বিলাসবহুল হোটেল নয় চিম্বুক পাহাড়ে স্কুল ও হাসপাতাল চাই

পাভেল পার্থ

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়সমূহের যে তালিকা তৈরি করে তাতে দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি রেঞ্জের ২৯টি পাহাড়ের ভেতর ৫টি রেঞ্জের ৯টি পাহাড়ের নামই পাংখোয়া ভাষার। পাহাড়ের নামকরণের সঙ্গে স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য, পাহাড়ের প্রতিবেশ, জাতিগত সংস্কৃতি এবং কোন সামাজিক স্মৃতিময় ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন পাহাড়ের অধিবাসীরা। যেমন বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়। চিমবক ম্রোর নামে পরিচিতি পেয়েছে এই পাহাড়। যদিও ম্রো আদিবাসীদের কাছে পাহাড়টির নাম ইয়াংবংহুং। চিম্বুকের কাছেই আরেক পাহাড়ের ম্রো নাম শোংনামহুং। মারমা ভাষায় নাইতং। বাঙালিরা এখন এই পাহাড়ের নাম দিয়েছে ‘চন্দ্রপাহাড়’। আর এই পাহাড়েই বিলাসবহুল পাঁচতারকা মার্কিন ম্যারিয়ট হোটেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে চিম্বুক পাহাড়ে জনমনে আশঙ্কা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশের নানাস্থানে তরুণ সমাজ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ম্রো গ্রাম এবং পাহাড় বিনাশ করে এমন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করছেন। ৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ম্যারিয়ট হোটেল বন্ধ এবং জীবন-জীবিকা সুরক্ষার দাবিতে বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে প্লুং বাঁশি বাজিয়ে ‘কালচারালাল শোডাউন’ করেছে ম্র্র্রোরা। দেশজুড়ে তর্ক উঠেছে, এই বিনোদন প্রকল্পকে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ এবং জনবসতিবিরোধী হিসেবে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। সারা পৃথিবী যখন করোনা মহামারীতে শংকিত ও তটস্থ তখন বাংলাদেশের এমন সুন্দর সবুজ পাহাড় বিনাশ করে এই বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ কার স্বার্থে?

২.

বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ও জনজীবন সুরক্ষায় আমাদের রাষ্ট্র নাগরিকের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু চিম্বুক পাহাড়ে সাম্প্রতিক ম্যারিয়ট হোটেলের এই স্থাপনা নির্মাণ আমাদের শংকিত করে। আমরা চাই আমাদের প্রিয় সবুজ চিম্বুক পাহাড় নীল মেঘের তলায় বেঁচে থাকুক। ম্রোসহ স্থানীয় আদিবাসীরা এই পাহাড়ে জুম আবাদসহ নিজেদের সভ্যতা বিকশিত করুক। রাষ্ট্র চিম্বুক পাহাড়ের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক। এই দারুণ সুন্দর পাহাড়ে যে মানুষেরা সভ্যতা গড়ে তুলেছেন তাদের একটা হাসপাতাল নেই। শিশুদের জন্য নেই বিদ্যালয়। গড়ে ওঠেনি পাঠাগার। এখন বিলাসবহুল ম্যারিয়ট হোটেল নির্মাণের নামে শিশুদের খেলার মাঠ, কৃষিজমি, ফলের বাগান, সমাধি, প্রার্থনালয় আর বহু প্রাচীন পাড়াগুলো কেড়ে নেয়া হবে।

৩.

