কোন যুক্তিতে মমতাকে বিজেপিবিরোধী বলা যায়?

গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনী সংগ্রামে কে সব থেকে বড় শত্রু, এ নিয়ে একটা বিতর্কের পরিবেশ একাংশের মানুষ তৈরি করেছেন। বিজেপি কে তারা প্রধান শত্রু হিসেবে নির্ধারণ করে, যাবতীয় অবিজেপি দলগুলোকে বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে একজোট হওয়ার পক্ষে তারা জোরদার সাওয়াল করছেন। এই প্রশ্নে তারা রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে-ই মনে করছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বার সব থেকে বড় শক্তি। সংবাদমাধ্যম যেভাবে গত লোকসভা ভোটের পর থেকে আসন সংখ্যার নিরিখে বামপন্থিদের নিঃশেষিত শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, সেই প্রচারের প্রতি আস্থা রেখেই এই অংশের বেশ কিছু মানুষ, তাদের ভেতর রাজনীতিকরা আছেন, সমাজকর্মী আছেন, শিল্পী, সাহিত্যিক থেকে সাধারণ কলেজ পড়ুয়াও আছেন, তারা এটাই বলতে চাইছেন যে, বাম-কংগ্রেসের একত্রিত শক্তি পারবে না বিজেপিকে রুখতে। সেটা পারে একমাত্র বাম- কংগ্রেস এবং তৃণমূলের ভেতরে নির্বাচনী সমঝোতা হলে। এই অংশের মানুষদের কাছে এই রাজ্যে গত শতকের নয়ের দশক থেকে বিজেপিকে পায়ের নিচে জমি করে দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের যে ভূমিকা সেটি আদৌ বিবেচ্য নয়। গত ১০ বছর ধরে তৃণমূল এই রাজ্যে শাসকের ভূমিকায় থেকে যে সীমাহীন দুর্নীতি করেছে, সেটাও তাদের কাছে প্রধান বিচার্য বিষয় হিসেবে উঠে আসছে না।

বিজেপি যে প্রধান শত্রু, এই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বিজেপিকে বিচার করতে গেলে সবার আগে বিচার করতে হবে তাদের মূল পরিচালক আরএসএসকে। ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট মানসিকতা প্রসূত এই সংগঠনটি নিজেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে মেলে ধরলেও এদের সুপ্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি হলো, সাম্প্রদায়িকতা। এই লক্ষ্যেই ১৯২৫ সালের জন্ম মুহূর্ত থেকে আরএসএস নিজেদের যাবতীয় শাখা সংগঠনকে পরিচালিত করেছে। সেই লক্ষ্যেই বিজেপিকেও তারা পরিচালিত করে। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা ভোটকে কেন্দ্র করে সেই সাম্প্রদায়িকতার তাস গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির একটা নতুন উদ্যমে খেলতে শুরু করেছে। তাই এই প্রেক্ষিতে বিজেপিকে ঠেকানোর প্রশ্নটার জরুরি ভিত্তি নিয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলের সঙ্গে নির্বাচনী সংগ্রামে আপোস করে লড়াই, যেটাকে ওরা বলছেন, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা-এই যুক্তির বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষিত কতখানি?

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সামাজিক ক্ষেত্রে আর এগোতে পারেনি। ফলে সংসদীয় রাজনীতিতেও এ রাজ্যে তারা আর এঁটে উঠতে পারেনি। হিন্দু স্বার্থে দেশভাগে যিনি শ্যামাপ্রসাদের সব থেকে বড় সহযোগী ছিলেন, সেই নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে জড়িত রাখলে সুনিশ্চিত থাকবে না বুঝেই, হিন্দুত্ববাদী শিবির ত্যাগ করেছিলেন।

