লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনা

রেলওয়ের অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

শুধু যাত্রী পরিবহনই নয়, মালামাল পরিবহনের জন্যও বিশ্বব্যাপী রেলপথকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। ট্রেনে চেপে বেশিসংখ্যক যাত্রী দ্রুততম সময়ে অধিক পথ নিরাপদে অতিক্রম করতে পারে। ট্রেনের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। রেলপথে ভ্রমণেও মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু বিশে^র মানুষের কাছে যাতায়াতের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত রেলপথ আজ বাংলাদেশে অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন কোন উন্নয়ন না হওয়ায় রেলওয়ে ক্রমশ গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বসেছে। লেভেল ক্রসিংগুলো অরক্ষিত থাকায় ক্রমাগত ঘটে চলেছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সড়কপথে যানবাহন ও রেললাইনে ট্রেন আলাদা দুটি পথ ধরে চলে। শুধু লেভেল ক্রসিংয়েই এ দু’ধরনের বাহনের সাক্ষাৎ হয়। রেললাইনের ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা ঘটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। অথচ এসব লেভেল ক্রসিংগুলো সুরক্ষিত না থাকার কারণে বারবার ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। গত ১৯ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের পুরানাপৈল লেভেল ক্রসিংয়ে গেটকিপার লোহার বার ফেলার পরও দ্রুত গতিতে আসা বাস তা ভেঙে গেটের ভেতর ঢুকে গেলে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং তাতে ১২ জন নিহত এবং ছয়জন গুরুতর আহত হয়। এর মাত্র ৩ দিন পর ২১ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ফুলবাড়ী বেলঘুণ্টি এলাকার একটি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন ও পণ্যবাহী ট্রাকের সংঘর্ষে গেটম্যান নিহত হয়। কোন শিডিউল ছাড়া সিগন্যাল ছাড়াই ট্রেনটি লেভেল ক্রসিংয়ে এসে ট্রাককে ধাক্কা দেয়ায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলসড়কের সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় পঞ্চক্রোশী এলাকার বেতকাকান্দিতে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত এবং অন্তত ছয়জন আহত হয়েছেন। ১৯ অক্টোবর রাজবাড়ীর কালুখালি-ভাটিয়াপাড়া ট্রেন রুটে বালিয়াকান্দি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন ও ইঞ্জিনচালিত গাড়ির সংঘর্ষে পাঁচজন শ্রমিক নিহত ও আটজন আহত হয়েছে। এক বেসরকারি সূত্রমতে জানা যায়, গত তিন বছরে ৫ হাজার দুর্ঘটনায় ৪৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। আহতের সংখ্যা হয়েছে তিন হাজার।

লেভেল ক্রসিংয়ে একটি রেললাইন একটি সড়কপথকে অতিক্রম করে যায়। উন্নত রেলযোগাযোগ ব্যবস্থায় লেভেল ক্রসিংয়ে রেলপথ ও সড়কপথ আলাদা দুটি লেভেল বা স্তর দিয়ে চলে। কাজেই সেখানে রেলপথে ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের সংঘর্ষের কোন সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও সে রকম ব্যবস্থা না থাকায় লেভেল ক্রসিংয়ে গেটবার দিয়ে সড়কপথ আটকে রেখে ট্রেনকে চলার সুযোগ করে দেয়া হয়। আর সেই ব্যবস্থাটি যথাযথভাবে কাজ করে না বলেই লেভেল ক্রসিংয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের দুই হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই হাজার ৮৯৬টি লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৪০০টি অবৈধ। এর মধ্যে ৯৬১টি লেভেল ক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এসব ক্রসিংয়ে নেই কোন গেটম্যান। এসব অরক্ষিত, গেটম্যানবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটে যতসব দুর্ঘটনা। রেলকর্তৃপক্ষের কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরি করে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইনে ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ। এছাড়া এসবের ৬৬১টিতে কোন গেটম্যানই নেই। পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৩৭৭টি ক্রসিংয়ের ৮১১টি অবৈধ আর ৩০০ বৈধ ক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান নেই। অনেক জায়গায় বেআইনিভাবে রেললাইন অতিক্রম করে যে যার প্রয়োজনে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে রেললাইন পেরোতে হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে ১৮১৯ অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটলেও দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। লেভেল ক্রসিংয়ের বেশিরভাগ গেটবারের অবস্থাও করুণ। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা ভাঙা গেটবার নামানো হচ্ছে কোন উপায়ে। এমনকি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন এসে পৌঁছার আগাম সংকেত পাওয়ার ব্যবস্থাও নেই সব জায়গায়। গেটম্যানদের আন্দাজ করে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তারা কোন কর্মবিরতি বা ছুটিছাটাও ভোগ করতে পারেন না। তাদের অনেকের আর্থিক অবস্থাও করুণ বলে জানা গেছে।

লেভেল ক্রসিং ছাড়াও রেললাইনের আশেপাশের জায়গাও সুরক্ষিত নয়। লেভেল ক্রসিংয়ের আশেপাশে গড়ে উঠেছে বস্তি, বাজারসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। রেলপথের ওপর অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণ করে থাকে সরকারের নানা সংস্থা। বিভিন্ন এলাকার অসচেতন জনগোষ্ঠী নিজেদের বাড়ির রাস্তা সোজা করতে রেললাইনের ওপর দিয়ে এখানে সেখানে অবৈধভাবে এপ্রোচ সড়ক তৈরি করে। রেললাইনের ওপরই প্রতিদিন পণ্য বেচাকেনা করতে জড়ো হন অসংখ্য মানুষ। পথচারী ও যানবাহনকে দ্রুত লেভেল ক্রসিং পেরুতে গিয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। সেলফোনে কথা বলা ও ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে চলার কারণেও গত বছর নিহত হয়েছেন ৩২২ জন। এছাড়া রেললাইনের ওপর বসা ও চলাচলের কারণে ১ হাজার ৯৭৬ জন, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ১৪৬ জন এবং অন্যান্য কারণে ২৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ট্রেন দুর্ঘটনা ও রেললাইনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৪৬৬ জন।

বর্তমানে রেলযোগাযোগের বেশ কিছু উন্নতি হলেও বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরাজমান নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জিত হচ্ছে না। যাত্রীসেবা মানের তেমন উন্নয়ন না ঘটায় মানুষের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। নিকট অতীতে আখাউড়া-সিলেট রেল সেকশনের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বড়ছড়া রেলব্রিজ ভেঙে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস নিচে পড়ে উল্টে চারজন যাত্রী নিহত এবং দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়। জোড়াতালি দেয়া রেললাইন, ওঠে যাওয়া ব্যালাস্ট, অতি পুরান ভাঙা কাঠের সিøপার, লাটবল্টু বা ডগস্পাইকের বদলে কাঠের গোজ লাগিয়ে মেরামত করা নড়বড়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়া ট্রেনে ছিল ১৭টি কোচে সহস্র্রাধিক যাত্রী যা কিনা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত। কোন এক সময় হাটহাজারীতে রেলসেতু ভেঙে তেলবাহী ট্যাংকার নিচে পড়ে যায়। পাহাড়ি ঢলে শ্রীমঙ্গল-সাঁতগাঁওয়ে সেতু ডেবে যায়। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রেলসেতুর গার্ডারের নিচের মাটি ধসে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রেলওয়ের অধিকাংশ সেতু হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। রেলপথে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার ১৪৩টির অধিক সেতু রয়েছে। দীর্ঘকাল সংস্কারের অভাবে অনেকগুলো সেতুর অবস্থা বেহাল। এসব সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চললে আগামীতে আরও বড় ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশের বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য সড়ক ও রেলপথের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। নদীবহুল বাংলাদেশের নদীপথ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসায় রেল ও সড়কপথের গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলছে। কিন্তু অব্যাহত দুর্ঘটনা রেলপথে চলাচলে মানুষের মনে আস্থাহীনতার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে ট্রেন দুর্ঘটনার ফলে যাত্রী হতাহত ছাড়াও পঙ্গুত্ববরণ করেন অনেকে। এদের পরিবার-পরিজন নিঃস্ব হয়ে যায়। কিন্তু এসবের জন্য মামলা কখনও বা হলেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। হতাহতদের মেলে না ক্ষতিপূরণ। একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় রেললাইন, ট্রেনের বগি, যন্ত্রাংশ ছাড়াও যাত্রীদের মালামালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর রেললাইন সচল করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলতে অনেক সময় লেগে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দেশে রেললাইনের প্রয়োজনীয় উপকরণ চুরি হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। রেললাইনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারেরও অভাব রয়েছে। অদক্ষ চালক দিয়ে চলছে বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা।

