উত্তরাঞ্চলে শীতে জবুথবু জনজীবন

বাড়ছে শীতজনিত রোগ

তীব্র শীতে কাঁপছে লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চল। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় জবুথবু হয়ে পড়েছে জনজীবন। ছিন্নমূল মানুষরা খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছেন। কাজ ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ। কমে গেছে যানবাহন চলাচল। গত ৩ দিন থেকে দেখা মিলছে না সূর্যের। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কাজকর্ম, ভোগান্তিতে আছে নিম্নআয়ের মানুষ। কনকনে ঠাণ্ডা আর ঘন কুয়াশায় তিস্তা, ধরলা ও সানিয়াজান নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের কয়েক লাখ শীতার্ত মানুষের কষ্ট বেড়েছে বহুগুণ। পরিবারগুলোতে শীতের পোশাক না থাকায় খড়কুটোর আগুনই ভরসা করে চলছে শীতার্ত দুস্থ মানুষ।

গত শুক্রবারের মতো গতকাল সারাদিনেও সূর্যের দেখা না পাওয়ায় বেড়েছে ঠাণ্ডার তীব্রতা। এতে কাবু হয়ে পড়েছে তিস্তা-ধরলাপাড়ের শিশু, বৃদ্ধ সবাই। তিস্তা-ধরলাপারের মানুষজন খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। গতকাল লালমনিরহাটের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ইনচার্জ সুবল চন্দ্র রায়। মাঘের শুরু থেকেই শীতের তীব্রতা বাড়ায় প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সকাল ১০টা ও সন্ধ্যা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে দিনে ও রাতে খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিচ্ছেন তারা। ঠাণ্ডার কারণে কাজের সন্ধানে ঘরের বাইরে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন খেটেখাওয়া নিম্নআয়ের মানুষ।

একটু উষ্ণতা পাওয়ার আশায় গ্রামাঞ্চলের শীতবস্ত্রহীন মানুষ তাকিয়ে থাকছেন সূর্যের আলোর দিকে। সারাদিন ঠাণ্ডার তীব্রতার কারণে হাট-বাজারেও লোকসমাগম অনেকটাই কম। তিস্তাপাড়ের ইশোরকুল গ্রামের রমজান আলী জানান, কুয়াশা ও ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে ঘর থেকে বেড় হওয়া যায় না। তিস্তাপাড়ে প্রচুর শীত। এই এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ দিনমজুর ও জেলে। ঠাণ্ডায় কাজকর্ম না পেয়ে এই শীতের মৌসুমে তাদের কষ্ট বেড়ে গেছে। সদরের গোকুন্ডার রিকশাচালক ঝন্টু বলেন, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর কুয়াশার জন্য সকাল থেকে রিকশা বের করার সাহস পাইনি। খুনিয়াগাছ গ্রামের কিবরিয়া বলেন, ঠাণ্ডার কারণে কোন কাজকর্ম করতে পারছি না। অনেক কষ্টে রাত কাটিয়েছি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছি।

চরবেষ্টিত সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা দুর্গম। এখানে প্রায় ১৭টি চর রয়েছে। এসব চরে বসবাসকারী শীতার্ত মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এখন পর্যন্ত শীতবস্ত্র বলতে ৪৬০টি কম্বল পেয়েছি। তিনি শীতার্ত মানুষের পাশে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। লালমনিরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় বলেন, হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। উপজেলা মেডিকেল টিম, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, লালমনিরহাটের শীতার্তদের মাঝে ৩১ হাজার ৮শ’ কম্বল ও ৩৭ লাখ টাকা ৫ উপজেলার জন্য শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ চলমান আছে। এদিকে লালমনিরহাটের সির্ভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় জানান, গত দুই দিনে শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ায় সদর হাসপাতালসহ ৫টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী সংখ্যা বেড়েছে । গত ২৪ ঘণ্টায় ৪১৩ জন শীতজনিত রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি হয়েছে ১০৩ জন ।

প্রতিনিধি, রাজিবপুর (কুড়িগ্রাম) জানান, প্রবাদে বলে, মাঘের শীতে বাঘ কান্দে। গত ৩ দিনের টানা শৈত্যপ্রবাহে তা যেন স্মরণ করে দিয়েছে। আর সেই মাঘের শীতে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরবাসীকে কাবু করে ফেলেছে। গতকাল দুপুরে শীতজনিত রোগে সদর ইউনিয়নের ইমান আলী (৭০) নামের ১ মোয়াজ্জিনের মৃত্যু হয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। শীতের তীব্রতা এতো বেশি যে, খেটে খাওয়া মানুষ গত ২ দিন ধরে কাজে যেতে পারছে না। ঘরে বসে অলস সময় পার করছে। গত ২ দিনে কিছুটা সূর্যের আলো দেখা গেলেও গতকাল সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। দিনভর ছিল ঘন-কুয়াশার চাদরে ঢাকা। এদিকে প্রচুর ঠাণ্ডার কারণে সীমান্ত এলাকার ও নদী বিচ্ছিন্ন গ্রামের বাড়ি বাড়ি সর্দি-কাশি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

রাজিবপুরবাসী শীতে কাতরালেও সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৩০ পিস কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এ ব্যাপারে চর রাজিবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সৌভ্রাত দাস জানান, আমরা প্রথম ধাপে ১৩৮০ পিস এবং দ্বিতীয় ধাপে ২ হাজার ৫০ পিস কম্বল ক্রয় করে শীতার্তদের মাঝে বিতরণ করেছি।

গত বুধবার উপজেলার এক সভায় শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র প্রদানের জন্য সরকারের পাশাপাশি এনজিও কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছেন চর রাজিবপুর উপাজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর হোসেন হিরো।

রবিবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২১ , ৩ মাঘ ১৪২৭, ৩ জমাদিউস সানি ১৪৪২

উত্তরাঞ্চলে শীতে জবুথবু জনজীবন

বাড়ছে শীতজনিত রোগ

মনিরুজ্জামান সরকার, লালমনিরহাট

তীব্র শীতে কাঁপছে লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চল। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় জবুথবু হয়ে পড়েছে জনজীবন। ছিন্নমূল মানুষরা খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছেন। কাজ ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ। কমে গেছে যানবাহন চলাচল। গত ৩ দিন থেকে দেখা মিলছে না সূর্যের। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কাজকর্ম, ভোগান্তিতে আছে নিম্নআয়ের মানুষ। কনকনে ঠাণ্ডা আর ঘন কুয়াশায় তিস্তা, ধরলা ও সানিয়াজান নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের কয়েক লাখ শীতার্ত মানুষের কষ্ট বেড়েছে বহুগুণ। পরিবারগুলোতে শীতের পোশাক না থাকায় খড়কুটোর আগুনই ভরসা করে চলছে শীতার্ত দুস্থ মানুষ।

গত শুক্রবারের মতো গতকাল সারাদিনেও সূর্যের দেখা না পাওয়ায় বেড়েছে ঠাণ্ডার তীব্রতা। এতে কাবু হয়ে পড়েছে তিস্তা-ধরলাপাড়ের শিশু, বৃদ্ধ সবাই। তিস্তা-ধরলাপারের মানুষজন খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। গতকাল লালমনিরহাটের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ইনচার্জ সুবল চন্দ্র রায়। মাঘের শুরু থেকেই শীতের তীব্রতা বাড়ায় প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সকাল ১০টা ও সন্ধ্যা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে দিনে ও রাতে খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিচ্ছেন তারা। ঠাণ্ডার কারণে কাজের সন্ধানে ঘরের বাইরে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন খেটেখাওয়া নিম্নআয়ের মানুষ।