চিম্বুক পাহাড়ের আদি ম্রো সভ্যতা আজ এক নিদারুণ উন্নয়ন-যন্ত্রণার মুখোমুখি। বান্দরবান জেলা পরিষদের ভাষ্য, পর্যটনের জন্য শোংনাম বা নাইতং পাহাড়ের ২০ একর ভূমি ৪০ বছরের জন্য লিজ দেয়া হয়েছে। যদিও ২০১২ সনে এই ভূমি লিজ বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল আঞ্চলিক পরিষদ। এখানে তৈরি হবে বহুজাতিক মার্কিন চেইন হোটেল ম্যারিয়ট। গণমাধ্যমে প্রকাশ, কেবল হোটেল নয়; ১২টি পাহাড়জুড়ে এই বিলাসি তান্ডব চলতে পারে। ক্যাবলকার (রোপওয়ে) হবে, বিনোদন পার্ক থাকবে। সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং সিকদার গ্রুপ (আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস) বাংলাদেশে এই কাজটি সমন্বয় করছে। এই বিলাসী উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে গেলে কাপ্রুপাড়া, কলাইপাড়া, এরা পাড়া, দলা পাড়া ম্রো গ্রামগুলো নিরুদ্দেশ হবে। আশঙ্কা, ভবিষ্যতে ম্র্রোদের ১১৬টি পাড়ার প্রায় ১০ হাজার মানুষ সংকটে পড়বে এবং বিপন্ন হয়ে ওঠবে হাজার একর পাহাড়ি বাস্তুসংস্থান। বাংলাদেশে এভাবেই ধনীদের ভোগবিলাসিতার নামে পাহাড়, অরণ্য, নদী, জলাভূমি কী কৃষিজমি সবকিছু ধ্বংস করেই একের পর এক গড়ে তোলা হচ্ছে অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও পরিবেশবিনাশী স্থাপনা। কোন সংবেদনশীল অঞ্চলে বৃহৎ স্থাপনা নির্মাণের আগে সেখানে প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা, পরিবেশগত প্রভাব যাচাই ও সামাজিক প্রভাব যাচাই করার কথা বাংলাদেশের পরিবেশ আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিশাল বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের আগে এমন কোন পরিবেশগত সমীক্ষা ও যাচাই হয়েছে কি না-আমরা জানি না।

৪.

ম্যারিয়ট হোটেলের এই প্রকল্প বিষয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ২২/১১/২০২০ তারিখে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে একটি সংবাদ সম্মেলন করে। পরিষদের চেয়ারম্যান তার লিখিত বক্তব্যে জানান, কৃষিপ্রযুক্তি ও উন্নত চাষাবাদ প্রদর্শনীর মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক পথ সুগম করার লক্ষ্যে স্থানীয় ম্রো নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নাইতং পাহাড়ের ২০ একর ভূমি নেয়া হয়েছে। ২০১২ সনে জেলা পরিষদের নামে কথিত জমি বন্দোবস্তি পাওয়ার জন্য বান্দরবান জেলা পরিষদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্দোবস্তি কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত জটিলতা থাকায় বন্দোবস্তি মামলাটি নিষ্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। চেয়ারম্যান তার লিখিত বক্তব্যে আরও উল্লেখ করেন, ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড, বান্দরবান সেনানিবাসের প্রস্তাব ও অনুরোধের প্রেক্ষিতে ১ জানুয়ারি ২০১৬ হতে ৩১ ডিসেম্বর ২০৫৫ সন পর্যন্ত ৪০ বছরের জন্য ১৮টি শর্তের চুক্তিতে উল্লিখিত জমিটি ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডকে ইজারা দেয়া হয়েছে। কিন্তু জেলার ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এখনও জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর হয়নি, কীভাবে তাহলে জেলা পরিষদ এই পাহাড়ি ভূমি ইজারা দিতে পারে? চিম্বুক পাহাড়বাসী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের এই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে ১১/১২/২০২০ তারিখে তাদের নিজেদের অবস্থান ও বক্তব্য তুলে ধরে। চিম্বুক পাহাড়বাসী তাদের লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করে, ৩০২ নং লুলাইং মৌজার প্রাক্তন হেডম্যান স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই কৃষি ও খামার প্রদর্শনীর প্রকল্পের জন্য জেলা পরিষদকে পাঁচ একর ভূমি সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেই পাঁচ একর ভূমি কীভাবে ২০ একর হয়ে গেল বিষয়টি চিম্বুকবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের জাগ্রত স্বপ্নজয়ী মানুষ বরাবরই সব ধরনের দুর্নীতি, মিথ্যা এবং প্রতারণার বিরুদ্ধে। চিম্বুক পাহাড়ের ভূমি নিয়ে ‘ইজারা’ সম্পর্কিত অস্পষ্টতা দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে স্পষ্ট করা জরুরি।

৫.

জুম চাষকে স্থানীয়ভাবে ম্রো ভাষায় ওয়াহ্ ল্যুপ বলে। ম্রো সমাজ ঐতিহাসিকভাবে জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল। রাইচা, রাইরিক, রাইস্যু, রাইজো, নাইংসা, জাম্মা এ রকম অসংখ্য পাহাড়ি ধানের প্রচলন করেছেন ম্রোরা চিম্বুক পাহাড়ে। গড়ে তুলেছেন পরিবেশবান্ধব শাকসবজি ও ফলমূলের বাগান। ম্রোদের কৃষি উৎপাদন দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর জুম আবাদের জন্য দরকার হয় পাহাড়ি অঞ্চল। অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর পর্যটনের নামে বারবার পাহাড়ি অঞ্চল দখলের ফলে ম্রোসহ পাহাড়ি সমাজ বারবার নিজস্ব জুম আবাদ থেকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হচ্ছেন। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে। চিম্বুক পাহাড়ের জুম জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের ভেতর দিয়ে দেশের কৃষি খাতকে আরও বেশি পরিবেশবান্ধব ও বৈচিত্র্যময় করে গড়ে তোলা সম্ভব। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এই বিপন্ন সময়ে একটি পাহাড়ে বিলাসবহুল হোটেল স্থাপনের চেয়ে সেই পাহাড় স্থানীয় জনগণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে রক্ষা করাই সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে চিম্বুক পাহাড়ে ম্যারিয়টসহ সব ধরনের বিলাসবহুল বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্র ও হোটেল নির্মাণ বন্ধ করে দেশের বিদ্যমান পরিবেশবান্ধব নীতি কাঠামোর ভেতর দিয়ে পাহাড় ও জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিলাসী হোটেল নয়, চিম্বুক পাহাড়ে একটা হাসপাতাল দরকার। বিদ্যালয় দরকার। বিশ্বাস করি রাষ্ট্র চিম্বুকবাসীর দাবিকে সম্মান জানিয়ে চিম্বুক পাহাড় আগলে দাঁড়াবে অচিরেই।

[লেখক : গবেষক]

animistbangla@gmail.com

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২১ , ১ মাঘ ১৪২৭, ১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

বিলাসবহুল হোটেল নয় চিম্বুক পাহাড়ে স্কুল ও হাসপাতাল চাই

পাভেল পার্থ

image

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়সমূহের যে তালিকা তৈরি করে তাতে দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি রেঞ্জের ২৯টি পাহাড়ের ভেতর ৫টি রেঞ্জের ৯টি পাহাড়ের নামই পাংখোয়া ভাষার। পাহাড়ের নামকরণের সঙ্গে স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য, পাহাড়ের প্রতিবেশ, জাতিগত সংস্কৃতি এবং কোন সামাজিক স্মৃতিময় ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন পাহাড়ের অধিবাসীরা। যেমন বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়। চিমবক ম্রোর নামে পরিচিতি পেয়েছে এই পাহাড়। যদিও ম্রো আদিবাসীদের কাছে পাহাড়টির নাম ইয়াংবংহুং। চিম্বুকের কাছেই আরেক পাহাড়ের ম্রো নাম শোংনামহুং। মারমা ভাষায় নাইতং। বাঙালিরা এখন এই পাহাড়ের নাম দিয়েছে ‘চন্দ্রপাহাড়’। আর এই পাহাড়েই বিলাসবহুল পাঁচতারকা মার্কিন ম্যারিয়ট হোটেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে চিম্বুক পাহাড়ে জনমনে আশঙ্কা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশের নানাস্থানে তরুণ সমাজ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ম্রো গ্রাম এবং পাহাড় বিনাশ করে এমন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করছেন। ৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ম্যারিয়ট হোটেল বন্ধ এবং জীবন-জীবিকা সুরক্ষার দাবিতে বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে প্লুং বাঁশি বাজিয়ে ‘কালচারালাল শোডাউন’ করেছে ম্র্র্রোরা। দেশজুড়ে তর্ক উঠেছে, এই বিনোদন প্রকল্পকে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ এবং জনবসতিবিরোধী হিসেবে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। সারা পৃথিবী যখন করোনা মহামারীতে শংকিত ও তটস্থ তখন বাংলাদেশের এমন সুন্দর সবুজ পাহাড় বিনাশ করে এই বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ কার স্বার্থে?