সাতের দশকে এই রাজ্যের বুকে জরুরি অবস্থাবিরোধী আন্দোলনে বামপন্থিরা সর্বাংশে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির জোরে লড়েছিলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে যারা লড়েছিলেন, তাদের ভেতরে আরএসএসের একদম ঘরের লোক হরিপদ ভারতীর মতো লোকেদের অবস্থানের জেরে, প্রয়োজনীয় সতর্কতা জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তেরা অবলম্বন করেছিলেন। ’৭৭ সালে বামফ্রন্টের সঙ্গে জনতা পার্টির নির্বাচনী সমঝোতা না হওয়ার ক্ষেত্রে হরিপদ ভারতীর মতো সংঘ কর্মীদের দ্বারা প্রফুল্লচন্দ্র সেনের প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টি খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম বামফ্রন্টের আমলে, মরিচঝাঁপি ঘিরে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা করতে বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে এই হরিপদ ভারতীর নেতৃত্বে আরএসএস অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মরিচঝাঁপি ঘিরে কুৎসা করার বহু চেষ্টা করেও আরএসএস ব্যর্থ হয়।

তাই আরএসএস বা তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কতখানি দেশের পক্ষে, মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, তা বামপন্থিদের নতুন করে বোঝাবার কিছু নেই। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালে এ রাজ্যে আরএসএসের সাংগঠনিক প্রসার কিন্তু অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১১ তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই কিন্তু নদিয়া-উত্তর চব্বিশ পরগণার মধ্যবর্তী গয়েশপুরে আরএসএস একটা বিশাল সাংগঠনিক সভা করে। মমতার উগ্র সমর্থক খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত আরএসএসের গয়েশপুরের সেই সাংগঠনিক সভা সম্পর্কে লিখেছিল, গত ২৫ বছরে এই ধরনের সভা করবার সাহস পশ্চিমবঙ্গের বুকে সঙ্ঘের হয়নি। যারা আজ মমতার সঙ্গে সমঝোতা করে বিজেপিকে আটকানোর কথা বলছেন, তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, মমতা ক্ষমতায় আসা মাত্র-ই সাংগঠনিক প্রসারের এই সাহস এবং সুযোগ পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস কি করে পেল?

যে মমতা-ই পারবেন আসন্ন বিধানসভার ভোটে বিজেপিকে রুখতে বলে একাংশের সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিক এবং নিজেদের লিবারেল বলে দাবি করা লোকজনেরা বলছেন, তাদের সেই মমতাই আরএসএসের মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্যে’র সম্পাদক তরুণ বিজয়ের লেখা ‘কমিউনিস্ট সন্ত্রাস’ বইটির উদ্বোধনে মোহন ভাগবত, মদধদাস দেবী, এইচভি শেষাদ্রির মতো শীর্ষস্তরের আরএসএস নেতার উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে সঙ্ঘের উদ্দেশে বলেছিলেন; আপনারা যদি আমাকে মাত্র এক শতাংশ মদত দেন, আমি লাল সন্ত্রাস খতম করে দেব (দি টেলিগ্রাফ, ১৫॥০৯॥২০০৩)। সেই অনুষ্ঠানে আরএসএস ঘনিষ্ঠ, বিজেপির বুদ্ধিজীবী সেলের আহ্বায়ক, তথা উত্তরপ্রদেশ থেকে বিজেপির টিকিটে দুবার রাজ্যসভায় যাওয়া বলবীর পুঞ্জ (এর পেশা ছিল সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমে তাবেদার তৈরিতে ইনি বিজেপিকে বিশেষ রকমের সাহায্য করেছিলেন) সেই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন; আমাদের প্রিয় মমতাজী হলেন সাক্ষাৎ দুর্গা। এহেন মমতা বিজেপির মোকাবিলায় একমাত্র অবলম্বন, পাঠক, বিশ্বাস করতে পারেন?

