পদ্মার এপার ওপার : নতুন ভাবনা নতুন প্রত্যাশা

সালাম জুবায়ের

পদ্মা সেতুকে সবাই বলছেন বাংলাদেশের স্বপ্নের সেতু। কি কারণে স্বপ্নের সেতু হলো- এ নিয়ে সাধারণ মানুষের কথা জানতে পদ্মা পাড়ে গিয়েছিলাম। ঘুরে দেখলাম দুই পাড়ের জীবন-জীবিকা, এখন কেমন আছে, পদ্মা সেতু চালু হলে কেমন হবে। আর সাধারণ মানুষ কি ভাবছেন, সেসব ভাবনার মধ্যে শুধু কি আনন্দ আর উচ্ছ্বাস, নাকি দুর্ভাবনাও কিছু আছে। পদ্মা পাড়ে দাঁড়িয়ে এমন সব প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া যায় দুই ধরনের চেতনা। তবে সবারই অপেক্ষা পদ্মা সেতু তাদের জীবন পাল্টে দেবে, ইতোমধ্যে পাল্টে দিতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ অনুভব করছেন, ধীরে ধীরে তাদের জীবন পাল্টে যাচ্ছে। এই পাল্টে যাওয়া, নতুন জীবনের স্বাদ পাওয়া ছিল তাদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করবে পদ্মা সেতু। এজন্য তাদের অন্তরজুড়ে পদ্মা সেতু হয়ে উঠেছে স্বপ্নের সেতু।

পদ্মা সেতু যেদিন সব স্প্যান বসানোর পর তার কাঠামোর পূর্ণ অবয়ব পেল সেদিন সে এলাকার মানুষ এবং তাদের সঙ্গে বলা যায় সারাদেশের মানুষ আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। যখন পদ্মা সেতু তার পরিকল্পিত যথার্থ রূপ পাবে সেদিন তো আনন্দে আত্মহারা হবে সে সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী মানুষ যেমন তেমনি সারাদেশের মানুষ।

এলাকার প্রায় শতভাগ মানুষ মনে করেন পদ্মা সেতু তাদের জীবন-মান অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে। সেই নতুন জীবনের স্বপ্ন এখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। প্রতিটি মানুষের জীবনের সঙ্গে পদ্মা সেতু যেন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছে। সে জন্যই তারা মনে করেন আমাদের জীবনের স্বপ্ন পূরণের সেতু পদ্মা সেতু, সারাদেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু পদ্মা সেতু।

আরেকটি কারণে পদ্মা সেতুকে স্বপ্নের সেতু বলা হচ্ছে। তা হচ্ছে পদ্মা সেতু নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে সে এলাকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক নেতারা মনে করেন, বিশ্বাস করেন। তাদের অভিমত; শুরুতে সে ষড়যন্ত্র না হলে পদ্মা সেতু এখন বাস্তবে দেখা যেত এবং তাদের এলাকারই শুধু নয়, পুরো দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়নের সেতু হয়ে উঠত। বর্তমান সরকারের বিরোধী একটি রাজনৈতিক দল সব সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করেছে স্রেফ রাজনৈতিক কারণে। সে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়নি। বরং বর্তমান সরকারের পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগকে পরিহাস করেছে।

পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ হিসেবে অর্থ জোগান দেয়ার কথা ছিল। ঋণ দেয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ হওয়ার পর হঠাৎ রহস্যজনক কারণে তারা ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। একপর্যায়ে এ প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে সে অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে। তখন অভিযোগ ওঠে, বর্তমান সরকারের মধ্য থেকে যেমন তেমনি বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন, বিশেষ করে পদ্মার দুই পাড়ের বিস্তৃত এলাকার, অন্য অর্থে পুরো দক্ষিণবঙ্গের রাজনীতি সচেতন মানুষ মনে করেন যে, সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক দল পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, সে দলের নেতারা বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে এবং ওয়াশিংটনে মার্কিন সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে ধরনা দিয়েছে যাতে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ না পায়। পদ্মা পাড়ের বিভিন্ন এলাকার রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলেন, পদ্মার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সে দল হলো বিএনপি। বিএনপির এ উদ্যোগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল দেশীয় স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী, যার মধ্যে এক নোবেল জয়ীও ছিলেন।

