আর্থিক খাতের সুশাসনেই নিশ্চিত হবে পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন

পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা ধরে রাখতে এবং বাজারকে স্ট্যাবল এবং ভাইব্র্যান্ট রাখতে হলে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আমরা দেশব্যাপী সকলে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও গতিশীল পুঁজিবাজার দেখতে চাই। যে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে ভালো শিল্প উদ্যোক্তারা বাজার থেকে টাকা তুলবে এবং তা শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ, আবাসন, নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার কররে। দেশের শিল্প উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখবে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি কোন চাপ থাকবে না দীর্ঘমেয়াদী শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য।

বর্তমান বাজারের গতি প্রকৃতি দেখে আমরা বলতে পারি, পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরে এসেছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। তারই প্রতিফলন আমরা এক্সচেঞ্জের টার্নওভারে দেখতে পাই। আমরা আগামী তিন বছরের মধ্যে ডেইলি টার্নওভার ৫০০০ কোটি টাকায় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, ইনশআল্লাহ। শুধু ইক্যুইটি মার্কেটের ওপর নির্ভর না হয়ে বিভিন্ন নতুন নতুন প্রডাক্ট বাজারে নিয়ে আসার জন্য বিএসইসি এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি (সিসিপি) চালু হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের ডে সেটেলমেন্টসহ নতুন নতুন প্রডাক্টস, সুকুক ডেরিভেটিভস/ ফিউচার চালু করার প্রচেষ্টা জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এসএমই প্লাটফর্ম ডিএসই তৈরি করে ফেলেছে। সরকারি ভালো ভালো শেয়ার বাজারে এনে বাজারের গভীরতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। দেশীয় ভালো ভালো প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার এবং মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার বাজারে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সফল, সৎ ও দক্ষ উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগ্রহ বাড়ছে। বন্ড মার্কেট স্ট্রং হচ্ছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে জিডিপিতে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের অবদান ৫০ শতাংশের লক্ষমাত্রা নিয়ে বিএসইসি এবং এক্সচেঞ্জ এগিয়ে যাচ্ছে। বাজারে বিনিয়োগকারীদের পার্টিসিপিসান বাড়ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসছে।

শেয়ারের দাম উঠানামা করলে ইনডেক্স বাড়ে এবং কমে। সেটাই স্বাভাবিক। বাজারে ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি থাকলে বাজার স্বাভাবিক থাকে। ফ্রি ফ্লট শেয়ার যে কোম্পানির বেশি থাকে সে কোম্পানির শেয়ার ম্যানিপুলেট করে বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। কারণ যেসব কোম্পানির মৌল ভিত্তি ভালো এবং ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি তারা নিজস্ব স্ট্রেংথতে বাড়ে। এসব শেয়ারের ইপিএস, পিই রেশিও, রিজার্ভ, বিজনেস ইক্সপেনশান. কোম্পানির মূলধন, দক্ষ পরিকল্পনা ও পরিচালনার কারণে ম্যাচিউড বিনিয়োগকারী বেশি বেশি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী থাকে। অন্যদিকে ‘জেড’ গ্রুপের শেয়ার, স্মল পেইড-আপ ক্যাপিটাল শেয়ার, নন-পারফরম্যান্স শেয়ারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ম্যানিপুলেশন করে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ম্যানিপুলেট করে সহজে বাড়িয়ে নেয়া যায়। এসব কোম্পানির লেনদেনের ক্ষেত্রে বিএসইসি এবং এক্সচেঞ্জকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।

বাজারের গতিশীলতা ধরে রাখতে হলে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংকে যারা স্পন্সর/ডিরেক্টর আছেন তাদের বুঝতে হবে। তারা ব্যাংকের মালিক নয় তারা শেয়ারহোল্ডার। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে এসব স্পন্সর/ডিরেক্টরদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংক ডিপোজিটরদের টাকায় চলে, সেসব পরিচালকের টাকায় চলে না। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, ব্যাংকের উদ্যোক্তা, পরিচালকরা ২০০৯/২০১০ সালে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে, ১০ টাকার শেয়ার মার্কেটে ১৭০ টাকা পর্যন্ত, বিক্রি করেছেন এবং হাজার হাজার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আজ সেসব শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকার নিচে। উদ্যোক্তা, পরিচালকরা বলেন, উনারা ব্যাংক ভালোভাবে পরিচালনা করছেন। যদি তা হয়, সেসব উদ্যোক্তা পরিচালকরা, যারা ১০ টাকার শেয়ার ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন, তারা এখন শেয়ার বাই-ব্যাক করছেন না কেন? কারণ তারা ভালো করে জানেন তারা ব্যাংকের টাকা লুটপাট করে ব্যাংকের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী পার্লামেন্টে বলেছিলেন, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে নামে/ বেনামে ভুল তথ্য দিয়ে/ ভুয়া জমি দেখিয়ে/ জাল দলিলপত্র দাখিল করে সরকারি খাস জমি বন্ধক রেখে/ ডোবা/খাল জলাশয় দেখিয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। ব্যাসেল-৩ পরিপালন করার অজুুহাতে বছরের পর বছর শুধুমাত্র বোনাস শেয়ার ইস্যু করে নিজেদের শেয়ার সংখ্যা বাড়িয়েছে অন্যদিকে বেশি দামে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারী প্রচ-ভাবে লোকসানের কবলে পড়েছেন। অন্যদিকে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া যেসব কোম্পানির মৌলভিত্তি ভালো এবং ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি বাজারে তাদের শেয়ারের দামও বিগত বছরগুলোতে অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু ভালো ফান্ডামেন্টাল শেয়ার ধরে রাখতে পারলে কোন অবস্থাতেই বিনিয়োগকারীকে লাভ দিতে না পারলেও লোকসান গুণতে হয় না, ইতিহাসের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়।

ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। যেকোন অবস্থায় ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দক্ষ ও সৎ ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের বুঝাতে হবে এটা তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান না। ব্যাংক ডিপোজিটরদের ডিপোজিটের টাকায় চলে। এর মালিক সব শেয়ারহোল্ডার। এখনও অনেক ব্যাংকের তথাকথিত স্পন্সর/ ডিরেক্টররা বাংকগুলোকে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করেন, তারা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। অনেক সময় তারা নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতামতেরও তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। আমার জানামতে, অনেক ব্যাংক তাদের বোর্ড মিটিং/ কমিটি মিটিংয়ের প্রসেডিং মিনিট আকারে রাখেন না, রেকর্ড করে রাখেন। রেকর্ড যেকোন সময় ধ্বংস করা সম্ভব। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসি কমিশন/ বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ উদ্যোগ নিবেন যাতে ব্যাংকগুলো তাদের প্রতিটি মিটিংয়ের প্রসেডিং মিনিট আকারে রাখেন এবং তা সংরক্ষণ করেন। ব্যাংকের বর্তমান কার্য-পরিচালনাপ্রণালী, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, স্বতন্ত্র পরিচালকদের ব্যাংকে কোনট্রিবিউশান সব কিছুর দলিল হলো বিভিন্ন মিটিংয়ের মিনিটস, যা আর্থিক খাতের সুশাসন আনয়নে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে বলে আমি মনে করি।

বিএসইসি কমিশন, সেন্ট্রাল ব্যাংক একসঙ্গে কাজ করে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ওনেস্ট, প্রফেসনাল ডেডিকেটেড ক্ষুদ্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। যেসব বিনিয়োগকারী এবং প্রতিষ্ঠানের ২ শতাংশ শেয়ার আছে তাদের পরিচালনা পর্ষদে সহজে ইনক্লুড করতে হবে। স্পন্সর, ডিরেক্টরদের কোন কোন ওজর-আপত্তি চলবে না। কারণ আমরা বাস্তবে দেখি স্পন্সর ডিরেক্টররা তাদের পছন্দমতো পরিচালক নিয়োগ দিতে চান, এটা বন্ধ করতে হবে। যাদের ২ শতাংশ শেয়ার আছে তাদের অটোমেটিক্যালি বোর্ডে ইনক্লুড হওয়ার পথ করে দিতে হবে। এতে যদি বোর্ডের আকার বাড়ে তাতে কোন অসুবিধার কারণ নেই। বরং এতে যারা বাজার থেকে শেয়ার কিনে পরিচালক হবেন তাদের দায়িত্ব, কমিটমেন্ট টু দি ইনভেস্টর আরও বেশি থাকবে। এতে স্বতন্ত্র পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের যৌথ পরিচালনায় ব্যাংকগুলো দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। ব্যাংকের লুটপাট বন্ধ হবে। ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা দূর হবে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়বে।

