আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী নিয়ে বড় বড় নেতাদের মুখরোচক বক্তব্য খুব আমোদজনক। কোন অপরাধজনক ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের কেউ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতারা বলতে থাকেন, ‘ওরা আমাদের দলের কেউ নয়, ‘ওরা কাওয়্যা, ওরা অনুপ্রবেশকারী’। অপরাধীদের বোঝানোর জন্য ‘হাইব্রিড’ শব্দও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। মনে হয় অনুপ্রবেশ না হলে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে কখনও কোন কলঙ্কের ছায়াও পড়তো না। স্বার্থ উদ্ধারে দলীয় ইমেজ ক্ষুণœœকারী নিজ দলের নেতাকর্মীদের সম্ভবত হাইব্রিড অভিধায় দল অভিষিক্ত করেছে। আওয়ামী লীগের পদ-পদবিতে না থাকা সত্ত্বেও দলের প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করছে এবং দলকে বিতর্কিত করছে। আওয়ামী লীগ তাদের দলে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে নাকি একটি তালিকাও তৈরি করেছে। কিসের ভিত্তিতে, কোন বিবেচনায় তারা এই তালিকা করেছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আওয়ামী লীগে বা এর কোন অঙ্গসংগঠনে এসে অনেক দিন যাবত কাজ করার পর হঠাৎ যদি তাদের অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে বের করে দেয়া হয় বা হেয় প্রতিপন্ন করা হয় তখন স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়ে যেতে পারে।

হাইব্রিড এবং অনুপ্রবেশকারী দুটি আলাদা বিষয়? অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগতরা হলো যারা অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন? আর হাইব্রিড হলো যারা আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে ব্যাপক সুবিধা নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। এই হাইব্রিড আওয়ামী লীগ দলের ভেতরেও অনেক আছে? কিন্তু তাদের নিয়ে কথা হচ্ছে না? আবার যারা নতুন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যেও ভালো মানুষ আছেন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আগে যাই বলুন না কেন, আওয়ামী লীগে অন্য দল থেকে যোগদানকারী সবাইকে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি আর অনুপ্রবেশকারী বলছেন না। অনুপ্রবেশকারী তারাই যারা অন্য দল থেকে এসে নেতাদের পেছনে ঘোরাঘুরি করে অপকর্মের মাধ্যমে দলকে বিতর্কিত করেন। আওয়ামী লীগ তাদেরই অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে যারা অন্য দল থেকে এসে দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করছে বা যাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগকে বিব্রত হতে হচ্ছে। যোগদানকারীদের কেউ অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পুলিশের হাতে ধরা না পড়লে বা সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে অথবা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারী কোন প্রকার মামলা-মোকদ্দমায় না জড়ালে তাকে অনুপ্রবেশকারী বলা হবে না। শোনা যায়, দলের শীর্ষ নেতার তরফ থেকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের আগের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই করাই আওয়ামী লীগের মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে প্রস্তুতকৃত তালিকা নিয়ে ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী বলে দলের কাউকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে দল থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্তে অনেকে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছেন।

দুরভিসন্ধি নিয়ে সরকারি দলে যোগদানের ইতিহাস বহু পুরোনো। সরকারি দলে থাকলে অনেক সুবিধা, প্রশাসন থেকে অপরাধমূলক কাজেও প্রশ্রয় পাওয়া যায়। সরকারি দলে না থাকলে সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি করে পার পাওয়া কঠিন; দলের নেতাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি চালায় তারা। পুলিশ প্রশাসন তাদের অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। সরকারি দলে থাকলে বিরোধী দলের লোকজনকে পুলিশের সম্মুখেই পেটানো যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ফায়দা লোটার জন্য ব্যবসায়ীরাও সরকারি দলের অনুকম্পা প্রত্যাশা করে থাকে। সরকারি দলে না থাকলে ফুটপাতের চাঁদার ভাগ পাওয়া যায় না, ঝুট ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ করা যায় না, টেন্ডারবাজির ভাগ পাওয়া যায় না, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরাও পাত্তা দেয় না। এই শ্রেণীটি সর্বদা সরকারি দল করে থাকে। সন্ত্রাস এবং খুনাখুনির অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি মিডিয়ায় প্রচার হলেই সরকার এবং সরকারি দল বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে এবং বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হলেই শুধু সরকার ও সরকারি দল অনুপ্রবেশকারী নিয়ে সোচ্চার হয়, সব অপরাধ অনুপ্রবেশকারীদের ওপর চাপিয়ে নিজেদের শুদ্ধাচারের সূচিরূপে জনগণের কাছে উপস্থাপন করে। তবে কোন দলে পরিকল্পিতভাবে ভিন্ন দলের লোক ঢুকিয়ে দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হতে পারে বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার কৌশলও থাকতেই পারে। তাই সম্ভবত আওয়ামী লীগ হাইব্রিডের চেয়ে অনুপ্রবেশকে বেশি ভয়ঙ্কর মনে করছেন। তবে এদের মুখোশ উন্মোচনের প্রক্রিয়াটি জনগণের কাছে বিশ্বাসযাগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।

লোম বাছতে কম্বল উজাড় হলে আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে। আওয়ামী লীগের মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলে, আওয়ামী লীগসহ তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অপরাধের কথা বললে, সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত বা নীতির সমালোচনা করলে রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইত্যাদি বলে মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি বা জামায়াতে ইসলামের মতো আওয়ামী লীগ ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করে না, তাদের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় পপুলার ভোটের ওপর। একাত্তরের যুদ্ধে যারা রাজাকার ছিল তাদের সন্তানদের সবাইকে রাজাকার বলে দূরে সরিয়ে রাখলে আওয়ামী লীগ লাটিমের মতো সমসংখ্যক ভোটের আনুপাতিক হার নিয়ে একই বৃত্তে ঘুরতে থাকবে, দলের পরিধি বাড়বে না। সত্যিকার অর্থে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে, বিগত দুটি নির্বাচনে বিজয়ী হতে আওয়ামী লীগকে কোনোরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা অনেক নেতার সরকার পরিচালনায় যথাযথ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকলে সরকার পরিচালনায় প্রশাসন নির্ভর হতে হতো না। আমলারা চালিকা শক্তি হওয়ার কারণেই সম্ভবত কানাডার বেগম পাড়ায় রাজনৈতিক নেতার চেয়ে আমলাদের সম্পদ বেশি। কিন্তু প্রশাসন ও রাজনীতি এক কথা নয়।

অনুপ্রবেশকারী তো নতুন নয়; প্রতিটি নির্বাচনেই তো অনুপ্রবেশকারীর আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি নির্বাচনে হঠাৎ জেগে উঠা সম্পদশালীদের মনোনয়পত্র সংগ্রহ করতে দেখা যায়, পুরোনো নেতাকর্মীরা এদের বহিরাগত বলে থাকেন। এই সম্পদশালী ব্যক্তিরা মাঠ বিচার করে মনোনয়নের জন্য ধরনা দিয়ে থাকেন, দলও মনে করে নির্বাচনে অঢেল অর্থের প্রয়োজন বিধায় এমন অনুপ্রবেশকারী দলের স্বার্থেই অপরিহার্য। জয়ের সম্ভাবনা বিচার করে অনেক ডাকসাইটে নেতার দল বদল করতে এক সেকেন্ডও লাগে না। অনেক এমপি আছেন যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের টিকিটে নির্বাচন করেছেন। বিএনপি আর জাতীয় পার্টি তো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীর সমন্বয়ে। আওয়ামী লীগের কাছে অনুপ্রবেশকারী শুধু তারাই যারা অন্য দল থেকে এসে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, অনৈতিক সুবিধা আদায় করছে, অপরাধ করে নিজেকে রক্ষা করছে, দলে অবস্থান করে নীতিহীন-আদর্শহীন কর্মকাণ্ড করছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করা সত্ত্বেও যারা দলের টিকিটে এমপি নির্বাচিত তাদের কিন্তু অনুপ্রবেশকারী বলা হয় না। অন্য দল থেকে এসে যারা দলের ভাবমূর্তি রক্ষা করছে, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তাদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী বলা দলের জন্য অনিষ্টকর। তাদের জায়গা না দিলে আওয়ামী লীগের পরিধি কীভাবে বাড়বে?