পদ্মা সেতু নির্মাণ করার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই পদ্মা পাড়ের মানুষ সব মাধ্যমে জানিয়ে আসছেন। সে এলাকার মানুষ অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন পদ্মার উপর সেতু নির্মাণের দাবিতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আগে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। বরং উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে এক অনুষ্ঠানে রিপোর্টার হিসেবে অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে বিএনপি সরকারের এক মন্ত্রীর কথা এখনও মনে আছে। সেই মন্ত্রী ছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। তিনি প্রকাশ্য সভায় জোর গলায় বললেন, কোন ব্যক্তির কবর জিয়ারত করতে যাওয়ার জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রয়োজন নেই। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের সব এলাকার মানুষ অত্যন্ত সহজে এবং কম সময়ে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবর জিয়ারত করতে পারবে, বিএনপি সে সুযোগ দিতে চায় না।

এভাবে নানা কারণে, একদিকে সে এলাকায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে পদ্মা সেতুর প্রয়োজনীয়তা এবং অন্যদিকে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে সেতু নির্মাণের বিষয়টি সে এলাকার মানুষের জেদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে থেকেই এটা তাদের স্বপ্ন হয়ে ওঠে। একইভাবে সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় জেদ ধরেন যেভাবেই হোক তার সরকারের আমলেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবেই। তিনি ঘোষণা করেন বিশ্বব্যাংকের টাকায় নয়, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে বাংলাদেশ। এরপর থেকেই পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি সবার স্বপ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয়। পদ্মা সেতু সম্পর্কে দেশের মানুষের মর্জি-মেজাজ অনুধাবন করে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রতিনিয়তই পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হিসেবে উল্লেখ করে সংবাদ প্রচার করতে শুরু করে।

এমন ঘটনার প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণ শুরুর পর থেকেই পদ্মা সেতু প্রচার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ খবরের মর্যাদা পাচ্ছে পদ্মা সেতু। সেতুর একেকটি পর্যায় নির্মাণ হওয়ার পরপরই সংবাদপত্রে লিড, দ্বিতীয় লিড নিউজের মর্যাদা পাচ্ছে। মানুষের স্বপ্নের সেতু না হলে সংবাদপত্র এত গুরুত্ব দিত বলে মনে করেন না সাধারণ মানুষ।

পদ্মা সেতুর প্রাথমিক কাঠামো পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল গত ১০ ডিসেম্বর। সেদিন দুপুর ১২টা ২ মিনিটে সেতুর কাঠামোর সব স্প্যান বসানো শেষ হয়। এর মধ্যদিয়ে যুক্ত হয় পদ্মার দুই পাড়। শেষ স্প্যানটি পাঠানোর আগে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে তৈরি হয় আনন্দঘন মুহূর্ত। স্প্যানটি সাজানো হয় বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা দিয়ে। স্প্যানের গায়ে বাংলা, ইংরেজি, চাইনিজ ভাষায় লেখা বিশেষ বার্তায় বলা হয়েছে, বহু বছরের প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি শ্রম শক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে। শেষ স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তটি উদযাপনের বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছিল সেতু বিভাগ। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। অনেকটাই অনাড়ম্বরভাবেই স্প্যান তোলার কাজ সম্পন্ন হয়। তবে শেষ স্প্যান বসানোর মধ্যদিয়ে পদ্মার মূল কাঠামো চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার এ আনন্দ চেপে রাখতে পারেননি পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ। বাঁধভাঙা স্রোতের মতো সবাই জড়ো হন নদীর পাড়ে। সবার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি পৌঁছার আনন্দ। ঢোল পিটিয়ে আতশবাজি ফুটিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেন পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। এ থেকেও বোঝা যায় পদ্মা সেতু তাদের মনে কত স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে।