জনগণের টাকা লোন করে যাতে কেউ পার পেয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ নজরদারি বাড়িয়ে সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি আগে অনেকবার বলেছি এখনও বলছি, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের লাইফস্টাইলে হাত দিতে হবে। দেওলিয়া আইনের সংশোধন করে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। কাউকে জেল দিয়ে কোন লাভ হবে না। লাইফস্টাইলে হাত দিলে দেখবেন অনেক টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছে। কেউ আর নিজেকে দেওলিয়া ঘোষণা করবে না। দেওলিয়া ঘোষণার কারণে তার বাড়ি গাড়ি কিছুই থাকেবে না, ছেলেমেয়েদের দামি স্কুলে পড়াতে পারবে না। প্লেনে চড়তে পারবে না। বিদেশে যেতে পারবে না। বড় বড় সরকারি-বেসরকারি পার্টিতে জয়েন্ট করতে পারবে না। এসব ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন দেশ, চায়না, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে ৭০%-৯০% পর্যন্ত টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সফল অর্থমন্ত্রীকে এই ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

বিএসইসি কমিশন বাজারে স্বচ্ছতা/জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছেন। আপনার দায়িত্ব আপনার কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের একটি অংশ পুঁজিবাজারে দক্ষতার সঙ্গে বিনিয়োগ করুন। আশা করি আপনি লাভবান হবেন ইনশাআল্লাহ। শুধু বুঝবেন, টাকাটা যেহেতু আপনার দিনের শেষে লাভও আপনার, লোকসানও আপনার। এখানে কাউকে বিশেষ করে সরকারকে অথবা বিএসইসি কমিশনকে আপনার ব্লেইম করার কোন সুযোগ নেই।

আমি দৃঢ়ভাবে আমার বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় বুঝি সরকার/ মাননীয় অর্থমন্ত্রী/ বাংলাদেশ ব্যাংক/ বিএসইসি/ এক্সচেঞ্জসহ সবাই পুঁজিবাজারের জন্য সঠিক কাজটি করে যাচ্ছেন। এইভাবে বিএসইসি কমিশনের সব সময়ে কঠোর অবস্থানের কারণে বাজার ইনশাআল্লাহ অনেক দূর যাবে। হাজারো বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ আসবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো উন্নয়নে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আগামী তিন বছরে দেশের পুঁজিবাজারে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে, ইনশাআল্লাহ। বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সফল অর্থমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ হবে। সরকার বড় বড় ইনফ্রাস্টাকচারে যে বিনিয়োগ করবে তা কোম্পানিতে রূপান্তর করে, পুঁজিবাজারে তার শেয়ার ছেড়ে জনগণ থেকে টাকা নিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারবে।

জনগণের সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে ইনশাআল্লাহ। যদি পুঁজিবাজার ভালো থাকে সবচেয়ে লাভবান হবে সরকার। উন্নয়নের জন্য টাকার একটি বড় অংশ আসবে জনগণের সঞ্চয় থেকে। তাতে জনগণের সঞ্চয়ের টাকা আনপ্রডাক্টতিভ খাত যেমন জমি জমায় বিনিয়োগ কম হবে অথবা টাকা বিদেশে পাচার হবে না। এটাই হবে সরকারের বড় সাফল্য।