বিগত বিধানসভা নির্বাচনের (২০১৬) কিছুদিন পর বিজেপি নেত্রী তথা আরএসএস ঘনিষ্ঠ কুমারী উমা ভারতী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, সেই নির্বাচনে আরএসএসের সাহায্য ছাড়া মমতার দলের রাজ্যে ক্ষমতা দখল সম্ভবপর ছিল না। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের বছরে এই রাজ্যে আরএসএসের শাখা ছিল ১১০০টি। পরের এক বছরে সঙ্ঘের ১৩৫০টি শাখা বৃদ্ধি পায় আমাদের রাজ্যে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৬॥০৩॥২০১৮)। এই সময়ে শুধু দক্ষিণবঙ্গের ৬৫০টি জায়গাতে আরএসএসের ৯১০টি শাখা ছিল। উত্তরবঙ্গের ৩৭৩টি স্থানে ছিল ৪৫২টি শাখা। শুধু উত্তরবঙ্গেই এই সময়ে আরএসএসের সাপ্তাহিক সংযোগ রক্ষাকারী সভা হতো ১০২৯টি। মাসিক সভা হতো ২২৬টি (ঐ)। গত দুই বছরে, বিশেষ করে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পর এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা সহজেই অনুমেয়। এরপর ও কি এই যুক্তি খাটে, মমতাই একমাত্র পারবেন এই রাজ্যে বিজেপিকে ঠেকাতে?

মমতা ২০১১ তে এই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে ওয়াকফের টাকা দিয়ে একাংশের ইমাম, মোয়াজ্জিনদের সামান্য কিছু ভাতা দিতে শুরু করেন। মমতার এই কর্মকান্ড আরএসএস-বিজেপিকে বিশেষভাবে এই রাজ্যে রাজনৈতিক হিন্দু মানসিকতাকে সংহত করবার কাজে কি সাহায্য করেনি? মমতা বামফ্রন্টের আমলে স্বামী পরিত্যক্তা মুসলমান মেয়েদের আর্থিক পুনর্বাসনের জন্য রেখে যাওয়া আর্থিক সংস্থানটিকে বন্ধ করে দেন। মাদরাসা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মাদরাসায় নিয়োগ বন্ধ করে দেন। মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কোন উন্নতির কথা না ভেবে একটা ছোট অংশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সামান্য কিছু টাকা পাইয়ে দিয়ে ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের ভেতর, একটা না পাওয়ার হতাশা তৈরি করে, তাদের সাম্প্রদায়িক করে তুলে, মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগেই এই রাজ্যে সামাজিক মেরুকরণের কাজ জোর কদমে শুরু করে দেন। পরবর্তীতে, ২০১৪ সালে মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেই মমতার এই ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরির প্রক্রিয়া কেই সফলভাবে গোটা দেশে প্রয়োগ করেন। পরবর্তীতে ইমাম ভাতার পাশাপাশি মমতা চালু করেন পুরোহিত ভাতা। এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ষোলকলা পূর্ণ হয়। সেই মমতা করবেন বিজেপির মোকাবিলা? এত রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে হয়; ‘এ যে দেখি, জলে ভাসে শীলা।’

মমতা তার গত ১০ বছরের শাসনকালে বিজেপি ব্যাতীত অন্য কোন রাজনৈতিক দলকে প্রবল প্রশাসনিক হেনস্থার বাইরে রেখেছিলেন? সব অবিজেপি দলগুলোর জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে, সাধারণ কর্মীকে তিনি বাধ্য করেছেন রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসে হয় যোগদান করতে, নতুবা প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের মতো, তৃণমূলের বশ্যতা স্বীকার করতে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যে আচরণ মমতা করেছেন, তার একাংশ ও কেন তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে করেননি? মমতা যে কোন ভোট সামনে এলেই নানারকম ফেরে বিজেপি বিরোধিতার কথা বলেন। অথচ তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তিনি কিন্তু বিজেপির মস্তিষ্ক আরএসএসের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। গত ১০ বছরে, মমতার শাসনকালে সরসঙ্ঘচালক যে নিরাপদবৃত্তে, মসৃণভাবে পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন, কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সভা করেছেন, অতীতে রাজ্য প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে এভাবে পশ্চিমবঙ্গের বুকে একজন ও সঙ্ঘপ্রধান সফর বা সভা করতে সক্ষম হননি। তারপরও কি আমাদের বলতে হবে, মমতাই একমাত্র পারবেন, আগামী বিধানসভার ভোটে বিজেপিকে ঠেকাতে?