গত শনিবার গিয়েছিলাম পদ্মার দুই পাড়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখতে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পুরো শেষ হতে আরও এক বছর লাগবে। কিন্তু দুই পাড়ের মানুষের জীবনমান এরই মধ্যে পাল্টে যেতে শুরু করেছে। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে পদ্মার পশ্চিমপাড়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার প্রায় সব উপজেলা এবং পশ্চিমপাড়ের জাজিরা উপজেলা থেকে শরীয়তপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এলাকা ঘুরে এবং লোকজনের সঙ্গে কথা বললে তাদের অন্তরের খুশি এবং উন্নয়ন চিন্তা টের পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার যারা কিছুটা অবস্থাপন্ন তারা এখন পরিকল্পনা করছেন তাদের নিজ বাড়িঘরে-জমিতে ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের। তাদের চিন্তা; পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তাদের এলাকার উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী খুব সহজেই এবং কম খরচে বাংলাদেশের যে কোন এলাকায় নিয়ে বাজারজাত করা সম্ভব হবে। তাদের নিজের বাড়িতেই যেহেতু জমি-জায়গা আছে ফলে নামমাত্র খরচে তারা শিল্প স্থাপন করতে পারবেন। আর যেহেতু সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত সহজ হয়ে যাচ্ছে সেহেতু সে এলাকায় শিল্প স্থাপনের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংগুলোও ঋণ দিতে আগ্রহী হবে। এসব চিন্তা এখন স্থানীয় ধনী লোকদের মাথায় খেলছে। একজন দোকানদার যিনি তার গ্রামে বসে বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখার চিন্তাও করেননি। তিনি এখন তার বাড়ির পাশের জমিতে মুরগি এবং নিজের পুকুরে হাঁস পালনের পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন, এখন কাজ শুরুর অপেক্ষা মাত্র।

তবে এত অনন্দের মধ্যে কিছু লোকের মধ্যে দুঃখবোধও চেপে বসেছে। সে দুঃখ ভিন্নরকম দুঃখ। পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর পদ্মার দুই পাড়ের প্রায় ২০-২৫ হাজার লোক বেকার হয়ে পড়বেন। এ ব্যাপারে কথা বলে জানতে পারলাম তাদের দুশ্চিন্তার কারণ। গাড়ি পারাপারের আবুল নামের এক ফেরিওয়ালা অনেকটা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে জানালেন, আর এক বছর পর আমাকে এখানে আর পাবেন না। কেন- জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, দেখছেন না এ নদীতে সেতু হচ্ছে, লোকজন বলাবলি করছে আর এক বছরের মধ্যেই সেতু চালু হয়ে যাবে। তখন তো কোন ফেরি চলবে না, গাড়ি ঢাকা থেকে এসে সোজা সেতু দিয়ে নদী পেরিয়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশালসহ দক্ষিণের সব জেলায় পৌঁছে যাবে। ফেরি না থাকলে আমার কাছ থেকে চানাচুর, সিদ্ধ ডিম, ঝালমুড়ি কে আর খাবে। আমি চিন্তা করছি, গ্রামে গিয়ে আলুর ক্ষেতে কাজ করব। অনেকে ভাবছেন ঢাকায় গিয়ে হকারি করবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পদ্মায় প্রায় ৮শ’র মতো স্পিডবোট, লঞ্চ, নৌকা চলাচল করে। প্রতিটি যানে গড়ে ৪ জন কাজ করেন, অর্থাৎ ৪টি পরিবার। সেতু চালু হলে তারা সবাই বেকার হয়ে পড়বেন। তাদের সবাইকে অন্য কাজ জোগাড় করতে হবে। তবে সবার পক্ষে হয়তো নতুন কাজ সে এলাকায় পাওয়া সম্ভব হবে না। তাদের অনেকেই নিজ বাড়িতে থেকে নদীর দুই পাড়ে নানা কাজ করতে পারতেন। সেতু হলে তাদের সেসব কাজ থাকবে না।

নদীর দুই পাড়ে প্রায় হাজার খানেক হোটেল-রেস্তোরাঁ সে পথে চলাচলকারী লোকজনের খাবার জোগান দিচ্ছিল। সেতু হলে এসব হোটেল-রেস্তোরাঁ আর থাকবে না। অনেকেরই দূরে কোথাও গিয়ে অন্য কিছু করার সঙ্গতি নেই। তাদের আবার ফিরে যেতে হবে গ্রামের কৃষি কাজের শ্রমিক হিসেবে।

সেতু হলে এত মানুষের বেকার বা পেশা বদলের যে দুশ্চিন্তা সেসব বিষয় নিয়ে ভাবার লোক নেই সেখানে। সবাই শুধু ভবিষ্যতে সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখছেন।

সোমবার, ১১ জানুয়ারী ২০২১ , ২৭ পৌষ ১৪২৭, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