প্রতিটি রাজনৈতিক দলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী নেতারা কর্মীদের নিজের দলে ভেড়াতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে থাকেন, কর্মীরা সুস্থ প্রতিযোগিতা ত্যাগ করে পরষ্পরকে বিনাশ করতে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কেউ একবার এমপি হলে, স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে একবার অধিষ্ঠিত হলে আমৃত্যু তা আর কাউকে দিতে চান না, কেউ যেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে না পারেন তার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা করে থাকেন। মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে দিয়ে জেলে ঢুকানো ছাড়াও নিজের হাতকে শক্তিশালী রাখতে নিজের সন্ত্রাসী কর্মী দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সদস্যদের পিটিয়ে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন; এইগুলো কোনটা সম্ভব না হলে দলের একনিষ্ঠ কর্মীদেরও বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আখ্যা দিয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা করেন। মেধাবী কিছু কর্মী যখন তার নেতৃত্ব গুণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়ে যান তাদের অবদমন করে রাখার জন্যও কখনো কখনও হাইব্রিড আখ্যা দেয়া হয়। তবে ত্যাগী নেতাকর্মীরদেরও যথাযথ মূল্যায়ন করা অপরিহার্য। দলীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না হয়ে যারা অপরাধ জগতে বিচরণ করে তাদের কাউয়্যা, হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী না বলে অপরাধী হিসেবে গণ্য করাই শ্রেয়। নবাগতরাই সব অপরাধ করে এই ধারণা ঠিক নয়; তাই নবাগত সমর্থক বা কর্মীদের কাওয়্যা না বলে দলের ভেতর গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করাই অধিকতর জরুরি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ১০ জানুয়ারী ২০২১ , ২৬ পৌষ ১৪২৭, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী নিয়ে বড় বড় নেতাদের মুখরোচক বক্তব্য খুব আমোদজনক। কোন অপরাধজনক ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের কেউ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতারা বলতে থাকেন, ‘ওরা আমাদের দলের কেউ নয়, ‘ওরা কাওয়্যা, ওরা অনুপ্রবেশকারী’। অপরাধীদের বোঝানোর জন্য ‘হাইব্রিড’ শব্দও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। মনে হয় অনুপ্রবেশ না হলে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে কখনও কোন কলঙ্কের ছায়াও পড়তো না। স্বার্থ উদ্ধারে দলীয় ইমেজ ক্ষুণœœকারী নিজ দলের নেতাকর্মীদের সম্ভবত হাইব্রিড অভিধায় দল অভিষিক্ত করেছে। আওয়ামী লীগের পদ-পদবিতে না থাকা সত্ত্বেও দলের প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করছে এবং দলকে বিতর্কিত করছে। আওয়ামী লীগ তাদের দলে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে নাকি একটি তালিকাও তৈরি করেছে। কিসের ভিত্তিতে, কোন বিবেচনায় তারা এই তালিকা করেছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আওয়ামী লীগে বা এর কোন অঙ্গসংগঠনে এসে অনেক দিন যাবত কাজ করার পর হঠাৎ যদি তাদের অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে বের করে দেয়া হয় বা হেয় প্রতিপন্ন করা হয় তখন স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়ে যেতে পারে।

হাইব্রিড এবং অনুপ্রবেশকারী দুটি আলাদা বিষয়? অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগতরা হলো যারা অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন? আর হাইব্রিড হলো যারা আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে ব্যাপক সুবিধা নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। এই হাইব্রিড আওয়ামী লীগ দলের ভেতরেও অনেক আছে? কিন্তু তাদের নিয়ে কথা হচ্ছে না? আবার যারা নতুন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যেও ভালো মানুষ আছেন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আগে যাই বলুন না কেন, আওয়ামী লীগে অন্য দল থেকে যোগদানকারী সবাইকে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি আর অনুপ্রবেশকারী বলছেন না। অনুপ্রবেশকারী তারাই যারা অন্য দল থেকে এসে নেতাদের পেছনে ঘোরাঘুরি করে অপকর্মের মাধ্যমে দলকে বিতর্কিত করেন। আওয়ামী লীগ তাদেরই অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে যারা অন্য দল থেকে এসে দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করছে বা যাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগকে বিব্রত হতে হচ্ছে। যোগদানকারীদের কেউ অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পুলিশের হাতে ধরা না পড়লে বা সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে অথবা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারী কোন প্রকার মামলা-মোকদ্দমায় না জড়ালে তাকে অনুপ্রবেশকারী বলা হবে না। শোনা যায়, দলের শীর্ষ নেতার তরফ থেকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের আগের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই করাই আওয়ামী লীগের মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে প্রস্তুতকৃত তালিকা নিয়ে ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী বলে দলের কাউকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে দল থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্তে অনেকে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছেন।

দুরভিসন্ধি নিয়ে সরকারি দলে যোগদানের ইতিহাস বহু পুরোনো। সরকারি দলে থাকলে অনেক সুবিধা, প্রশাসন থেকে অপরাধমূলক কাজেও প্রশ্রয় পাওয়া যায়। সরকারি দলে না থাকলে সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি করে পার পাওয়া কঠিন; দলের নেতাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি চালায় তারা। পুলিশ প্রশাসন তাদের অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। সরকারি দলে থাকলে বিরোধী দলের লোকজনকে পুলিশের সম্মুখেই পেটানো যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ফায়দা লোটার জন্য ব্যবসায়ীরাও সরকারি দলের অনুকম্পা প্রত্যাশা করে থাকে। সরকারি দলে না থাকলে ফুটপাতের চাঁদার ভাগ পাওয়া যায় না, ঝুট ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ করা যায় না, টেন্ডারবাজির ভাগ পাওয়া যায় না, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরাও পাত্তা দেয় না। এই শ্রেণীটি সর্বদা সরকারি দল করে থাকে। সন্ত্রাস এবং খুনাখুনির অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি মিডিয়ায় প্রচার হলেই সরকার এবং সরকারি দল বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে এবং বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হলেই শুধু সরকার ও সরকারি দল অনুপ্রবেশকারী নিয়ে সোচ্চার হয়, সব অপরাধ অনুপ্রবেশকারীদের ওপর চাপিয়ে নিজেদের শুদ্ধাচারের সূচিরূপে জনগণের কাছে উপস্থাপন করে। তবে কোন দলে পরিকল্পিতভাবে ভিন্ন দলের লোক ঢুকিয়ে দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হতে পারে বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার কৌশলও থাকতেই পারে। তাই সম্ভবত আওয়ামী লীগ হাইব্রিডের চেয়ে অনুপ্রবেশকে বেশি ভয়ঙ্কর মনে করছেন। তবে এদের মুখোশ উন্মোচনের প্রক্রিয়াটি জনগণের কাছে বিশ্বাসযাগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।

লোম বাছতে কম্বল উজাড় হলে আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে। আওয়ামী লীগের মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলে, আওয়ামী লীগসহ তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অপরাধের কথা বললে, সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত বা নীতির সমালোচনা করলে রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইত্যাদি বলে মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি বা জামায়াতে ইসলামের মতো আওয়ামী লীগ ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করে না, তাদের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় পপুলার ভোটের ওপর। একাত্তরের যুদ্ধে যারা রাজাকার ছিল তাদের সন্তানদের সবাইকে রাজাকার বলে দূরে সরিয়ে রাখলে আওয়ামী লীগ লাটিমের মতো সমসংখ্যক ভোটের আনুপাতিক হার নিয়ে একই বৃত্তে ঘুরতে থাকবে, দলের পরিধি বাড়বে না। সত্যিকার অর্থে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে, বিগত দুটি নির্বাচনে বিজয়ী হতে আওয়ামী লীগকে কোনোরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা অনেক নেতার সরকার পরিচালনায় যথাযথ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকলে সরকার পরিচালনায় প্রশাসন নির্ভর হতে হতো না। আমলারা চালিকা শক্তি হওয়ার কারণেই সম্ভবত কানাডার বেগম পাড়ায় রাজনৈতিক নেতার চেয়ে আমলাদের সম্পদ বেশি। কিন্তু প্রশাসন ও রাজনীতি এক কথা নয়।