মমতার দলের যে সব লোকেরা, জনপ্রতিনিধিরা আজ বিজেপির কেষ্টবিষ্টু হয়ে বসে আছেন, সেসব ব্যক্তিরা তৃণমূল কংগ্রেস দলটিতে থাকাকালীন আরএসএস- বিজেপির চর হয়ে কাজ করেননি- এ কথা কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়? আজকে বিজেপি দলে এই রাজ্যের এমন অনেক জনপ্রতিনিধি আছেন, যারা তৃণমূলে থাকার সময়েও আরএসএস-বিজেপির হয়েই কাজ করে গিয়েছেন। আজকের একাধিক বিজেপি সাংসদ আছেন, যারা নোটবন্দির সময়কালে তৃণমূল দল প্রকাশ্যে নোটবন্দির বিরোধিতা করলেও, এরা নোটবন্দির পক্ষে গলা ফাটিয়েছেন। তাই তৃণমূলে থেকে বিধানসভায় জিতে, সেইসব লোকেরা অচিরেই দলত্যাগবিরোধী আইন বাঁচিয়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?

গত কয়েকবছর ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে এই রাজ্যে খোলাখুলি দাঙ্গার উসকানি দিচ্ছে আরএসএস-বিজেপি। সেই উসকানি মোকাবিলায় মমতার প্রশাসন কেন কোন প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করেনি? মমতার দলই বা কেন বিষয়টির রাজনৈতিক মোকাবিলার বদলে, বিজেপির হাত শক্ত করবার লক্ষ্যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পথে হাঁটছে। রামনবমীতে বিজেপি অস্ত্র মিছিল করছে। শিশু, নারীদের সেই মিছিলের সামনে রাখা হচ্ছে। এই মিছিলের বিরোধিতার নাম করে মমতার দল হনুমানজয়ন্তী পালন করছে প্রকাশ্যে। বিজেপির রামনবমীর অস্ত্র মিছিলের বিরুদূধতার নাম করে মমতার দল হনুমানজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে অস্ত্র মিছিল বের করছে। এভাবে উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতাকে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় যে মমতা এবং তার দল, তৃণমূল কংগ্রেস ঠেলে দিচ্ছে, সেই দল সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলার প্রশ্নে বিজেপিকে রুখবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য? বিজেপির রামনবমীর অস্ত্র মিছিলের মোকাবিলায়, মমতার দলের হনুমানজয়ন্তী কতখানি অহিংস ছিল, তা বোঝা যায়, সেই মিছিলের লোকেদের দ্বারা ভাটপাড়াতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মূর্তি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায়। এহেন মমতা পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভার ভোটে বিজেপি প্রতিরোধের আইকন হবেন, তা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?

সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে রাজ্যসভায় মোদির সরকার বিপদে পড়লেই মমতার দল, তৃণমূল কংগ্রেস যে কোন উপায়ে সরকারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এনআরসির প্রশ্নে যে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যসভায় বিজেপির বিপদতারণের ভূমিকা পালন করে, সেই তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যের ভোটে বিজেপিকে ঠেকাবে, এটা একটি শিশু ও বিশ্বাস করবে? এনআরসিবিরোধী আন্দোলন, শাহিনবাগকে বিধ্বস্ত করতে বিজেপি সংগঠিত করে দিল্লি গণহত্যা। ভয়াবহ অত্যাচার চালায় জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উপর। সাফুরা জারগার থেকে ডা. কাফিল খান, উমর খলিদেরা বিজেপির প্রতিহিংসার শিকার হন। প্রতিটি অবিজেপি রাজনৈতিক দল এদের পাশে দাঁড়ালেও, তৃণমূল কংগ্রেস একটি বারের জন্যেও ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে লড়াই করা, এসব মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে? সেই তৃণমূল রুখবে এ রাজ্যে বিজেপিকে?