রিপোর্টারের সাতকাহন

পদ্মার এপার ওপার : নতুন ভাবনা নতুন প্রত্যাশা

সালাম জুবায়ের

পদ্মা সেতুকে সবাই বলছেন বাংলাদেশের স্বপ্নের সেতু। কি কারণে স্বপ্নের সেতু হলো- এ নিয়ে সাধারণ মানুষের কথা জানতে পদ্মা পাড়ে গিয়েছিলাম। ঘুরে দেখলাম দুই পাড়ের জীবন-জীবিকা, এখন কেমন আছে, পদ্মা সেতু চালু হলে কেমন হবে। আর সাধারণ মানুষ কি ভাবছেন, সেসব ভাবনার মধ্যে শুধু কি আনন্দ আর উচ্ছ্বাস, নাকি দুর্ভাবনাও কিছু আছে। পদ্মা পাড়ে দাঁড়িয়ে এমন সব প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া যায় দুই ধরনের চেতনা। তবে সবারই অপেক্ষা পদ্মা সেতু তাদের জীবন পাল্টে দেবে, ইতোমধ্যে পাল্টে দিতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ অনুভব করছেন, ধীরে ধীরে তাদের জীবন পাল্টে যাচ্ছে। এই পাল্টে যাওয়া, নতুন জীবনের স্বাদ পাওয়া ছিল তাদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করবে পদ্মা সেতু। এজন্য তাদের অন্তরজুড়ে পদ্মা সেতু হয়ে উঠেছে স্বপ্নের সেতু।

পদ্মা সেতু যেদিন সব স্প্যান বসানোর পর তার কাঠামোর পূর্ণ অবয়ব পেল সেদিন সে এলাকার মানুষ এবং তাদের সঙ্গে বলা যায় সারাদেশের মানুষ আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। যখন পদ্মা সেতু তার পরিকল্পিত যথার্থ রূপ পাবে সেদিন তো আনন্দে আত্মহারা হবে সে সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী মানুষ যেমন তেমনি সারাদেশের মানুষ।

এলাকার প্রায় শতভাগ মানুষ মনে করেন পদ্মা সেতু তাদের জীবন-মান অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে। সেই নতুন জীবনের স্বপ্ন এখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। প্রতিটি মানুষের জীবনের সঙ্গে পদ্মা সেতু যেন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছে। সে জন্যই তারা মনে করেন আমাদের জীবনের স্বপ্ন পূরণের সেতু পদ্মা সেতু, সারাদেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু পদ্মা সেতু।

আরেকটি কারণে পদ্মা সেতুকে স্বপ্নের সেতু বলা হচ্ছে। তা হচ্ছে পদ্মা সেতু নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে সে এলাকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক নেতারা মনে করেন, বিশ্বাস করেন। তাদের অভিমত; শুরুতে সে ষড়যন্ত্র না হলে পদ্মা সেতু এখন বাস্তবে দেখা যেত এবং তাদের এলাকারই শুধু নয়, পুরো দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়নের সেতু হয়ে উঠত। বর্তমান সরকারের বিরোধী একটি রাজনৈতিক দল সব সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করেছে স্রেফ রাজনৈতিক কারণে। সে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়নি। বরং বর্তমান সরকারের পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগকে পরিহাস করেছে।

পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ হিসেবে অর্থ জোগান দেয়ার কথা ছিল। ঋণ দেয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ হওয়ার পর হঠাৎ রহস্যজনক কারণে তারা ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। একপর্যায়ে এ প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে সে অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে। তখন অভিযোগ ওঠে, বর্তমান সরকারের মধ্য থেকে যেমন তেমনি বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন, বিশেষ করে পদ্মার দুই পাড়ের বিস্তৃত এলাকার, অন্য অর্থে পুরো দক্ষিণবঙ্গের রাজনীতি সচেতন মানুষ মনে করেন যে, সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক দল পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, সে দলের নেতারা বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে এবং ওয়াশিংটনে মার্কিন সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে ধরনা দিয়েছে যাতে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ না পায়। পদ্মা পাড়ের বিভিন্ন এলাকার রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলেন, পদ্মার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সে দল হলো বিএনপি। বিএনপির এ উদ্যোগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল দেশীয় স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী, যার মধ্যে এক নোবেল জয়ীও ছিলেন।

