ক্যাপিটল হিলে হামলা : মার্কিন গণতন্ত্রের সংকট

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটাল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার সময় এক পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। জো বাইডেনের জয়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে ট্রাম্প সমর্থকরা ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং পুলিশের বাধা অতিক্রম করে ভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের আবশ্যকতার কথা বলার পরই সমর্থকরা জোর করে ক্যাপিটেল হিলে ঢুকার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠে। পরিস্থিতি এত ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল যে, রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি ও ভার্জিনিয়ায় সান্ধ্য আইন জারি করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কোন দিন ঘটেনি। শেষে গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে সিনেটরদের অন্য আরেকটি নিরাপদ ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্বাচনের ফল ঘোষণার শুরু থেকেই ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে আসছেন। কয়েকটি রাজ্যে মামলা করলেও ট্রাম্প এই কারচুপির বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। করোনার কারণে ভোটারেরা ডাকযোগে ভোট দেয়ার সুযোগ পাওয়ায় অন্যান্যবারের চেয়ে এবার ভোট পড়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি এবং ডাকে প্রেরিত বেশিরভাগ ভোট পেয়েছেন জো বাইডেন। ডাকযোগে ভোট দেয়ার এমন অবাধ সুযোগ না থাকলে ভোটাররা হয়তো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে তত আগ্রহী হতো না, এতে জো বাইডেনের ভোট কমে যেত এবং ট্রাম্প জিতে যেতেন বা কম ভোটের ব্যবধানে অভিযোগ উত্থাপন করে ভোট কারচুপি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারতেন। ভোট কারচুপির অভিযোগ নিয়ে ট্রাম্প অবিচল থাকলেও ক্যাপিটল হিলের ঘটনার পর ট্রাম্প ক্ষমতা হস্তান্তরে সম্মত হয়েছেন; তবে তিনি জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থে বা গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কত যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, কত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে তার ইয়েত্তা নেই। চিলির প্রেসিডেন্ট আয়েন্দ, কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা, মিসরের জামাল আবদেল নাসের, আর্জেন্টিনার প্যারো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ত, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতাচ্যুতির পেছনে আমেরিকার হাত রয়েছে বলে পৃথিবীর মানুষ বিশ্বাস করে। আফগানিস্তানের ড. নজীবুল্লাহ্, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফির স্বজাতির হাতে নৃশংসভাবে হত্যার পেছনে আমেরিকা কাজ করেছে বলেও সবার বিশ্বাস। পানামা খালে আমেরিকার অনিয়ন্ত্রিত প্রভাব বজায় রাখার প্রতিবন্ধক পানামার সামরিক শাসক নরিয়েগাকে তার দেশ থেকে তুলে নিয়ে নিজের দেশে শাস্তি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রির সুবিধা গ্রহণ করে সাংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যা নিয়ে আমেরিকা সামান্যতম উচ্চবাচ্যও করেনি। অস্ত্র বিক্রি করে পেট্রো ডলার কামিয়ে নিতে আমেরিকা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে। গণতন্ত্র আর মানবিকতার ছদ্মবেশে অন্য জাতিকে শাস্তি দেয়ার মনোবৃত্তি স্পষ্ট হয়েছে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেন, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে। গৃহযুদ্ধের কারণে এই দেশগুলো কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। গৃহযুদ্ধ লাগানোর কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় দলই সিদ্ধহস্ত। ইরাক আক্রমণে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন এক হয়ে গিয়েছিলেন। ভেনিজুয়েলায় একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকা সত্ত্বেও বিরোধীদলীয় নেতা জুয়ান গুয়াইদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আমেরিকা গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল।

জো বাইডেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে ঘিরে নাশকতার আশঙ্কায় নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে ট্রাম্প যাচ্ছেন না জেনে জো বাইডেন খুশি। আমেরিকার হোয়াইট এস্টাবলিশমেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় ট্রাম্প এত ভোট পেয়েছেন। কিন্তু ক্যাপিটল হিল দখল করে হলেও ট্রাম্পকে ক্ষমতায় রাখার এই হোয়াইট সেন্টিমেন্ট অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতি নষ্ট করবে। আমেরিকায় কিছু লোকের মধ্যে অভিবাসী, কালো মানুষ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে তীব্র ঘৃণা তার নগ্ন বহির্প্রকাশ এখনও স্পষ্ট হয়নি, কিন্তু একটি বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। এই বিভাজনের গ্যাপ হ্রাসে জো বাইডেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না, বরং ট্রাম্পকে অভিশংসন করার পদক্ষেপ এই বিভাজনকে বড় করবে, ট্রাম্পের সমর্থকরা আরও বেশি হিংস্র হয়ে উঠবে।