২.

বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ও জনজীবন সুরক্ষায় আমাদের রাষ্ট্র নাগরিকের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু চিম্বুক পাহাড়ে সাম্প্রতিক ম্যারিয়ট হোটেলের এই স্থাপনা নির্মাণ আমাদের শংকিত করে। আমরা চাই আমাদের প্রিয় সবুজ চিম্বুক পাহাড় নীল মেঘের তলায় বেঁচে থাকুক। ম্রোসহ স্থানীয় আদিবাসীরা এই পাহাড়ে জুম আবাদসহ নিজেদের সভ্যতা বিকশিত করুক। রাষ্ট্র চিম্বুক পাহাড়ের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক। এই দারুণ সুন্দর পাহাড়ে যে মানুষেরা সভ্যতা গড়ে তুলেছেন তাদের একটা হাসপাতাল নেই। শিশুদের জন্য নেই বিদ্যালয়। গড়ে ওঠেনি পাঠাগার। এখন বিলাসবহুল ম্যারিয়ট হোটেল নির্মাণের নামে শিশুদের খেলার মাঠ, কৃষিজমি, ফলের বাগান, সমাধি, প্রার্থনালয় আর বহু প্রাচীন পাড়াগুলো কেড়ে নেয়া হবে।

৩.

চিম্বুক পাহাড়ের আদি ম্রো সভ্যতা আজ এক নিদারুণ উন্নয়ন-যন্ত্রণার মুখোমুখি। বান্দরবান জেলা পরিষদের ভাষ্য, পর্যটনের জন্য শোংনাম বা নাইতং পাহাড়ের ২০ একর ভূমি ৪০ বছরের জন্য লিজ দেয়া হয়েছে। যদিও ২০১২ সনে এই ভূমি লিজ বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল আঞ্চলিক পরিষদ। এখানে তৈরি হবে বহুজাতিক মার্কিন চেইন হোটেল ম্যারিয়ট। গণমাধ্যমে প্রকাশ, কেবল হোটেল নয়; ১২টি পাহাড়জুড়ে এই বিলাসি তান্ডব চলতে পারে। ক্যাবলকার (রোপওয়ে) হবে, বিনোদন পার্ক থাকবে। সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং সিকদার গ্রুপ (আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস) বাংলাদেশে এই কাজটি সমন্বয় করছে। এই বিলাসী উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে গেলে কাপ্রুপাড়া, কলাইপাড়া, এরা পাড়া, দলা পাড়া ম্রো গ্রামগুলো নিরুদ্দেশ হবে। আশঙ্কা, ভবিষ্যতে ম্র্রোদের ১১৬টি পাড়ার প্রায় ১০ হাজার মানুষ সংকটে পড়বে এবং বিপন্ন হয়ে ওঠবে হাজার একর পাহাড়ি বাস্তুসংস্থান। বাংলাদেশে এভাবেই ধনীদের ভোগবিলাসিতার নামে পাহাড়, অরণ্য, নদী, জলাভূমি কী কৃষিজমি সবকিছু ধ্বংস করেই একের পর এক গড়ে তোলা হচ্ছে অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও পরিবেশবিনাশী স্থাপনা। কোন সংবেদনশীল অঞ্চলে বৃহৎ স্থাপনা নির্মাণের আগে সেখানে প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা, পরিবেশগত প্রভাব যাচাই ও সামাজিক প্রভাব যাচাই করার কথা বাংলাদেশের পরিবেশ আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিশাল বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের আগে এমন কোন পরিবেশগত সমীক্ষা ও যাচাই হয়েছে কি না-আমরা জানি না।

৪.