পদ্মা সেতু নির্মাণ করার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই পদ্মা পাড়ের মানুষ সব মাধ্যমে জানিয়ে আসছেন। সে এলাকার মানুষ অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন পদ্মার উপর সেতু নির্মাণের দাবিতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আগে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। বরং উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে এক অনুষ্ঠানে রিপোর্টার হিসেবে অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে বিএনপি সরকারের এক মন্ত্রীর কথা এখনও মনে আছে। সেই মন্ত্রী ছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। তিনি প্রকাশ্য সভায় জোর গলায় বললেন, কোন ব্যক্তির কবর জিয়ারত করতে যাওয়ার জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রয়োজন নেই। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের সব এলাকার মানুষ অত্যন্ত সহজে এবং কম সময়ে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবর জিয়ারত করতে পারবে, বিএনপি সে সুযোগ দিতে চায় না।

এভাবে নানা কারণে, একদিকে সে এলাকায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে পদ্মা সেতুর প্রয়োজনীয়তা এবং অন্যদিকে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে সেতু নির্মাণের বিষয়টি সে এলাকার মানুষের জেদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে থেকেই এটা তাদের স্বপ্ন হয়ে ওঠে। একইভাবে সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় জেদ ধরেন যেভাবেই হোক তার সরকারের আমলেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবেই। তিনি ঘোষণা করেন বিশ্বব্যাংকের টাকায় নয়, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে বাংলাদেশ। এরপর থেকেই পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি সবার স্বপ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয়। পদ্মা সেতু সম্পর্কে দেশের মানুষের মর্জি-মেজাজ অনুধাবন করে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রতিনিয়তই পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হিসেবে উল্লেখ করে সংবাদ প্রচার করতে শুরু করে।

এমন ঘটনার প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণ শুরুর পর থেকেই পদ্মা সেতু প্রচার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ খবরের মর্যাদা পাচ্ছে পদ্মা সেতু। সেতুর একেকটি পর্যায় নির্মাণ হওয়ার পরপরই সংবাদপত্রে লিড, দ্বিতীয় লিড নিউজের মর্যাদা পাচ্ছে। মানুষের স্বপ্নের সেতু না হলে সংবাদপত্র এত গুরুত্ব দিত বলে মনে করেন না সাধারণ মানুষ।

পদ্মা সেতুর প্রাথমিক কাঠামো পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল গত ১০ ডিসেম্বর। সেদিন দুপুর ১২টা ২ মিনিটে সেতুর কাঠামোর সব স্প্যান বসানো শেষ হয়। এর মধ্যদিয়ে যুক্ত হয় পদ্মার দুই পাড়। শেষ স্প্যানটি পাঠানোর আগে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে তৈরি হয় আনন্দঘন মুহূর্ত। স্প্যানটি সাজানো হয় বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা দিয়ে। স্প্যানের গায়ে বাংলা, ইংরেজি, চাইনিজ ভাষায় লেখা বিশেষ বার্তায় বলা হয়েছে, বহু বছরের প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি শ্রম শক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে। শেষ স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তটি উদযাপনের বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছিল সেতু বিভাগ। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। অনেকটাই অনাড়ম্বরভাবেই স্প্যান তোলার কাজ সম্পন্ন হয়। তবে শেষ স্প্যান বসানোর মধ্যদিয়ে পদ্মার মূল কাঠামো চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার এ আনন্দ চেপে রাখতে পারেননি পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ। বাঁধভাঙা স্রোতের মতো সবাই জড়ো হন নদীর পাড়ে। সবার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি পৌঁছার আনন্দ। ঢোল পিটিয়ে আতশবাজি ফুটিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেন পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। এ থেকেও বোঝা যায় পদ্মা সেতু তাদের মনে কত স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে।

