সমবায় সমিতির নামে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ

তাদের কেউ বাসাবাড়িতে কাজ করে, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আবার কেউ কর্মহীন অসুস্থ ব্যক্তি। এলাকার দুই ইউপি মেম্বারের দুই ভাতিজা সবাইকে ব্যাংকের মতোই লভ্যাংশ দেয়ার কথা জানিয়ে তাদের সমবায় সমিতিতে এফডিআর এবং দৈনিক সঞ্চয়ের প্রস্তাব দেয়। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকাবাসী সরল বিশ্বাসে সাইফুল ইসলাম এবং শাহ আজিজুর রহমান শাকিলের সমিতি রূপসী বাংলা শ্রমজীবী সমিতিতে এফডিআর এবং দৈনিক সঞ্চয়ও শুরু করে। এক দুই করে কয়েক শত গ্রামবাসী ওই সমিতিতে টাকা বিনিয়োগ করে লভ্যাংশ তো দূরের কথা মূল চালান খুইয়েছেন। টাকা চাইতে গিয়ে মারধরেরও শিকার হয়েছে। প্রতারণার অভিযোগে করা মামলায় রূপগঞ্জের বদি ও খোকন মেম্বারের ভাতিজা সাইফুল ও শাকিলকে গ্রেপ্তারের পর খবর পেয়ে সিআইডির কার্যালয়ে এসে সঞ্চয় হারানোর কথা এভাবেই তুলে ধরে ভুক্তভোগীরা।

সিআইডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, রূপগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলার সূত্র ধরে মো. সাইফুল ইসলাম এবং মো. শাহ আজিজুর রহমান শাকিলকে আটক করা হয়েছে। তারা রূপসি বাংলা শ্রমজীবী সমমায় সমিতি খুলে অবৈধভাবে মানুষকে ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় লভ্যাংশ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এফডিআর এবং দৈনিক সঞ্চয় করতে বলে। সমিতি খোলার জন্য অনুমোদন, ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম চালানোর কোন অনুমোদনও ছিল না। ২০১৩ সাল থেকে সমবায় সমিতিতে মানুষ এফডিআর এবং দৈনিক সঞ্চয় করে আসছিল। ২০১৯ সালে সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ওই সমিতিতে অর্থ বিনিয়োগকারী শত শত গ্রাহক বিপাকে পড়েন।

ফল ব্যবসায়ী রুস্তম জানান, তিনি ওই সমিতিতে ৪ লাখ টাকা এফডিআর করেছেন। তাকে বলা হয়েছে প্রতিমাসে ১ লাখ টাকার বিপরীতে দেড় হাজার টাকা লভ্যাংশ দেয়া হবে। সে হিসাবে ৪ লাখ টাকায় প্রতিমাসে ৬ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ পাওয়ার কথা। প্রতিমাসে লভ্যাংশ দেয়ার কথা বলা হলেও এফডিআর করার পর তাদের বলা হয়েছে একসঙ্গে লভ্যাংশসহ মূল টাকা ফেরত দেয়া হবে। ২০১৯ সালে সমিতিতে তালা মেরে সভাপতি সাইফুল এবং সাধারণ সম্পাদক শকিল আত্মগোপন করে। তারা গ্রাহকের টাকা দিয়ে নিজেরা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। টাকা ফেরত চাওয়ায় তাদের হুমকি দেয়া হতো। অনেককে মারধরও করা হয়েছে। স্থানীয় যুবক সোহেল জানায়, তার বাবা কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি চিকিৎসার জন্য ৩ লাখ টাকা জমিয়েছেন। সমিতি খোলার পর সোহেল ও শাকিল তার বাবা শুরত আলীকে এ বলে প্রভোলন দেখান, কাকা আপনারা ব্যাংকে এফডিআর করলে যে লভ্যাংশ পাবেন তার চেয়ে বেশি লভ্যাংশ এখান থেকে দেয়া হবে। এখানে টাকা রাখলে আপনার চিকিৎসাও হবে। তাদের এমন কথায় তার বাবা শুরত আলী ১ বছরের জন্য ৩ লাখ টাকা এফডিআর করে। কিন্তু লভ্যাংশ তো দূরের কথা মূল টাকা আত্মসাত করে তারা সমিতির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

নূরনাহার নামের এক গৃহবধূ জানান, বিয়ের পর দুই সন্তানসহ তাকে ফেলে চলে যায় তার স্বামী। তিনি জীবিকার তাগিদে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে আয়ার কাজ নেন। যে টাকা পেতেন সেই টাকায় কোনমতে দুই ছেলেকে নিয়ে জীবন চলছিল। দুই সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ৩ লাখ টাকা এফডিআর করেন। লভ্যাংশ এবং মূল টাকা না দিয়ে সমিতি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি সাইফুল ও শাকিলের বাসায় যান। সেখানে তাদের বেধড়ক মারপিট করে সাইফুল ও শাকিলের স্বজনরা। একই কথা জানালেন গৃহপরিচারিকা পারভীন। মানুষের বাসা বাড়িতে কাজ করে দৈনিক ৫শ টাকা করে সঞ্চয় করতেন। পুরো টাকা খুইয়ে তিনি এখন পথে বসেছেন।

ক্ষতিগ্রস্তরা জানায়, সাইফুল ও শাকিলের চাচা স্থানীয় ইউপি মেম্বার। সাইফুলের চাচাকে বদি মেম্বার হিসেবে চিনে এলাকার লোকজন। আর শাকিলের চাচাকে খোকন মেম্বার হিসেবে চিনে। তারা দুজনেই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। ইউপি মেম্বারের ভাতিজা হওয়ায় তাদের প্রভাব আরও বেশি ছিল। সমিতি যখন করেছে তখন মানুষের সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলেছে। এলাকার লোকজন মনে করেছে এরা তো স্থানীয় মেম্বারের ভাতিজা। বাড়িঘরও সবাই চিনে। এরা তো প্রতারণা করবে না। সেই সরল বিশ্বাসে সবাই তাদের সমিতিতে টাকা রেখেছে। যারা টাকা জমা করেছে তাদের অধিকাংশই এলাকার শ্রমজীবী মানুষ। কেউ গার্মেন্টসে চাকরি করে, কেউ বাসা বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করে, আবার কেউ রিকশাচালক অথবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নারী-পুরুষ মিলিয়ে সমিতিতে কয়েক হাজার গ্রাহক হবে। এলাকাবাসীর কাছ থেকে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে এই সমিতি।

বুধবার, ২০ জানুয়ারী ২০২১ , ৬ মাঘ ১৪২৭, ৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

রূপগঞ্জে

সমবায় সমিতির নামে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

তাদের কেউ বাসাবাড়িতে কাজ করে, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আবার কেউ কর্মহীন অসুস্থ ব্যক্তি। এলাকার দুই ইউপি মেম্বারের দুই ভাতিজা সবাইকে ব্যাংকের মতোই লভ্যাংশ দেয়ার কথা জানিয়ে তাদের সমবায় সমিতিতে এফডিআর এবং দৈনিক সঞ্চয়ের প্রস্তাব দেয়। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকাবাসী সরল বিশ্বাসে সাইফুল ইসলাম এবং শাহ আজিজুর রহমান শাকিলের সমিতি রূপসী বাংলা শ্রমজীবী সমিতিতে এফডিআর এবং দৈনিক সঞ্চয়ও শুরু করে। এক দুই করে কয়েক শত গ্রামবাসী ওই সমিতিতে টাকা বিনিয়োগ করে লভ্যাংশ তো দূরের কথা মূল চালান খুইয়েছেন। টাকা চাইতে গিয়ে মারধরেরও শিকার হয়েছে। প্রতারণার অভিযোগে করা মামলায় রূপগঞ্জের বদি ও খোকন মেম্বারের ভাতিজা সাইফুল ও শাকিলকে গ্রেপ্তারের পর খবর পেয়ে সিআইডির কার্যালয়ে এসে সঞ্চয় হারানোর কথা এভাবেই তুলে ধরে ভুক্তভোগীরা।

সিআইডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, রূপগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলার সূত্র ধরে মো. সাইফুল ইসলাম এবং মো. শাহ আজিজুর রহমান শাকিলকে আটক করা হয়েছে। তারা রূপসি বাংলা শ্রমজীবী সমমায় সমিতি খুলে অবৈধভাবে মানুষকে ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় লভ্যাংশ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এফডিআর এবং দৈনিক সঞ্চয় করতে বলে। সমিতি খোলার জন্য অনুমোদন, ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম চালানোর কোন অনুমোদনও ছিল না। ২০১৩ সাল থেকে সমবায় সমিতিতে মানুষ এফডিআর এবং দৈনিক সঞ্চয় করে আসছিল। ২০১৯ সালে সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ওই সমিতিতে অর্থ বিনিয়োগকারী শত শত গ্রাহক বিপাকে পড়েন।

