চরমপন্থার জীবন দর্শন ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রত্যয়

তারা ৯ জন। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৭। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ছাত্র বা শ্রমজীবী। তারা সবাই জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হিজবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য ছিল। জঙ্গি সন্দেহে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে এদের অনুসরণ করছিল র্যাব। এখন তাদের গ্রেপ্তার না করে পুনর্বাসন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে র্যাব। তাদের পেশার ধরন অনুযায়ী পুনর্বাসন করা হবে। গতকাল র্যাব হেডকোয়ার্টারে তাদের ‘চরমপন্থার জীবনদর্শন ত্যাগ করে সমাজের মূলধারায় ফিরে’ আসা উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, র?্যাব মহাপরিচালক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। র?্যাব তাদের এই কর্মসূচিকে বলছে ‘নব দিগন্তের পথে’। এসব তরুণ-তরুণীকে সন্ত্রাস ও চরমপন্থার দর্শন থেকে সমাজের মূল ধারায় স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসাই এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য।

কুমিল্লার আবিদা জান্নাত আসমা সচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রী ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। পরিবারের অমতে স্কুলে পড়া অবস্থায় ওই যুবককে বিয়ে করে। আসমা তখন এসএসপি পরীক্ষার্থী। ২০১৯ সালে এসএসসি পাসের পর স্বামীর প্ররোচনায় উচ্চ শিক্ষার কথা বলে চীনে যায় আসমা। তখন আসমা জানতো না সে যাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে সে মূলত জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। দেশের বাইরে ৬ মাস অবস্থানের পর আসমা তার স্বামীর আসল রূপ জানতে পারে। আসমার ওপর চাপ বাড়তে থাকে স্বামীর জঙ্গি কার্যক্রমে সহযোগিতা করার। এক পর্যায়ে দেশে ফিরে এসে দেড় বছর বিভিন্ন জেলায় আত্মগোপনে থেকে আসমা সিদ্ধান্ত নেয় এ ভুল পথ ছেড়ে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে। র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসমা আত্মসমপর্ণের সিদ্ধান্ত নেয়। ধীর্ঘদিন ধরে র‌্যাবের ডি রেডিক্যালাইজেশন (বি জঙ্গিকরণ) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গতকাল আসমা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া, জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত থাকাকালীন পরিবার বিচ্ছিন জীবনের নানা কাহিনী বর্ণনা করেন। শুধু আসমাই নয় র‌্যাবের ডি র‌্যাডিক্যালাইজেশন প্রক্রিয়ায় ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, কোরআনে হাফেজসহ ৯ তরুণ তরুণী ও যুবক ফিরে এসেছে স্বাভাবিক জীবনে।

র‌্যাব জানায়, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা এ ৯ জনকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তারা হলোÑ সিলেটের শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪) এবং তার স্ত্রী ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯), চাঁদপুরের মোহাম্মদ হোসেন ওরফে হোসেন গাজী (২৩), মো. সাইফুল্লাহ (৩৭), ঝিনাইদহের সাইফুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গার মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬), মো. সাইদুর রহমান (২২) এবং কুমিল্লার আবদুর রহমান সোহেল। এরা সবাই আনসার আল ইসলাম, হিযুবত তাহরীর, জামিয়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি’র) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এদের মধ্যে আবদুর রহমান সোহেল, সাইদুর রহমান, আবদুল্লাহ আল মামুন জঙ্গি ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ফেরারি আসামি। অন্যরা কোন নাশকতামূলক অপরেশনে সম্পৃক্ত না হলেও দাওয়াতি কার্যক্রমের মধ্যে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত ছিল।

প্রতিক্রিয়ায় জঙ্গিবাদ থেকে ফিরে আসা আসমা জানায়, আমি যে ভুল পথে পা বাড়িয়েছি সেটি আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। একটি স্বাভাবিক জীবনে বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা সবকিছু থেকে দূরে সরে এসে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হয়। ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যে মানুষটি (আসমার স্বামী) ভুল পথে পা বাড়িয়েছে সেও আমার মতো কষ্টের জীবনযাপন করতে থাকে। সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি মানুষিকভাবে ভেঙে পড়ি। তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো। এমন পরিস্থিতিতে আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমপর্ণের সিদ্ধান্ত নেই। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করি। আসমা বলেন, আমি ভুল করে এ পথে এসেছি। কিন্তু আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছি। আমি চাই না আমার মতো কেউ এ ভুল পথে পা বাড়াক। সবাই যেন সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। আমি চাই আমার স্বামীও এ ভুল পথ থেকে ফিরে আসুক। সবাইকে বলবো নিজের আত্মীক মানসিকতার পরিচর্যা করুন। আমাদের যেন কারও ফাঁদে পড়তে না হয়। নিজেরা যেন নিজেদের ওপর জাজমেন্ট করতে পারি।

মেয়েকে ফিরে পেয়ে আসমার মা বলেন, আমরা দেশের একটি সাধারণ পরিবার। আসমা স্কুলজীবনে এ কাজে জড়িয়ে পড়ে যা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা আমাদের মেয়েকে ফিরে পেয়ে কৃতজ্ঞ।

সপরিবারে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ইঞ্জিনিয়ার শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করা অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে সে জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের দাওয়াতি কার্যক্রমে যুক্ত হয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত সে হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকে। এ সময় তার ঘণিষ্ঠ বন্ধুদের তার কার্যক্রমে মোটিভেট করে। ২০১৬ সালে সে হিজবুত তাহরীরে শীর্ষ পর্যায়ের নেতার নির্দেশে হিজরত করে এবং প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসে। ২০১৭ সালে সে পরিবারসহ ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে হিসবুত তাহরীরের সিকিউরিটি অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট শাখার দায়িত্ব নেন। হিজরতে থাকার সময় তার স্ত্রী ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে স্ত্রীসহ তাকে ওই সময় আত্মগোপনে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়। পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চিকিৎসক স্ত্রীর পেশাগত দিকটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এসব কারণে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এখন থেকে নতুন এক শাওনের জন্ম হলো।

ছেলেকে ফিরে পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার শাওনের ব্যাংকার বাবা বলেন, আমার ৩ ছেলেমেয়ের মধ্যে শাওন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেট্রোলিং বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। সামাজিকভাবে আমার অবস্থান থাকলেও আমার ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘরছাড়া হয়ে পড়ে। ওই সময়টি আমি আমার ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনতে পারিনি। আমি আমার ছেলের বউ, নাতি নাতনিদেরও দেখতে পারিনি। সন্তান বিপদগামী হলে বাবা-মায়ের যে কি বেদনা সেটি বুঝানো যাবে না। আমি বলবো আমাদের সন্তানদের বিপথে যাওয়া থেকে বাঁচাতে হলে আমাদের পরিবারগুলোকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। আমি চাই জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে আমাদের মতো কোন বাবা-মায়ের যেন এমন পরিস্থিতি তৈরি না হয়।

অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা এটা কখনই বলি না আমরা জঙ্গিবাদকে নিমূল করে দিয়েছি, বলি না মূল উৎপাটন করে দিয়েছি। আমরা শুধু বলি আমরা জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আমি পৃথিবীর অনেক দেশেই গিয়েছি। সব জায়গায় জিজ্ঞাসিত হয়েছি জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে তোমাদের মূল শক্তিটা কি? আমরা সবখানে গলা উঁচু করে বলতে পারি আমাদের দেশের জনগণ কোনদিন জঙ্গিবাদকে পছন্দ করে না। আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। সেজন্য আমরা সফল হয়েছি।

অনুষ্ঠানে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বলেন, আমরা যাদের সন্ত্রাসী বলি, সবাই সন্ত্রাসী নয়। কারও মনে সামান্য সিমপেথি থাকে, এক পর্যায়ে সাপোর্টার হয়ে যায়, এরপর এক্টিভিস্ট হয়। একস্ট্রিমিস্ট হওয়ার পর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। তখন সবাইকে শত্রু মনে করতে থাকে। তার ধারণায় আঘাত করতে হবে। যেটা শুধুমাত্র বন্দুক দিয়ে সম্ভব নয়। দরকার হয় ডিরেডিকেলাইজেশন।

অনুষ্ঠানে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম বলেন, আমাদের গোয়েন্দারা তাদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করে যোগাযোগ স্থাপন করে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রস্তাব দিয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে। এক পর্যায়ে তাদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করে। পরবর্তীতে মোটিভেশনের মাধ্যমে ডি রেডিক্যালইজেশন নতুন পন্থা অবলম্বর করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে তাদের নতুনভাবে সমাজে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

র‌্যাবের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে বেশকিছু জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে র‌্যাব। এক পর্যায়ে ওইসব জঙ্গিদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করে। র‌্যাবের ডি রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে বার বার যোগাযোগ করা হলেও অনেকেই আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ব্যাপারে কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। এ ৯ জনও দ্বিধাবিভক্তিতে ছিল। তাদের মধ্যে ভয় ছিল আত্মসমর্পণ করলে নানাকিছু হতে পারে। কিন্তু র‌্যাব হাল ছাড়েনি। ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে বার বার যোগাযোগ করে তাদের মোটিভেশন করতে সক্ষম হয় র‌্যাব। এক পর্যায়ে ওই ৯ জন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আগ্রহী হয়। তবে এখনও আরও একটি গ্রুপ রয়েছে তাদের পিছনে জোঁকের মতো লেগে আছে র‌্যাব। ওই গ্রুপটিকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই আছেন তারা নাশকাতমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত না হলেও জঙ্গিদের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। আবার অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন মামলায় ফেরারি। র‌্যাব ডি রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে তাদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে সমাজে পুনর্বাসনের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২১ , ১ মাঘ ১৪২৭, ১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

নবদিগন্তের পথে ওরা ৯ জন

চরমপন্থার জীবন দর্শন ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রত্যয়

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

তারা ৯ জন। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৭। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ছাত্র বা শ্রমজীবী। তারা সবাই জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হিজবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য ছিল। জঙ্গি সন্দেহে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে এদের অনুসরণ করছিল র্যাব। এখন তাদের গ্রেপ্তার না করে পুনর্বাসন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে র্যাব। তাদের পেশার ধরন অনুযায়ী পুনর্বাসন করা হবে। গতকাল র্যাব হেডকোয়ার্টারে তাদের ‘চরমপন্থার জীবনদর্শন ত্যাগ করে সমাজের মূলধারায় ফিরে’ আসা উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, র?্যাব মহাপরিচালক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। র?্যাব তাদের এই কর্মসূচিকে বলছে ‘নব দিগন্তের পথে’। এসব তরুণ-তরুণীকে সন্ত্রাস ও চরমপন্থার দর্শন থেকে সমাজের মূল ধারায় স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসাই এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য।

কুমিল্লার আবিদা জান্নাত আসমা সচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রী ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। পরিবারের অমতে স্কুলে পড়া অবস্থায় ওই যুবককে বিয়ে করে। আসমা তখন এসএসপি পরীক্ষার্থী। ২০১৯ সালে এসএসসি পাসের পর স্বামীর প্ররোচনায় উচ্চ শিক্ষার কথা বলে চীনে যায় আসমা। তখন আসমা জানতো না সে যাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে সে মূলত জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। দেশের বাইরে ৬ মাস অবস্থানের পর আসমা তার স্বামীর আসল রূপ জানতে পারে। আসমার ওপর চাপ বাড়তে থাকে স্বামীর জঙ্গি কার্যক্রমে সহযোগিতা করার। এক পর্যায়ে দেশে ফিরে এসে দেড় বছর বিভিন্ন জেলায় আত্মগোপনে থেকে আসমা সিদ্ধান্ত নেয় এ ভুল পথ ছেড়ে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে। র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসমা আত্মসমপর্ণের সিদ্ধান্ত নেয়। ধীর্ঘদিন ধরে র‌্যাবের ডি রেডিক্যালাইজেশন (বি জঙ্গিকরণ) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গতকাল আসমা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া, জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত থাকাকালীন পরিবার বিচ্ছিন জীবনের নানা কাহিনী বর্ণনা করেন। শুধু আসমাই নয় র‌্যাবের ডি র‌্যাডিক্যালাইজেশন প্রক্রিয়ায় ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, কোরআনে হাফেজসহ ৯ তরুণ তরুণী ও যুবক ফিরে এসেছে স্বাভাবিক জীবনে।

র‌্যাব জানায়, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা এ ৯ জনকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তারা হলোÑ সিলেটের শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪) এবং তার স্ত্রী ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯), চাঁদপুরের মোহাম্মদ হোসেন ওরফে হোসেন গাজী (২৩), মো. সাইফুল্লাহ (৩৭), ঝিনাইদহের সাইফুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গার মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬), মো. সাইদুর রহমান (২২) এবং কুমিল্লার আবদুর রহমান সোহেল। এরা সবাই আনসার আল ইসলাম, হিযুবত তাহরীর, জামিয়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি’র) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এদের মধ্যে আবদুর রহমান সোহেল, সাইদুর রহমান, আবদুল্লাহ আল মামুন জঙ্গি ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ফেরারি আসামি। অন্যরা কোন নাশকতামূলক অপরেশনে সম্পৃক্ত না হলেও দাওয়াতি কার্যক্রমের মধ্যে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত ছিল।

প্রতিক্রিয়ায় জঙ্গিবাদ থেকে ফিরে আসা আসমা জানায়, আমি যে ভুল পথে পা বাড়িয়েছি সেটি আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। একটি স্বাভাবিক জীবনে বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা সবকিছু থেকে দূরে সরে এসে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হয়। ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যে মানুষটি (আসমার স্বামী) ভুল পথে পা বাড়িয়েছে সেও আমার মতো কষ্টের জীবনযাপন করতে থাকে। সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি মানুষিকভাবে ভেঙে পড়ি। তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো। এমন পরিস্থিতিতে আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমপর্ণের সিদ্ধান্ত নেই। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করি। আসমা বলেন, আমি ভুল করে এ পথে এসেছি। কিন্তু আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছি। আমি চাই না আমার মতো কেউ এ ভুল পথে পা বাড়াক। সবাই যেন সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। আমি চাই আমার স্বামীও এ ভুল পথ থেকে ফিরে আসুক। সবাইকে বলবো নিজের আত্মীক মানসিকতার পরিচর্যা করুন। আমাদের যেন কারও ফাঁদে পড়তে না হয়। নিজেরা যেন নিজেদের ওপর জাজমেন্ট করতে পারি।

মেয়েকে ফিরে পেয়ে আসমার মা বলেন, আমরা দেশের একটি সাধারণ পরিবার। আসমা স্কুলজীবনে এ কাজে জড়িয়ে পড়ে যা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা আমাদের মেয়েকে ফিরে পেয়ে কৃতজ্ঞ।

সপরিবারে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ইঞ্জিনিয়ার শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করা অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে সে জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের দাওয়াতি কার্যক্রমে যুক্ত হয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত সে হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকে। এ সময় তার ঘণিষ্ঠ বন্ধুদের তার কার্যক্রমে মোটিভেট করে। ২০১৬ সালে সে হিজবুত তাহরীরে শীর্ষ পর্যায়ের নেতার নির্দেশে হিজরত করে এবং প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসে। ২০১৭ সালে সে পরিবারসহ ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে হিসবুত তাহরীরের সিকিউরিটি অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট শাখার দায়িত্ব নেন। হিজরতে থাকার সময় তার স্ত্রী ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে স্ত্রীসহ তাকে ওই সময় আত্মগোপনে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়। পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চিকিৎসক স্ত্রীর পেশাগত দিকটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এসব কারণে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এখন থেকে নতুন এক শাওনের জন্ম হলো।

ছেলেকে ফিরে পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার শাওনের ব্যাংকার বাবা বলেন, আমার ৩ ছেলেমেয়ের মধ্যে শাওন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেট্রোলিং বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। সামাজিকভাবে আমার অবস্থান থাকলেও আমার ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘরছাড়া হয়ে পড়ে। ওই সময়টি আমি আমার ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনতে পারিনি। আমি আমার ছেলের বউ, নাতি নাতনিদেরও দেখতে পারিনি। সন্তান বিপদগামী হলে বাবা-মায়ের যে কি বেদনা সেটি বুঝানো যাবে না। আমি বলবো আমাদের সন্তানদের বিপথে যাওয়া থেকে বাঁচাতে হলে আমাদের পরিবারগুলোকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। আমি চাই জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে আমাদের মতো কোন বাবা-মায়ের যেন এমন পরিস্থিতি তৈরি না হয়।

অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা এটা কখনই বলি না আমরা জঙ্গিবাদকে নিমূল করে দিয়েছি, বলি না মূল উৎপাটন করে দিয়েছি। আমরা শুধু বলি আমরা জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আমি পৃথিবীর অনেক দেশেই গিয়েছি। সব জায়গায় জিজ্ঞাসিত হয়েছি জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে তোমাদের মূল শক্তিটা কি? আমরা সবখানে গলা উঁচু করে বলতে পারি আমাদের দেশের জনগণ কোনদিন জঙ্গিবাদকে পছন্দ করে না। আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। সেজন্য আমরা সফল হয়েছি।

অনুষ্ঠানে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বলেন, আমরা যাদের সন্ত্রাসী বলি, সবাই সন্ত্রাসী নয়। কারও মনে সামান্য সিমপেথি থাকে, এক পর্যায়ে সাপোর্টার হয়ে যায়, এরপর এক্টিভিস্ট হয়। একস্ট্রিমিস্ট হওয়ার পর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। তখন সবাইকে শত্রু মনে করতে থাকে। তার ধারণায় আঘাত করতে হবে। যেটা শুধুমাত্র বন্দুক দিয়ে সম্ভব নয়। দরকার হয় ডিরেডিকেলাইজেশন।

অনুষ্ঠানে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম বলেন, আমাদের গোয়েন্দারা তাদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করে যোগাযোগ স্থাপন করে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রস্তাব দিয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে। এক পর্যায়ে তাদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করে। পরবর্তীতে মোটিভেশনের মাধ্যমে ডি রেডিক্যালইজেশন নতুন পন্থা অবলম্বর করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে তাদের নতুনভাবে সমাজে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

র‌্যাবের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে বেশকিছু জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে র‌্যাব। এক পর্যায়ে ওইসব জঙ্গিদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করে। র‌্যাবের ডি রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে বার বার যোগাযোগ করা হলেও অনেকেই আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ব্যাপারে কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। এ ৯ জনও দ্বিধাবিভক্তিতে ছিল। তাদের মধ্যে ভয় ছিল আত্মসমর্পণ করলে নানাকিছু হতে পারে। কিন্তু র‌্যাব হাল ছাড়েনি। ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে বার বার যোগাযোগ করে তাদের মোটিভেশন করতে সক্ষম হয় র‌্যাব। এক পর্যায়ে ওই ৯ জন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আগ্রহী হয়। তবে এখনও আরও একটি গ্রুপ রয়েছে তাদের পিছনে জোঁকের মতো লেগে আছে র‌্যাব। ওই গ্রুপটিকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই আছেন তারা নাশকাতমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত না হলেও জঙ্গিদের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। আবার অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন মামলায় ফেরারি। র‌্যাব ডি রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে তাদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে সমাজে পুনর্বাসনের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।