মরুভূমি থেকে মরূদ্যান

বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিতে নীরব বিপ্লব

মরুভূমিতে পরিণত হওয়া একসময়ের বরেন্দ্র অঞ্চল এখন সবুজের সমারোহ। লাল মাটির জন্য বিখ্যাত রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর, নওগাঁ জেলার সাপাহার, নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, পোরশা উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। এসব এলাকার কোন কোন স্থানে উঁচু-নিচু টিলার মতো ভূমি। যাকে বলা হয় বরেন্দ্র অঞ্চল।

এ অঞ্চলের অনেক জমিতে বছরে মাত্র একটি ফসল ধান উৎপাদন করতে পারতেন কৃষকরা। ফলে ফলে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কেটে নেয়ার পর অনেকটা মরুভূমির মতো পড়ে থাকত এ অঞ্চল। গত চার-পাঁচ বছরে বরেন্দ্র অঞ্চল যেন সবুজের লিলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এই অঞ্চলের যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই যেন ফলের বাগান। আম, পেয়ারা, কমলা, মাল্টা, লিচু, ড্রাগন, মেওয়া (আতা লেওয়া) থেকে শুরু করে মরুভূমিরতে জন্মানো খেজুরও চাষ হচ্ছে এখনে। তবে ব্যাপক হারে চাষ হয়েছে বা হচ্ছে আম। মরুভূমি থেকে মরূদ্যানে পরিণত হওয়া বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিতে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে কয়েক বছরে। এখনও ফলের গাছ রোপণ হচ্ছে হাজার হাজার বিঘা জমিতে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা রাত-দিন নানা জাতের ফল চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আবার কোন কোন জমিতে লাগানো গাছ থেকে ফল পেড়ে বাজারজাত করতেও ব্যস্ত সময় পার করছেন অনেকেই। তবে আমের মৌসুমে এই ব্যস্ততা বেড়ে যায় হাজার গুণ। কারণ এই অঞ্চলের প্রায় অধিকাংশ জমিতে এখন আমচাষে ঝুঁকেছেন কৃষকরা।

সেসব আমগাছ থেকে বছরে শত শত কোটি টাকার আম উৎপাদন হচ্ছে। মৌসুম ছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ও কোন কোন বাগান থেকে পাড়া হচ্ছে বারোমাসি আম। এসব আমের যেমন চাহিদা আছে, তেমন বাজার দরও ভালো। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটে গেছে। ঘটেছে শত শত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন। বেকার যুবকরাও এখন আমসহ বিভিন্ন ফলের বাগান করে সাবলম্বি হচ্ছেন। অনেকেই কোটিপতি বনে গেছেন শুধু ফলের বাগানের ওপর নির্ভর করে।

বিশেষ করে নওগাঁর তিনটি উপজেলায় আম পাল্টে দিয়েছে প্রাচীন বরেন্দ্রভূমির সভ্যতাকে। এক কালের ঠাঁঠাঁ বরেন্দ্র অঞ্চল সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর এলাকার মাঠে মাঠে এখন যেন সোনা ফলছে। অতিতে যেখানে প্রতিবিঘা জমিতে কৃষক পেত বড় জোর ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ধান সেখানে এখন তারা প্রতিবিঘা জমি থেকে বছরে আম বিক্রি করেই পাচ্ছেন লক্ষাধিক টাকা।

কয়েক বছর আগেও এইসব এলাকার মানুষজন প্রকৃতি নির্ভর চার পদ্ধতিতে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকতেন। শত বিঘা জমির মালিকের ঘরেও ছিল অর্থনৈতিক টানাপোড়েন।

আমসহ বিভিন্ন ফল ফলিয়ে বদলে গেছে কৃষকদের ভাগ্য। মজুর শ্রেণীর জুটেছে কর্মসংস্থান। কোন কোন জমির মালিক জমি বর্গা দিয়েও বছরে লাখ লাখ টাকা ঘরে তুলছেন।