গণতন্ত্রই যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের শিকড় ও শক্তি; অথচ সেই দেশেই আজ গণতন্ত্রের সংকটের কথা ভেবে অনেকে শঙ্কিত। বহির্বিশ্ব নিয়ে আমেরিকার কুটিল রাজনীতির নড়চড় হয় না; অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবিকতা ও গণতন্ত্রবিরোধী কিছু স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অবমূল্যায়ন হয় বিধায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়নি; শুধু এই কারণে সম্ভবত করোনায় সেই দেশে সবচেয়ে বেশি লোক মারা গেল। অস্ত্র বিক্রেতার প্রভাব মুখ্য কারণ হলেও ব্যক্তি স্বাধীনতায় নিজের সুরক্ষার জন্য নিজের কাছে অস্ত্র রাখার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমেরিকায় কঠোর আইন করা হয় না। জনগণের ভোটে জয়লাভ করেও অতীতে অনেক প্রেসিডেন্ট ইলেক্টোরাল ভোটে হেরে পারাজয় মেনে নিয়েছেন। হিলারি ক্লিন্টন পপুলার ভোটে জয়লাভ করেছিলেন, ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছিলেন, কিন্তু ইলেক্টোরাল ভোট কম হওয়ায় ট্রাম্পের জয় মেনে নিয়েছিলেন। ট্রাম্প কিন্তু পরাজয় মানতে নারাজ। আমেরিকায় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বিপন্ন হলে বহির্জগতে তাদের শক্তিশালী নেতৃত্ব অক্ষুণœ রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই আমেরিকাই অন্য দেশের স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে থাকে; অথচ তাদের নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে সারা বিশ্বে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো ট্রাম্পও অভিযোগ তুলেছেন যে, কোন কোন রাজ্যে তাদের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এবারের নির্বাচন যেভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে তাতে হয়তো ভবিষ্যতে আমেরিকার গণতন্ত্রের সবক দেয়ার মানসিক শক্তি কিছুটা কমবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বক্তব্য দিয়ে যারা মার্কিন দূতাবাসে ছুটেন, এখন যেতে তাদেরও কিছুটা লজ্জা লাগবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচেনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই উত্থাপিত হোক না কেন, নির্বাচন যে নিরপেক্ষ হয়েছে তা প্রমাণিত হয় ট্রাম্প তার নিজের প্রশাসনের বিরুদ্ধেই ভোটে কারসাজি করার অভিযোগ তুলছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে ট্রাম্প জিতে যেতে পারত। সরকারপ্রধান ট্রাম্পের আদেশ-নির্দেশ মেনে নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসন নির্বাচনকে প্রভাবিত করেনি। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করা হয় এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন পরিচালনার জন্য অগণতান্ত্রিক তত্ত্ববধায়ক সরকারকে নির্ভরযোগ্য সরকার মনে করা হয়। তবে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও নির্বাচনে পরাজয়ের পর সব রাজনৈতিক দলই অভিযোগ করেছে। আমেরিকায় ট্রাম্প ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করলেও তা স্থায়ী হবে না, কারণ রিপাবলিক দল এবং ট্রাম্প প্রশাসন ট্রাম্পকে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে সহায়তা করবে না। এছাড়া আমেরিকার জনগণও তাদের সংবিধানে বিধৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করা কোন অভিসন্ধিতে সমর্থন দেবে না।

আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সব দেশে সব রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় যেতে চায়, ক্ষমতায় থাকতে চায়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে ক্ষমতায় টিকে থাকার মানসিকতা ক্ষমতার মোহ থেকে তৈরি হয়। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সম্ভব না হলেও আমেরিকার নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এমন সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের মতো অনুন্নত দেশে কোন দিনই হবে না। কারণ জনগণ ভোটের ব্যাপারে নির্লিপ্ত, নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়; অবৈধ টাকায় মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির সয়লাব হয়ে যায়Ñএই অপরাধের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল বা জনগণকে কোন অভিযোগ করতে শোনা যায় না। অভিযোগ উঠে ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে। সত্তরের নির্বাচনের বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। আমেরিকায় এমন কিছু না হলেও আমেরিকার অভ্যন্তরে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা চাঙ্গা হতে শুরু করেছে; কট্টর ডানপন্থিদের এই উগ্রতায় পৃথিবীর অসম্প্রদায়িক লোকগুলো উদ্বিগ্ন। ধারণা, বর্ণবাদ আর উগ্র জাতীয়তাবাদ উত্থানের কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প সাত কোটি ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনোত্তর ট্রাম্পের উসকানিমূলক বক্তব্য, তার সমর্থক গোষ্ঠী কর্তৃক ক্যাপিটল ভবনে জোর করে প্রবেশের ঘটনা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের একগুঁয়ে অগণতান্ত্রিক জেদের কারণে ২০২০ সনের আমেরিকার নির্বাচন ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমধর্মী নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২১ , ৩ মাঘ ১৪২৭, ৩ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ক্যাপিটল হিলে হামলা : মার্কিন গণতন্ত্রের সংকট

