বেসরকারি সিলিন্ডারের দাম ৮৬৬ টাকা করার সুপারিশ

সরকারি সাড়ে ১২ কেজির দাম ৯০২ টাকা

আবাসিকে রান্নায় ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি সব কোম্পানির ১২ কেজির সিলিন্ডারের মূল্য ৮৬৬ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি)। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি এলপিজির মূল্য ধরা হয়েছে ৭২ টাকা ১৪ পয়সা। এছাড়া বেসরকারি ৩৫ কেজির সিলিন্ডারের দাম ২৫২৫ টাকা, ৪৫ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৩২৪৬ টাকা করার সুপরিশ করেছে টিইসি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে চাহিদার প্রায় সাড়ে ৯৮ শতাংশ এলপিজি সরবরাহ করে।

এদিকে রাষ্ট্রীয় একমাত্র প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের (এলপিজিএল) প্রতি কেজি এলপিজির দাম ৭২ টাকা ১৭ পয়সা ধরে সরকারি সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের মূল্য ৯০২ টাকা করার প্রস্তাব করেছে টিইসি। তবে মোট মূল্যের সঙ্গে কারিগরি কমিটির যুক্ত করা ৩৩৩ টাকা সাবসিডি বাদ দিলে সরকারি সাড়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম দাড়ায় ৫৬৯ টাকা। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে দেশে মোট চাহিদার মাত্র দেড় শতাংশ এলপি গ্যাস সরবরাহ করছে।

গতকাল রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এলপি গ্যাসের মূল্য পুনঃনির্ধারণে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আয়োজিত গণশুনানিতে কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি এসব সুপারিশ করে।

শুনানি শেষে বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, ‘আগামী সাত দিনের মধ্যে লিখিত মতামত দেয়া যাবে। এরপর আবারও ছোট পরিসরে বসে দামের বিষয়ে মূল্যায়ন করে সবার স্বার্থ রক্ষা করে যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত দামের আদেশ দেবে কমিশন।’

দীর্ঘদিন পর হলেও সারাদেশে রান্নার জ্বালানি হিসেবে বহুল ব্যবহৃত এলপিজির অভিন্ন মূল্য নির্ধারণে বিইআরসির উদ্যোগকে স্বাগত জানান শুনানিতে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। তাদের মতে, বিইআরসি এলপিজির মূল্য ঘোষণা করে আদেশ জারি করলে ভোক্তা পর্যায়ে সুলভ ও নির্দিষ্ট মূল্যে এলপিজি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হবে। বন্ধ হবে বেসরকরি কোম্পানি, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির তৎপরতা।

কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিলের সভাপতিত্বে গতকাল কমিশন সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ আবু ফারুক, সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী, সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান এবং সদস্য (পেট্রোলিয়াম) মো. কামরুজ্জামান শুনানি গ্রহণ করেন। বিইআরসির সচিব রফিকুল ইসলামসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী-ভোক্তা সংগঠনসহ রাজনীতিক, সমাজকর্মী, অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করতে শুনানিতে অংশ নেন।

সকালে সূচনা বক্তব্যে কমিশন চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল জানান, সরকারি-বেসরকারি ২৯টি প্রতিষ্ঠান মূল্য নির্ধারণে তাদের প্রস্তাব কমিশনে জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান খান শুনানির শুরুতে তার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। এরপর বেসরকারি আঠাশটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংশ্লিষ্ট সমিতির ছয়জন প্রতিনিধি তাদের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির পক্ষে কমিশনের উপপরিচালক ও কমিটির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান সুপারিশগুলো তুলে ধরেন।

শুনানিতে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপি গ্যাসের দাম ১ হাজার ২৫৯ টাকার প্রস্তাব করে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সংগঠন এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব)। তবে প্রমিতা এলপিজি লিমিটেড ১২ কেজি এলপি গ্যাসের ১ হাজার ২৪ টাকা প্রস্তাব করে। অন্যদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেড-এলপিজিএল সাড়ে ১২ কেজি এলপি গ্যাসের দাম ৭০০ টাকা করার প্রস্তাব করে। যদিও এর বিদ্যমান মূল্য ৬০০ টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য উঠানামা বিবেচনায় দেশের বাজারে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম মাসে মাসে নির্ধারণ করার সুযোগ সৃষ্টিরও সুপারিশ করে টিইসি।