গত শনিবার গিয়েছিলাম পদ্মার দুই পাড়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখতে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পুরো শেষ হতে আরও এক বছর লাগবে। কিন্তু দুই পাড়ের মানুষের জীবনমান এরই মধ্যে পাল্টে যেতে শুরু করেছে। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে পদ্মার পশ্চিমপাড়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার প্রায় সব উপজেলা এবং পশ্চিমপাড়ের জাজিরা উপজেলা থেকে শরীয়তপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এলাকা ঘুরে এবং লোকজনের সঙ্গে কথা বললে তাদের অন্তরের খুশি এবং উন্নয়ন চিন্তা টের পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার যারা কিছুটা অবস্থাপন্ন তারা এখন পরিকল্পনা করছেন তাদের নিজ বাড়িঘরে-জমিতে ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের। তাদের চিন্তা; পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তাদের এলাকার উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী খুব সহজেই এবং কম খরচে বাংলাদেশের যে কোন এলাকায় নিয়ে বাজারজাত করা সম্ভব হবে। তাদের নিজের বাড়িতেই যেহেতু জমি-জায়গা আছে ফলে নামমাত্র খরচে তারা শিল্প স্থাপন করতে পারবেন। আর যেহেতু সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত সহজ হয়ে যাচ্ছে সেহেতু সে এলাকায় শিল্প স্থাপনের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংগুলোও ঋণ দিতে আগ্রহী হবে। এসব চিন্তা এখন স্থানীয় ধনী লোকদের মাথায় খেলছে। একজন দোকানদার যিনি তার গ্রামে বসে বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখার চিন্তাও করেননি। তিনি এখন তার বাড়ির পাশের জমিতে মুরগি এবং নিজের পুকুরে হাঁস পালনের পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন, এখন কাজ শুরুর অপেক্ষা মাত্র।

তবে এত অনন্দের মধ্যে কিছু লোকের মধ্যে দুঃখবোধও চেপে বসেছে। সে দুঃখ ভিন্নরকম দুঃখ। পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর পদ্মার দুই পাড়ের প্রায় ২০-২৫ হাজার লোক বেকার হয়ে পড়বেন। এ ব্যাপারে কথা বলে জানতে পারলাম তাদের দুশ্চিন্তার কারণ। গাড়ি পারাপারের আবুল নামের এক ফেরিওয়ালা অনেকটা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে জানালেন, আর এক বছর পর আমাকে এখানে আর পাবেন না। কেন- জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, দেখছেন না এ নদীতে সেতু হচ্ছে, লোকজন বলাবলি করছে আর এক বছরের মধ্যেই সেতু চালু হয়ে যাবে। তখন তো কোন ফেরি চলবে না, গাড়ি ঢাকা থেকে এসে সোজা সেতু দিয়ে নদী পেরিয়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশালসহ দক্ষিণের সব জেলায় পৌঁছে যাবে। ফেরি না থাকলে আমার কাছ থেকে চানাচুর, সিদ্ধ ডিম, ঝালমুড়ি কে আর খাবে। আমি চিন্তা করছি, গ্রামে গিয়ে আলুর ক্ষেতে কাজ করব। অনেকে ভাবছেন ঢাকায় গিয়ে হকারি করবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পদ্মায় প্রায় ৮শ’র মতো স্পিডবোট, লঞ্চ, নৌকা চলাচল করে। প্রতিটি যানে গড়ে ৪ জন কাজ করেন, অর্থাৎ ৪টি পরিবার। সেতু চালু হলে তারা সবাই বেকার হয়ে পড়বেন। তাদের সবাইকে অন্য কাজ জোগাড় করতে হবে। তবে সবার পক্ষে হয়তো নতুন কাজ সে এলাকায় পাওয়া সম্ভব হবে না। তাদের অনেকেই নিজ বাড়িতে থেকে নদীর দুই পাড়ে নানা কাজ করতে পারতেন। সেতু হলে তাদের সেসব কাজ থাকবে না।

নদীর দুই পাড়ে প্রায় হাজার খানেক হোটেল-রেস্তোরাঁ সে পথে চলাচলকারী লোকজনের খাবার জোগান দিচ্ছিল। সেতু হলে এসব হোটেল-রেস্তোরাঁ আর থাকবে না। অনেকেরই দূরে কোথাও গিয়ে অন্য কিছু করার সঙ্গতি নেই। তাদের আবার ফিরে যেতে হবে গ্রামের কৃষি কাজের শ্রমিক হিসেবে।

সেতু হলে এত মানুষের বেকার বা পেশা বদলের যে দুশ্চিন্তা সেসব বিষয় নিয়ে ভাবার লোক নেই সেখানে। সবাই শুধু ভবিষ্যতে সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখছেন।