ধর্ষণের ২৫ মামলায় বিচারে অসঙ্গতি পর্যবেক্ষণ এমজেএফের

দ্রুতবিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। দেশে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অন্তত ২৫টি ধর্ষণ মামলার বেশিরভাগ আসামি জামিন পেয়েছেন। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী তাদের জামিন পাওয়ার কথা নয়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর (এমজেএফ) এক অনুসন্ধানে ২৫টি মামলার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে এ কথা বলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগ আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার ২৪ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছেন। জামিনে মুক্ত হয়ে মামলাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। গতকাল অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে এমজেএফ।

৭টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে দেশের ১০টি জেলার ফলোআপকৃত ২৫টি ধর্ষণ মামলার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা এবং ধর্ষণ মামলা পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণগুলো খুঁজে বের করাই সংবাদ সম্মেলনের উদ্দেশ্য বলে জানায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। এতে বলা হয়, বর্তমানে ২৫ আসামির মধ্যে মাত্র তিন জন কারাগারে আছে, বাকিরা মুক্ত হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে এবং মামলাকে প্রভাবিত করছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর প্রতি ইচ্ছাকৃত খারাপ আচরণ করেন। এমনকি আইনে ধর্ষণের অপরাধ আপসঅযোগ্য হলেও, পারিপার্শ্বিক চাপে আপসরফার ক্ষেত্রে আদালত অনেক সময় নির্লিপ্ত থাকেন। এছাড়া মেডিকো লিগ্যাল ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ক্ষেত্রে টু-ফিঙ্গার টেস্টের মতো অবমাননাকর পদ্ধতি উচ্চ আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এমজেএফ জানায়, ২৫টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে অধিকাংশই বিচারাধীন ও সাক্ষ্যের পর্যায়ে আছে। মামলার পর থেকে ৬ মাসের মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২২টির। তবে ২০১৪ -২০১৫ সালে চার্জশিট হয়েছে এ রকম ৯টি মামলার রায় এখনও হয়নি। ২০১৬-২০১৭ সালে চার্জশিট হয়েছে এ রকম ১২টি মামলার রায় হয়নি এবং তেমন কোন অগ্রগতিও নেই। ৩টি মামলাতে এখন পর্যন্ত অভিযোগপত্র দাখিলই করা হয়নি।

এছাড়া ২৫টি মামলার মধ্যে ২টি মামলা একদম নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে এবং ৪টি মামলার নথিই পাওয়া যাচ্ছে না। এমজেএফের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশিরভাগ সাক্ষী হাজির না হওয়াতে এইসব মামলার তারিখ পিছিয়ে গেছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর আদালতে যেতে চাইছেন না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার জন্য মামলা চালাতে পারছেন না। ধর্ষণের ২৫ মামলায় ধর্ষণের শিকার ২৫ নারী ও শিশুর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারী ৩ জন। ধর্ষণের ঘটনায় দু’জন প্রতিবন্ধী নারীর ২টি সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু এই শিশু দুটি এখনও পিতৃত্বের পরিচয় পায়নি বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে। এছাড়া অস্বাভাবিক দেরিতে ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয় বলে আলামত নষ্ট হওয়া, মেডিকেল রিপোর্ট সঠিকভাবে না লেখা, ভিকটিমের বয়স রিপোর্টে সঠিকভাবে না লেখা, এমনকি যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, তা ভিকটিমকে সরবরাহ করা হয় না বলেও জানায় এমজেএফ। দেশের বেশিরভাগ জেলা সদর হাসপাতালে ভিকটিমের বয়স নির্ধারনের ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ডিএনএ টেস্ট করা হয় না। আর হলেও আসামি ডিএনএ টেস্টের ফলাফল প্রভাবিত করে।

সংবাদ সম্মেলনে বলেন এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, বিচারের বদলে বাড়ছে ধর্ষণ, ধর্ষণের আগে নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর পোশাক, চলাফেরা, কাজের ক্ষেত্র, ও পরিবারের প্রতি নানা ধরনের অভিযোগ। আমরা আরও দেখেছি, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর প্রতি দোষ দেয়ার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে এবং এইসব অপরাধ ঘটাতে আরও অনুপ্রাণিত হচ্ছে। ধর্ষণের সব মামলার দ্রুত বিচারের দাবি জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণের শিকার নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি দাবি জানানো হয়। যার মধ্যে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন সংস্কার করা, সাক্ষীসুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা, নির্ধারিত সময়ে তদন্ত ও বিচার শেষ করা ও আইনি বিধানসমূহ সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা প্রবর্তন ও দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ধর্ষণের মামলা আপস করা বা আপসের চেষ্টা করাকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার কথা বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, কোর্টস্টাফ ও ধর্ষণ মামলার বিচার সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের জেন্ডার সমতা, হাইকোর্টের নির্দেশনা, সংস্কারকৃত আইন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে এমজেএফ।