শুনানিতে জেরা পর্ব

এলপিজির দাম মাসে মাসে নির্ধারণ করার সুযোগ তৈরিতে টিইসির সুপারিশের আইন ও নীতিগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘আদালতের আদেশ পালন করতে গিয়ে এলপিজির দাম নির্ধারণের এই উদ্যোগে এখনই মাসে মাসে দাম নির্ধারণের নিয়ম চালু করার প্রয়োজন আছে কিনা, তা পুনঃবিবেচনা করা প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘মাসে মাসে মূল্যবৃদ্ধির এই প্রস্তাব বিইআরসি আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। সম্প্রতি সংসদে আইন করে বছরে একাধিকবার জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির যে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে তাও এভাবে নিশ্চিতভাবে মাসে মাসে মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগকে সমর্থন করে না। তাই কমিশন এ ধরনের চিন্তা পুনঃবিবেচনা করবে বলে আশা করি। আদালতের আদেশ পালন করা মানে এমন একটি সিদ্ধান্তে আসা নয়।‘ শুনানিতে সরকারি কোম্পানির গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এতে সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। ফলে চিনি শিল্পের মতো পরিণতির দিকে যাবে।

ক্যাবের জেরার জবাবে সাবসিডি বাবদ ওই অর্থ যোগ করার প্রয়োজন নেই বলে জানান এলপিজিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান খান।

সিপিবির প্রতিনিধি রুহিন হোসেন প্রিন্স শুনানিতে বলেন, রাষ্ট্রীয়খাতের উন্নয়ন না করে তাদের পণ্যের দাম এমন পর্যায়ে নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে করে রাষ্ট্রীয় খাত ধ্বংস হয়, ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়। রাষ্ট্রীয় সুলভ মূল্যের গ্যাস সেনাবাহিনীকে দেয়ার পর যা থাকে, তা পরিকল্পিতভাবে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, এনার্জি কমিশনের যে নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে তার প্রয়োগ না ঘটনার কারণে ভোক্তাদের তাদের দাবি আদায়ে আদালতের দ্বারস্ত হতে হয়। আশা করব এই শুনানিতে সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা হবে।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর টিইসির সুপারিশের আলোকে ভোক্তাদের লাভ-ক্ষতি নিয়ে যুক্ত উপস্থাপন করেন।

টিইসির ১৪ দফা সুপারিশ

ভোক্তা পর্যায়ে সুলভ ও নিরাপদে এলপি গ্যাস পৌঁছানো নিশ্চিতকরণে ১৪ দফা সুপারিশ করে টিইসি। সুপারিশে বলা হয়, সাধারণভাবে সব ক্ষেত্রের জন্য এলপিজি’র (অটোগ্যাসসহ) মিশ্রণে প্রোপেন ৩০% থেকে ৪০% এবং করেসপন্ডিং বিউটেন ৭০% থেকে ৬০% এরমধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে। প্রোপেনের অধিক হিটিং ভ্যালু এবং আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য বিবেচনায় মূল্যহার নির্ধারণে প্রোপেন এবং বিউটেনের অনুপাত ৪০:৬০ বিবেচনা করা যেতে পারে। সৌদি আরামকো কর্তৃক মাসভিত্তিক ঘোষিত এলপিজি’র সৌদি কন্ট্রাক্ট প্রাইস (সৌদি সিপি) বিবেচনায় কমিশন কর্তৃক সারাদেশে এলপিজির অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণে কমিটি একটি ফর্মূলাও দেয়া হয়। গাড়িতে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ফর্মূলাও উল্লেখ করা হয় সুপারিশে।

এছাড়া সিলিন্ডারের গায়ে মূল্য ও মেয়াদ লেখা, এলপিজির দাম কমাতে মধ্যম আকারের জাহাজের মাধ্যমে আমদানি এবং ভোক্তা পর্যায়ে ভর্তুকি দেয়ার কথাও বলা হয় টিইসির সুপারিশে।

বিইআরসি’র পরিচালক (গ্যাস) সিএফকে মুসাদ্দেক আহমদকে আহ্বায়ক এবং উপপরিচালক (ট্যারিফ) কামরুজ্জামানকে সদস্য সচিব করে গঠিত সাত সদস্যের ওই কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন বিইআরসি’র পরিচালক (পেট্রোলিয়াম) ড. মো. দিদারুল আলম, উপপরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. শরিফুল ইসলাম শাহীন, উপপরিচালক (গ্যাস) মো. নুরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক (গ্যাস-২) নাজিয়া হক ও সহকারী পরিচালক (ট্যারিফ-২) রাজু আহমেদ।

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২১ , ১ মাঘ ১৪২৭, ১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

