একযোগে ৬৪ জেলায় টিকা কর্মসূচি

এক সপ্তাহ পরই দেশে আসছে করোনার টিকা (ভ্যাকসিন)। ৬৪ জেলায় একযোগে শুরু হবে টিকাদান কর্মসূচি। প্রথমে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, এরপর ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ও কমিউনিটি ক্লিনিকে টিকা দেয়া হবে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে গতকাল শুরু হয়েছে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। মহামারীকালে এই টিকার সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং টিকা গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাই এখন স্বাস্থ্য বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু

প্রতিমাসে ৫০ লাখ করে আগামী চার মাসে দুই কোটি মানুষকে করোনার টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। কেন্দ্রীয়ভাবে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।

টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকাদান) ডা. শামসুল হক গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আজ থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। আজকে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণ হয়েছে। এরপর জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রশিক্ষণ পাবেন, তারা গিয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবেন।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রণয়ন করা প্রশিক্ষণ সহায়তার আলোকেই টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া অনলাইন প্রশিক্ষণ, মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ ও বাজেট চূড়ান্তকরণের কাজও এই প্রশিক্ষণ নির্দেশিকার আলোকে হচ্ছে। এই নির্দেশিকা ১৮ জানুয়ারির মধ্যে সব জেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এছাড়া জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের (ডেপুটি সিভিল সার্জন, ইউএইচএফপিও) টিকা বিষয়ক প্রশিক্ষণ আগামী ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের (ট্রেইনার) প্রশিক্ষণ ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি এবং টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ ২৩ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। আর ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি হবে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের ওরিয়েনটেশন।

করোনার টিকা দেয়ার জন্য দেশব্যাপী সাত হাজার ৩৪৪টি দল তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একটি দলের মধ্যে ছয়জন সদস্য থাকবে। এর মধ্যে দু’জন টিকাদানকারী (নার্স, স্যাকমো, পরিবারকল্যাণ সহকারী) ও চারজন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। তারাই উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা সদর হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, পুলিশ-বিজেপি হাসপাতাল ও সিএমএইচ, বক্ষব্যাধি হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন।

টিকা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রচার-প্রচারণার শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচার ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘তিনটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রথমত, অগ্রাধিকারের তালিকা তৈরির বিষয়ে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা হবে। এরপর মানুষকে বোঝানো হবে টিকা দেয়া কেন দরকার। তৃতীয়ত, টিকা দেয়ার পর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে কী করতে হবে- সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হবে।’

টিকা কার্যক্রমে মাঠের চ্যালেঞ্জ

করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচার ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমরা সচরাচর শিশুদের টিকা দিয়ে থাকি। কিন্তু করোনার টিকা দেয়া হবে অ্যাডাল্ট (প্রাপ্ত বয়স্ক) নাগরিকদের। এ কারণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, অনেকে হুড়োহুড়ি লাগাতে পারে, তালিকা করতে গিয়েও সমস্যা হতে পারে, শক্তিমানরা যদি শক্তি দেখায়- তাতেও সমস্যা হতে পারে, এগুলো ম্যানেজ করাই চ্যালেঞ্জ।’

নির্দিষ্ট কাঠামো অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়ে আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা স্বাস্থ্য কেন্দ্র্রগুলোতে টিকা পাবেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা হবে। পরবর্তীতে বয়সভিত্তিক যখন টিকা দেয়া হবে, তখন ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ও কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে যাবে। আর প্রাতিষ্ঠানিক অর্থাৎ বিভিন্ন অফিসের কর্মীদের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে বলা হবে, বিভিন্ন পেশায় যারা আছেন, যারা অর্গানাইজড। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বস্তরের মানুষকে এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে।’

মানুষকে সচেতন করতে নানা ধরনের প্রচার কৌশল হাতে নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এক ধরনের পরীক্ষামূলক প্রকাশ ঘটবে। সবাইকে ধৈর্য ধরে পর্যায়ক্রমে টিকা নেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা, টিকা সম্পর্কে মানুষের কোন ধরনের ভয় বা বিভ্রান্তি না থাকে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।’

রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসক (কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত) নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘করোনার ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু করার আগে স্বাস্থ্য বিভাগের সতর্কতার সঙ্গে এ সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা চালানো উচিৎ। কারণ প্রথমত, করোনার কোন টিকাই চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি, গবেষণাও চলমান। আবার মহামারীর রাশ টেনে ধরতে জরুরি অনুমোদনের বিকল্পও নেই। কিন্তু টিকার নেতিবাচক দিক নিয়ে নানা মাধ্যমের অপপ্রচারে মানুষ যাতে বিভ্রান্ত না হয় সে বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে পদক্ষেপ নিতে হবে। মহামারী সময়ে এই ধরনের অপপ্রচার সামাল দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’

ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে নানা রকম অপপ্রচার শুরু হয়েছেÑ মন্তব্য করে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘বর্তমানে বিশ^ব্যাপী ৬/৭টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিনের প্রয়োগ চলছে। সবাই নিজেদের ভ্যাকসিনকে ভালো বা বেশি কার্যকর দাবি করছে। এটি বেশি বেশি প্রচার হচ্ছে, যাতে বিভ্রান্তি আরও বাড়ছে। এ কারণে আমাদের যেসব ভ্যাকসিন দেয়া হবে, সেগুলোর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।’

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ উদ্ভাবিত করোনার টিকা আগামী ২১-২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে আসবে বলে গত ১১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি জানান, প্রথম ধাপে ৫০ লাখ টিকা আসবে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই মানুষ টিকা পাবে।

টিকার সম্মতিপত্র নিয়ে বিভ্রান্তি

করোনার টিকা নিতে হলে আগ্রহী ব্যক্তিকে একটি সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ‘এতে বলা থাকবে, আমি স্বজ্ঞানে, স্ব-ইচ্ছায় এই টিকা নিচ্ছি।’

টিকা বিতরণ কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. শামসুল হক বলেন, ‘যাকে আমরা টিকা দিচ্ছি, তার একটা অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। আমরা একটি সম্মতিপত্র তৈরি করেছি। সেখানে রেজিস্ট্রেশন নম্বর, তারিখ, পরিচয়পত্র ও নাম থাকবে। সম্মতিপত্রে লেখা থাকবে- করোনার টিকা সম্পর্কে আমাকে অনলাইনে এবং সামনাসামনি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই টিকা গ্রহণের সময়, অথবা পরে যেকোন অসুস্থতা, আঘাত বা ক্ষতি হলে, তার দায়ভার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা সরকারের নয়। টিকাদান পরবর্তী প্রতিবেদন, অথবা গবেষণাপত্র তৈরির বিষয়ে অনুমতি দিলাম। আমি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে এই টিকার উপকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে টিকা গ্রহণে সম্মত আছি।’

এই সম্মতিপত্রের কারণে টিকা গ্রহণে মানুষের মধ্যে অনীহা দেখা দিতে পারে কীনা জানতে চাইলে আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এতে এতোটা শঙ্কার কারণ নেই। কারণ যেকোন অপারেশনের সময়ও আমরা অঙ্গীকারনামা দেই। প্রশ্ন আসতে পারে, যে কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিন তৈরি করেছে তাদের দায়মুক্তি দিতে হবে। কারণ হলো- ইর্মাজেন্সি ইউজ অথরাইজেশন। এটি এই কারণে যে, এগুলিকে (টিকা) ফার্মানেন্ট লাইসেন্স দেয়া হয়নি। মহামারীকে প্রতিরোধ করার জন্য ছয় মাসের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের পর কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা দেখে এগুলিকে (টিকা) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিনের মারাত্মক কোন পাশর্^প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, ‘অনেকে হয়তো টিকা নেবে না, যদি কেউ না দেয়, সেটা না হয় থেকে যাবে। আমরা চেষ্টা করব বেশি মানুষকে টিকা দিতে।’

