শেকড়কে বাদ দিয়ে কিছু ভাবতে পারি না

সমর মজুমদার

সমর মজুমদার বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে এক স্বতন্ত্র নাম। মৃত্তিকালগ্ন জীবন ও আবহমান বাংলার নিসর্গ-প্রকৃতি তাঁর চিত্রের প্রধান উপজীব্য। একজন খ্যাতিমান প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সমধিক পরিচিত। এ পর্যন্ত পাঁচ সহস্রাধিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিনি। তাঁর শিল্পকর্মকে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য রীতির মিশ্রণ বলা হয়, যেখানে ঐতিহ্যের অনুসন্ধানের পাশাপাশি আধুনিকতার সংযোগ ঘটেছে। ইতোমধ্যে তিনি অনেকগুলো একক প্রদর্শনী করেছেন। এখনো শিল্পাঙ্গনে তাঁর সরব উপস্থিতি লক্ষ্যযোগ্য। সম্প্রতি তাঁর সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে এই কথোপকথনে অংশ নেন ওবায়েদ আকাশ। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেন খন্দকার মুনতাসীর মামুন।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার কাজের ধারাটি আমাদের প্রকৃতি, মাটি এবং সবুজের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। জানতে চাই, এই ধারার প্রতি আপনার আগ্রহের সূত্রপাত কি ব্যাপক পঠন-পাঠনের পর নাকি শুরু থেকেই কাজের মধ্য দিয়ে এর ভেতরে ঢুকে পড়া।

সমর মজুমদার : এটা আমার ভালোবাসার ধারা। এই ভালোবাসা আমার দেশের প্রতি, আমার মাটির প্রতি। আমি এর বাইরে যেতে চাই না। ছোটবেলায় আমি বড় হয়েছি আধা গ্রাম আধা শহর- এমন একটি জায়গায়। খেলাধুলা করেছি রাখালদের সঙ্গে। শৈশবে আমার বাড়ির আশেপাশে কোন গাছে কেমন আম ধরত, কোথায় বরই গাছ, কোথায় পেয়ারা গাছ, কোথায় কী পাওয়া যায়, কোন গাছে কোন পাখি বাসা বাঁধে আমি সেগুলো খুঁজে বেড়াতাম। আমি এমন একটা প্রকৃতি বান্ধবময় গ্রামে বড় হয়েছি। এমন স্থানে বড় হওয়ার কারণে আমার ভেতরে একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। আমার গ্রামের রঙ, আমার গ্রামের মানুষের রঙ আমাকে ডাকে। এরপরে তো আমি ওদেরকে ছেড়ে যেতে পারি না।

অনেক ছোটবেলায় আমার একটা মজার খেলা ছিল। খেলতে খেলতে আমি গরুর দড়িকে ছুড়ে মারতাম। গরুর দড়ি নানা ফর্মে ঘাসের মধ্যে পড়ত। সেই ফর্মগুলো আমার কাছে নানা আকৃতিতে ধরা দিতো। ফর্মগুলো থেকে আমি শিল্প খুঁজে বের করতাম। কখনও সেটা গরুর মতো হতো, কখনও মেঘের মতো হতো, কখনও গাছের মতো হতো, কখনও নদীর মতো হতো, কখনো শুধুই সুন্দর ফর্ম। আমি মুগ্ধ হয়ে এই ফর্মগুলো দেখতাম। এবং একই রকম ফর্ম আবার বানানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু কখনও সেই পূর্বের ফর্মে ফিরে যেতে পারতাম না। সেই দুঃখ আমাকে একই কাজ করতে বার বার প্রলুব্ধ করতো।

আরেকটা ঘটনা বলি। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন আমার শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডে একটা বই রেখে চারপাশে চক ঘুরিয়ে বই এঁকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এমনভাবে বই আঁকতে। আমি আঁকতে গিয়ে বুঝলাম, দু’টি দৈর্ঘ্য আর দু’টি প্রস্থ সমান হলেই বই হয় না। এভাবেই চারুকলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুরু হলো। আমি দেখলাম যে, আমার গ্রামের মানুষকে, প্রকৃতিকে না আঁকলে সেটা পূর্ণাঙ্গ ছবি হচ্ছে না। আমাকে তৃপ্ত করতে পারছে না। আমার একটা একাকিত্বের, ভাবনার জগৎ ছিলো।

ও. আ. : তার মানে গ্রামের প্রতি মুগ্ধতা, প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা এবং ছেলেবেলার নস্টালজিয়া থেকেই আপনি ছবি আঁকেন।

স. ম. : ছেলেবেলায় আমার যে গ্রামকে আমি দেখেছি এখনও চোখ বন্ধ করে সেই গ্রামকেই দেখি। অর্থাৎ সেই সাঁকো, সেই চর, সেই নদী-বিল, গাছের কোটরে পাখির বাসা- সেটাই আমার গ্রাম। সেই গ্রাম মনের মধ্যে একটুও বদলায়নি। বর্তমান সময়ে হয়ত সেই গ্রামে আর বাঁশের সাঁকো খুঁজে পাওয়া যাবে না, মাটির ঘর পাওয়া যাবে না, এমনকি নদীর কিনারগুলোও হয়ত পাকা ব্লকে বাঁধানো হয়ে গেছে। আমার মন পড়ে আছে শৈশবের সেই নদীতীরে। কাজেই আমি কোনো ইজম নিয়ে ভাবি না। আমি কী ইজমে আঁকলাম, কী ইজম হলো, কোথায় কোন আধুনিক স্কেচ হলো- সেসব আমাকে ভাবায় না। আমি আমার তৃপ্তি মতো ছবি আঁকি।

ও. আ. : আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে, এই ধারায় কাজ করে বিশ্বমানের শিল্পী হওয়া যাবে না? কখনও কি ধারা পরিবর্তনের ইচ্ছা জেগেছে? দেশ-বিদেশের অনেক প্রখ্যাত শিল্পীই তো গ্রামকে এড়িয়ে অনেক বড় শিল্পী হয়ে উঠেছেন। সেদিকে আপনার ঝোঁক ছিল না?

স. ম. : এসব করার প্রচুর শিল্পী আছে। যাদের ইচ্ছা আছে আধুনিক ধারায় কাজ করার, কিংবা উত্তর আধুনিক ধারায় কাজ করার- তারা তো সেটা করতেই পারে। তারা সেটা করুক। আমি যে কাজটি করে আনন্দ পাই, সেটাই করে যেতে চাই।

ও. আ. : এই ধারায় থাকতে গিয়ে আপনি কি কখনও সমালোচিত হয়েছেন বা উপেক্ষিত হয়েছেন?

স. ম. : আমার সামনে কেউ কখনও বলেনি যে, আরও মডার্ন ছবি আঁকো।

ও. আ. : তাহলে এটা আমরা বলতে পারি যে, যাদের শেকড় গ্রাম তারা সবাই আপনার কাজকে গ্রহণ করেছে।

স. ম. : আমি যাদের সঙ্গে মিশেছি, বড় হয়েছি তাদের প্রাণও তো একই জায়গায় বাঁধা। ওদের শেকড়ও তো গ্রাম। ওরা কীভাবে সমালোচনা করবে, উল্টো জড়িয়ে ধরে বলেছে, অনেকদিন পর সেই হারানো গ্রামকে ফিরিয়ে দিলে।

আমি মনে করি, আমাদের ছোটবেলার বিষয়গুলো, যেগুলো দেখে দেখে আমরা বড় হয়েছি, সেগুলো ফিরে পেলেই আমরা সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হই। আমি ছবি এঁকে আনন্দ পাই, আমার আশেপাশে আরও পাঁচ-দশজন যদি আমার ছবি দেখে আনন্দ পায় তবেই তো আমার সুখ। ছবি দেখে কেউ যদি ভাবে, আরে আমাদের শৈশব তো এমনই ছিল- তবেই তো সুখ। যেভাবে আমাদেরকে অপু-দুর্গা টানে, পথের পাঁচালি, অপরাজিত টানে, শৈশবের কবিতা-গল্পগুলো টানে, শরৎকাহিনী টানে, তেমন ব্যাপার তো ছবির ক্ষেত্রেও হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে, পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে...। আমিও সেই গানের মতোই বুঝতে পারি, যেখানে আমাদের শেকড়, যে গ্রামে আমাদের ভিত তৈরি হয়ে আছে, যে সিঁড়িতে পা দিয়ে দিয়ে আমরা এখানে এসেছি, সেই সিঁড়িগুলো ফেলনা নয়। সেই সিঁড়িগুলোকে স্মরণ করতে হবে আমাদের।

ও. আ. : আপনার দৃষ্টিতে শিল্পের দায়টা আসলে কোথায়?

স. ম. : ছবি আঁকার সময় নিজে তৃপ্তি পেলাম কিনা শিল্পী প্রথমত সেটাই ভাবে। এরপর ভাবে তার পরিবেশ এবং সমাজকে কিছু দিতে পারছে কিনা। এই দেয়ার বিষয়টি, নেহাত আনন্দ হতে পারে, সুস্থ সমাজ গঠনের দিকে একটা বাতাবরণ হতে পারে। তবে বিষয়টি যে চূড়ান্তভাবে শিক্ষণীয় কিছু হতেই হবে, তা নয়। অর্থাৎ কাউকে মানুষ করার জন্য, কাউকে কিছু শেখানোর জন্যই কেউ ছবি আঁকে না। শিল্পী তার ফর্মে ছবি আঁকে, সেই আঁকা থেকে কেউ যদি কোনো শিক্ষা নিতে পারে সেটা ভালো। তার চেয়ে আরও ভালো হলো, ঐ ছবি থেকে সে যদি তার শান্তিময় জীবনটাকে অন্বেষণ করতে পারে।

ও. আ. : একজন শিল্পী যখন কাজ করছে তখন তার মনের প্রতিবিম্ব শিল্পে প্রতিফলিত হচ্ছে। আপনি যখন একজন শিল্পী এবং আমি যখন দর্শক তখন আমার মনের প্রতিবিম্বটা কি শিল্পী হিসেবে আপনার শিল্পে আশা করেন? নাকি নিজের মনের প্রতিফলনটারই বাস্তবায়ন ঘটান?

স. ম. : আমি আমার নিজের প্রতিফলনটারই বাস্তবায়ন করি। কিন্তু দেখা যায়, সেখানে অন্যান্যরাও চলে আসে। অর্থাৎ আমরা একই ঘরে বাস করি বলে আশপাশের সবার সঙ্গেই আমার মনের ভাবনাগুলো মিলে যায়। আমাদের চিন্তাগুলো মিলে যায়, আমাদের স্মৃতিগুলো মিলে যায়। কাজেই যিনি দেখছেন তিনিও বলে ওঠেন, বাহ, এ তো আমার পরিচিত জায়গা। এ দৃশ্য আমি অনেকবার দেখেছি। দর্শকরা আনন্দিত হয়ে ওঠেন। তাদের মনে পুলক ছড়ায়।

ও. আ. : কোন সালে কিংবা কোন দশকে আপনি প্রথম ভাবতে পারলেন যে, আমি ভালো আঁকতে পেরেছি।

স. ম. : আমি এখনও মনে করি, আমি শুধু ছবি আঁকার চেষ্টা করছি। আমার খুব ইচ্ছা, এমন একটা ছবি আঁকার, যা দেখে সবাই বলবে এটা আমাদের চেতনার, আমাদের সত্তার, আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রতিবিম্ব। সেই ছবির ভাষা মানুষের অন্তরকে নাড়িয়ে দেবে। সেই ছবির ভাষা, সেই ছবির রঙ, সেই ছবির বর্ণবিন্যাস হবে সবার মনের প্রতিবিম্ব। আমি খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু এখনও আমি সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি।

ও. আ. : আপনি কি আপনার সব শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করেন?

স. ম. : যতটা পারি। আমি দীর্ঘসময় সরকারি চাকরি করেছি। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি চাকরিতে মনোনিবেশ করতে হয়। অর্থাৎ যতটা সরকার চায়, কর্মকর্তা-কর্মচারিকেও ততটাই মনোনিবেশ করতে হবে। কাজেই ওখানে আমি কোনো ছাড় পাইনি। আমার শিল্প সৃষ্টির সমস্ত বিষয় জমা হয়ে ছিল। সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় আমি শিল্পের শুধু খসড়া করেছি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেদিন আমি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করবো সেদিন থেকেই আমি পূর্ণাঙ্গ শিল্পী হব। এবং আর কোনো বাণিজ্যিক কাজ করবো না, কোনো ফরমায়েশি কাজ করবো না। এবং পুরোপুরিভাবে নিজের অনুভবকে প্রকাশ করার জন্য আমি শ্রম দেব। আমি এখন প্রতিনিয়ত চিন্তাশীল একজন শিল্পী। শিল্প নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তা করি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, দেশে যদি শুধু ছবি এঁকেই কেউ জীবনযাপন করতে পারতো, তাহলে আমার মতো অনেকেই শুধু ছবি আঁকত।

ও. আ. : ভবিষ্যতে আপনার কাজের ধারা নিশ্চয় একই রকম থাকবে...

স. ম. : ভবিষ্যতে আমার কাজের ধারা শাণিত হতে পারে। কিন্তু আমি আমার কাজের ধারা পরিবর্তন করতে চাই না।

ও. আ. : আমরা যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতার দিকে তাকাই দেখতে পাই, তিনি একেক সময় একেক ধরনের কবিতা লিখেছেন। তাঁর লেখায় নানা বৈচিত্র্য আছে। আবার আমরা যখন তার শিল্পের দিকে তাকাই সেখানেও দেখি নানা বৈচিত্র্য। আপনি বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?

স. ম. : বৈচিত্র্য আছে কি? আমার তো মনে হয়, যে কেউ রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখে বলে দিতে পারবে এটা রবীন্দ্রনাথের আঁকা। আমার মনে হয়, সেটাই হওয়া উচিত।

ও. আ. : আপনি কোন দশক থেকে ছবি আঁকা শুরু করলেন?

স. ম. : আমি ছবি আঁকি ছোটবেলা থেকেই। চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৭৫-এ। পাস করে বের

হলাম ১৯৮০ সালে। তারপর থেকেই একাডেমিক ছেড়ে এক্সপেরিমেন্টাল কাজগুলো শুরু হয়েছে। একসময় বহু বই-এর প্রচ্ছদ করেছি। প্রচ্ছদের কাজগুলো খুবই ছোট বলে যে কোনো জায়গায় বসেই এঁকে ফেলতে পারি। প্রচ্ছদের ব্যাপারে একটা বিষয় বলতে হয়- প্রচ্ছদও কিন্তু ডিজাইন, কম্যুনিকেশনই এর প্রধান উদ্দেশ্য। প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। শুরু করেছিলাম ব্লক প্রিন্ট দিয়ে। প্রথমদিকে জিংক-ব্লক দিয়ে প্রচ্ছদ তৈরি হতো। তারপর এলো এক বা দুই রঙের ম্যানুয়েল সেপারেশন করে অফসেটে ছাপা। কম্পিউটার চলে আসার পর সবকিছুই দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেল। এখন কম্পিউটার কালার সেপারেশন করছে। এবং অফসেট প্রেসে প্রিন্ট হচ্ছে। একসময় আমাদের দেশে যেসব অফসেট প্রেস ছিল সব রিকন্ডিশন। অর্থাৎ বিভিন্ন দেশ থেকে ফেলে দেয়া প্রেসগুলো এদেশে আসত। এসব এনে বই ছাপার কাজ হতো। এখানে তো কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। আমি নিজেই ধাক্কা খেয়ে খেয়ে শিখেছি। এমন একটা সময় ছিল যখন কোনো ফ্ল্যাট স্ক্যানার ছিল না। আমি যে আমার কোনো শিল্পকর্মকে স্ক্যান করে নিয়ে কম্পিউটারে কাজ করবো তার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। কম্পিউটারে হয়ত কোনো ডিজাইন তৈরি করেছি, সেটাকে কালার সেপারেশন করার জন্য বিশাল হার্ডডিস্কটা নিয়ে যেতে হতো আলাদা প্রতিষ্ঠানে। এই সমস্যাগুলো আমাকে খুব ভুগিয়েছে। এগুলো নিয়ে নানা ভাবনাচিন্তা করতে করতে অনেক সময় নষ্ট করেছি। অনেকগুলো শিল্পভাবনা নষ্ট হয়েছে। এখন অনেক সুন্দর সুন্দর প্রেস এসেছে আমাদের দেশে। কম্পিউটারেও দক্ষ লোকজন কাজ করছে। কম্পিউটার থেকে সরাসরি প্রেসে ছাপা হচ্ছে। সেই বিষয়গুলো তখন কল্পনারও বাইরে ছিল।

তখনকার প্রকাশকরা অফসেট কাগজে প্রচ্ছদ ছাপলেই সেটাকে যথেষ্ট মনে করত। অর্থাৎ তারা ভাবতো, অফসেট কাগজের কারণে যে কোনো কিছু ভালো হতে বাধ্য। এখন সে মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। এখন কোনো প্রকাশক হোয়াইট প্রিন্টেও কোনো বইয়ের টেক্সট ছাপে না। আগে হোয়াইট প্রিন্টের ঊর্ধ্বে উঠতে বহু চিন্তা করতে হতো। ভাবত, এত খরচ উঠে আসবে তো।

ও. আ. : প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু শিল্পের বিবর্তন কি হয়েছে? প্রচ্ছদশিল্পীর হাতের কাজ কি বদলেছে?

স. ম. : মেশিনে যে কাপড় বোনা হয় তার সঙ্গে জামদানি শাড়ির হাতের কাজের পার্থক্য তো আছেই। জামদানি শাড়ি বুননের ক্ষেত্রে তাঁতির কাজে দরদ মিশে থাকে; মেশিনে বোনা কাপড়গুলো অনেক নিখুঁতভাবে তৈরি হয়, কিন্তু তাতে দরদ থাকে না। মেশিনে বোনা কাপড়গুলো অনেক রংচঙে কিন্তু তা মানুষকে টানে না, জামদানীই টানে। ব্যবধানটা এখানেই। আমরা যখন প্রচ্ছদগুলো হাতে করতাম তখন এর মধ্যে এক ধরনের হৃদয়ের স্পর্শ ছিল। কিন্তু এখন কম্পিউটারে এর চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেও মনে হয় এসব তো আমার কাজ নয়। এর অনেকটাই কম্পিউটার করে দিয়েছে। গ্রাফিক্সে আগে যারা পড়াশোনা করতো চারুকলায় তাদের ছাত্রজীবনের আশি শতাংশ চলে যেত শুধু টাইপোগ্রাফি শিখতে, কীভাবে সুন্দর করে অ, আ লেখা যায়, সেটাই শিখতে হতো। কিন্তু এখন দেখা যায় কম্পিউটার নিজেই অনেক ধরনের টাইপোগ্রাফির ফরমেট দিয়ে দিচ্ছে। এবং ওখান থেকেও ইচ্ছা করলেই ভাঙ্গা যাচ্ছে। কাজেই প্রযুক্তি যে কীভাবে মানুষকে বদলে দিচ্ছে, সহজ করে দিচ্ছে তা কল্পনাতীত।

ও. আ. : তরুণদের মধ্যে যারা গ্রাফিক্স নিয়ে কাজ করছে, তাদের অনেকে হাতের কাজও করছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

স. ম. : যারা হাতের কাজ করে তাদের কাজ ভালো হতে বাধ্য। কারণ হাতের কাজে মেধার সংযোগটা তৈরি হয়।

ও. আ. : আপনাদের সময় সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই। আপনাদের সময়ে পরস্পরের যে ভাবনা বিনিময় এবং শিল্পের উৎকর্ষে যেসব কাজ করা হয়েছে- সে ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন-

স. ম. : এখন একজন প্রকাশক এবং লেখকদের সঙ্গে প্রচ্ছদশিল্পী কিংবা যারা গ্রাফিক্স নিয়ে কাজ করছে তাদের দেখাই হয় না। কারণ একজন লেখক কিংবা প্রকাশক ইমেইলে বই-এর নাম পাঠিয়ে দিচ্ছে। ডিজাইনার চাইলে টেক্সটও পাঠাচ্ছে। প্রকাশক তার স্মার্ট ফোনে ডিজাইন দেখে কোনটা লাগবে- সেটা বলে দিচ্ছে বা ইমেইলে সংশোধন করে দিচ্ছে। ডিজাইনার সেটা ঠিক করে দিচ্ছে। সেটা চলে যাচ্ছে মুদ্রকের কাছে। এখন প্রকাশক, লেখক কিংবা প্রচ্ছদশিল্পীর সাথে কথাবার্তা হচ্ছে না, ভাব বিনিময় হচ্ছে না। আমাদের সময় এমন ছিলো না। আমরা একসঙ্গে বসে কাজের বাইরেও প্রচুর কথা বলতাম। কারও কবিতা কিংবা গল্প নিয়ে, কারও ভাবনা নিয়ে। প্রকাশক জানাতেন পাঠকের কাছে তিনি কোন বার্তা পৌঁছাতে চাচ্ছেন। এসব নিয়ে ভাবনার আদান-প্রদান ছিলো। এই একটা পজেটিভ জিনিস ছিলো। এসব থেকে প্রচ্ছদশিল্পীরা এখন বঞ্চিত। তাদের সুবিধা, তারা এখন বিকাশে টাকা পাচ্ছে। কিন্তু আড্ডা বন্ধ হয়ে গেছে।

ও. আ. : ফেসবুক, ইন্টারনেট- এসব কি শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?

স. ম. : কিছু কিছু সুবিধাও আছে। যেমন আমার ক্ষমতা নেই বড় বড় গ্যালরিতে প্রদর্শনী করার। কিন্তু আমি দিব্যি ফেসবুকে প্রদর্শনী করছি। অনেক মানুষের কাছাকাছি যেতে পারছি। এটা অনেকটা অক্ষমের আনন্দের মতো। ফেসবুকের প্রদর্শনীতে অনেকে মন্তব্য করছেন, তাদের কারও কারও মন্তব্য আমি ফেলতেও পারি না। কখনও কোনো বড় কবি কোনো মন্তব্য করলেন কিংবা কোনো বোদ্ধা ব্যক্তি, কোনো শিল্প সমালোচক কোনো কথা বললেন- এসব মন্তব্য তো আমাকে নাড়া না দিয়ে পারে না।

ও. আ. : আপনি কতোগুলো দেশে এক্সিবিশন করেছেন? প্যারিসে কি আপনার কোনো এক্সিবিশন হয়েছে?

স. ম. : না না। আমি প্যারিসে এক্সিবিশন ও জাদুঘর দেখতে গিয়েছি। কিন্তু ওখানে আমার কোনো এক্সিবিশন করা হয়নি। আমি মেইনলি বাংলাদেশেই করেছি। তবে ভারতেও কয়েকটি যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে।

ও. আ. : প্যারিসের শিল্প দেখা এবং বাংলাদেশের শিল্প দেখার মধ্যে কি ধরনের পার্থক্য খুঁজে পান?

স. ম. : এটা বলার মতো কিছু নেই। প্যারিস হচ্ছে শিল্পের স্বর্গ। শিল্পীদের স্বর্গ।

ও. আ. : তবে কি বাংলাদেশের শিল্প দেখে প্রায়শ আপনার মন ভেঙে যায়?

স. ম. : না, ভাঙে না। এটা বলতে গেলে আগের কথা বলতে হবে। আমাদের গান, কবিতার যেমন সুদৃঢ় ঐতিহ্য আছে, তেমন করে সুদৃঢ় ঐতিহ্য অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে আসেনি। এ অঞ্চলে ছবির ভাষাকে কালজয়ী ভাষা হিসেবে তেমনভাবে মনে করা হয়নি। পালযুগের পুঁথিতে মাঝে মাঝে কিছুু ইলাস্ট্রেশন ছিলো, লোককলায় কালীঘাটের পট, সরাচিত্র, নকশি কাথা ছিল, কিন্তু সেটা তেমন বড় কিছু নয়। কালীঘাটের পটে মনোজগৎকে নাড়া দেয়ার মতো বিষয় ছিল না, কিছু তির্যক ও রসালো বিষয় ছিলো। কিন্তু অতো ইন্টালেকচুয়াল কাজ ওগুলো ছিলো না। সে তুলনায় মধুমন্তী, ওয়ারলি উন্নততর। এ অঞ্চলে অভিজাত শিল্পকর্ম কিছু তৈরি হয় মোগল আমলে। অজন্তা, ইলোরা, রাজস্থানী পেইন্টিং, কিছু টেরাকোটা উল্লেখ করার মতো। এছাড়া জাদুঘরে গেলে পুরনো ভাস্কর্যগুলো দেখা যায়। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসা পটচিত্র দেখা যায়। তবে একথা বলতেই হয় যে, শিল্পের চর্চায় ইউরোপীয়রা যেভাবে এগিয়েছে, যেভাবে ওরা গবেষণা করেছে, সেভাবে আমরা পারিনি। তেমন কিছু আমরা ভাবতেও পারি না। একসময় অবন ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, গনেশ পাইন প্রমুখের হাত ধরে বাঙালির শিল্পচর্চা জাগ্রত হরার চেষ্টা হয়েছিলো কিন্তু ইউরোপিয়ান ছবির দাপট এখানে অনেক বেশি। বাংলাদেশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যদি চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না করতেন তাহলে হয়ত এদেশে শিল্পীরা এতদূর এগুতে পারতেন না। উপমহাদেশের বর্তমান চারুকলার শিক্ষাপদ্ধতি ও উপকরণ পাশ্চাত্য রেখেই শিল্পীরা যে যার মতো করে আঁকছেন। শিল্পাচার্য আমাদের শেখালেন, ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হয় এবং মাতৃভূমিতে দাঁড়িয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১ , ৭ মাঘ ১৪২৭, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

শেকড়কে বাদ দিয়ে কিছু ভাবতে পারি না

সমর মজুমদার

image

সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে নিজস্ব স্টুডিওতে ছবি আঁকছেন শিল্পী সমর মজুমদার

সমর মজুমদার বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে এক স্বতন্ত্র নাম। মৃত্তিকালগ্ন জীবন ও আবহমান বাংলার নিসর্গ-প্রকৃতি তাঁর চিত্রের প্রধান উপজীব্য। একজন খ্যাতিমান প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সমধিক পরিচিত। এ পর্যন্ত পাঁচ সহস্রাধিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিনি। তাঁর শিল্পকর্মকে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য রীতির মিশ্রণ বলা হয়, যেখানে ঐতিহ্যের অনুসন্ধানের পাশাপাশি আধুনিকতার সংযোগ ঘটেছে। ইতোমধ্যে তিনি অনেকগুলো একক প্রদর্শনী করেছেন। এখনো শিল্পাঙ্গনে তাঁর সরব উপস্থিতি লক্ষ্যযোগ্য। সম্প্রতি তাঁর সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে এই কথোপকথনে অংশ নেন ওবায়েদ আকাশ। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেন খন্দকার মুনতাসীর মামুন।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার কাজের ধারাটি আমাদের প্রকৃতি, মাটি এবং সবুজের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। জানতে চাই, এই ধারার প্রতি আপনার আগ্রহের সূত্রপাত কি ব্যাপক পঠন-পাঠনের পর নাকি শুরু থেকেই কাজের মধ্য দিয়ে এর ভেতরে ঢুকে পড়া।

সমর মজুমদার : এটা আমার ভালোবাসার ধারা। এই ভালোবাসা আমার দেশের প্রতি, আমার মাটির প্রতি। আমি এর বাইরে যেতে চাই না। ছোটবেলায় আমি বড় হয়েছি আধা গ্রাম আধা শহর- এমন একটি জায়গায়। খেলাধুলা করেছি রাখালদের সঙ্গে। শৈশবে আমার বাড়ির আশেপাশে কোন গাছে কেমন আম ধরত, কোথায় বরই গাছ, কোথায় পেয়ারা গাছ, কোথায় কী পাওয়া যায়, কোন গাছে কোন পাখি বাসা বাঁধে আমি সেগুলো খুঁজে বেড়াতাম। আমি এমন একটা প্রকৃতি বান্ধবময় গ্রামে বড় হয়েছি। এমন স্থানে বড় হওয়ার কারণে আমার ভেতরে একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। আমার গ্রামের রঙ, আমার গ্রামের মানুষের রঙ আমাকে ডাকে। এরপরে তো আমি ওদেরকে ছেড়ে যেতে পারি না।

অনেক ছোটবেলায় আমার একটা মজার খেলা ছিল। খেলতে খেলতে আমি গরুর দড়িকে ছুড়ে মারতাম। গরুর দড়ি নানা ফর্মে ঘাসের মধ্যে পড়ত। সেই ফর্মগুলো আমার কাছে নানা আকৃতিতে ধরা দিতো। ফর্মগুলো থেকে আমি শিল্প খুঁজে বের করতাম। কখনও সেটা গরুর মতো হতো, কখনও মেঘের মতো হতো, কখনও গাছের মতো হতো, কখনও নদীর মতো হতো, কখনো শুধুই সুন্দর ফর্ম। আমি মুগ্ধ হয়ে এই ফর্মগুলো দেখতাম। এবং একই রকম ফর্ম আবার বানানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু কখনও সেই পূর্বের ফর্মে ফিরে যেতে পারতাম না। সেই দুঃখ আমাকে একই কাজ করতে বার বার প্রলুব্ধ করতো।

আরেকটা ঘটনা বলি। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন আমার শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডে একটা বই রেখে চারপাশে চক ঘুরিয়ে বই এঁকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এমনভাবে বই আঁকতে। আমি আঁকতে গিয়ে বুঝলাম, দু’টি দৈর্ঘ্য আর দু’টি প্রস্থ সমান হলেই বই হয় না। এভাবেই চারুকলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুরু হলো। আমি দেখলাম যে, আমার গ্রামের মানুষকে, প্রকৃতিকে না আঁকলে সেটা পূর্ণাঙ্গ ছবি হচ্ছে না। আমাকে তৃপ্ত করতে পারছে না। আমার একটা একাকিত্বের, ভাবনার জগৎ ছিলো।

ও. আ. : তার মানে গ্রামের প্রতি মুগ্ধতা, প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা এবং ছেলেবেলার নস্টালজিয়া থেকেই আপনি ছবি আঁকেন।

স. ম. : ছেলেবেলায় আমার যে গ্রামকে আমি দেখেছি এখনও চোখ বন্ধ করে সেই গ্রামকেই দেখি। অর্থাৎ সেই সাঁকো, সেই চর, সেই নদী-বিল, গাছের কোটরে পাখির বাসা- সেটাই আমার গ্রাম। সেই গ্রাম মনের মধ্যে একটুও বদলায়নি। বর্তমান সময়ে হয়ত সেই গ্রামে আর বাঁশের সাঁকো খুঁজে পাওয়া যাবে না, মাটির ঘর পাওয়া যাবে না, এমনকি নদীর কিনারগুলোও হয়ত পাকা ব্লকে বাঁধানো হয়ে গেছে। আমার মন পড়ে আছে শৈশবের সেই নদীতীরে। কাজেই আমি কোনো ইজম নিয়ে ভাবি না। আমি কী ইজমে আঁকলাম, কী ইজম হলো, কোথায় কোন আধুনিক স্কেচ হলো- সেসব আমাকে ভাবায় না। আমি আমার তৃপ্তি মতো ছবি আঁকি।

ও. আ. : আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে, এই ধারায় কাজ করে বিশ্বমানের শিল্পী হওয়া যাবে না? কখনও কি ধারা পরিবর্তনের ইচ্ছা জেগেছে? দেশ-বিদেশের অনেক প্রখ্যাত শিল্পীই তো গ্রামকে এড়িয়ে অনেক বড় শিল্পী হয়ে উঠেছেন। সেদিকে আপনার ঝোঁক ছিল না?

স. ম. : এসব করার প্রচুর শিল্পী আছে। যাদের ইচ্ছা আছে আধুনিক ধারায় কাজ করার, কিংবা উত্তর আধুনিক ধারায় কাজ করার- তারা তো সেটা করতেই পারে। তারা সেটা করুক। আমি যে কাজটি করে আনন্দ পাই, সেটাই করে যেতে চাই।

ও. আ. : এই ধারায় থাকতে গিয়ে আপনি কি কখনও সমালোচিত হয়েছেন বা উপেক্ষিত হয়েছেন?

স. ম. : আমার সামনে কেউ কখনও বলেনি যে, আরও মডার্ন ছবি আঁকো।

ও. আ. : তাহলে এটা আমরা বলতে পারি যে, যাদের শেকড় গ্রাম তারা সবাই আপনার কাজকে গ্রহণ করেছে।

স. ম. : আমি যাদের সঙ্গে মিশেছি, বড় হয়েছি তাদের প্রাণও তো একই জায়গায় বাঁধা। ওদের শেকড়ও তো গ্রাম। ওরা কীভাবে সমালোচনা করবে, উল্টো জড়িয়ে ধরে বলেছে, অনেকদিন পর সেই হারানো গ্রামকে ফিরিয়ে দিলে।

আমি মনে করি, আমাদের ছোটবেলার বিষয়গুলো, যেগুলো দেখে দেখে আমরা বড় হয়েছি, সেগুলো ফিরে পেলেই আমরা সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হই। আমি ছবি এঁকে আনন্দ পাই, আমার আশেপাশে আরও পাঁচ-দশজন যদি আমার ছবি দেখে আনন্দ পায় তবেই তো আমার সুখ। ছবি দেখে কেউ যদি ভাবে, আরে আমাদের শৈশব তো এমনই ছিল- তবেই তো সুখ। যেভাবে আমাদেরকে অপু-দুর্গা টানে, পথের পাঁচালি, অপরাজিত টানে, শৈশবের কবিতা-গল্পগুলো টানে, শরৎকাহিনী টানে, তেমন ব্যাপার তো ছবির ক্ষেত্রেও হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে, পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে...। আমিও সেই গানের মতোই বুঝতে পারি, যেখানে আমাদের শেকড়, যে গ্রামে আমাদের ভিত তৈরি হয়ে আছে, যে সিঁড়িতে পা দিয়ে দিয়ে আমরা এখানে এসেছি, সেই সিঁড়িগুলো ফেলনা নয়। সেই সিঁড়িগুলোকে স্মরণ করতে হবে আমাদের।

ও. আ. : আপনার দৃষ্টিতে শিল্পের দায়টা আসলে কোথায়?

স. ম. : ছবি আঁকার সময় নিজে তৃপ্তি পেলাম কিনা শিল্পী প্রথমত সেটাই ভাবে। এরপর ভাবে তার পরিবেশ এবং সমাজকে কিছু দিতে পারছে কিনা। এই দেয়ার বিষয়টি, নেহাত আনন্দ হতে পারে, সুস্থ সমাজ গঠনের দিকে একটা বাতাবরণ হতে পারে। তবে বিষয়টি যে চূড়ান্তভাবে শিক্ষণীয় কিছু হতেই হবে, তা নয়। অর্থাৎ কাউকে মানুষ করার জন্য, কাউকে কিছু শেখানোর জন্যই কেউ ছবি আঁকে না। শিল্পী তার ফর্মে ছবি আঁকে, সেই আঁকা থেকে কেউ যদি কোনো শিক্ষা নিতে পারে সেটা ভালো। তার চেয়ে আরও ভালো হলো, ঐ ছবি থেকে সে যদি তার শান্তিময় জীবনটাকে অন্বেষণ করতে পারে।

ও. আ. : একজন শিল্পী যখন কাজ করছে তখন তার মনের প্রতিবিম্ব শিল্পে প্রতিফলিত হচ্ছে। আপনি যখন একজন শিল্পী এবং আমি যখন দর্শক তখন আমার মনের প্রতিবিম্বটা কি শিল্পী হিসেবে আপনার শিল্পে আশা করেন? নাকি নিজের মনের প্রতিফলনটারই বাস্তবায়ন ঘটান?

স. ম. : আমি আমার নিজের প্রতিফলনটারই বাস্তবায়ন করি। কিন্তু দেখা যায়, সেখানে অন্যান্যরাও চলে আসে। অর্থাৎ আমরা একই ঘরে বাস করি বলে আশপাশের সবার সঙ্গেই আমার মনের ভাবনাগুলো মিলে যায়। আমাদের চিন্তাগুলো মিলে যায়, আমাদের স্মৃতিগুলো মিলে যায়। কাজেই যিনি দেখছেন তিনিও বলে ওঠেন, বাহ, এ তো আমার পরিচিত জায়গা। এ দৃশ্য আমি অনেকবার দেখেছি। দর্শকরা আনন্দিত হয়ে ওঠেন। তাদের মনে পুলক ছড়ায়।

ও. আ. : কোন সালে কিংবা কোন দশকে আপনি প্রথম ভাবতে পারলেন যে, আমি ভালো আঁকতে পেরেছি।

স. ম. : আমি এখনও মনে করি, আমি শুধু ছবি আঁকার চেষ্টা করছি। আমার খুব ইচ্ছা, এমন একটা ছবি আঁকার, যা দেখে সবাই বলবে এটা আমাদের চেতনার, আমাদের সত্তার, আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রতিবিম্ব। সেই ছবির ভাষা মানুষের অন্তরকে নাড়িয়ে দেবে। সেই ছবির ভাষা, সেই ছবির রঙ, সেই ছবির বর্ণবিন্যাস হবে সবার মনের প্রতিবিম্ব। আমি খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু এখনও আমি সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি।

ও. আ. : আপনি কি আপনার সব শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করেন?

স. ম. : যতটা পারি। আমি দীর্ঘসময় সরকারি চাকরি করেছি। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি চাকরিতে মনোনিবেশ করতে হয়। অর্থাৎ যতটা সরকার চায়, কর্মকর্তা-কর্মচারিকেও ততটাই মনোনিবেশ করতে হবে। কাজেই ওখানে আমি কোনো ছাড় পাইনি। আমার শিল্প সৃষ্টির সমস্ত বিষয় জমা হয়ে ছিল। সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় আমি শিল্পের শুধু খসড়া করেছি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেদিন আমি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করবো সেদিন থেকেই আমি পূর্ণাঙ্গ শিল্পী হব। এবং আর কোনো বাণিজ্যিক কাজ করবো না, কোনো ফরমায়েশি কাজ করবো না। এবং পুরোপুরিভাবে নিজের অনুভবকে প্রকাশ করার জন্য আমি শ্রম দেব। আমি এখন প্রতিনিয়ত চিন্তাশীল একজন শিল্পী। শিল্প নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তা করি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, দেশে যদি শুধু ছবি এঁকেই কেউ জীবনযাপন করতে পারতো, তাহলে আমার মতো অনেকেই শুধু ছবি আঁকত।

ও. আ. : ভবিষ্যতে আপনার কাজের ধারা নিশ্চয় একই রকম থাকবে...

স. ম. : ভবিষ্যতে আমার কাজের ধারা শাণিত হতে পারে। কিন্তু আমি আমার কাজের ধারা পরিবর্তন করতে চাই না।

ও. আ. : আমরা যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতার দিকে তাকাই দেখতে পাই, তিনি একেক সময় একেক ধরনের কবিতা লিখেছেন। তাঁর লেখায় নানা বৈচিত্র্য আছে। আবার আমরা যখন তার শিল্পের দিকে তাকাই সেখানেও দেখি নানা বৈচিত্র্য। আপনি বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?

স. ম. : বৈচিত্র্য আছে কি? আমার তো মনে হয়, যে কেউ রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখে বলে দিতে পারবে এটা রবীন্দ্রনাথের আঁকা। আমার মনে হয়, সেটাই হওয়া উচিত।

ও. আ. : আপনি কোন দশক থেকে ছবি আঁকা শুরু করলেন?

স. ম. : আমি ছবি আঁকি ছোটবেলা থেকেই। চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৭৫-এ। পাস করে বের

হলাম ১৯৮০ সালে। তারপর থেকেই একাডেমিক ছেড়ে এক্সপেরিমেন্টাল কাজগুলো শুরু হয়েছে। একসময় বহু বই-এর প্রচ্ছদ করেছি। প্রচ্ছদের কাজগুলো খুবই ছোট বলে যে কোনো জায়গায় বসেই এঁকে ফেলতে পারি। প্রচ্ছদের ব্যাপারে একটা বিষয় বলতে হয়- প্রচ্ছদও কিন্তু ডিজাইন, কম্যুনিকেশনই এর প্রধান উদ্দেশ্য। প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। শুরু করেছিলাম ব্লক প্রিন্ট দিয়ে। প্রথমদিকে জিংক-ব্লক দিয়ে প্রচ্ছদ তৈরি হতো। তারপর এলো এক বা দুই রঙের ম্যানুয়েল সেপারেশন করে অফসেটে ছাপা। কম্পিউটার চলে আসার পর সবকিছুই দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেল। এখন কম্পিউটার কালার সেপারেশন করছে। এবং অফসেট প্রেসে প্রিন্ট হচ্ছে। একসময় আমাদের দেশে যেসব অফসেট প্রেস ছিল সব রিকন্ডিশন। অর্থাৎ বিভিন্ন দেশ থেকে ফেলে দেয়া প্রেসগুলো এদেশে আসত। এসব এনে বই ছাপার কাজ হতো। এখানে তো কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। আমি নিজেই ধাক্কা খেয়ে খেয়ে শিখেছি। এমন একটা সময় ছিল যখন কোনো ফ্ল্যাট স্ক্যানার ছিল না। আমি যে আমার কোনো শিল্পকর্মকে স্ক্যান করে নিয়ে কম্পিউটারে কাজ করবো তার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। কম্পিউটারে হয়ত কোনো ডিজাইন তৈরি করেছি, সেটাকে কালার সেপারেশন করার জন্য বিশাল হার্ডডিস্কটা নিয়ে যেতে হতো আলাদা প্রতিষ্ঠানে। এই সমস্যাগুলো আমাকে খুব ভুগিয়েছে। এগুলো নিয়ে নানা ভাবনাচিন্তা করতে করতে অনেক সময় নষ্ট করেছি। অনেকগুলো শিল্পভাবনা নষ্ট হয়েছে। এখন অনেক সুন্দর সুন্দর প্রেস এসেছে আমাদের দেশে। কম্পিউটারেও দক্ষ লোকজন কাজ করছে। কম্পিউটার থেকে সরাসরি প্রেসে ছাপা হচ্ছে। সেই বিষয়গুলো তখন কল্পনারও বাইরে ছিল।

তখনকার প্রকাশকরা অফসেট কাগজে প্রচ্ছদ ছাপলেই সেটাকে যথেষ্ট মনে করত। অর্থাৎ তারা ভাবতো, অফসেট কাগজের কারণে যে কোনো কিছু ভালো হতে বাধ্য। এখন সে মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। এখন কোনো প্রকাশক হোয়াইট প্রিন্টেও কোনো বইয়ের টেক্সট ছাপে না। আগে হোয়াইট প্রিন্টের ঊর্ধ্বে উঠতে বহু চিন্তা করতে হতো। ভাবত, এত খরচ উঠে আসবে তো।

ও. আ. : প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু শিল্পের বিবর্তন কি হয়েছে? প্রচ্ছদশিল্পীর হাতের কাজ কি বদলেছে?

স. ম. : মেশিনে যে কাপড় বোনা হয় তার সঙ্গে জামদানি শাড়ির হাতের কাজের পার্থক্য তো আছেই। জামদানি শাড়ি বুননের ক্ষেত্রে তাঁতির কাজে দরদ মিশে থাকে; মেশিনে বোনা কাপড়গুলো অনেক নিখুঁতভাবে তৈরি হয়, কিন্তু তাতে দরদ থাকে না। মেশিনে বোনা কাপড়গুলো অনেক রংচঙে কিন্তু তা মানুষকে টানে না, জামদানীই টানে। ব্যবধানটা এখানেই। আমরা যখন প্রচ্ছদগুলো হাতে করতাম তখন এর মধ্যে এক ধরনের হৃদয়ের স্পর্শ ছিল। কিন্তু এখন কম্পিউটারে এর চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেও মনে হয় এসব তো আমার কাজ নয়। এর অনেকটাই কম্পিউটার করে দিয়েছে। গ্রাফিক্সে আগে যারা পড়াশোনা করতো চারুকলায় তাদের ছাত্রজীবনের আশি শতাংশ চলে যেত শুধু টাইপোগ্রাফি শিখতে, কীভাবে সুন্দর করে অ, আ লেখা যায়, সেটাই শিখতে হতো। কিন্তু এখন দেখা যায় কম্পিউটার নিজেই অনেক ধরনের টাইপোগ্রাফির ফরমেট দিয়ে দিচ্ছে। এবং ওখান থেকেও ইচ্ছা করলেই ভাঙ্গা যাচ্ছে। কাজেই প্রযুক্তি যে কীভাবে মানুষকে বদলে দিচ্ছে, সহজ করে দিচ্ছে তা কল্পনাতীত।

ও. আ. : তরুণদের মধ্যে যারা গ্রাফিক্স নিয়ে কাজ করছে, তাদের অনেকে হাতের কাজও করছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