অনুপ্রবেশকারী তো নতুন নয়; প্রতিটি নির্বাচনেই তো অনুপ্রবেশকারীর আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি নির্বাচনে হঠাৎ জেগে উঠা সম্পদশালীদের মনোনয়পত্র সংগ্রহ করতে দেখা যায়, পুরোনো নেতাকর্মীরা এদের বহিরাগত বলে থাকেন। এই সম্পদশালী ব্যক্তিরা মাঠ বিচার করে মনোনয়নের জন্য ধরনা দিয়ে থাকেন, দলও মনে করে নির্বাচনে অঢেল অর্থের প্রয়োজন বিধায় এমন অনুপ্রবেশকারী দলের স্বার্থেই অপরিহার্য। জয়ের সম্ভাবনা বিচার করে অনেক ডাকসাইটে নেতার দল বদল করতে এক সেকেন্ডও লাগে না। অনেক এমপি আছেন যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের টিকিটে নির্বাচন করেছেন। বিএনপি আর জাতীয় পার্টি তো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীর সমন্বয়ে। আওয়ামী লীগের কাছে অনুপ্রবেশকারী শুধু তারাই যারা অন্য দল থেকে এসে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, অনৈতিক সুবিধা আদায় করছে, অপরাধ করে নিজেকে রক্ষা করছে, দলে অবস্থান করে নীতিহীন-আদর্শহীন কর্মকাণ্ড করছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করা সত্ত্বেও যারা দলের টিকিটে এমপি নির্বাচিত তাদের কিন্তু অনুপ্রবেশকারী বলা হয় না। অন্য দল থেকে এসে যারা দলের ভাবমূর্তি রক্ষা করছে, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তাদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী বলা দলের জন্য অনিষ্টকর। তাদের জায়গা না দিলে আওয়ামী লীগের পরিধি কীভাবে বাড়বে?

প্রতিটি রাজনৈতিক দলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী নেতারা কর্মীদের নিজের দলে ভেড়াতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে থাকেন, কর্মীরা সুস্থ প্রতিযোগিতা ত্যাগ করে পরষ্পরকে বিনাশ করতে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কেউ একবার এমপি হলে, স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে একবার অধিষ্ঠিত হলে আমৃত্যু তা আর কাউকে দিতে চান না, কেউ যেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে না পারেন তার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা করে থাকেন। মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে দিয়ে জেলে ঢুকানো ছাড়াও নিজের হাতকে শক্তিশালী রাখতে নিজের সন্ত্রাসী কর্মী দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সদস্যদের পিটিয়ে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন; এইগুলো কোনটা সম্ভব না হলে দলের একনিষ্ঠ কর্মীদেরও বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আখ্যা দিয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা করেন। মেধাবী কিছু কর্মী যখন তার নেতৃত্ব গুণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়ে যান তাদের অবদমন করে রাখার জন্যও কখনো কখনও হাইব্রিড আখ্যা দেয়া হয়। তবে ত্যাগী নেতাকর্মীরদেরও যথাযথ মূল্যায়ন করা অপরিহার্য। দলীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না হয়ে যারা অপরাধ জগতে বিচরণ করে তাদের কাউয়্যা, হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী না বলে অপরাধী হিসেবে গণ্য করাই শ্রেয়। নবাগতরাই সব অপরাধ করে এই ধারণা ঠিক নয়; তাই নবাগত সমর্থক বা কর্মীদের কাওয়্যা না বলে দলের ভেতর গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করাই অধিকতর জরুরি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com