পোরশা উপজেলার সাওর গ্রামের হুমায়ন আলী জানান, বছর সাতেক আগে প্রায় ৯ বিঘা জমিতে আম্রপালি জাতের আমচাষ করেন। এখন তিনি বছরে অন্তত ৫-৬ লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারেন।

সাওর গ্রামের ইমতিয়াজ বলেন, ‘তিন বিঘা জমিতে চাষ করা মাল্টা থেকেই বছরে অন্তত তিন লাখ টাকা আয় হচ্ছে তার। সেখান থেকে বাগানের পরিচর্যার জন্য শ্রমিক এবং সার-বিষের খরচ যাচ্ছে বড়জোর এক লাখ টাকা। তার পরও বছর শেষে আয় হচ্ছে অন্তত দুই লাখ টাকা। আর প্রায় ২০ বিঘা জমিতে রোপণ করা আমগাছ থেকে আয় হচ্ছে আরও অন্তত ৮-৯ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে মাল্টা ও আমচাষ করেই বছরে অন্তত ১০ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।’

নওগাঁ জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শামসুল ওয়াদুদ জানান, নওগাঁ জেলাজুড়ে যে আম উৎপাদন হয় তার সিংহভাগ উৎপাদন হয়ে থাকে ঘেঁষা সাপাহার ও পোরশা উপজেলায়। এই জেলায় যে আম উৎপাদন হয়ে থাকে তার মধ্যে ৬০ ভাগ আম্রপালি ও বাকি ৪০ ভাগ ফজলি, নাগফজলি, ন্যাংড়া, খিরশা, হিমসাগরসহ বারোমাসি জাতেরও আম রয়েছে। গত মৌসুমে জেলায় সর্বমোট ২৪ হাজার ৭৫০ হেক্টোর জমিতে আমের চাষাবাদ হয়। সেখান থেকে যে আম উৎপাদন হয়, তার যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। যা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলেও এতো আয় হয়নি। ফলে নওগাঁ জেলাকে আমের বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা দেয়া হয় গত বছর।

image
আরও খবর

শনিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২১ , ২ মাঘ ১৪২৭, ২ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মরুভূমি থেকে মরূদ্যান

বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিতে নীরব বিপ্লব

সুব্রতদাস, রাজশাহী

image

মরুভূমিতে পরিণত হওয়া একসময়ের বরেন্দ্র অঞ্চল এখন সবুজের সমারোহ। লাল মাটির জন্য বিখ্যাত রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর, নওগাঁ জেলার সাপাহার, নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, পোরশা উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। এসব এলাকার কোন কোন স্থানে উঁচু-নিচু টিলার মতো ভূমি। যাকে বলা হয় বরেন্দ্র অঞ্চল।

এ অঞ্চলের অনেক জমিতে বছরে মাত্র একটি ফসল ধান উৎপাদন করতে পারতেন কৃষকরা। ফলে ফলে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কেটে নেয়ার পর অনেকটা মরুভূমির মতো পড়ে থাকত এ অঞ্চল। গত চার-পাঁচ বছরে বরেন্দ্র অঞ্চল যেন সবুজের লিলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এই অঞ্চলের যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই যেন ফলের বাগান। আম, পেয়ারা, কমলা, মাল্টা, লিচু, ড্রাগন, মেওয়া (আতা লেওয়া) থেকে শুরু করে মরুভূমিরতে জন্মানো খেজুরও চাষ হচ্ছে এখনে। তবে ব্যাপক হারে চাষ হয়েছে বা হচ্ছে আম। মরুভূমি থেকে মরূদ্যানে পরিণত হওয়া বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিতে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে কয়েক বছরে। এখনও ফলের গাছ রোপণ হচ্ছে হাজার হাজার বিঘা জমিতে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা রাত-দিন নানা জাতের ফল চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আবার কোন কোন জমিতে লাগানো গাছ থেকে ফল পেড়ে বাজারজাত করতেও ব্যস্ত সময় পার করছেন অনেকেই। তবে আমের মৌসুমে এই ব্যস্ততা বেড়ে যায় হাজার গুণ। কারণ এই অঞ্চলের প্রায় অধিকাংশ জমিতে এখন আমচাষে ঝুঁকেছেন কৃষকরা।

সেসব আমগাছ থেকে বছরে শত শত কোটি টাকার আম উৎপাদন হচ্ছে। মৌসুম ছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ও কোন কোন বাগান থেকে পাড়া হচ্ছে বারোমাসি আম। এসব আমের যেমন চাহিদা আছে, তেমন বাজার দরও ভালো। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটে গেছে। ঘটেছে শত শত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন। বেকার যুবকরাও এখন আমসহ বিভিন্ন ফলের বাগান করে সাবলম্বি হচ্ছেন। অনেকেই কোটিপতি বনে গেছেন শুধু ফলের বাগানের ওপর নির্ভর করে।

বিশেষ করে নওগাঁর তিনটি উপজেলায় আম পাল্টে দিয়েছে প্রাচীন বরেন্দ্রভূমির সভ্যতাকে। এক কালের ঠাঁঠাঁ বরেন্দ্র অঞ্চল সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর এলাকার মাঠে মাঠে এখন যেন সোনা ফলছে। অতিতে যেখানে প্রতিবিঘা জমিতে কৃষক পেত বড় জোর ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ধান সেখানে এখন তারা প্রতিবিঘা জমি থেকে বছরে আম বিক্রি করেই পাচ্ছেন লক্ষাধিক টাকা।

কয়েক বছর আগেও এইসব এলাকার মানুষজন প্রকৃতি নির্ভর চার পদ্ধতিতে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকতেন। শত বিঘা জমির মালিকের ঘরেও ছিল অর্থনৈতিক টানাপোড়েন।

আমসহ বিভিন্ন ফল ফলিয়ে বদলে গেছে কৃষকদের ভাগ্য। মজুর শ্রেণীর জুটেছে কর্মসংস্থান। কোন কোন জমির মালিক জমি বর্গা দিয়েও বছরে লাখ লাখ টাকা ঘরে তুলছেন।

পোরশা উপজেলার সাওর গ্রামের হুমায়ন আলী জানান, বছর সাতেক আগে প্রায় ৯ বিঘা জমিতে আম্রপালি জাতের আমচাষ করেন। এখন তিনি বছরে অন্তত ৫-৬ লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারেন।

সাওর গ্রামের ইমতিয়াজ বলেন, ‘তিন বিঘা জমিতে চাষ করা মাল্টা থেকেই বছরে অন্তত তিন লাখ টাকা আয় হচ্ছে তার। সেখান থেকে বাগানের পরিচর্যার জন্য শ্রমিক এবং সার-বিষের খরচ যাচ্ছে বড়জোর এক লাখ টাকা। তার পরও বছর শেষে আয় হচ্ছে অন্তত দুই লাখ টাকা। আর প্রায় ২০ বিঘা জমিতে রোপণ করা আমগাছ থেকে আয় হচ্ছে আরও অন্তত ৮-৯ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে মাল্টা ও আমচাষ করেই বছরে অন্তত ১০ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।’

নওগাঁ জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শামসুল ওয়াদুদ জানান, নওগাঁ জেলাজুড়ে যে আম উৎপাদন হয় তার সিংহভাগ উৎপাদন হয়ে থাকে ঘেঁষা সাপাহার ও পোরশা উপজেলায়। এই জেলায় যে আম উৎপাদন হয়ে থাকে তার মধ্যে ৬০ ভাগ আম্রপালি ও বাকি ৪০ ভাগ ফজলি, নাগফজলি, ন্যাংড়া, খিরশা, হিমসাগরসহ বারোমাসি জাতেরও আম রয়েছে। গত মৌসুমে জেলায় সর্বমোট ২৪ হাজার ৭৫০ হেক্টোর জমিতে আমের চাষাবাদ হয়। সেখান থেকে যে আম উৎপাদন হয়, তার যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। যা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলেও এতো আয় হয়নি। ফলে নওগাঁ জেলাকে আমের বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা দেয়া হয় গত বছর।