স. ম. : যারা হাতের কাজ করে তাদের কাজ ভালো হতে বাধ্য। কারণ হাতের কাজে মেধার সংযোগটা তৈরি হয়।

ও. আ. : আপনাদের সময় সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই। আপনাদের সময়ে পরস্পরের যে ভাবনা বিনিময় এবং শিল্পের উৎকর্ষে যেসব কাজ করা হয়েছে- সে ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন-

স. ম. : এখন একজন প্রকাশক এবং লেখকদের সঙ্গে প্রচ্ছদশিল্পী কিংবা যারা গ্রাফিক্স নিয়ে কাজ করছে তাদের দেখাই হয় না। কারণ একজন লেখক কিংবা প্রকাশক ইমেইলে বই-এর নাম পাঠিয়ে দিচ্ছে। ডিজাইনার চাইলে টেক্সটও পাঠাচ্ছে। প্রকাশক তার স্মার্ট ফোনে ডিজাইন দেখে কোনটা লাগবে- সেটা বলে দিচ্ছে বা ইমেইলে সংশোধন করে দিচ্ছে। ডিজাইনার সেটা ঠিক করে দিচ্ছে। সেটা চলে যাচ্ছে মুদ্রকের কাছে। এখন প্রকাশক, লেখক কিংবা প্রচ্ছদশিল্পীর সাথে কথাবার্তা হচ্ছে না, ভাব বিনিময় হচ্ছে না। আমাদের সময় এমন ছিলো না। আমরা একসঙ্গে বসে কাজের বাইরেও প্রচুর কথা বলতাম। কারও কবিতা কিংবা গল্প নিয়ে, কারও ভাবনা নিয়ে। প্রকাশক জানাতেন পাঠকের কাছে তিনি কোন বার্তা পৌঁছাতে চাচ্ছেন। এসব নিয়ে ভাবনার আদান-প্রদান ছিলো। এই একটা পজেটিভ জিনিস ছিলো। এসব থেকে প্রচ্ছদশিল্পীরা এখন বঞ্চিত। তাদের সুবিধা, তারা এখন বিকাশে টাকা পাচ্ছে। কিন্তু আড্ডা বন্ধ হয়ে গেছে।

ও. আ. : ফেসবুক, ইন্টারনেট- এসব কি শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?

স. ম. : কিছু কিছু সুবিধাও আছে। যেমন আমার ক্ষমতা নেই বড় বড় গ্যালরিতে প্রদর্শনী করার। কিন্তু আমি দিব্যি ফেসবুকে প্রদর্শনী করছি। অনেক মানুষের কাছাকাছি যেতে পারছি। এটা অনেকটা অক্ষমের আনন্দের মতো। ফেসবুকের প্রদর্শনীতে অনেকে মন্তব্য করছেন, তাদের কারও কারও মন্তব্য আমি ফেলতেও পারি না। কখনও কোনো বড় কবি কোনো মন্তব্য করলেন কিংবা কোনো বোদ্ধা ব্যক্তি, কোনো শিল্প সমালোচক কোনো কথা বললেন- এসব মন্তব্য তো আমাকে নাড়া না দিয়ে পারে না।

ও. আ. : আপনি কতোগুলো দেশে এক্সিবিশন করেছেন? প্যারিসে কি আপনার কোনো এক্সিবিশন হয়েছে?

স. ম. : না না। আমি প্যারিসে এক্সিবিশন ও জাদুঘর দেখতে গিয়েছি। কিন্তু ওখানে আমার কোনো এক্সিবিশন করা হয়নি। আমি মেইনলি বাংলাদেশেই করেছি। তবে ভারতেও কয়েকটি যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে।

ও. আ. : প্যারিসের শিল্প দেখা এবং বাংলাদেশের শিল্প দেখার মধ্যে কি ধরনের পার্থক্য খুঁজে পান?

স. ম. : এটা বলার মতো কিছু নেই। প্যারিস হচ্ছে শিল্পের স্বর্গ। শিল্পীদের স্বর্গ।

ও. আ. : তবে কি বাংলাদেশের শিল্প দেখে প্রায়শ আপনার মন ভেঙে যায়?

স. ম. : না, ভাঙে না। এটা বলতে গেলে আগের কথা বলতে হবে। আমাদের গান, কবিতার যেমন সুদৃঢ় ঐতিহ্য আছে, তেমন করে সুদৃঢ় ঐতিহ্য অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে আসেনি। এ অঞ্চলে ছবির ভাষাকে কালজয়ী ভাষা হিসেবে তেমনভাবে মনে করা হয়নি। পালযুগের পুঁথিতে মাঝে মাঝে কিছুু ইলাস্ট্রেশন ছিলো, লোককলায় কালীঘাটের পট, সরাচিত্র, নকশি কাথা ছিল, কিন্তু সেটা তেমন বড় কিছু নয়। কালীঘাটের পটে মনোজগৎকে নাড়া দেয়ার মতো বিষয় ছিল না, কিছু তির্যক ও রসালো বিষয় ছিলো। কিন্তু অতো ইন্টালেকচুয়াল কাজ ওগুলো ছিলো না। সে তুলনায় মধুমন্তী, ওয়ারলি উন্নততর। এ অঞ্চলে অভিজাত শিল্পকর্ম কিছু তৈরি হয় মোগল আমলে। অজন্তা, ইলোরা, রাজস্থানী পেইন্টিং, কিছু টেরাকোটা উল্লেখ করার মতো। এছাড়া জাদুঘরে গেলে পুরনো ভাস্কর্যগুলো দেখা যায়। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসা পটচিত্র দেখা যায়। তবে একথা বলতেই হয় যে, শিল্পের চর্চায় ইউরোপীয়রা যেভাবে এগিয়েছে, যেভাবে ওরা গবেষণা করেছে, সেভাবে আমরা পারিনি। তেমন কিছু আমরা ভাবতেও পারি না। একসময় অবন ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, গনেশ পাইন প্রমুখের হাত ধরে বাঙালির শিল্পচর্চা জাগ্রত হরার চেষ্টা হয়েছিলো কিন্তু ইউরোপিয়ান ছবির দাপট এখানে অনেক বেশি। বাংলাদেশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যদি চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না করতেন তাহলে হয়ত এদেশে শিল্পীরা এতদূর এগুতে পারতেন না। উপমহাদেশের বর্তমান চারুকলার শিক্ষাপদ্ধতি ও উপকরণ পাশ্চাত্য রেখেই শিল্পীরা যে যার মতো করে আঁকছেন। শিল্পাচার্য আমাদের শেখালেন, ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হয় এবং মাতৃভূমিতে দাঁড়িয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।