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২১ , ১ মাঘ ১৪২৭, ১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

কোন যুক্তিতে মমতাকে বিজেপিবিরোধী বলা যায়?

গৌতম রায়

image

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনী সংগ্রামে কে সব থেকে বড় শত্রু, এ নিয়ে একটা বিতর্কের পরিবেশ একাংশের মানুষ তৈরি করেছেন। বিজেপি কে তারা প্রধান শত্রু হিসেবে নির্ধারণ করে, যাবতীয় অবিজেপি দলগুলোকে বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে একজোট হওয়ার পক্ষে তারা জোরদার সাওয়াল করছেন। এই প্রশ্নে তারা রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে-ই মনে করছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বার সব থেকে বড় শক্তি। সংবাদমাধ্যম যেভাবে গত লোকসভা ভোটের পর থেকে আসন সংখ্যার নিরিখে বামপন্থিদের নিঃশেষিত শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, সেই প্রচারের প্রতি আস্থা রেখেই এই অংশের বেশ কিছু মানুষ, তাদের ভেতর রাজনীতিকরা আছেন, সমাজকর্মী আছেন, শিল্পী, সাহিত্যিক থেকে সাধারণ কলেজ পড়ুয়াও আছেন, তারা এটাই বলতে চাইছেন যে, বাম-কংগ্রেসের একত্রিত শক্তি পারবে না বিজেপিকে রুখতে। সেটা পারে একমাত্র বাম- কংগ্রেস এবং তৃণমূলের ভেতরে নির্বাচনী সমঝোতা হলে। এই অংশের মানুষদের কাছে এই রাজ্যে গত শতকের নয়ের দশক থেকে বিজেপিকে পায়ের নিচে জমি করে দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের যে ভূমিকা সেটি আদৌ বিবেচ্য নয়। গত ১০ বছর ধরে তৃণমূল এই রাজ্যে শাসকের ভূমিকায় থেকে যে সীমাহীন দুর্নীতি করেছে, সেটাও তাদের কাছে প্রধান বিচার্য বিষয় হিসেবে উঠে আসছে না।

বিজেপি যে প্রধান শত্রু, এই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বিজেপিকে বিচার করতে গেলে সবার আগে বিচার করতে হবে তাদের মূল পরিচালক আরএসএসকে। ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট মানসিকতা প্রসূত এই সংগঠনটি নিজেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে মেলে ধরলেও এদের সুপ্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি হলো, সাম্প্রদায়িকতা। এই লক্ষ্যেই ১৯২৫ সালের জন্ম মুহূর্ত থেকে আরএসএস নিজেদের যাবতীয় শাখা সংগঠনকে পরিচালিত করেছে। সেই লক্ষ্যেই বিজেপিকেও তারা পরিচালিত করে। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা ভোটকে কেন্দ্র করে সেই সাম্প্রদায়িকতার তাস গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির একটা নতুন উদ্যমে খেলতে শুরু করেছে। তাই এই প্রেক্ষিতে বিজেপিকে ঠেকানোর প্রশ্নটার জরুরি ভিত্তি নিয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলের সঙ্গে নির্বাচনী সংগ্রামে আপোস করে লড়াই, যেটাকে ওরা বলছেন, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা-এই যুক্তির বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষিত কতখানি?

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সামাজিক ক্ষেত্রে আর এগোতে পারেনি। ফলে সংসদীয় রাজনীতিতেও এ রাজ্যে তারা আর এঁটে উঠতে পারেনি। হিন্দু স্বার্থে দেশভাগে যিনি শ্যামাপ্রসাদের সব থেকে বড় সহযোগী ছিলেন, সেই নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে জড়িত রাখলে সুনিশ্চিত থাকবে না বুঝেই, হিন্দুত্ববাদী শিবির ত্যাগ করেছিলেন।