মো. রকিবুর রহমান

সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড

সোমবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২১ , ৪ মাঘ ১৪২৭, ৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আর্থিক খাতের সুশাসনেই নিশ্চিত হবে পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন

image

পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা ধরে রাখতে এবং বাজারকে স্ট্যাবল এবং ভাইব্র্যান্ট রাখতে হলে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আমরা দেশব্যাপী সকলে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও গতিশীল পুঁজিবাজার দেখতে চাই। যে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে ভালো শিল্প উদ্যোক্তারা বাজার থেকে টাকা তুলবে এবং তা শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ, আবাসন, নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার কররে। দেশের শিল্প উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখবে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি কোন চাপ থাকবে না দীর্ঘমেয়াদী শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য।

বর্তমান বাজারের গতি প্রকৃতি দেখে আমরা বলতে পারি, পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরে এসেছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। তারই প্রতিফলন আমরা এক্সচেঞ্জের টার্নওভারে দেখতে পাই। আমরা আগামী তিন বছরের মধ্যে ডেইলি টার্নওভার ৫০০০ কোটি টাকায় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, ইনশআল্লাহ। শুধু ইক্যুইটি মার্কেটের ওপর নির্ভর না হয়ে বিভিন্ন নতুন নতুন প্রডাক্ট বাজারে নিয়ে আসার জন্য বিএসইসি এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি (সিসিপি) চালু হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের ডে সেটেলমেন্টসহ নতুন নতুন প্রডাক্টস, সুকুক ডেরিভেটিভস/ ফিউচার চালু করার প্রচেষ্টা জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এসএমই প্লাটফর্ম ডিএসই তৈরি করে ফেলেছে। সরকারি ভালো ভালো শেয়ার বাজারে এনে বাজারের গভীরতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। দেশীয় ভালো ভালো প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার এবং মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার বাজারে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সফল, সৎ ও দক্ষ উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগ্রহ বাড়ছে। বন্ড মার্কেট স্ট্রং হচ্ছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে জিডিপিতে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের অবদান ৫০ শতাংশের লক্ষমাত্রা নিয়ে বিএসইসি এবং এক্সচেঞ্জ এগিয়ে যাচ্ছে। বাজারে বিনিয়োগকারীদের পার্টিসিপিসান বাড়ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসছে।

শেয়ারের দাম উঠানামা করলে ইনডেক্স বাড়ে এবং কমে। সেটাই স্বাভাবিক। বাজারে ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি থাকলে বাজার স্বাভাবিক থাকে। ফ্রি ফ্লট শেয়ার যে কোম্পানির বেশি থাকে সে কোম্পানির শেয়ার ম্যানিপুলেট করে বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। কারণ যেসব কোম্পানির মৌল ভিত্তি ভালো এবং ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি তারা নিজস্ব স্ট্রেংথতে বাড়ে। এসব শেয়ারের ইপিএস, পিই রেশিও, রিজার্ভ, বিজনেস ইক্সপেনশান. কোম্পানির মূলধন, দক্ষ পরিকল্পনা ও পরিচালনার কারণে ম্যাচিউড বিনিয়োগকারী বেশি বেশি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী থাকে। অন্যদিকে ‘জেড’ গ্রুপের শেয়ার, স্মল পেইড-আপ ক্যাপিটাল শেয়ার, নন-পারফরম্যান্স শেয়ারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ম্যানিপুলেশন করে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ম্যানিপুলেট করে সহজে বাড়িয়ে নেয়া যায়। এসব কোম্পানির লেনদেনের ক্ষেত্রে বিএসইসি এবং এক্সচেঞ্জকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।