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২১ , ৩০ পৌষ ১৪২৭, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

একযোগে ৬৪ জেলায় টিকা কর্মসূচি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

এক সপ্তাহ পরই দেশে আসছে করোনার টিকা (ভ্যাকসিন)। ৬৪ জেলায় একযোগে শুরু হবে টিকাদান কর্মসূচি। প্রথমে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, এরপর ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ও কমিউনিটি ক্লিনিকে টিকা দেয়া হবে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে গতকাল শুরু হয়েছে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। মহামারীকালে এই টিকার সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং টিকা গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাই এখন স্বাস্থ্য বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু

প্রতিমাসে ৫০ লাখ করে আগামী চার মাসে দুই কোটি মানুষকে করোনার টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। কেন্দ্রীয়ভাবে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।

টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকাদান) ডা. শামসুল হক গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আজ থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। আজকে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণ হয়েছে। এরপর জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রশিক্ষণ পাবেন, তারা গিয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবেন।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রণয়ন করা প্রশিক্ষণ সহায়তার আলোকেই টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া অনলাইন প্রশিক্ষণ, মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ ও বাজেট চূড়ান্তকরণের কাজও এই প্রশিক্ষণ নির্দেশিকার আলোকে হচ্ছে। এই নির্দেশিকা ১৮ জানুয়ারির মধ্যে সব জেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এছাড়া জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের (ডেপুটি সিভিল সার্জন, ইউএইচএফপিও) টিকা বিষয়ক প্রশিক্ষণ আগামী ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের (ট্রেইনার) প্রশিক্ষণ ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি এবং টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ ২৩ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। আর ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি হবে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের ওরিয়েনটেশন।

করোনার টিকা দেয়ার জন্য দেশব্যাপী সাত হাজার ৩৪৪টি দল তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একটি দলের মধ্যে ছয়জন সদস্য থাকবে। এর মধ্যে দু’জন টিকাদানকারী (নার্স, স্যাকমো, পরিবারকল্যাণ সহকারী) ও চারজন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। তারাই উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা সদর হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, পুলিশ-বিজেপি হাসপাতাল ও সিএমএইচ, বক্ষব্যাধি হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন।

টিকা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রচার-প্রচারণার শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচার ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘তিনটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রথমত, অগ্রাধিকারের তালিকা তৈরির বিষয়ে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা হবে। এরপর মানুষকে বোঝানো হবে টিকা দেয়া কেন দরকার। তৃতীয়ত, টিকা দেয়ার পর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে কী করতে হবে- সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হবে।’

টিকা কার্যক্রমে মাঠের চ্যালেঞ্জ

করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচার ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমরা সচরাচর শিশুদের টিকা দিয়ে থাকি। কিন্তু করোনার টিকা দেয়া হবে অ্যাডাল্ট (প্রাপ্ত বয়স্ক) নাগরিকদের। এ কারণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, অনেকে হুড়োহুড়ি লাগাতে পারে, তালিকা করতে গিয়েও সমস্যা হতে পারে, শক্তিমানরা যদি শক্তি দেখায়- তাতেও সমস্যা হতে পারে, এগুলো ম্যানেজ করাই চ্যালেঞ্জ।’

নির্দিষ্ট কাঠামো অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়ে আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা স্বাস্থ্য কেন্দ্র্রগুলোতে টিকা পাবেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা হবে। পরবর্তীতে বয়সভিত্তিক যখন টিকা দেয়া হবে, তখন ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ও কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে যাবে। আর প্রাতিষ্ঠানিক অর্থাৎ বিভিন্ন অফিসের কর্মীদের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে বলা হবে, বিভিন্ন পেশায় যারা আছেন, যারা অর্গানাইজড। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বস্তরের মানুষকে এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে।’

মানুষকে সচেতন করতে নানা ধরনের প্রচার কৌশল হাতে নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এক ধরনের পরীক্ষামূলক প্রকাশ ঘটবে। সবাইকে ধৈর্য ধরে পর্যায়ক্রমে টিকা নেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা, টিকা সম্পর্কে মানুষের কোন ধরনের ভয় বা বিভ্রান্তি না থাকে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।’

রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসক (কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত) নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘করোনার ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু করার আগে স্বাস্থ্য বিভাগের সতর্কতার সঙ্গে এ সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা চালানো উচিৎ। কারণ প্রথমত, করোনার কোন টিকাই চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি, গবেষণাও চলমান। আবার মহামারীর রাশ টেনে ধরতে জরুরি অনুমোদনের বিকল্পও নেই। কিন্তু টিকার নেতিবাচক দিক নিয়ে নানা মাধ্যমের অপপ্রচারে মানুষ যাতে বিভ্রান্ত না হয় সে বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে পদক্ষেপ নিতে হবে। মহামারী সময়ে এই ধরনের অপপ্রচার সামাল দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’

ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে নানা রকম অপপ্রচার শুরু হয়েছেÑ মন্তব্য করে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘বর্তমানে বিশ^ব্যাপী ৬/৭টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিনের প্রয়োগ চলছে। সবাই নিজেদের ভ্যাকসিনকে ভালো বা বেশি কার্যকর দাবি করছে। এটি বেশি বেশি প্রচার হচ্ছে, যাতে বিভ্রান্তি আরও বাড়ছে। এ কারণে আমাদের যেসব ভ্যাকসিন দেয়া হবে, সেগুলোর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।’

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ উদ্ভাবিত করোনার টিকা আগামী ২১-২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে আসবে বলে গত ১১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি জানান, প্রথম ধাপে ৫০ লাখ টিকা আসবে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই মানুষ টিকা পাবে।

টিকার সম্মতিপত্র নিয়ে বিভ্রান্তি

করোনার টিকা নিতে হলে আগ্রহী ব্যক্তিকে একটি সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ‘এতে বলা থাকবে, আমি স্বজ্ঞানে, স্ব-ইচ্ছায় এই টিকা নিচ্ছি।’

টিকা বিতরণ কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. শামসুল হক বলেন, ‘যাকে আমরা টিকা দিচ্ছি, তার একটা অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। আমরা একটি সম্মতিপত্র তৈরি করেছি। সেখানে রেজিস্ট্রেশন নম্বর, তারিখ, পরিচয়পত্র ও নাম থাকবে। সম্মতিপত্রে লেখা থাকবে- করোনার টিকা সম্পর্কে আমাকে অনলাইনে এবং সামনাসামনি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই টিকা গ্রহণের সময়, অথবা পরে যেকোন অসুস্থতা, আঘাত বা ক্ষতি হলে, তার দায়ভার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা সরকারের নয়। টিকাদান পরবর্তী প্রতিবেদন, অথবা গবেষণাপত্র তৈরির বিষয়ে অনুমতি দিলাম। আমি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে এই টিকার উপকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে টিকা গ্রহণে সম্মত আছি।’

এই সম্মতিপত্রের কারণে টিকা গ্রহণে মানুষের মধ্যে অনীহা দেখা দিতে পারে কীনা জানতে চাইলে আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এতে এতোটা শঙ্কার কারণ নেই। কারণ যেকোন অপারেশনের সময়ও আমরা অঙ্গীকারনামা দেই। প্রশ্ন আসতে পারে, যে কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিন তৈরি করেছে তাদের দায়মুক্তি দিতে হবে। কারণ হলো- ইর্মাজেন্সি ইউজ অথরাইজেশন। এটি এই কারণে যে, এগুলিকে (টিকা) ফার্মানেন্ট লাইসেন্স দেয়া হয়নি। মহামারীকে প্রতিরোধ করার জন্য ছয় মাসের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের পর কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা দেখে এগুলিকে (টিকা) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিনের মারাত্মক কোন পাশর্^প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, ‘অনেকে হয়তো টিকা নেবে না, যদি কেউ না দেয়, সেটা না হয় থেকে যাবে। আমরা চেষ্টা করব বেশি মানুষকে টিকা দিতে।’