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটাল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার সময় এক পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। জো বাইডেনের জয়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে ট্রাম্প সমর্থকরা ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং পুলিশের বাধা অতিক্রম করে ভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের আবশ্যকতার কথা বলার পরই সমর্থকরা জোর করে ক্যাপিটেল হিলে ঢুকার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠে। পরিস্থিতি এত ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল যে, রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি ও ভার্জিনিয়ায় সান্ধ্য আইন জারি করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কোন দিন ঘটেনি। শেষে গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে সিনেটরদের অন্য আরেকটি নিরাপদ ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্বাচনের ফল ঘোষণার শুরু থেকেই ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে আসছেন। কয়েকটি রাজ্যে মামলা করলেও ট্রাম্প এই কারচুপির বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। করোনার কারণে ভোটারেরা ডাকযোগে ভোট দেয়ার সুযোগ পাওয়ায় অন্যান্যবারের চেয়ে এবার ভোট পড়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি এবং ডাকে প্রেরিত বেশিরভাগ ভোট পেয়েছেন জো বাইডেন। ডাকযোগে ভোট দেয়ার এমন অবাধ সুযোগ না থাকলে ভোটাররা হয়তো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে তত আগ্রহী হতো না, এতে জো বাইডেনের ভোট কমে যেত এবং ট্রাম্প জিতে যেতেন বা কম ভোটের ব্যবধানে অভিযোগ উত্থাপন করে ভোট কারচুপি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারতেন। ভোট কারচুপির অভিযোগ নিয়ে ট্রাম্প অবিচল থাকলেও ক্যাপিটল হিলের ঘটনার পর ট্রাম্প ক্ষমতা হস্তান্তরে সম্মত হয়েছেন; তবে তিনি জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থে বা গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কত যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, কত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে তার ইয়েত্তা নেই। চিলির প্রেসিডেন্ট আয়েন্দ, কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা, মিসরের জামাল আবদেল নাসের, আর্জেন্টিনার প্যারো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ত, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতাচ্যুতির পেছনে আমেরিকার হাত রয়েছে বলে পৃথিবীর মানুষ বিশ্বাস করে। আফগানিস্তানের ড. নজীবুল্লাহ্, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফির স্বজাতির হাতে নৃশংসভাবে হত্যার পেছনে আমেরিকা কাজ করেছে বলেও সবার বিশ্বাস। পানামা খালে আমেরিকার অনিয়ন্ত্রিত প্রভাব বজায় রাখার প্রতিবন্ধক পানামার সামরিক শাসক নরিয়েগাকে তার দেশ থেকে তুলে নিয়ে নিজের দেশে শাস্তি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রির সুবিধা গ্রহণ করে সাংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যা নিয়ে আমেরিকা সামান্যতম উচ্চবাচ্যও করেনি। অস্ত্র বিক্রি করে পেট্রো ডলার কামিয়ে নিতে আমেরিকা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে। গণতন্ত্র আর মানবিকতার ছদ্মবেশে অন্য জাতিকে শাস্তি দেয়ার মনোবৃত্তি স্পষ্ট হয়েছে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেন, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে। গৃহযুদ্ধের কারণে এই দেশগুলো কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। গৃহযুদ্ধ লাগানোর কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় দলই সিদ্ধহস্ত। ইরাক আক্রমণে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন এক হয়ে গিয়েছিলেন। ভেনিজুয়েলায় একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকা সত্ত্বেও বিরোধীদলীয় নেতা জুয়ান গুয়াইদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আমেরিকা গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল।

জো বাইডেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে ঘিরে নাশকতার আশঙ্কায় নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে ট্রাম্প যাচ্ছেন না জেনে জো বাইডেন খুশি। আমেরিকার হোয়াইট এস্টাবলিশমেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় ট্রাম্প এত ভোট পেয়েছেন। কিন্তু ক্যাপিটল হিল দখল করে হলেও ট্রাম্পকে ক্ষমতায় রাখার এই হোয়াইট সেন্টিমেন্ট অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতি নষ্ট করবে। আমেরিকায় কিছু লোকের মধ্যে অভিবাসী, কালো মানুষ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে তীব্র ঘৃণা তার নগ্ন বহির্প্রকাশ এখনও স্পষ্ট হয়নি, কিন্তু একটি বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। এই বিভাজনের গ্যাপ হ্রাসে জো বাইডেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না, বরং ট্রাম্পকে অভিশংসন করার পদক্ষেপ এই বিভাজনকে বড় করবে, ট্রাম্পের সমর্থকরা আরও বেশি হিংস্র হয়ে উঠবে।