সাতের দশকে এই রাজ্যের বুকে জরুরি অবস্থাবিরোধী আন্দোলনে বামপন্থিরা সর্বাংশে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির জোরে লড়েছিলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে যারা লড়েছিলেন, তাদের ভেতরে আরএসএসের একদম ঘরের লোক হরিপদ ভারতীর মতো লোকেদের অবস্থানের জেরে, প্রয়োজনীয় সতর্কতা জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তেরা অবলম্বন করেছিলেন। ’৭৭ সালে বামফ্রন্টের সঙ্গে জনতা পার্টির নির্বাচনী সমঝোতা না হওয়ার ক্ষেত্রে হরিপদ ভারতীর মতো সংঘ কর্মীদের দ্বারা প্রফুল্লচন্দ্র সেনের প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টি খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম বামফ্রন্টের আমলে, মরিচঝাঁপি ঘিরে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা করতে বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে এই হরিপদ ভারতীর নেতৃত্বে আরএসএস অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মরিচঝাঁপি ঘিরে কুৎসা করার বহু চেষ্টা করেও আরএসএস ব্যর্থ হয়।

তাই আরএসএস বা তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কতখানি দেশের পক্ষে, মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, তা বামপন্থিদের নতুন করে বোঝাবার কিছু নেই। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালে এ রাজ্যে আরএসএসের সাংগঠনিক প্রসার কিন্তু অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১১ তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই কিন্তু নদিয়া-উত্তর চব্বিশ পরগণার মধ্যবর্তী গয়েশপুরে আরএসএস একটা বিশাল সাংগঠনিক সভা করে। মমতার উগ্র সমর্থক খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত আরএসএসের গয়েশপুরের সেই সাংগঠনিক সভা সম্পর্কে লিখেছিল, গত ২৫ বছরে এই ধরনের সভা করবার সাহস পশ্চিমবঙ্গের বুকে সঙ্ঘের হয়নি। যারা আজ মমতার সঙ্গে সমঝোতা করে বিজেপিকে আটকানোর কথা বলছেন, তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, মমতা ক্ষমতায় আসা মাত্র-ই সাংগঠনিক প্রসারের এই সাহস এবং সুযোগ পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস কি করে পেল?

যে মমতা-ই পারবেন আসন্ন বিধানসভার ভোটে বিজেপিকে রুখতে বলে একাংশের সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিক এবং নিজেদের লিবারেল বলে দাবি করা লোকজনেরা বলছেন, তাদের সেই মমতাই আরএসএসের মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্যে’র সম্পাদক তরুণ বিজয়ের লেখা ‘কমিউনিস্ট সন্ত্রাস’ বইটির উদ্বোধনে মোহন ভাগবত, মদধদাস দেবী, এইচভি শেষাদ্রির মতো শীর্ষস্তরের আরএসএস নেতার উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে সঙ্ঘের উদ্দেশে বলেছিলেন; আপনারা যদি আমাকে মাত্র এক শতাংশ মদত দেন, আমি লাল সন্ত্রাস খতম করে দেব (দি টেলিগ্রাফ, ১৫॥০৯॥২০০৩)। সেই অনুষ্ঠানে আরএসএস ঘনিষ্ঠ, বিজেপির বুদ্ধিজীবী সেলের আহ্বায়ক, তথা উত্তরপ্রদেশ থেকে বিজেপির টিকিটে দুবার রাজ্যসভায় যাওয়া বলবীর পুঞ্জ (এর পেশা ছিল সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমে তাবেদার তৈরিতে ইনি বিজেপিকে বিশেষ রকমের সাহায্য করেছিলেন) সেই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন; আমাদের প্রিয় মমতাজী হলেন সাক্ষাৎ দুর্গা। এহেন মমতা বিজেপির মোকাবিলায় একমাত্র অবলম্বন, পাঠক, বিশ্বাস করতে পারেন?