এলপি গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ বিইআরসির

বেসরকারি সিলিন্ডারের দাম ৮৬৬ টাকা করার সুপারিশ

সরকারি সাড়ে ১২ কেজির দাম ৯০২ টাকা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

আবাসিকে রান্নায় ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি সব কোম্পানির ১২ কেজির সিলিন্ডারের মূল্য ৮৬৬ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি)। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি এলপিজির মূল্য ধরা হয়েছে ৭২ টাকা ১৪ পয়সা। এছাড়া বেসরকারি ৩৫ কেজির সিলিন্ডারের দাম ২৫২৫ টাকা, ৪৫ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৩২৪৬ টাকা করার সুপরিশ করেছে টিইসি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে চাহিদার প্রায় সাড়ে ৯৮ শতাংশ এলপিজি সরবরাহ করে।

এদিকে রাষ্ট্রীয় একমাত্র প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের (এলপিজিএল) প্রতি কেজি এলপিজির দাম ৭২ টাকা ১৭ পয়সা ধরে সরকারি সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের মূল্য ৯০২ টাকা করার প্রস্তাব করেছে টিইসি। তবে মোট মূল্যের সঙ্গে কারিগরি কমিটির যুক্ত করা ৩৩৩ টাকা সাবসিডি বাদ দিলে সরকারি সাড়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম দাড়ায় ৫৬৯ টাকা। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে দেশে মোট চাহিদার মাত্র দেড় শতাংশ এলপি গ্যাস সরবরাহ করছে।

গতকাল রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এলপি গ্যাসের মূল্য পুনঃনির্ধারণে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আয়োজিত গণশুনানিতে কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি এসব সুপারিশ করে।

শুনানি শেষে বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, ‘আগামী সাত দিনের মধ্যে লিখিত মতামত দেয়া যাবে। এরপর আবারও ছোট পরিসরে বসে দামের বিষয়ে মূল্যায়ন করে সবার স্বার্থ রক্ষা করে যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত দামের আদেশ দেবে কমিশন।’

দীর্ঘদিন পর হলেও সারাদেশে রান্নার জ্বালানি হিসেবে বহুল ব্যবহৃত এলপিজির অভিন্ন মূল্য নির্ধারণে বিইআরসির উদ্যোগকে স্বাগত জানান শুনানিতে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। তাদের মতে, বিইআরসি এলপিজির মূল্য ঘোষণা করে আদেশ জারি করলে ভোক্তা পর্যায়ে সুলভ ও নির্দিষ্ট মূল্যে এলপিজি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হবে। বন্ধ হবে বেসরকরি কোম্পানি, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির তৎপরতা।

কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিলের সভাপতিত্বে গতকাল কমিশন সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ আবু ফারুক, সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী, সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান এবং সদস্য (পেট্রোলিয়াম) মো. কামরুজ্জামান শুনানি গ্রহণ করেন। বিইআরসির সচিব রফিকুল ইসলামসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী-ভোক্তা সংগঠনসহ রাজনীতিক, সমাজকর্মী, অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করতে শুনানিতে অংশ নেন।

সকালে সূচনা বক্তব্যে কমিশন চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল জানান, সরকারি-বেসরকারি ২৯টি প্রতিষ্ঠান মূল্য নির্ধারণে তাদের প্রস্তাব কমিশনে জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান খান শুনানির শুরুতে তার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। এরপর বেসরকারি আঠাশটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংশ্লিষ্ট সমিতির ছয়জন প্রতিনিধি তাদের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির পক্ষে কমিশনের উপপরিচালক ও কমিটির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান সুপারিশগুলো তুলে ধরেন।

শুনানিতে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপি গ্যাসের দাম ১ হাজার ২৫৯ টাকার প্রস্তাব করে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সংগঠন এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব)। তবে প্রমিতা এলপিজি লিমিটেড ১২ কেজি এলপি গ্যাসের ১ হাজার ২৪ টাকা প্রস্তাব করে। অন্যদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেড-এলপিজিএল সাড়ে ১২ কেজি এলপি গ্যাসের দাম ৭০০ টাকা করার প্রস্তাব করে। যদিও এর বিদ্যমান মূল্য ৬০০ টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য উঠানামা বিবেচনায় দেশের বাজারে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম মাসে মাসে নির্ধারণ করার সুযোগ সৃষ্টিরও সুপারিশ করে টিইসি।