একটু উষ্ণতা পাওয়ার আশায় গ্রামাঞ্চলের শীতবস্ত্রহীন মানুষ তাকিয়ে থাকছেন সূর্যের আলোর দিকে। সারাদিন ঠাণ্ডার তীব্রতার কারণে হাট-বাজারেও লোকসমাগম অনেকটাই কম। তিস্তাপাড়ের ইশোরকুল গ্রামের রমজান আলী জানান, কুয়াশা ও ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে ঘর থেকে বেড় হওয়া যায় না। তিস্তাপাড়ে প্রচুর শীত। এই এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ দিনমজুর ও জেলে। ঠাণ্ডায় কাজকর্ম না পেয়ে এই শীতের মৌসুমে তাদের কষ্ট বেড়ে গেছে। সদরের গোকুন্ডার রিকশাচালক ঝন্টু বলেন, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর কুয়াশার জন্য সকাল থেকে রিকশা বের করার সাহস পাইনি। খুনিয়াগাছ গ্রামের কিবরিয়া বলেন, ঠাণ্ডার কারণে কোন কাজকর্ম করতে পারছি না। অনেক কষ্টে রাত কাটিয়েছি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছি।

চরবেষ্টিত সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা দুর্গম। এখানে প্রায় ১৭টি চর রয়েছে। এসব চরে বসবাসকারী শীতার্ত মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এখন পর্যন্ত শীতবস্ত্র বলতে ৪৬০টি কম্বল পেয়েছি। তিনি শীতার্ত মানুষের পাশে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। লালমনিরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় বলেন, হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। উপজেলা মেডিকেল টিম, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, লালমনিরহাটের শীতার্তদের মাঝে ৩১ হাজার ৮শ’ কম্বল ও ৩৭ লাখ টাকা ৫ উপজেলার জন্য শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ চলমান আছে। এদিকে লালমনিরহাটের সির্ভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় জানান, গত দুই দিনে শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ায় সদর হাসপাতালসহ ৫টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী সংখ্যা বেড়েছে । গত ২৪ ঘণ্টায় ৪১৩ জন শীতজনিত রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি হয়েছে ১০৩ জন ।

প্রতিনিধি, রাজিবপুর (কুড়িগ্রাম) জানান, প্রবাদে বলে, মাঘের শীতে বাঘ কান্দে। গত ৩ দিনের টানা শৈত্যপ্রবাহে তা যেন স্মরণ করে দিয়েছে। আর সেই মাঘের শীতে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরবাসীকে কাবু করে ফেলেছে। গতকাল দুপুরে শীতজনিত রোগে সদর ইউনিয়নের ইমান আলী (৭০) নামের ১ মোয়াজ্জিনের মৃত্যু হয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। শীতের তীব্রতা এতো বেশি যে, খেটে খাওয়া মানুষ গত ২ দিন ধরে কাজে যেতে পারছে না। ঘরে বসে অলস সময় পার করছে। গত ২ দিনে কিছুটা সূর্যের আলো দেখা গেলেও গতকাল সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। দিনভর ছিল ঘন-কুয়াশার চাদরে ঢাকা। এদিকে প্রচুর ঠাণ্ডার কারণে সীমান্ত এলাকার ও নদী বিচ্ছিন্ন গ্রামের বাড়ি বাড়ি সর্দি-কাশি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

রাজিবপুরবাসী শীতে কাতরালেও সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৩০ পিস কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এ ব্যাপারে চর রাজিবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সৌভ্রাত দাস জানান, আমরা প্রথম ধাপে ১৩৮০ পিস এবং দ্বিতীয় ধাপে ২ হাজার ৫০ পিস কম্বল ক্রয় করে শীতার্তদের মাঝে বিতরণ করেছি।

গত বুধবার উপজেলার এক সভায় শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র প্রদানের জন্য সরকারের পাশাপাশি এনজিও কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছেন চর রাজিবপুর উপাজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর হোসেন হিরো।