বাজারের গতিশীলতা ধরে রাখতে হলে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংকে যারা স্পন্সর/ডিরেক্টর আছেন তাদের বুঝতে হবে। তারা ব্যাংকের মালিক নয় তারা শেয়ারহোল্ডার। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে এসব স্পন্সর/ডিরেক্টরদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংক ডিপোজিটরদের টাকায় চলে, সেসব পরিচালকের টাকায় চলে না। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, ব্যাংকের উদ্যোক্তা, পরিচালকরা ২০০৯/২০১০ সালে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে, ১০ টাকার শেয়ার মার্কেটে ১৭০ টাকা পর্যন্ত, বিক্রি করেছেন এবং হাজার হাজার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আজ সেসব শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকার নিচে। উদ্যোক্তা, পরিচালকরা বলেন, উনারা ব্যাংক ভালোভাবে পরিচালনা করছেন। যদি তা হয়, সেসব উদ্যোক্তা পরিচালকরা, যারা ১০ টাকার শেয়ার ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন, তারা এখন শেয়ার বাই-ব্যাক করছেন না কেন? কারণ তারা ভালো করে জানেন তারা ব্যাংকের টাকা লুটপাট করে ব্যাংকের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী পার্লামেন্টে বলেছিলেন, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে নামে/ বেনামে ভুল তথ্য দিয়ে/ ভুয়া জমি দেখিয়ে/ জাল দলিলপত্র দাখিল করে সরকারি খাস জমি বন্ধক রেখে/ ডোবা/খাল জলাশয় দেখিয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। ব্যাসেল-৩ পরিপালন করার অজুুহাতে বছরের পর বছর শুধুমাত্র বোনাস শেয়ার ইস্যু করে নিজেদের শেয়ার সংখ্যা বাড়িয়েছে অন্যদিকে বেশি দামে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারী প্রচ-ভাবে লোকসানের কবলে পড়েছেন। অন্যদিকে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া যেসব কোম্পানির মৌলভিত্তি ভালো এবং ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি বাজারে তাদের শেয়ারের দামও বিগত বছরগুলোতে অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু ভালো ফান্ডামেন্টাল শেয়ার ধরে রাখতে পারলে কোন অবস্থাতেই বিনিয়োগকারীকে লাভ দিতে না পারলেও লোকসান গুণতে হয় না, ইতিহাসের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়।

ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। যেকোন অবস্থায় ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দক্ষ ও সৎ ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের বুঝাতে হবে এটা তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান না। ব্যাংক ডিপোজিটরদের ডিপোজিটের টাকায় চলে। এর মালিক সব শেয়ারহোল্ডার। এখনও অনেক ব্যাংকের তথাকথিত স্পন্সর/ ডিরেক্টররা বাংকগুলোকে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করেন, তারা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। অনেক সময় তারা নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতামতেরও তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। আমার জানামতে, অনেক ব্যাংক তাদের বোর্ড মিটিং/ কমিটি মিটিংয়ের প্রসেডিং মিনিট আকারে রাখেন না, রেকর্ড করে রাখেন। রেকর্ড যেকোন সময় ধ্বংস করা সম্ভব। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসি কমিশন/ বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ উদ্যোগ নিবেন যাতে ব্যাংকগুলো তাদের প্রতিটি মিটিংয়ের প্রসেডিং মিনিট আকারে রাখেন এবং তা সংরক্ষণ করেন। ব্যাংকের বর্তমান কার্য-পরিচালনাপ্রণালী, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, স্বতন্ত্র পরিচালকদের ব্যাংকে কোনট্রিবিউশান সব কিছুর দলিল হলো বিভিন্ন মিটিংয়ের মিনিটস, যা আর্থিক খাতের সুশাসন আনয়নে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে বলে আমি মনে করি।

বিএসইসি কমিশন, সেন্ট্রাল ব্যাংক একসঙ্গে কাজ করে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ওনেস্ট, প্রফেসনাল ডেডিকেটেড ক্ষুদ্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। যেসব বিনিয়োগকারী এবং প্রতিষ্ঠানের ২ শতাংশ শেয়ার আছে তাদের পরিচালনা পর্ষদে সহজে ইনক্লুড করতে হবে। স্পন্সর, ডিরেক্টরদের কোন কোন ওজর-আপত্তি চলবে না। কারণ আমরা বাস্তবে দেখি স্পন্সর ডিরেক্টররা তাদের পছন্দমতো পরিচালক নিয়োগ দিতে চান, এটা বন্ধ করতে হবে। যাদের ২ শতাংশ শেয়ার আছে তাদের অটোমেটিক্যালি বোর্ডে ইনক্লুড হওয়ার পথ করে দিতে হবে। এতে যদি বোর্ডের আকার বাড়ে তাতে কোন অসুবিধার কারণ নেই। বরং এতে যারা বাজার থেকে শেয়ার কিনে পরিচালক হবেন তাদের দায়িত্ব, কমিটমেন্ট টু দি ইনভেস্টর আরও বেশি থাকবে। এতে স্বতন্ত্র পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের যৌথ পরিচালনায় ব্যাংকগুলো দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। ব্যাংকের লুটপাট বন্ধ হবে। ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা দূর হবে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়বে।

