইয়ে এ নিয়ে কিছুটা স্মৃতিচারণও করেছেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। ‘পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে এলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে তাকে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে সহযাত্রী হই আমি।’ স্মৃতিচারণ করেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। সঙ্গে ছিলেন সে সময়ের ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া। আরও ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী হামিদা হোসেন।

বিমানে তারা পাশাপাশি আসনে বসলেন। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ। উৎফুল্ল মুজিবের তখন দেশে ফেরার তর সইছে না।

আপ্লুত কণ্ঠে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলে উঠলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ তিনি ধন্যবাদ জানালেন দীর্ঘদিন তাকে সহযোগিতার জন্য। বললেন, ‘ব্যানার্জি, এবার একটি বিশেষ সহযোগিতা চাই।’ শশাঙ্ক বললেন, ‘আয়ত্তের মধ্যে হলে অবশ্যই চেষ্টা করব।’ ধীর লয়ে মুজিব বললেন, ‘দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তার কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে বাংলাদেশ ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোন বাধা থাকবে না।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র সাদা মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। তার চোখ ভরে উঠেছে জলে। তিনি বললেন, ‘ব্যানার্জি, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নিই।’ তারা দু’জনে মিলে গানটা গাইলেন। বঙ্গবন্ধু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরও কঠোর সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। বুকে শুধু একটাই বল, আমার দেশের আপামর মানুষ।’

শশাঙ্ককে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?’ শশাঙ্ক জবাব দিলেন, ‘ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’

লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছলে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি. গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে ভাষণ দেন, তিনি বলেন, ‘আমার জন্য এটা পরম আনন্দের মুহূর্ত। বাংলাদেশ যাওয়ার পথে আমি মহান ভারতের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী- যিনি কেবল মানুষের নয় মানবতারও নেতা, তার নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দীদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা। অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ নয় মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাকে যখন আমার মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল, আমাকে যখন বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের কোটি বিজয়ী হাসির মাঝে। বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার বিশাল যজ্ঞে যোগ দেয়ার জন্য, আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে। আজ আমার হৃদয়ে কারও জন্য কোন বিদ্বেষ নেই বরং আছে পরিতৃপ্তি। এই পরিতৃপ্তি মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভর বিজয়ের। জয় বাংলা! জয় হিন্দ!’

দিল্লী থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। সে জনসভায় তিনি বলেন : ‘আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে। যাদের হত্যা করা হয়েছে আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করি। আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু, আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমি আমার যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে, তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আজ প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এতো মানুষ এতো সাধারণ জনগণ মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই যা আমার সাত কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোন আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও- এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তবে মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম, বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করছো। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই। তাদের আমি দেখব না।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই। আমার জনগণ গৃহহারা-সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো। মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও, দিতে হবে, উপায় নাই, দিতে হবে। আমি আমরা হার মানব না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’ কবিগুরু আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এতো লোক আত্মহুতি, এতো লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।‘ ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম- ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছো। তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’ বঙ্গবন্ধু তবে মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম, বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করছ। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই।’ (সংক্ষেপিত)

রবিবার, ১০ জানুয়ারী ২০২১ , ২৬ পৌষ ১৪২৭, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