শুনানিতে জেরা পর্ব

এলপিজির দাম মাসে মাসে নির্ধারণ করার সুযোগ তৈরিতে টিইসির সুপারিশের আইন ও নীতিগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘আদালতের আদেশ পালন করতে গিয়ে এলপিজির দাম নির্ধারণের এই উদ্যোগে এখনই মাসে মাসে দাম নির্ধারণের নিয়ম চালু করার প্রয়োজন আছে কিনা, তা পুনঃবিবেচনা করা প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘মাসে মাসে মূল্যবৃদ্ধির এই প্রস্তাব বিইআরসি আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। সম্প্রতি সংসদে আইন করে বছরে একাধিকবার জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির যে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে তাও এভাবে নিশ্চিতভাবে মাসে মাসে মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগকে সমর্থন করে না। তাই কমিশন এ ধরনের চিন্তা পুনঃবিবেচনা করবে বলে আশা করি। আদালতের আদেশ পালন করা মানে এমন একটি সিদ্ধান্তে আসা নয়।‘ শুনানিতে সরকারি কোম্পানির গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এতে সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। ফলে চিনি শিল্পের মতো পরিণতির দিকে যাবে।

ক্যাবের জেরার জবাবে সাবসিডি বাবদ ওই অর্থ যোগ করার প্রয়োজন নেই বলে জানান এলপিজিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান খান।

সিপিবির প্রতিনিধি রুহিন হোসেন প্রিন্স শুনানিতে বলেন, রাষ্ট্রীয়খাতের উন্নয়ন না করে তাদের পণ্যের দাম এমন পর্যায়ে নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে করে রাষ্ট্রীয় খাত ধ্বংস হয়, ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়। রাষ্ট্রীয় সুলভ মূল্যের গ্যাস সেনাবাহিনীকে দেয়ার পর যা থাকে, তা পরিকল্পিতভাবে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, এনার্জি কমিশনের যে নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে তার প্রয়োগ না ঘটনার কারণে ভোক্তাদের তাদের দাবি আদায়ে আদালতের দ্বারস্ত হতে হয়। আশা করব এই শুনানিতে সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা হবে।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর টিইসির সুপারিশের আলোকে ভোক্তাদের লাভ-ক্ষতি নিয়ে যুক্ত উপস্থাপন করেন।

টিইসির ১৪ দফা সুপারিশ

ভোক্তা পর্যায়ে সুলভ ও নিরাপদে এলপি গ্যাস পৌঁছানো নিশ্চিতকরণে ১৪ দফা সুপারিশ করে টিইসি। সুপারিশে বলা হয়, সাধারণভাবে সব ক্ষেত্রের জন্য এলপিজি’র (অটোগ্যাসসহ) মিশ্রণে প্রোপেন ৩০% থেকে ৪০% এবং করেসপন্ডিং বিউটেন ৭০% থেকে ৬০% এরমধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে। প্রোপেনের অধিক হিটিং ভ্যালু এবং আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য বিবেচনায় মূল্যহার নির্ধারণে প্রোপেন এবং বিউটেনের অনুপাত ৪০:৬০ বিবেচনা করা যেতে পারে। সৌদি আরামকো কর্তৃক মাসভিত্তিক ঘোষিত এলপিজি’র সৌদি কন্ট্রাক্ট প্রাইস (সৌদি সিপি) বিবেচনায় কমিশন কর্তৃক সারাদেশে এলপিজির অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণে কমিটি একটি ফর্মূলাও দেয়া হয়। গাড়িতে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ফর্মূলাও উল্লেখ করা হয় সুপারিশে।

এছাড়া সিলিন্ডারের গায়ে মূল্য ও মেয়াদ লেখা, এলপিজির দাম কমাতে মধ্যম আকারের জাহাজের মাধ্যমে আমদানি এবং ভোক্তা পর্যায়ে ভর্তুকি দেয়ার কথাও বলা হয় টিইসির সুপারিশে।

বিইআরসি’র পরিচালক (গ্যাস) সিএফকে মুসাদ্দেক আহমদকে আহ্বায়ক এবং উপপরিচালক (ট্যারিফ) কামরুজ্জামানকে সদস্য সচিব করে গঠিত সাত সদস্যের ওই কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন বিইআরসি’র পরিচালক (পেট্রোলিয়াম) ড. মো. দিদারুল আলম, উপপরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. শরিফুল ইসলাম শাহীন, উপপরিচালক (গ্যাস) মো. নুরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক (গ্যাস-২) নাজিয়া হক ও সহকারী পরিচালক (ট্যারিফ-২) রাজু আহমেদ।