গণতন্ত্রই যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের শিকড় ও শক্তি; অথচ সেই দেশেই আজ গণতন্ত্রের সংকটের কথা ভেবে অনেকে শঙ্কিত। বহির্বিশ্ব নিয়ে আমেরিকার কুটিল রাজনীতির নড়চড় হয় না; অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবিকতা ও গণতন্ত্রবিরোধী কিছু স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অবমূল্যায়ন হয় বিধায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়নি; শুধু এই কারণে সম্ভবত করোনায় সেই দেশে সবচেয়ে বেশি লোক মারা গেল। অস্ত্র বিক্রেতার প্রভাব মুখ্য কারণ হলেও ব্যক্তি স্বাধীনতায় নিজের সুরক্ষার জন্য নিজের কাছে অস্ত্র রাখার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমেরিকায় কঠোর আইন করা হয় না। জনগণের ভোটে জয়লাভ করেও অতীতে অনেক প্রেসিডেন্ট ইলেক্টোরাল ভোটে হেরে পারাজয় মেনে নিয়েছেন। হিলারি ক্লিন্টন পপুলার ভোটে জয়লাভ করেছিলেন, ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছিলেন, কিন্তু ইলেক্টোরাল ভোট কম হওয়ায় ট্রাম্পের জয় মেনে নিয়েছিলেন। ট্রাম্প কিন্তু পরাজয় মানতে নারাজ। আমেরিকায় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বিপন্ন হলে বহির্জগতে তাদের শক্তিশালী নেতৃত্ব অক্ষুণœ রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই আমেরিকাই অন্য দেশের স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে থাকে; অথচ তাদের নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে সারা বিশ্বে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো ট্রাম্পও অভিযোগ তুলেছেন যে, কোন কোন রাজ্যে তাদের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এবারের নির্বাচন যেভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে তাতে হয়তো ভবিষ্যতে আমেরিকার গণতন্ত্রের সবক দেয়ার মানসিক শক্তি কিছুটা কমবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বক্তব্য দিয়ে যারা মার্কিন দূতাবাসে ছুটেন, এখন যেতে তাদেরও কিছুটা লজ্জা লাগবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচেনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই উত্থাপিত হোক না কেন, নির্বাচন যে নিরপেক্ষ হয়েছে তা প্রমাণিত হয় ট্রাম্প তার নিজের প্রশাসনের বিরুদ্ধেই ভোটে কারসাজি করার অভিযোগ তুলছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে ট্রাম্প জিতে যেতে পারত। সরকারপ্রধান ট্রাম্পের আদেশ-নির্দেশ মেনে নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসন নির্বাচনকে প্রভাবিত করেনি। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করা হয় এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন পরিচালনার জন্য অগণতান্ত্রিক তত্ত্ববধায়ক সরকারকে নির্ভরযোগ্য সরকার মনে করা হয়। তবে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও নির্বাচনে পরাজয়ের পর সব রাজনৈতিক দলই অভিযোগ করেছে। আমেরিকায় ট্রাম্প ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করলেও তা স্থায়ী হবে না, কারণ রিপাবলিক দল এবং ট্রাম্প প্রশাসন ট্রাম্পকে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে সহায়তা করবে না। এছাড়া আমেরিকার জনগণও তাদের সংবিধানে বিধৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করা কোন অভিসন্ধিতে সমর্থন দেবে না।

আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সব দেশে সব রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় যেতে চায়, ক্ষমতায় থাকতে চায়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে ক্ষমতায় টিকে থাকার মানসিকতা ক্ষমতার মোহ থেকে তৈরি হয়। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সম্ভব না হলেও আমেরিকার নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এমন সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের মতো অনুন্নত দেশে কোন দিনই হবে না। কারণ জনগণ ভোটের ব্যাপারে নির্লিপ্ত, নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়; অবৈধ টাকায় মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির সয়লাব হয়ে যায়Ñএই অপরাধের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল বা জনগণকে কোন অভিযোগ করতে শোনা যায় না। অভিযোগ উঠে ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে। সত্তরের নির্বাচনের বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। আমেরিকায় এমন কিছু না হলেও আমেরিকার অভ্যন্তরে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা চাঙ্গা হতে শুরু করেছে; কট্টর ডানপন্থিদের এই উগ্রতায় পৃথিবীর অসম্প্রদায়িক লোকগুলো উদ্বিগ্ন। ধারণা, বর্ণবাদ আর উগ্র জাতীয়তাবাদ উত্থানের কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প সাত কোটি ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনোত্তর ট্রাম্পের উসকানিমূলক বক্তব্য, তার সমর্থক গোষ্ঠী কর্তৃক ক্যাপিটল ভবনে জোর করে প্রবেশের ঘটনা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের একগুঁয়ে অগণতান্ত্রিক জেদের কারণে ২০২০ সনের আমেরিকার নির্বাচন ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমধর্মী নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন]

ahmedzeauddin0@gmail.com