বিগত বিধানসভা নির্বাচনের (২০১৬) কিছুদিন পর বিজেপি নেত্রী তথা আরএসএস ঘনিষ্ঠ কুমারী উমা ভারতী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, সেই নির্বাচনে আরএসএসের সাহায্য ছাড়া মমতার দলের রাজ্যে ক্ষমতা দখল সম্ভবপর ছিল না। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের বছরে এই রাজ্যে আরএসএসের শাখা ছিল ১১০০টি। পরের এক বছরে সঙ্ঘের ১৩৫০টি শাখা বৃদ্ধি পায় আমাদের রাজ্যে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৬॥০৩॥২০১৮)। এই সময়ে শুধু দক্ষিণবঙ্গের ৬৫০টি জায়গাতে আরএসএসের ৯১০টি শাখা ছিল। উত্তরবঙ্গের ৩৭৩টি স্থানে ছিল ৪৫২টি শাখা। শুধু উত্তরবঙ্গেই এই সময়ে আরএসএসের সাপ্তাহিক সংযোগ রক্ষাকারী সভা হতো ১০২৯টি। মাসিক সভা হতো ২২৬টি (ঐ)। গত দুই বছরে, বিশেষ করে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পর এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা সহজেই অনুমেয়। এরপর ও কি এই যুক্তি খাটে, মমতাই একমাত্র পারবেন এই রাজ্যে বিজেপিকে ঠেকাতে?

মমতা ২০১১ তে এই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে ওয়াকফের টাকা দিয়ে একাংশের ইমাম, মোয়াজ্জিনদের সামান্য কিছু ভাতা দিতে শুরু করেন। মমতার এই কর্মকান্ড আরএসএস-বিজেপিকে বিশেষভাবে এই রাজ্যে রাজনৈতিক হিন্দু মানসিকতাকে সংহত করবার কাজে কি সাহায্য করেনি? মমতা বামফ্রন্টের আমলে স্বামী পরিত্যক্তা মুসলমান মেয়েদের আর্থিক পুনর্বাসনের জন্য রেখে যাওয়া আর্থিক সংস্থানটিকে বন্ধ করে দেন। মাদরাসা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মাদরাসায় নিয়োগ বন্ধ করে দেন। মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কোন উন্নতির কথা না ভেবে একটা ছোট অংশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সামান্য কিছু টাকা পাইয়ে দিয়ে ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের ভেতর, একটা না পাওয়ার হতাশা তৈরি করে, তাদের সাম্প্রদায়িক করে তুলে, মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগেই এই রাজ্যে সামাজিক মেরুকরণের কাজ জোর কদমে শুরু করে দেন। পরবর্তীতে, ২০১৪ সালে মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেই মমতার এই ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরির প্রক্রিয়া কেই সফলভাবে গোটা দেশে প্রয়োগ করেন। পরবর্তীতে ইমাম ভাতার পাশাপাশি মমতা চালু করেন পুরোহিত ভাতা। এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ষোলকলা পূর্ণ হয়। সেই মমতা করবেন বিজেপির মোকাবিলা? এত রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে হয়; ‘এ যে দেখি, জলে ভাসে শীলা।’

মমতা তার গত ১০ বছরের শাসনকালে বিজেপি ব্যাতীত অন্য কোন রাজনৈতিক দলকে প্রবল প্রশাসনিক হেনস্থার বাইরে রেখেছিলেন? সব অবিজেপি দলগুলোর জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে, সাধারণ কর্মীকে তিনি বাধ্য করেছেন রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসে হয় যোগদান করতে, নতুবা প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের মতো, তৃণমূলের বশ্যতা স্বীকার করতে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যে আচরণ মমতা করেছেন, তার একাংশ ও কেন তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে করেননি? মমতা যে কোন ভোট সামনে এলেই নানারকম ফেরে বিজেপি বিরোধিতার কথা বলেন। অথচ তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তিনি কিন্তু বিজেপির মস্তিষ্ক আরএসএসের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। গত ১০ বছরে, মমতার শাসনকালে সরসঙ্ঘচালক যে নিরাপদবৃত্তে, মসৃণভাবে পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন, কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সভা করেছেন, অতীতে রাজ্য প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে এভাবে পশ্চিমবঙ্গের বুকে একজন ও সঙ্ঘপ্রধান সফর বা সভা করতে সক্ষম হননি। তারপরও কি আমাদের বলতে হবে, মমতাই একমাত্র পারবেন, আগামী বিধানসভার ভোটে বিজেপিকে ঠেকাতে?

মমতার দলের যে সব লোকেরা, জনপ্রতিনিধিরা আজ বিজেপির কেষ্টবিষ্টু হয়ে বসে আছেন, সেসব ব্যক্তিরা তৃণমূল কংগ্রেস দলটিতে থাকাকালীন আরএসএস- বিজেপির চর হয়ে কাজ করেননি- এ কথা কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়? আজকে বিজেপি দলে এই রাজ্যের এমন অনেক জনপ্রতিনিধি আছেন, যারা তৃণমূলে থাকার সময়েও আরএসএস-বিজেপির হয়েই কাজ করে গিয়েছেন। আজকের একাধিক বিজেপি সাংসদ আছেন, যারা নোটবন্দির সময়কালে তৃণমূল দল প্রকাশ্যে নোটবন্দির বিরোধিতা করলেও, এরা নোটবন্দির পক্ষে গলা ফাটিয়েছেন। তাই তৃণমূলে থেকে বিধানসভায় জিতে, সেইসব লোকেরা অচিরেই দলত্যাগবিরোধী আইন বাঁচিয়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?

গত কয়েকবছর ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে এই রাজ্যে খোলাখুলি দাঙ্গার উসকানি দিচ্ছে আরএসএস-বিজেপি। সেই উসকানি মোকাবিলায় মমতার প্রশাসন কেন কোন প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করেনি? মমতার দলই বা কেন বিষয়টির রাজনৈতিক মোকাবিলার বদলে, বিজেপির হাত শক্ত করবার লক্ষ্যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পথে হাঁটছে। রামনবমীতে বিজেপি অস্ত্র মিছিল করছে। শিশু, নারীদের সেই মিছিলের সামনে রাখা হচ্ছে। এই মিছিলের বিরোধিতার নাম করে মমতার দল হনুমানজয়ন্তী পালন করছে প্রকাশ্যে। বিজেপির রামনবমীর অস্ত্র মিছিলের বিরুদূধতার নাম করে মমতার দল হনুমানজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে অস্ত্র মিছিল বের করছে। এভাবে উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতাকে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় যে মমতা এবং তার দল, তৃণমূল কংগ্রেস ঠেলে দিচ্ছে, সেই দল সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলার প্রশ্নে বিজেপিকে রুখবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য? বিজেপির রামনবমীর অস্ত্র মিছিলের মোকাবিলায়, মমতার দলের হনুমানজয়ন্তী কতখানি অহিংস ছিল, তা বোঝা যায়, সেই মিছিলের লোকেদের দ্বারা ভাটপাড়াতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মূর্তি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায়। এহেন মমতা পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভার ভোটে বিজেপি প্রতিরোধের আইকন হবেন, তা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?

সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে রাজ্যসভায় মোদির সরকার বিপদে পড়লেই মমতার দল, তৃণমূল কংগ্রেস যে কোন উপায়ে সরকারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এনআরসির প্রশ্নে যে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যসভায় বিজেপির বিপদতারণের ভূমিকা পালন করে, সেই তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যের ভোটে বিজেপিকে ঠেকাবে, এটা একটি শিশু ও বিশ্বাস করবে? এনআরসিবিরোধী আন্দোলন, শাহিনবাগকে বিধ্বস্ত করতে বিজেপি সংগঠিত করে দিল্লি গণহত্যা। ভয়াবহ অত্যাচার চালায় জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উপর। সাফুরা জারগার থেকে ডা. কাফিল খান, উমর খলিদেরা বিজেপির প্রতিহিংসার শিকার হন। প্রতিটি অবিজেপি রাজনৈতিক দল এদের পাশে দাঁড়ালেও, তৃণমূল কংগ্রেস একটি বারের জন্যেও ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে লড়াই করা, এসব মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে? সেই তৃণমূল রুখবে এ রাজ্যে বিজেপিকে?