অব্যাহত ট্রেন দুর্ঘটনা বন্ধ করতে বাংলাদেশের রেল বিভাগের অব্যবস্থা, অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। লেভেল ক্রসিং সংস্কার, রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা সব অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার অনতিবিলম্বে উচ্ছেদ করতে হবে। বর্তমান রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়নকল্পে রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি, সিগনাল ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিয়মিত সংরক্ষণ ও মেরামত করা অত্যাবশ্যক। লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যানের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির পাশাপাশি রেলওয়ে ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা নিশ্চিত করা জরুরি। যাত্রীদের টিকিট প্রদানের ব্যাপারে অনিয়ম বন্ধ করাসহ যাত্রী ছাউনি ও প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেভেল ক্রসিংয়ের সংস্কারসহ ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দক্ষ চালক নিয়োগ, রেলবিভাগের সর্বস্তরে যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনবল কাঠামো সুদৃঢ় করা আবশ্যক। রেলওয়েতে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ট্রেন দুর্ঘটনায় জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন ও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা গেলে রেলযোগাযোগের ভবিষ্যৎ উন্নয়নও সম্ভব হবে।

[লেখক : প্রাক্তন প্রকৌশলবিষয়ক শিক্ষক]

শনিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২১ , ২ মাঘ ১৪২৭, ২ জমাদিউস সানি ১৪৪২

লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনা

রেলওয়ের অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

image

শুধু যাত্রী পরিবহনই নয়, মালামাল পরিবহনের জন্যও বিশ্বব্যাপী রেলপথকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। ট্রেনে চেপে বেশিসংখ্যক যাত্রী দ্রুততম সময়ে অধিক পথ নিরাপদে অতিক্রম করতে পারে। ট্রেনের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। রেলপথে ভ্রমণেও মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু বিশে^র মানুষের কাছে যাতায়াতের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত রেলপথ আজ বাংলাদেশে অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন কোন উন্নয়ন না হওয়ায় রেলওয়ে ক্রমশ গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বসেছে। লেভেল ক্রসিংগুলো অরক্ষিত থাকায় ক্রমাগত ঘটে চলেছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সড়কপথে যানবাহন ও রেললাইনে ট্রেন আলাদা দুটি পথ ধরে চলে। শুধু লেভেল ক্রসিংয়েই এ দু’ধরনের বাহনের সাক্ষাৎ হয়। রেললাইনের ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা ঘটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। অথচ এসব লেভেল ক্রসিংগুলো সুরক্ষিত না থাকার কারণে বারবার ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। গত ১৯ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের পুরানাপৈল লেভেল ক্রসিংয়ে গেটকিপার লোহার বার ফেলার পরও দ্রুত গতিতে আসা বাস তা ভেঙে গেটের ভেতর ঢুকে গেলে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং তাতে ১২ জন নিহত এবং ছয়জন গুরুতর আহত হয়। এর মাত্র ৩ দিন পর ২১ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ফুলবাড়ী বেলঘুণ্টি এলাকার একটি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন ও পণ্যবাহী ট্রাকের সংঘর্ষে গেটম্যান নিহত হয়। কোন শিডিউল ছাড়া সিগন্যাল ছাড়াই ট্রেনটি লেভেল ক্রসিংয়ে এসে ট্রাককে ধাক্কা দেয়ায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলসড়কের সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় পঞ্চক্রোশী এলাকার বেতকাকান্দিতে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত এবং অন্তত ছয়জন আহত হয়েছেন। ১৯ অক্টোবর রাজবাড়ীর কালুখালি-ভাটিয়াপাড়া ট্রেন রুটে বালিয়াকান্দি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন ও ইঞ্জিনচালিত গাড়ির সংঘর্ষে পাঁচজন শ্রমিক নিহত ও আটজন আহত হয়েছে। এক বেসরকারি সূত্রমতে জানা যায়, গত তিন বছরে ৫ হাজার দুর্ঘটনায় ৪৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। আহতের সংখ্যা হয়েছে তিন হাজার।

লেভেল ক্রসিংয়ে একটি রেললাইন একটি সড়কপথকে অতিক্রম করে যায়। উন্নত রেলযোগাযোগ ব্যবস্থায় লেভেল ক্রসিংয়ে রেলপথ ও সড়কপথ আলাদা দুটি লেভেল বা স্তর দিয়ে চলে। কাজেই সেখানে রেলপথে ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের সংঘর্ষের কোন সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও সে রকম ব্যবস্থা না থাকায় লেভেল ক্রসিংয়ে গেটবার দিয়ে সড়কপথ আটকে রেখে ট্রেনকে চলার সুযোগ করে দেয়া হয়। আর সেই ব্যবস্থাটি যথাযথভাবে কাজ করে না বলেই লেভেল ক্রসিংয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের দুই হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই হাজার ৮৯৬টি লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৪০০টি অবৈধ। এর মধ্যে ৯৬১টি লেভেল ক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এসব ক্রসিংয়ে নেই কোন গেটম্যান। এসব অরক্ষিত, গেটম্যানবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটে যতসব দুর্ঘটনা। রেলকর্তৃপক্ষের কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরি করে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইনে ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ। এছাড়া এসবের ৬৬১টিতে কোন গেটম্যানই নেই। পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৩৭৭টি ক্রসিংয়ের ৮১১টি অবৈধ আর ৩০০ বৈধ ক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান নেই। অনেক জায়গায় বেআইনিভাবে রেললাইন অতিক্রম করে যে যার প্রয়োজনে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে রেললাইন পেরোতে হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে ১৮১৯ অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটলেও দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। লেভেল ক্রসিংয়ের বেশিরভাগ গেটবারের অবস্থাও করুণ। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা ভাঙা গেটবার নামানো হচ্ছে কোন উপায়ে। এমনকি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন এসে পৌঁছার আগাম সংকেত পাওয়ার ব্যবস্থাও নেই সব জায়গায়। গেটম্যানদের আন্দাজ করে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তারা কোন কর্মবিরতি বা ছুটিছাটাও ভোগ করতে পারেন না। তাদের অনেকের আর্থিক অবস্থাও করুণ বলে জানা গেছে।

লেভেল ক্রসিং ছাড়াও রেললাইনের আশেপাশের জায়গাও সুরক্ষিত নয়। লেভেল ক্রসিংয়ের আশেপাশে গড়ে উঠেছে বস্তি, বাজারসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। রেলপথের ওপর অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণ করে থাকে সরকারের নানা সংস্থা। বিভিন্ন এলাকার অসচেতন জনগোষ্ঠী নিজেদের বাড়ির রাস্তা সোজা করতে রেললাইনের ওপর দিয়ে এখানে সেখানে অবৈধভাবে এপ্রোচ সড়ক তৈরি করে। রেললাইনের ওপরই প্রতিদিন পণ্য বেচাকেনা করতে জড়ো হন অসংখ্য মানুষ। পথচারী ও যানবাহনকে দ্রুত লেভেল ক্রসিং পেরুতে গিয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। সেলফোনে কথা বলা ও ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে চলার কারণেও গত বছর নিহত হয়েছেন ৩২২ জন। এছাড়া রেললাইনের ওপর বসা ও চলাচলের কারণে ১ হাজার ৯৭৬ জন, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ১৪৬ জন এবং অন্যান্য কারণে ২৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ট্রেন দুর্ঘটনা ও রেললাইনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৪৬৬ জন।

বর্তমানে রেলযোগাযোগের বেশ কিছু উন্নতি হলেও বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরাজমান নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জিত হচ্ছে না। যাত্রীসেবা মানের তেমন উন্নয়ন না ঘটায় মানুষের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। নিকট অতীতে আখাউড়া-সিলেট রেল সেকশনের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বড়ছড়া রেলব্রিজ ভেঙে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস নিচে পড়ে উল্টে চারজন যাত্রী নিহত এবং দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়। জোড়াতালি দেয়া রেললাইন, ওঠে যাওয়া ব্যালাস্ট, অতি পুরান ভাঙা কাঠের সিøপার, লাটবল্টু বা ডগস্পাইকের বদলে কাঠের গোজ লাগিয়ে মেরামত করা নড়বড়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়া ট্রেনে ছিল ১৭টি কোচে সহস্র্রাধিক যাত্রী যা কিনা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত। কোন এক সময় হাটহাজারীতে রেলসেতু ভেঙে তেলবাহী ট্যাংকার নিচে পড়ে যায়। পাহাড়ি ঢলে শ্রীমঙ্গল-সাঁতগাঁওয়ে সেতু ডেবে যায়। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রেলসেতুর গার্ডারের নিচের মাটি ধসে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রেলওয়ের অধিকাংশ সেতু হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। রেলপথে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার ১৪৩টির অধিক সেতু রয়েছে। দীর্ঘকাল সংস্কারের অভাবে অনেকগুলো সেতুর অবস্থা বেহাল। এসব সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চললে আগামীতে আরও বড় ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশের বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য সড়ক ও রেলপথের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। নদীবহুল বাংলাদেশের নদীপথ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসায় রেল ও সড়কপথের গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলছে। কিন্তু অব্যাহত দুর্ঘটনা রেলপথে চলাচলে মানুষের মনে আস্থাহীনতার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে ট্রেন দুর্ঘটনার ফলে যাত্রী হতাহত ছাড়াও পঙ্গুত্ববরণ করেন অনেকে। এদের পরিবার-পরিজন নিঃস্ব হয়ে যায়। কিন্তু এসবের জন্য মামলা কখনও বা হলেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। হতাহতদের মেলে না ক্ষতিপূরণ। একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় রেললাইন, ট্রেনের বগি, যন্ত্রাংশ ছাড়াও যাত্রীদের মালামালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর রেললাইন সচল করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলতে অনেক সময় লেগে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দেশে রেললাইনের প্রয়োজনীয় উপকরণ চুরি হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। রেললাইনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারেরও অভাব রয়েছে। অদক্ষ চালক দিয়ে চলছে বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা।

অব্যাহত ট্রেন দুর্ঘটনা বন্ধ করতে বাংলাদেশের রেল বিভাগের অব্যবস্থা, অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। লেভেল ক্রসিং সংস্কার, রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা সব অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার অনতিবিলম্বে উচ্ছেদ করতে হবে। বর্তমান রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়নকল্পে রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি, সিগনাল ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিয়মিত সংরক্ষণ ও মেরামত করা অত্যাবশ্যক। লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যানের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির পাশাপাশি রেলওয়ে ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা নিশ্চিত করা জরুরি। যাত্রীদের টিকিট প্রদানের ব্যাপারে অনিয়ম বন্ধ করাসহ যাত্রী ছাউনি ও প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেভেল ক্রসিংয়ের সংস্কারসহ ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দক্ষ চালক নিয়োগ, রেলবিভাগের সর্বস্তরে যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনবল কাঠামো সুদৃঢ় করা আবশ্যক। রেলওয়েতে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ট্রেন দুর্ঘটনায় জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন ও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা গেলে রেলযোগাযোগের ভবিষ্যৎ উন্নয়নও সম্ভব হবে।

[লেখক : প্রাক্তন প্রকৌশলবিষয়ক শিক্ষক]