মুক্ত স্বদেশে ফিরলেন মহানায়ক

image

যেভাবে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে সামরিক জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেই রাতে তাকে আটক রাখা হয় তৎকালীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, বর্তমান শহীদ আনোয়ার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে। পরদিন তাকে নেয়া হয় ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে, সেখান থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করাচি নেয়া হয়। করাচি বিমানবন্দরে পেছনে দাঁড়ানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার সামনের আসনে বসা বঙ্গবন্ধুর ছবি পরদিন সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। করাচি থেকে কঠোর গোপনীয়তায় বঙ্গবন্ধুকে নেয়া হয় লাহোরের ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর শহরের কারাগারে। বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়েছিল নিঃসঙ্গ সেলে, গরমে তেতে উঠা সেই কারাকক্ষে কোন পাখাও ছিল না। পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুর আটক থাকার প্রথম স্বীকৃতি মেলে ১৯ জুলাই ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ প্রকাশিত ছোট্ট খবরে। এরপর ৮ আগস্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সানডে টাইমস-এর সংবাদদাতা রালফ শ’কে জানান, পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শ্রেণীর কারাগারে আটক শেখ মুজিব জীবিত ও সুস্থ আছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া আরও বলেন, আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কী হবে, সে বিষয়ে তিনি ওয়াদা করে কিছু বলতে পারেন না। এর কয়েক দিন আগে ১ আগস্ট পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ ইরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে বড় আকারে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ইরানি সংবাদদাতা আমির তাহিরি রাওয়ালপিন্ডির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার ঢাকা সফরের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড। সেই সময়ের কষ্টকর অভিজ্ঞতার সামান্য ছায়াপাত মেলে বঙ্গবন্ধুর কারাগারে লেখা ডায়েরিতে, কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, ‘লেখাপড়া করতে ইচ্ছা হয় না। সময়ও কাটে না, জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয় যাকে ইংরেজিতে বলে সলিটারি কনফাইনমেন্ট তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।’ বঙ্গবন্ধুর বিচারে সরকারের দিক থেকে প্রবীণ আইনজীবী একে ব্রোহিকে অভিযুক্তের (বঙ্গবন্ধু) পক্ষে মামলা পরিচালনায় নিয়োগ দেয়া হয়। আদালতের কার্যক্রমের শুরুতে ১২ দফা অভিযোগনামা পড়ে শোনানো হয়। এরমধ্যে ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযোগ। ছয়টি অপরাধের জন্য শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। আদালতে ইয়াহিয়া খানের ২৬ মার্চ প্রদত্ত ভাষণের টেপ বাজিয়ে শোনানো হয়। সেই বক্তব্য শোনার পর বঙ্গবন্ধু আদালতের কোন কার্যক্রমে অংশ নেয়া এবং তার পক্ষে কৌঁসুলি নিয়োগে অস্বীকৃতি জানান। ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোন দাম নেই, দেখলাম এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র। তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এ বিচারের রায় অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালত গঠন করেছেন তিনি।’ গোটা বিচারকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কার্যত আদালতের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে ছিলেন। আদালতকক্ষে যা কিছু ঘটেছে, তা তিনি নিস্পৃহতা দিয়ে বরণ করেছিলেন, বিচারপ্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থন তো দূরের কথা, কোন কার্যক্রমেই অংশ নেননি। এ ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদী প্রত্যাখ্যানের লড়াইয়ের আরেক প্রকাশ। পরদিন ৪ ডিসেম্বর সামরিক আদালত বিচারের রায় ঘোষণা করে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। আদালতের কার্যক্রম শেষে তাকে নেয়া হয় মিয়ানওয়ালি জেলে। সেখানে দণ্ডাদেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হতে থাকে। যে সেলে তিনি ছিলেন, তার পাশে কবরও খোঁড়া হয়।

এদিকে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের কয়েকটি সামরিক বিমানঘাঁটি আক্রমণ করলে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রেসকোর্সে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক পরাজয়ের পর ২৪ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রশ্ন করেন, তাকেও বন্দী করা হয়েছে কিনা। জবাবে ভুট্টো বলেন, তিনি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। কিভাবে তুমি প্রেসিডেন্ট হও, যেখানে তোমার চেয়ে নির্বাচনে আমি দ্বিগুণ আসন পেয়েছি, হেসে জানতে চান বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো উত্তর দেন, তুমি যদি চাও তাহলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারো। দৃঢ়কণ্ঠে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, ‘না, আমি চাই না। তবে যত দ্রুত সম্ভব আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।’

বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো জানান, এজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি নেবেন, তবে তার জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে। সে সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, কয়েক মাস আগে তার বিচারে যেসব আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন তাদের কথোপকথনে তিনি জানতে পেরেছেন ড. কামাল হোসেনও বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে বন্দী। এরপর বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ড. কামাল হোসেনকেও শিহালাতে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ও ড. কামালকে বলা হয়েছিল, পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে তারা লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন, বিশেষভাবে ৭ জানুয়ারি রাতে এটি হবে বলে জানানো হয়েছিল। আরও জানানো হয়, লন্ডনে যাওয়ার আগে তাদের সৌজন্যে প্রেসিডেন্টের অতিথি ভবনে ভুট্টো নৈশভোজের আয়োজন করতে চান। ভুট্টো আসেন এবং কুশলাদি বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, ‘তুমি যদি আমাদের কথা শুনতে তবে রক্তপাত এড়ানো যেতো এবং পরবর্তীতে যা কিছু ঘটেছে তাও। কিন্তু তুমি নির্মম সশস্ত্র হামলা চালিয়েছ। দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তাছাড়া আর কিভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে তা আমি জানি না।’ ভুট্টো বারবার বঙ্গবন্ধুকে তার অনুরোধ পুনর্বিবেচনার কথা জানালে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার পর তিনি এর উত্তর দেবেন।

তারপরই ভুট্টো এক অনাকাক্সিক্ষত প্রস্তাব রাখেন। তিনি জানান, ইরানের শাহ পাকিস্তান সফরে আসছেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। আর এ কারণে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা পরদিন সকাল পর্যন্ত পেছাতে পারে। এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, রাতেই তাদের যাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং জানান ইরানের শাহের সঙ্গে দেখা করার কোন ইচ্ছা তার নেই। আর যদি নির্ধারিত সময়ে লন্ডন যাত্রার ব্যবস্থা ভুট্টো না করতে পারেন, তাহলে যতদ্রুত সম্ভব তাদের কারাগারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষোভ বুঝতে পেরে ভুট্টো জানান, নৈশভোজের পরেই করাচি থেকে তাদের যাত্রার নির্দেশ দেয়া হবে।

বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে এরপর বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত এগিয়ে দেন ভুট্টো। তাদের বলা হয়, যাত্রা সম্পর্কে এখনই কিছু জানানো হবে না, যখন লন্ডন থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে থাকবে উড়োজাহাজ তখন ঘোষণা দেয়া হবে। যখন তারা লন্ডনের কাছাকাছি পৌঁছাবেন, তখন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে একটি বার্তা পাঠানো হবে, যাতে থাকবে বঙ্গবন্ধু সকাল সাতটার দিকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন।

৯ জানুয়ারি ১৯৭২, ভোর ছয়টা। লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছালেন বঙ্গবন্ধু। তাকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিলেন ইয়ান। আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন।

সেদিন যা বলেছিলেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন গিয়ে প্রথম মুক্তভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তার লন্ডন পৌঁছার পর ক্লারিজেস হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। জনাকীর্ণ এই সংবাদ সম্মেলনে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের লড়াইয়ের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। পাকিস্তানের কারাগারের কনডেম সেলে আমি যখন ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন বাংলাদেশের জনগণ আমাকে তাদের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছে। আমি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতাকামী সব রাষ্ট্র যারা আমাদের সমর্থন দিয়েছে তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষত ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বাধীনতাকামী জনগণ যারা আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন তাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এখন আমি বাংলাদেশকে অতিসত্বর স্বীকৃতি দিতে এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন জানাতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানাই।’ ২ মিনিটের লিখিত বক্তব্য শেষ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

প্রশ্ন : আপনি ঢাকার পরিবর্তে কেন লন্ডনে এলেন?

মুজিব : আমি বন্দী ছিলাম। এটি পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছে, আমার নয়। আমি এখানে কতক্ষণ থাকব তা জানি না। তবে লন্ডন ত্যাগের আগে আমি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করার আশা করছি।

প্রশ্ন : পাকিস্তানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে?

মুজিব : ভুট্টো আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনা করি। আমি তাকে বলেছি, আমার দেশের জনগণের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারব না।

প্রশ্ন : পাকিস্তানিদের নির্যাতনের ব্যাপারে তাদের আপনি কীভাবে অভিযুক্ত করবেন?

মুজিব : পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন অত্যাচার-নির্যাতনে রুদ্ধ করতে চেয়েছে, তারা প্রত্যেকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত। পাকিস্তান অত্যন্ত জঘন্য খেলা খেলছে। গণহত্যার দায়ে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। আজ যদি হিটলার বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিও লজ্জা পেতেন।

প্রশ্ন : যুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

মুজিব : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অবদানের জন্য আমার শুভেচ্ছা জানাই। শুভেচ্ছা জানাই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের প্রতি। আমি গোটা বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানাই। আশা করি আমরা শীঘ্রই জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত হব। আমি বিশ্বের অনেক মানুষের প্রতি আমার লাখ লাখ ক্ষুধার্ত, অনাহারি মানুষকে বাঁচানোর আবেদন জানাই। বাংলাদেশ কয়েকশ বছর ধরে শোষণ-বঞ্চনার শিকার। এজন্য ব্রিটেনও অনেকাংশে দায়ী। যদিও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার সুসম্পর্ক বিদ্যমান।

প্রশ্ন : আপনাকে জেলখানায় শারীরিকভাবে কোন প্রকার নির্যাতন বা খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে?

মুজিব : আমাকে রাখা হয়েছিল বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক জনমানবহীন কারাগারে। তাও সাধারণ কোন সেলে নয়, ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের সেলে। কোন দর্শনার্থী নেই, কোন চিঠি নেই, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। আমাকে নিয়ে বিচারের আনুষ্ঠানিকতা ছিল একজন বেসামরিক নাগরিকের কোর্ট মার্শালের মতো। আমি এখন মুক্ত মানব, কিন্তু বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি জানি না আমি মরব কি বাঁচব। কিন্তু এটা জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। ওই বিচারের প্রহসন যদি এখন চলে তাহলেও আমি মানসিকভাবে মরতে প্রস্তুত।

প্রশ্ন : ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যে সংঘাত তাতে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মুজিব : (কিছুক্ষণ চিন্তাক্লিষ্ট থেকে) আমি এখনও বন্দীদশায়। জানি না এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি যখন ঢাকায় ফিরে যাব, তখন আমার জনগণের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করতে হবে। এরই মধ্যে শেখ মুজিব অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যেতে আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারছি না। বাংলাদেশে জনগণের মতো এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা এবং স্বাধীনতার জন্য এত চরম মূল্য আর কোন জাতি দেয়নি। আমি আগামীকাল বা পরশু আমার দেশে ফিরে যাব। জয় বাংলা।’

সূত্র : দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ জানুয়ারি ১৯৭২।

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হলেন তার ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। কেমন ছিল ১৩ ঘণ্টার সেই সফরের অভিজ্ঞতা?

‘ইন্ডিয়া, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ লিবারেশন অ্যান্ড পাকিস্তান’ বইয়ে এ নিয়ে কিছুটা স্মৃতিচারণও করেছেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। ‘পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে এলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে তাকে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে সহযাত্রী হই আমি।’ স্মৃতিচারণ করেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। সঙ্গে ছিলেন সে সময়ের ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া। আরও ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী হামিদা হোসেন।

বিমানে তারা পাশাপাশি আসনে বসলেন। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ। উৎফুল্ল মুজিবের তখন দেশে ফেরার তর সইছে না।

আপ্লুত কণ্ঠে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলে উঠলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ তিনি ধন্যবাদ জানালেন দীর্ঘদিন তাকে সহযোগিতার জন্য। বললেন, ‘ব্যানার্জি, এবার একটি বিশেষ সহযোগিতা চাই।’ শশাঙ্ক বললেন, ‘আয়ত্তের মধ্যে হলে অবশ্যই চেষ্টা করব।’ ধীর লয়ে মুজিব বললেন, ‘দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তার কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে বাংলাদেশ ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোন বাধা থাকবে না।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র সাদা মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। তার চোখ ভরে উঠেছে জলে। তিনি বললেন, ‘ব্যানার্জি, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নিই।’ তারা দু’জনে মিলে গানটা গাইলেন। বঙ্গবন্ধু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরও কঠোর সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। বুকে শুধু একটাই বল, আমার দেশের আপামর মানুষ।’

শশাঙ্ককে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?’ শশাঙ্ক জবাব দিলেন, ‘ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’

লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছলে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি. গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে ভাষণ দেন, তিনি বলেন, ‘আমার জন্য এটা পরম আনন্দের মুহূর্ত। বাংলাদেশ যাওয়ার পথে আমি মহান ভারতের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী- যিনি কেবল মানুষের নয় মানবতারও নেতা, তার নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দীদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা। অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ নয় মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাকে যখন আমার মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল, আমাকে যখন বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের কোটি বিজয়ী হাসির মাঝে। বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার বিশাল যজ্ঞে যোগ দেয়ার জন্য, আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে। আজ আমার হৃদয়ে কারও জন্য কোন বিদ্বেষ নেই বরং আছে পরিতৃপ্তি। এই পরিতৃপ্তি মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভর বিজয়ের। জয় বাংলা! জয় হিন্দ!’

দিল্লী থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। সে জনসভায় তিনি বলেন : ‘আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে। যাদের হত্যা করা হয়েছে আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করি। আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু, আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমি আমার যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে, তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আজ প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এতো মানুষ এতো সাধারণ জনগণ মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই যা আমার সাত কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোন আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও- এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তবে মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম, বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করছো। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই। তাদের আমি দেখব না।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই। আমার জনগণ গৃহহারা-সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো। মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও, দিতে হবে, উপায় নাই, দিতে হবে। আমি আমরা হার মানব না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’ কবিগুরু আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এতো লোক আত্মহুতি, এতো লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।‘ ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম- ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছো। তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’ বঙ্গবন্ধু তবে মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম, বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করছ। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই।’ (সংক্ষেপিত)