ফল ব্যবসায়ী রুস্তম জানান, তিনি ওই সমিতিতে ৪ লাখ টাকা এফডিআর করেছেন। তাকে বলা হয়েছে প্রতিমাসে ১ লাখ টাকার বিপরীতে দেড় হাজার টাকা লভ্যাংশ দেয়া হবে। সে হিসাবে ৪ লাখ টাকায় প্রতিমাসে ৬ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ পাওয়ার কথা। প্রতিমাসে লভ্যাংশ দেয়ার কথা বলা হলেও এফডিআর করার পর তাদের বলা হয়েছে একসঙ্গে লভ্যাংশসহ মূল টাকা ফেরত দেয়া হবে। ২০১৯ সালে সমিতিতে তালা মেরে সভাপতি সাইফুল এবং সাধারণ সম্পাদক শকিল আত্মগোপন করে। তারা গ্রাহকের টাকা দিয়ে নিজেরা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। টাকা ফেরত চাওয়ায় তাদের হুমকি দেয়া হতো। অনেককে মারধরও করা হয়েছে। স্থানীয় যুবক সোহেল জানায়, তার বাবা কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি চিকিৎসার জন্য ৩ লাখ টাকা জমিয়েছেন। সমিতি খোলার পর সোহেল ও শাকিল তার বাবা শুরত আলীকে এ বলে প্রভোলন দেখান, কাকা আপনারা ব্যাংকে এফডিআর করলে যে লভ্যাংশ পাবেন তার চেয়ে বেশি লভ্যাংশ এখান থেকে দেয়া হবে। এখানে টাকা রাখলে আপনার চিকিৎসাও হবে। তাদের এমন কথায় তার বাবা শুরত আলী ১ বছরের জন্য ৩ লাখ টাকা এফডিআর করে। কিন্তু লভ্যাংশ তো দূরের কথা মূল টাকা আত্মসাত করে তারা সমিতির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

নূরনাহার নামের এক গৃহবধূ জানান, বিয়ের পর দুই সন্তানসহ তাকে ফেলে চলে যায় তার স্বামী। তিনি জীবিকার তাগিদে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে আয়ার কাজ নেন। যে টাকা পেতেন সেই টাকায় কোনমতে দুই ছেলেকে নিয়ে জীবন চলছিল। দুই সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ৩ লাখ টাকা এফডিআর করেন। লভ্যাংশ এবং মূল টাকা না দিয়ে সমিতি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি সাইফুল ও শাকিলের বাসায় যান। সেখানে তাদের বেধড়ক মারপিট করে সাইফুল ও শাকিলের স্বজনরা। একই কথা জানালেন গৃহপরিচারিকা পারভীন। মানুষের বাসা বাড়িতে কাজ করে দৈনিক ৫শ টাকা করে সঞ্চয় করতেন। পুরো টাকা খুইয়ে তিনি এখন পথে বসেছেন।

ক্ষতিগ্রস্তরা জানায়, সাইফুল ও শাকিলের চাচা স্থানীয় ইউপি মেম্বার। সাইফুলের চাচাকে বদি মেম্বার হিসেবে চিনে এলাকার লোকজন। আর শাকিলের চাচাকে খোকন মেম্বার হিসেবে চিনে। তারা দুজনেই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। ইউপি মেম্বারের ভাতিজা হওয়ায় তাদের প্রভাব আরও বেশি ছিল। সমিতি যখন করেছে তখন মানুষের সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলেছে। এলাকার লোকজন মনে করেছে এরা তো স্থানীয় মেম্বারের ভাতিজা। বাড়িঘরও সবাই চিনে। এরা তো প্রতারণা করবে না। সেই সরল বিশ্বাসে সবাই তাদের সমিতিতে টাকা রেখেছে। যারা টাকা জমা করেছে তাদের অধিকাংশই এলাকার শ্রমজীবী মানুষ। কেউ গার্মেন্টসে চাকরি করে, কেউ বাসা বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করে, আবার কেউ রিকশাচালক অথবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নারী-পুরুষ মিলিয়ে সমিতিতে কয়েক হাজার গ্রাহক হবে। এলাকাবাসীর কাছ থেকে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে এই সমিতি।