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২১ , ১ মাঘ ১৪২৭, ১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ধর্ষণের ২৫ মামলায় বিচারে অসঙ্গতি পর্যবেক্ষণ এমজেএফের

image

কলাবাগান শিক্ষার্থী ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে ও ন্যায়বিচারের দাবিতে গতকাল ধানমন্ডি মাস্টারমাইন্ড স্কুলের সামনে বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ সমাবেশ (খবর শেষ পৃষ্ঠায়) - সোহরাব আলম

দ্রুতবিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। দেশে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অন্তত ২৫টি ধর্ষণ মামলার বেশিরভাগ আসামি জামিন পেয়েছেন। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী তাদের জামিন পাওয়ার কথা নয়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর (এমজেএফ) এক অনুসন্ধানে ২৫টি মামলার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে এ কথা বলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগ আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার ২৪ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছেন। জামিনে মুক্ত হয়ে মামলাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। গতকাল অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে এমজেএফ।

৭টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে দেশের ১০টি জেলার ফলোআপকৃত ২৫টি ধর্ষণ মামলার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা এবং ধর্ষণ মামলা পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণগুলো খুঁজে বের করাই সংবাদ সম্মেলনের উদ্দেশ্য বলে জানায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। এতে বলা হয়, বর্তমানে ২৫ আসামির মধ্যে মাত্র তিন জন কারাগারে আছে, বাকিরা মুক্ত হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে এবং মামলাকে প্রভাবিত করছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর প্রতি ইচ্ছাকৃত খারাপ আচরণ করেন। এমনকি আইনে ধর্ষণের অপরাধ আপসঅযোগ্য হলেও, পারিপার্শ্বিক চাপে আপসরফার ক্ষেত্রে আদালত অনেক সময় নির্লিপ্ত থাকেন। এছাড়া মেডিকো লিগ্যাল ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ক্ষেত্রে টু-ফিঙ্গার টেস্টের মতো অবমাননাকর পদ্ধতি উচ্চ আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এমজেএফ জানায়, ২৫টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে অধিকাংশই বিচারাধীন ও সাক্ষ্যের পর্যায়ে আছে। মামলার পর থেকে ৬ মাসের মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২২টির। তবে ২০১৪ -২০১৫ সালে চার্জশিট হয়েছে এ রকম ৯টি মামলার রায় এখনও হয়নি। ২০১৬-২০১৭ সালে চার্জশিট হয়েছে এ রকম ১২টি মামলার রায় হয়নি এবং তেমন কোন অগ্রগতিও নেই। ৩টি মামলাতে এখন পর্যন্ত অভিযোগপত্র দাখিলই করা হয়নি।

এছাড়া ২৫টি মামলার মধ্যে ২টি মামলা একদম নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে এবং ৪টি মামলার নথিই পাওয়া যাচ্ছে না। এমজেএফের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশিরভাগ সাক্ষী হাজির না হওয়াতে এইসব মামলার তারিখ পিছিয়ে গেছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর আদালতে যেতে চাইছেন না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার জন্য মামলা চালাতে পারছেন না। ধর্ষণের ২৫ মামলায় ধর্ষণের শিকার ২৫ নারী ও শিশুর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারী ৩ জন। ধর্ষণের ঘটনায় দু’জন প্রতিবন্ধী নারীর ২টি সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু এই শিশু দুটি এখনও পিতৃত্বের পরিচয় পায়নি বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে। এছাড়া অস্বাভাবিক দেরিতে ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয় বলে আলামত নষ্ট হওয়া, মেডিকেল রিপোর্ট সঠিকভাবে না লেখা, ভিকটিমের বয়স রিপোর্টে সঠিকভাবে না লেখা, এমনকি যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, তা ভিকটিমকে সরবরাহ করা হয় না বলেও জানায় এমজেএফ। দেশের বেশিরভাগ জেলা সদর হাসপাতালে ভিকটিমের বয়স নির্ধারনের ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ডিএনএ টেস্ট করা হয় না। আর হলেও আসামি ডিএনএ টেস্টের ফলাফল প্রভাবিত করে।

সংবাদ সম্মেলনে বলেন এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, বিচারের বদলে বাড়ছে ধর্ষণ, ধর্ষণের আগে নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর পোশাক, চলাফেরা, কাজের ক্ষেত্র, ও পরিবারের প্রতি নানা ধরনের অভিযোগ। আমরা আরও দেখেছি, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর প্রতি দোষ দেয়ার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে এবং এইসব অপরাধ ঘটাতে আরও অনুপ্রাণিত হচ্ছে। ধর্ষণের সব মামলার দ্রুত বিচারের দাবি জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণের শিকার নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি দাবি জানানো হয়। যার মধ্যে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন সংস্কার করা, সাক্ষীসুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা, নির্ধারিত সময়ে তদন্ত ও বিচার শেষ করা ও আইনি বিধানসমূহ সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা প্রবর্তন ও দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ধর্ষণের মামলা আপস করা বা আপসের চেষ্টা করাকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার কথা বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, কোর্টস্টাফ ও ধর্ষণ মামলার বিচার সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের জেন্ডার সমতা, হাইকোর্টের নির্দেশনা, সংস্কারকৃত আইন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে এমজেএফ।