ম্যারিয়ট হোটেলের এই প্রকল্প বিষয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ২২/১১/২০২০ তারিখে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে একটি সংবাদ সম্মেলন করে। পরিষদের চেয়ারম্যান তার লিখিত বক্তব্যে জানান, কৃষিপ্রযুক্তি ও উন্নত চাষাবাদ প্রদর্শনীর মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক পথ সুগম করার লক্ষ্যে স্থানীয় ম্রো নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নাইতং পাহাড়ের ২০ একর ভূমি নেয়া হয়েছে। ২০১২ সনে জেলা পরিষদের নামে কথিত জমি বন্দোবস্তি পাওয়ার জন্য বান্দরবান জেলা পরিষদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্দোবস্তি কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত জটিলতা থাকায় বন্দোবস্তি মামলাটি নিষ্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। চেয়ারম্যান তার লিখিত বক্তব্যে আরও উল্লেখ করেন, ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড, বান্দরবান সেনানিবাসের প্রস্তাব ও অনুরোধের প্রেক্ষিতে ১ জানুয়ারি ২০১৬ হতে ৩১ ডিসেম্বর ২০৫৫ সন পর্যন্ত ৪০ বছরের জন্য ১৮টি শর্তের চুক্তিতে উল্লিখিত জমিটি ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডকে ইজারা দেয়া হয়েছে। কিন্তু জেলার ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এখনও জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর হয়নি, কীভাবে তাহলে জেলা পরিষদ এই পাহাড়ি ভূমি ইজারা দিতে পারে? চিম্বুক পাহাড়বাসী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের এই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে ১১/১২/২০২০ তারিখে তাদের নিজেদের অবস্থান ও বক্তব্য তুলে ধরে। চিম্বুক পাহাড়বাসী তাদের লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করে, ৩০২ নং লুলাইং মৌজার প্রাক্তন হেডম্যান স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই কৃষি ও খামার প্রদর্শনীর প্রকল্পের জন্য জেলা পরিষদকে পাঁচ একর ভূমি সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেই পাঁচ একর ভূমি কীভাবে ২০ একর হয়ে গেল বিষয়টি চিম্বুকবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের জাগ্রত স্বপ্নজয়ী মানুষ বরাবরই সব ধরনের দুর্নীতি, মিথ্যা এবং প্রতারণার বিরুদ্ধে। চিম্বুক পাহাড়ের ভূমি নিয়ে ‘ইজারা’ সম্পর্কিত অস্পষ্টতা দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে স্পষ্ট করা জরুরি।

৫.

জুম চাষকে স্থানীয়ভাবে ম্রো ভাষায় ওয়াহ্ ল্যুপ বলে। ম্রো সমাজ ঐতিহাসিকভাবে জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল। রাইচা, রাইরিক, রাইস্যু, রাইজো, নাইংসা, জাম্মা এ রকম অসংখ্য পাহাড়ি ধানের প্রচলন করেছেন ম্রোরা চিম্বুক পাহাড়ে। গড়ে তুলেছেন পরিবেশবান্ধব শাকসবজি ও ফলমূলের বাগান। ম্রোদের কৃষি উৎপাদন দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর জুম আবাদের জন্য দরকার হয় পাহাড়ি অঞ্চল। অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর পর্যটনের নামে বারবার পাহাড়ি অঞ্চল দখলের ফলে ম্রোসহ পাহাড়ি সমাজ বারবার নিজস্ব জুম আবাদ থেকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হচ্ছেন। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে। চিম্বুক পাহাড়ের জুম জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের ভেতর দিয়ে দেশের কৃষি খাতকে আরও বেশি পরিবেশবান্ধব ও বৈচিত্র্যময় করে গড়ে তোলা সম্ভব। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এই বিপন্ন সময়ে একটি পাহাড়ে বিলাসবহুল হোটেল স্থাপনের চেয়ে সেই পাহাড় স্থানীয় জনগণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে রক্ষা করাই সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে চিম্বুক পাহাড়ে ম্যারিয়টসহ সব ধরনের বিলাসবহুল বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্র ও হোটেল নির্মাণ বন্ধ করে দেশের বিদ্যমান পরিবেশবান্ধব নীতি কাঠামোর ভেতর দিয়ে পাহাড় ও জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিলাসী হোটেল নয়, চিম্বুক পাহাড়ে একটা হাসপাতাল দরকার। বিদ্যালয় দরকার। বিশ্বাস করি রাষ্ট্র চিম্বুকবাসীর দাবিকে সম্মান জানিয়ে চিম্বুক পাহাড় আগলে দাঁড়াবে অচিরেই।

[লেখক : গবেষক]

animistbangla@gmail.com