জনগণের টাকা লোন করে যাতে কেউ পার পেয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ নজরদারি বাড়িয়ে সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি আগে অনেকবার বলেছি এখনও বলছি, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের লাইফস্টাইলে হাত দিতে হবে। দেওলিয়া আইনের সংশোধন করে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। কাউকে জেল দিয়ে কোন লাভ হবে না। লাইফস্টাইলে হাত দিলে দেখবেন অনেক টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছে। কেউ আর নিজেকে দেওলিয়া ঘোষণা করবে না। দেওলিয়া ঘোষণার কারণে তার বাড়ি গাড়ি কিছুই থাকেবে না, ছেলেমেয়েদের দামি স্কুলে পড়াতে পারবে না। প্লেনে চড়তে পারবে না। বিদেশে যেতে পারবে না। বড় বড় সরকারি-বেসরকারি পার্টিতে জয়েন্ট করতে পারবে না। এসব ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন দেশ, চায়না, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে ৭০%-৯০% পর্যন্ত টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সফল অর্থমন্ত্রীকে এই ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

বিএসইসি কমিশন বাজারে স্বচ্ছতা/জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছেন। আপনার দায়িত্ব আপনার কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের একটি অংশ পুঁজিবাজারে দক্ষতার সঙ্গে বিনিয়োগ করুন। আশা করি আপনি লাভবান হবেন ইনশাআল্লাহ। শুধু বুঝবেন, টাকাটা যেহেতু আপনার দিনের শেষে লাভও আপনার, লোকসানও আপনার। এখানে কাউকে বিশেষ করে সরকারকে অথবা বিএসইসি কমিশনকে আপনার ব্লেইম করার কোন সুযোগ নেই।

আমি দৃঢ়ভাবে আমার বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় বুঝি সরকার/ মাননীয় অর্থমন্ত্রী/ বাংলাদেশ ব্যাংক/ বিএসইসি/ এক্সচেঞ্জসহ সবাই পুঁজিবাজারের জন্য সঠিক কাজটি করে যাচ্ছেন। এইভাবে বিএসইসি কমিশনের সব সময়ে কঠোর অবস্থানের কারণে বাজার ইনশাআল্লাহ অনেক দূর যাবে। হাজারো বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ আসবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো উন্নয়নে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আগামী তিন বছরে দেশের পুঁজিবাজারে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে, ইনশাআল্লাহ। বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সফল অর্থমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ হবে। সরকার বড় বড় ইনফ্রাস্টাকচারে যে বিনিয়োগ করবে তা কোম্পানিতে রূপান্তর করে, পুঁজিবাজারে তার শেয়ার ছেড়ে জনগণ থেকে টাকা নিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারবে।

জনগণের সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে ইনশাআল্লাহ। যদি পুঁজিবাজার ভালো থাকে সবচেয়ে লাভবান হবে সরকার। উন্নয়নের জন্য টাকার একটি বড় অংশ আসবে জনগণের সঞ্চয় থেকে। তাতে জনগণের সঞ্চয়ের টাকা আনপ্রডাক্টতিভ খাত যেমন জমি জমায় বিনিয়োগ কম হবে অথবা টাকা বিদেশে পাচার হবে না। এটাই হবে সরকারের বড় সাফল্য।

মো. রকিবুর রহমান

সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড