কবিতার উপায় ও উপকরণ

দিলারা হাফিজ

হাজার হাজার বছর কেটে গেলো, তবু যার মীমাংসা এলো না, তাহলো কবিতা শিল্প। কবিতার জন্মমুহূর্ত থেকে স্বয়ং কবি, দার্শনিক, সমালোচক, সাহিত্যের শাস্ত্রকারদের একটিই প্রশ্ন, কবিতা আসলে কী?

কবি, কীভাবে সৃষ্টি করেন তাঁর কাব্যশিল্পের মায়া-হরিণ।

শতভাগ, মীমাংসাহীন এই প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা আলো প্রথম জ্বালিয়েছিলেন আচার্য ভরত, তাঁর বিখ্যাত নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে। অলঙ্কারশাস্ত্রের ইতিহাসে এ যাবৎ প্রাপ্ত প্রাচীনতম গ্রন্থ হচ্ছে ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’ নামের এই গ্রন্থটি। ভাবা যায়! গ্রন্থটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

ভাবুন তো, সে কত কত সময়ের স্রোতে পেরিয়ে গেছে মানব সভ্যতার বাতাবরণে।

আচার্য ভরত ছিলেন মুখ্যত নাট্যশাস্ত্রকার, তাই তাঁর আলোচনার মূল বিষয় ছিল নাটক ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়।

তবে প্রসঙ্গক্রমে তিনি বাক্য, বাক্যবিন্যাস, বাক্যের দোষ, গুণ, অলঙ্কার, লক্ষণ ইত্যাদি এবং শৃঙ্গারাদি আট প্রকার রসের আলোচনাও করেছিলেন সেই গ্রন্থটিতে। আলোচনা, সমালোচনার প্রথম যাত্রাটি শুরু হয়েছিলো ঐ আঁকর গ্রন্থের আলো নিয়ে।

ভরতের পরে দণ্ডী তাঁর গ্রন্থে কাব্যের গুণ, ধর্ম ও প্রকারভেদের পাশাপাশি ছত্রিশটি অর্থালঙ্কারও উদাহরণসহ আলোচনা করেছেন।

দণ্ডীর মতে অলঙ্কারই হচ্ছে কাব্যের সৌন্দর্য-বিধায়ক ধর্ম।

দণ্ডীর পওে আচার্য বামন (৮০০-এর কাছাকাছি) তাঁর কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তি গ্রন্থে ‘উপমাকেই’ কবিতার প্রধান অলঙ্কার হিসেবে মেনে নিয়ে প্রসঙ্গত অন্যান্য অলঙ্কারের আলোচনা করেছিলেন।

এতো গেলো শাস্ত্রকারদের কথা। যারা কবিতার সৃষ্টিকর্তা তাঁরা কী ভাবেন কবিতা নিয়ে, কিংবা কী চোখে দেখেন এই অধরা শিল্পকে, কবিতাকে- সেটি একটু জেনে নিলে তবেই আশা করি, বায়বীয় এই আলোচনা মাটির তল খুঁজে পাবে সামান্য হলেও।

একসময় বলা হতো, মানুষ তার মনের ভেতরের যেকোনো ভাব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিগুলো যখন ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশ করে, তখনই সেটা হয়ে ওঠে কবিতা।

বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’

এবার না হয়, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সাহিত্যের দিকপাল কবিদের মুখ থেকে জানি, অসামান্য কিছু কথা।

কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘কবিতা হলো ‘পারফরমেন্স ইন ওয়ার্ডস’।

কবি এডগার এলান বলেছেন, ‘কবিতা হলো সৌন্দর্যের ছন্দোময় সৃষ্টি।’

কবি এলিয়ট বলেছেন, ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’

একজন ইংরেজ কবি বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্বে কবিতার মৃত্যু নেই’।

বাংলা ভাষার কবি সৈয়দ শামসুল হকের মতে, ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। সর্বোত্তম ভাবের সঙ্গে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে।

আমি মনে করি, নানা মাত্রায় কবিতাকে সংজ্ঞাবদ্ধ না করে বরং এক কথায় বলা যায়, ‘কবিতা ঈশ্বরের আত্মার সঙ্গীত’।

শুদ্ধ শিল্প হিসেবে পৃথিবীতে কবিতার আগমনও প্রথমে। সাহিত্যের সেই শুদ্ধতম অশ্রুপাত, যা মানব অন্তরকে অলৌকিক আনন্দ আস্বাদনে দলিত, মথিত, স্পন্দিত করে।

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার পক্ষে যা সম্ভব নয়।

প্রত্যেক কবি তার কবিতার মধ্যে অলৌকিক এক মায়ার জগত সৃষ্টি করেন। যা পাঠককে সম্মোহনের মতো ধরে রাখে এবং পাঠে বাধ্য করে।

এ কথা আমার নয়, কাব্য-জিজ্ঞাসু অলঙ্কার শাস্ত্রকারদের। হাজার হাজার বছর আগেই তারা কবিতার জগতকে এভাবে মহিমান্বিত করে গেছেন, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কেন এবং কীভাবে তা সম্পাদন করেন একজন কবি।

কবিতার শরীরে ও আত্মায় লাবণ্য জুড়ে দিয়ে কবি সৃষ্টি করেন অনাস্বাদিতপূর্ব এক মরমী চৈতন্যের রস-ব্যঞ্জনা।

সৃষ্টিশীল কাব্য-কৌশলের সেই তন্ময় মুহূর্তে কবিতায় যুক্ত হতে থাকে এক এক করে তার প্রধান উপাদানসমূহ-।

কবিচিত্তের অনায়াস লব্ধজ্ঞান, কল্পনা ও ভাবাবেগ থেকেই তা উৎসারিত হয়ে থাকে। এজন্যে ভালো কবিতা রচনার জন্যে কবির পঠন-পাঠনও জরুরি বলে মনে করেন সমালোচকবৃন্দ। কবিতার পাঠকদেরকেও বলেছেন, সহৃদয়হৃদয়সংবাদী হতে।

কবিতা সৃষ্টিতে কী কী প্রয়োজন? প্রধানত চারটি উপাদান হলেই একটি সার্থক কবিতা রচনা সম্ভব।

১। ভাব ২। ভাষা ৩। ছন্দ ৪। অলঙ্কার।

১। ভাব: প্রথমেই ভাবের কথা আসে এই জন্যে যে, মনে ভাব না এলে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, যিনি কবি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কবিতা লিখবে কেন?

ভাব বা বিষয়বস্তু বলতে কবির মনের ভাব বোঝালেও প্রাচীন আলঙ্কারিক শাস্ত্র অনুযায়ী কবিতার ভাব বা বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট করে দেয়া ছিলো সেই যুগে।

মানুষের মন তো একটা অন্ধকার জঙ্গল। শিক্ষার আলো দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, সেটুকু ছাড়া বাকিটুকু তো অন্ধকার। সেখানে ঠাঁইঅঠাঁই কত ভাবের উদয় হয়? সবই কি কবিতা লেখার বিষয়? নিশ্চয় নয়।

প্রধানত, প্রেমবোধ, আদর্শ কিংবা ধর্মীয় আদর্শকে বিষয়বস্তু করে কবিতা লেখা হতো প্রাচীন ও মধ্যযুগে। জাতীয় জীবনের বীরত্বপূর্ণ কোনো কাহিনি বা আদর্শ বীরের জয়গাথা কিংবা কোনো আদর্শের কথা প্রচারের জন্যে কবিতা রচনা করাই ছিলো রীতি।

কাজেই আমরা লক্ষ করি, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য সাহিত্য প্রধানত দেবতাদের মাহাত্ম্য ও গুণ-কীর্তন করেই রচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে মধ্যযুগের শেষে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলে পরিচিত ও বিখ্যাত সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তই প্রথম তুচ্ছ যে কোনো বিষয়কে কবিতার বিষয় করে তুলেছিলেন।

উদাহরণত, তাঁর ‘তপসে মাছ’ পাঠা, রসময় রসের ছাগল ও আনারস, এমনকি নারী শিক্ষা নিয়েও তিনি অনেক সার্থক রঙ্গব্যঙ্গকবিতা রচনা করেছেন। এই সমসূত্রে কবিতার ভাব বা বিষয়বস্তুর নির্দিষ্ট অর্গলটিও তিনি ভেঙে দিয়েছেন।

আধুনিক সময়ে যে কোনো বিষয়, কবিতার বিষয় হতে পারে, কবি যদি তা যথোচিতভাবে ফুটিয়ে তুলে বিষয়টিকে কবিতা করে তুলতে পারেন। তবেই তা সার্থক।

কবির জীবনবোধ ও কবিতার বিষয় হতে পারে, যেমন-

‘না থেকেও, থাকে যে, বাতাসে প্রীতি

সে বড় অসহ আত্মরতি!

স্মৃতির খননে বাড়ে নিজেরই ক্ষতি,

নতুনের কাছে পুরোনো যেন চিহ্নহীন যতি।’

কবিতায় এখনো প্রেমবোধ একটি আকর্ষণীয় ভাব বা বিষয়। শতলক্ষকোটি কবিতা রচনা হয়েছে প্রেম নিয়ে। যুগে যুগে তার প্যাটার্ন বদলেছে, কিন্তু কবির ব্যক্তি অনুভূতির ছায়াপাতে প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে নানা মাত্রিকতায়। যেমন রফিক আজাদের প্রেমের কবিতা হিসেবে ‘প্রতীক্ষা’, ‘ভালোবাসার সংজ্ঞা’, ‘তুমি : বিশ বছর আগে ও পরে’ তুমুল জনপ্রিয় কবিতা। কবির ভক্ত পাঠক ও আবৃত্তিকারদের মুখে মুখে ফিরছে তা আজো।

‘ভালোবাসা মানে দু’জনের পাগলামি,

পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;

ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,

বিরহ-বালুতে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি;’

মধ্যযুগের চতুর্দশ শতকের বাঙালি কবি বড়– চণ্ডীদাস যখন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের আখ্যানে কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রেমের আকূতিকে শব্দরূপ দেন, একইভাবে আমাদের হৃদয়কে তা আলোড়িত করে।

‘কে না বাঁশি বায়ে বড়ায়ি কালিনী নই কূলে

কে না বাঁশি বায়ে বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে

আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন

বাঁশির শব্দে মোঁ আইলাইলো রান্ধন’।

পরিশেষে, একথা বলতে চাই যে, যে কোনো বিষয় আজ কবিতার বিষয়। যে কোনো বিষয় বা ভাব নিয়ে কবিরা কবিতা লিখতে পারেন আজ অনায়াসে। তবে শর্ত একটাই- তা যেন কবিতা হয়ে ওঠে!

২। ভাষা: ভাষা কী? ভাষা মানুষের সংযোগ সেতু। মন থেকে মনে ভাব বিনিময়ের প্রধান বাহন এই মাতৃভাষা বাংলা। এই মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে আনতে গিয়ে আমাদের সূর্য সন্তানেরা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছেন। সৃষ্টি হয়েছে বাঙালির বীজমন্ত্র বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, সেই শক্তি নিয়ে গর্জে উঠেছে মহান একাত্তর। আমরা পেয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্র ও লাল-সবুজ পতাকা। কাজেই বাংলা ভাষা আমাদের দ্বিতীয় ঈশ্বর।

শস্যদানার মতো কবিতার প্রধান উপাদান ভাষা। অবশ্যই মাতৃভাষা কবিতা রচনার উত্তম মাধ্যম। বিশেষভাবে পলিকাদার সহজ, স্বাদু-মিষ্টি ও কাব্যিক ভাষা হিসেবে বাংলা চিরকালই বিশেষ স্থান দখল করে আছে। উপরন্তু বাংলার নিজস্ব শব্দ ছাড়াও ভূ-রাজনীতির কারণে আরবি-ফারসি-ইংরেজি, চাইনিজ-পুর্তগীজ, সংস্কৃতসহ বিভিন্ন ভাষা থেকে অভিবাসিত শব্দাবলী নিয়ে বাংলা ভাষার শব্দ-ভাণ্ডার আজ পরিপূর্ণ, অফুরন্ত।

কথায় আছে- যে কোনো ভাষায় ‘শব্দই ব্রহ্ম’।

অভিধানে শব্দ পড়ে থাকে মৃত মাছির মতো। একজন কবিই তার ব্যবহার গুণে শব্দে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। একমাত্র কবির হাতেই শব্দের সর্বোত্তম ব্যবহার হয়ে থাকে। কীভাবে? এর উত্তরে একটি মাত্র উদাহরণই যথেষ্ট।

মনে করুন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ‘খোঁড়াখুড়ি’ শব্দটির কথা। সাধারণত এই কেজো শব্দটি ব্যবহার করি, মাটি ও কবরখোঁড়া প্রসঙ্গে।

কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাশ যখন দীর্ঘ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সাজিয়ে তাঁর ‘হায় চিল’ কবিতায় বলেন,

‘পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে

গেছে রূপ নিয়ে দূরে;

আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’!

তখন এই খুঁড়ে শব্দটি হৃদয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে তার দৈনন্দিনতা এবং দীনতা পরিহার করে ভিন্ন এক অলৌকিক রস-ব্যঞ্জনায় বেজে ওঠে। শব্দটির মহিমা বেড়ে যায় হাজার গুণ। পাঠকের শ্রুতিতেও নতুন হাওয়া বয়ে যায়। হৃদয় নেচে ওঠে বিদ্যুৎ লতার মতো। তাই নয় কি?

যে কবি প্রতিটি শব্দের বুক থেকে তার গানকে এভাবেই মুক্ত করে দিয়ে তাতে নতুনতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তিনি পাঠকহৃদয়ে বেঁচে থাকেন।

৩। ছন্দ: ছন্দ কি এবং কেন, তা বলবার আগে একটু ভূমিকা দরকার অবশ্যই। যেহেতু বর্তমান সময়ে, বিশেষভাবে ফেসবুক যখন কবিতা চর্চার কেন্দ্রভূমিতে রয়েছে, সম্পাদক ও সম্পাদনাহীন কবিতা পাঠ করছি প্রতিদিন। সেখানে প্রধানত, নবীন কবিদের কবিতায় ছন্দর সবিশেষ পরিচয় খুব কমই খুঁজে পাই।

ছন্দ ছাড়াই যেহেতু কবিতা লেখা যায়, কাজেই কবিতার ব্যাপক জন্ম-বিস্ফোরণ লক্ষ করছে আমার মতো অনেকেই।

কবিতায় ছন্দের ব্যবহার অনেকটা শৌখিনতার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে অতীতের মতো ছন্দ বাধ্যতামূলক নয় বলে, অকবিতার বৃদ্ধিও ততোধিক বলেই মনে করি।

কাজেই একথা বলা যায় যে, একবিংশ শতাব্দীতে কবিতা ও ছন্দের সম্পর্ক নিঃসন্দেহে অতীতের মতো নেই। প্রাচীনযুগ মধ্যযুগ হয়ে রবীন্দ্রনাথের কাল পর্যন্ত কবিরা ছন্দহীন কবিতা রচনার কথা ভাবতেও পারেননি একটা পর্যায় পর্যন্ত। কবিতার শিল্প বিচারের ক্ষেত্রে আধার ও আধেয়ের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখা যায় কবিদের কেউ কেউ তাদের কবিতায় ভাব-রস-ব্যঞ্জনার চেয়ে আঙ্গিকের প্রতি যতœবান বেশি। অর্থাৎ ভাষা ও ছন্দের দিকে মনোযোগ অধিক। এই প্রসঙ্গে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথা বলা যায়, সমালোচকেরা যাকে কবির চেয়ে ছান্দসিক হিসেবে অধিক বিখ্যাত মনে করেন। এ রকম কবির সংখ্যা অতীতে অনেক ছিলো।

গোল বাঁধলো তিরিশের দশকের পঞ্চপাণ্ডব বলে খ্যাত কবিবৃন্দ নিয়ে।

এদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ মাত্র ৫৫ বছর বেঁচেছিলেন অপরদিকে পাঁচজনের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী প্রায় ৮৭ বছরের দীর্ঘজীবী কবি। এই পাঁচজন কবিই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং পরবর্তী সময়ে অধ্যাপনা করেছেন।

পত্রিকা সম্পাদনায় সিদ্ধহস্ত। কবিতার ইতিহাসে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা পত্রিকা’ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকা একটি মাইল ফলক। ধারাবাহিকভাবে পাঁচজন কবির জন্ম ও মৃত্যুর সময়কাল মনে রাখলে তাদের বুঝতে সহজহবে।

১। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৫), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৭), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)।

কবি বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস কবিতার দ্বারা গদ্যরাজ্য জয়ের ইতিহাস। কবিতার এই পঞ্চপাণ্ডব সম্পর্কে আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর এক নিবন্ধে বলেছিলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী, ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কবিতাকে এরা আধুনিক কবিতা হিসেবে দেখেছিলেন।’

কথা সত্য। এই পঞ্চের বিদ্রোহটি শুরু হয়েছিলো রবীন্দ্রবলয় ভেঙে বেরিয়ে এসে আলাদা ধরনের নতুন কবিতা রচনার তাগিদ থেকে। ইংরেজি সাহিত্য পঠন-পাঠনের ফলে ইতোমধ্যে তাঁরা জেনে গেছেন যে, ১৮৮০ সালে ইউরোপীয় সাহিত্যে গড়ে ওঠা ডাডাবাদ, স্যুররিয়ালিজমসহ কবিতা কেন্দ্রিক বিভিন্ন আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে। সর্বোপরি ইউরেপীয় সাহিত্যে তখন শার্লবোদলেয়ার এবং মালার্মের আবির্ভাব কালকে আধুনিকতার সূচনাকাল হিসেবে ইতোমধ্যে গুনা করতে শুরু করেছে পাশ্চাত্যসাহিত্যবোদ্ধারা।

এই সূত্রেই বাংলা ভাষার কবিরাও প্রথমে ছন্দের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বক্তব্যকে ঢালাওভাবে ছড়িয়ে দিলেন গদ্য ছন্দে। ভাবের প্রশ্নে, রাবীন্দ্রিক প্রেমের প্লেটোনিক সূত্রকে অগ্রাহ্য করে পুরাতন প্রেমের মন-অস্তিত্বকে অস্বীকার করে সেখানে রক্ত-মাংসের দেহজ-কামনা-বাসনা সম্বলিত প্রেমিকার জয় ঘোষণা করলেন। সেই প্রেমকে আবাহন করে গোবিন্দ চন্দ্র দাস প্রথম কবিতায় ঘোষণা দিলেন, ‘আমি তাকে ভালোবাসি অস্থি-মজ্জাসহ।’

পরে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অর্কেস্ট্রা কাব্যের ‘শাশ্বতী’ নামক কবিতায় বললেন নতুন কথা। কবিতাটির বক্তব্যে নতুনত্ব এনেছেন, তাই বলে ছন্দ কিন্তু তিনি এখানে পরিহার করেননি। ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত এ কবিতাটি প্রেমের উৎকৃষ্ট কবিতার উদাহরণ। এক বাদল শেষের রাতে কবির দয়িতা এসেছেন তার কাছে, সহসা তার হাতে হাত রেখে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘ভালোবাসি’। মুহূর্তেই যেন সরণীজুড়ে মাধুরি-মদিরায় দেহ ও মন তাদের এক ঘোর অমৃতলোকে জেগে ওঠে।

হাতের সামান্য ছোঁয়া আর দয়িতার মুখ-নিঃসৃত একটি মাত্র ৪ মাত্রার শব্দ ‘ভালোবাসি’ মহাকালের চিরচঞ্চল গতিকে থামিয়ে স্থির করে দিয়েছিলো সেদিনের সেই মুহূর্তে, এখানেই প্রেমের কবিতার সার্থকতা।

‘একদা এমন বাদল শেষের রাতে/ মনে হয় যেন শত জনমের আগে/ সে এসে সহসা, হাত রেখেছিলো হাতে/ চেয়েছিলো মুখে সহজিয়া অনুরাগে/ অনাদি যুগের যত চাওয়া যত পাওয়া/ খুঁজেছিলো তার আনত দিঠির মানে... / একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে / ভর করেছিলো সাতটি অমরাবতী / একটি নিমেষ দাঁড?ালো সরণী জুড়ে / থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।’

তবে, এই তিরিশের দশক থেকে গদ্যছন্দের কবিতায় সাড়া দেন কবিরাও।

প্রত্যেক যুগেই কবিকে পুরোনো ঐতিহ্য পেছনে ফেলে সন্ধান করতে হয় আধুনিকতার। সেই আধুনিকতা কবিতায় দেখা দেয় দুভাবে কবিতার ভাব বা বিষয়বস্তুতে এবং আঙ্গিকে অর্থাৎ ভাষায় ও ছন্দে। সবাই জানি, ছন্দ ভাষার অন্যতম প্রাণশক্তি। প্রকৃতিতে ছন্দের অসংখ্য উদাহরণ আছে। বাতাসের দোলা, নদীর ¯্রােত, পাতার দুলুনি ইত্যাদি। ছন্দ মূলত বাণী বিন্যাস কৌশল।

মানুষ যখন কথা বলে, তখন স্বাভাবিকভাবে এক ধরনের ছন্দ সে ব্যবহার করে। ছন্দ অর্থ ছাঁচ, গড়ন বা ভঙ্গি। উপযুক্ত ছন্দ কবিতাকে অর্থের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি দানে সহায়তা করে।

বিষয়ভেদে কবিতাতে নানা রকম ছন্দ প্রযুক্ত হয়। ভাবকে কথার অপূর্ব লীলা দিয়ে মূর্ত করে তোলা হয় কবিতায়, সেক্ষেত্রে ছন্দ কাজ করে অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো। ছন্দ কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।

প্রধানত, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত- এই তিন প্রকার ছন্দের কথাই বলতে চাই আমি। নানা প্রকার ছন্দ আছে, বিশেষভাবে পাঠে আগ্রহীরা তা পড়ে জেনে নেবেন। প্রাথমিকভাবে একজন নবীন কবিকে এটুকু জানলেই চলবে, তিনি যদি ছন্দে কবিতা নাও লিখতে চান তবু ছন্দ জানা থাকলে গদ্যছন্দেও তিনি কবিতার সৌন্দর্য বিন্যাস অনিবার্য করে তুলতে পারবেন অনায়াসে।

বাংলা ভাষার প্রাচীন ছন্দ হিসেবে পয়ার বা অক্ষরবৃত্তের নাম সকলেরই জানা। এই ছন্দ তো একদিনে সৃষ্টি হয়নি, তার পেছনে মজার ইতিহাস আছে।

বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির আগে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে প্রাচ্য সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দুটি মহাকাব্য। রামায়ন ওমহাভারত। এছাড়াও ভবভূতি, ভর্তৃহরি এবং কালিদাসের মতো বিখ্যাত সংস্কৃত ভাষার কবির মূল্যবান রচনা আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। কালিদাসের বিখ্যাত ‘মেঘদূত কাব্য’ সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় চমৎকার অনুবাদ করেছেন তিরিশের কবি বুদ্ধদেব বসু। রামায়ণ, মহাভারত মধ্যযুগেই বাংলায় অনূদিত হয়েছে মাত্র।

কথিত আছে যে, আদি কবি বাল্মীকি, সংস্কৃত ভাষায় তাঁর রচিত দুই পংক্তির শ্লোক হলো প্রথম কবিতা।

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমঃ অগমঃ শাশ্বতী সমাঃ

যত্ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদ একম্ অবধী কামমোহিতম”।

বাংলায় যার অর্থ, হে নিষাদ তুমি মিলনরত ক্রৌঞ্চ পাখির একটিকে বধ করেছো, কাজেই জগতে তুমি প্রতিষ্ঠা পাবে না। ক্রৌঞ্চবধের শোক থেকে উচ্চারণ করেছিলেন বলেই বাল্মীকি তার নাম দিয়েছিলেন শ্লোক।

এই বাল্মীকি সংস্কৃত ভাষায় প্রথম রামায়ণ রচনা করেছিলেন অনুষ্টুপ ছন্দে। বলা হয়ে থাকে যে, এই অনুষ্টুপ ছন্দই বাংলা ছন্দের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। বাংলা কাব্য ইতিহাসের দীর্ঘ অবলোকনে এ কথা বলা সঙ্গত যে, বাংলা ভাষার কবিদের আবেগ সমৃদ্ধ মৌলিক সৃষ্টিধর্মী চিন্তা ও কৌশল সব চেয়ে বেশি কাজ করেছে বাংলা ছন্দের ইতিহাস বিনির্মাণে। এজন্যে বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন ছন্দ হিসেবে ‘পয়ার’-এর স্বীকৃতি সর্বজনবিদিত।

পয়ার বলতে সাধারণ আট-ছয় পর্বের চৌদ্দ অক্ষরের পংক্তিবিশিষ্ট কবিতার ছন্দকে নির্দেশ করে।

মধ্যযুগের পয়ারের উদাহরণ:

মহাভারতের কথা/ অমৃত সমান। ৮+৬=১৪

কাশীরাম দাশ ভণে/ শুনে পুন্যবান।। ৮+৬=১৪

লক্ষণীয় যে, পয়ারের প্রত্যেক চরণ শেষে এক। দাঁড়ি, দ্বিতীয় চরণে দুই।। দাঁড়ি।

প্রত্যেক চরণেই আলাদা আলাদা বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে।

যে কারণে বক্তব্যের মধ্যে কোনো প্রবহমানতা নেই।

পয়ার অক্ষরবৃত্তের একটি শাখা।

পয়ার ছাড়াও অক্ষরবৃত্তের আরো শাখাসমূহ নানা নামে পরিচিত। আমি কিছু নাম উল্লেখ করেছি শুধু ছন্দের বৈচিত্র্য বোঝাতে।

যেমন, তরুল পয়ার, মালঝাঁপ পয়ার, মালতি, বিশাখ পয়ার, কুসুম মালিকা, মহাপয়ার, সমিল মহাপয়ার, অমিল মহাপয়ার, পর্যায়সম, মহাপয়ার, মধ্যাসম মহাপয়ার, একাবলী, দীর্ঘ একাবলী, মিশ্রছন্দ, ত্রিপদী ছন্দ, লঘু ত্রিপদী, দীর্গ ত্রিপদী, অসমপর্বিক, ত্রিপদী, চতুষ্পদী, লঘু চৌপদী, দীর্ঘ চৌপদী ও অমিত্রাক্ষর।

সর্বশেষ অমিত্রাক্ষর ছন্দে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর আধুনিক ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য বাংলা ভাষায় রচনা করেন। পয়ারে যেমন প্রত্যেক পংক্তি শেষে অন্ত্যমিল ছিলো, তিনি তা পরিহার করেছেন, এবং প্রত্যেক পংক্তি শেষে এক ও দুই দাঁড়ি তুলে দিয়েছেন। বক্তব্যের প্রবহমানতা সৃষ্টির জন্যে দাঁড়ি ছাড়াও অন্যান্য বিরতি চিহ্নের ব্যবহার করেছেন প্রয়োজন অনুসারে। ছন্দটিকে মহাকাব্যের বীররস তথা বক্তব্যের গুরুভার বহনের যোগ্য করে তুলেছেন তিনিই প্রথম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রামায়ণের কাহিনির নবরূপ দিয়ে তিনি নয় সর্গে মহাকাব্যটি শেষ করেছেন। প্রথম সর্গের নাম ‘অভিষেক’। নায়ক রাবণের পুত্র বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ দিয়ে কাব্যের শুরু হয়েছে এভাবে:

‘সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি

বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে

অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,

কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,

পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি

রাঘবারি?’

এখানে বক্তব্যের প্রবহমানতা গড়িয়ে গড়িয়ে পাঁচ চরণে এসে শেষ হয়েছে। এটাই অমিত্রাক্ষর ছন্দের নতুনত্ব এবং পয়ার থেকে ভিন্ন হয়ে উঠেছে।

মাইকেল মধুসূদনের পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ছন্দের রূপ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত- তিন প্রকার ছন্দেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন। বিশেষভাবে মাত্রাবৃত্ত রচনায় স্বকীয়তা অভাবনীয়। মানসী কাব্যে মাত্রাবৃত্তের সফল প্রয়োগ লক্ষণীয়। নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতাটিরশুরু এভাবে:

আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে ৬+৬

হে সুন্দরী ৫

বলো, কোন্ পার ভিড়িবে তোমার ৬+৬

সোনার তরী। ৫

তেমনি ক্ষণিকা কাব্যে স্বরবৃত্তের মতো লঘু ছন্দে যে গুরুভার বক্তব্য প্রকাশ করা যায়, সেটিও প্রমাণ করেছেন।

চমকে দিয়েছেন পাঠককে।

নীলেরকোলে/শ্যামল সে দ্বীপ/প্রবাল দিয়ে/ঘেরা ৪+৪+৪+২

শৈল চূড়ায়/নীড় বেঁধেছে/সাগর বিহঙ/গেরা ৪+৪+৪+২

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বভাবগত কারণেই অক্ষরবৃত্তের তুলনায় স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অগ্নিবীণাকাব্যসহ অনেক গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে নতুন এক ধরনের ঝোঁক বা শ্বাসাঘাত তৈরির চেষ্টা করেছেন। তাঁর রচিত রণসঙ্গীত লক্ষণীয়,

চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে ৬+৬

বাজে মাদল ৫

নিম্নে উতলা ধরণীরতল ৬+৬

চলরে চল। ৫

মম/ এক হাতে বাঁকা/ বাঁশের বাঁশরী ২+৬+৬

আর হাতে রণ/তূর্য ৬+৩

‘মম’ শব্দটি দুই মাত্রার অতি পর্ব যা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে চরণের প্রথমে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় চরণে ৬ মাত্রার পূর্ণ পর্ব একটি এবং চরণ শেষে ৩ মাত্রার একটি অপূর্ণ পর্ব রয়েছে। অক্ষরবৃত্তের সর্বশেষ একটি ধারা গদ্যছন্দ।

গদ্যছন্দ (Prose Verse) : আধুনিক কালে কবিতায় গদ্যছন্দ ব্যবহার করা হয় বক্তব্যের প্রয়োজনে।

অনেকের ধারণা আধুনিক কবিতায় কোনো ছন্দ নেই। তাদের ধারণা, ছন্দ মানে অন্ত্যমিল। গদ্যছন্দের ক্ষেত্রে গদ্যভাষার ছন্দ, সুষমাকে ব্যবহার করা হয়। যাকে বলা চলে ছন্দস্পন্দ। এই ছন্দ অস্ফুট।

গদ্য ছন্দে পদ্য ছন্দের মতো যতির দ্বারা চরণ বা পংক্তি পর্বে বিভক্তি হয় না। উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ কাব্যের ক্যামেলিয়া কবিতাটির কথা ধরা যাক।

‘নাম তার কমলা।

দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা-

সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।

আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে’।

(ক্যামেলিয়া)

প্রবহমান পয়ার:

যে কবিতায় অন্ত্যমিল ঠিক রেখে পংক্তিগুলোর প্রবহমানতা বিদ্যমান থাকে, তা প্রবহমান সমিল পয়ার!

উদাহরণ:

“হে দারিদ্র্য তুমি মোরে/ করেছ মহান/ তুমি মোরে দানিয়েছ/ খ্রিস্টের সম্মান।/ কণ্টক-মুকুট শোভ!/-দিয়াছ, তাপস / অসঙ্কোচ প্রকাশের/ দুরন্ত সাহস:” (দারিদ্র্য / কাজী নজরুল ইসলাম)

নদী যেমন তটের শাসন মেনে চলে, অন্যথায় প্লাবিত করে জনপদ, ঘরদোর অনেক কিছু। কবির আবেগও যদি ছন্দের শৃঙ্খলা বা সামান্য শাসন মেনে প্রবাহিত হয়, তবে তা সহজেই কবিতা হয়ে ওঠে। অন্যথায় অন্ধ আবেগের উদ্গীরণে তা হয়ে ওঠে ভাবোচ্ছ্বাসবা ভাবালু কথকতা।

৪। অলঙ্কার: সংস্কৃত ‘অলম’ শব্দ থেকে অলঙ্কার শব্দটি এসেছে। যার অর্থ ভূষণ। নবম শতকের শেষদিকে কাব্য-জিজ্ঞাসার সমসূত্রে অলঙ্কার একটি বিশিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বাংলা অলঙ্কার শাস্ত্র মূলত সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রেরই যমজ।

নারীদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে মেয়েরা যেমন নানা অঙ্গে বিভিন্ন ডিজাইনের অলঙ্কার ধারণ করে, কাব্যদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যেও সৃষ্টি হয়েছে কাব্যালঙ্কার। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, যেগুণ দ্বরা ভাষার শক্তিবর্ধন ও সৌন্দর্য সম্পাদন হয়, তাকে অলঙ্কার বলে। অলঙ্কার প্রধানত, দুই প্রকার।

১। শব্দালঙ্কার: শব্দালঙ্কারের লক্ষ কবিতায় ব্যবহৃত শব্দে ধ্বনিমাধুর্য ও শ্রুতিসুষমা সৃষ্টি করা। বিভিন্ন রকমের শব্দালঙ্কারের মধ্যে প্রধানত, অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি, ধ্বনুক্তি ইত্যাদি।

অনুপ্রাসের একটি উদাহরণ:

‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নেশা’

‘র’ বর্ণটি পর পর চারবার উচ্চারিত হওয়ার ফলে যে ধ্বনিসুষমা ও সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে, এ কারণে অনুপ্রাস অলঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে এখানে।

২। অর্থালঙ্কার: যে অলঙ্কার শব্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অর্থের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে, তাকে অর্থালঙ্কার বলে। অর্থালঙ্কারের যথোচিত প্রয়োগের ফলে বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে।

অর্থালঙ্কার পাঁচ প্রকার। যথা- ১. সাদৃশ্যমূলক, ২. বিরোধমূলক, ৩. শৃঙ্খলামূলক, ৪. ন্যায়মূলক, ৫. গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক।

এই পঞ্চমের অধীনে উল্লেখযোগ্য অলঙ্কারসমূহ যথাক্রমে, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, সন্দেহ, বিরোধাভাস, ব্যাজস্তুতি অন্যতম।

উপমা: দুই বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে যখন তুলনা করা হয় তখন, উপমা অলঙ্কার সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ:

‘মেয়েটি লতার মতো দিন দিন বাড়িয়া উঠিতেছে’ কিংবা: ‘কচি কলপাতা সন্ধ্যা’।

এখানে লতা ও মেয়ে দুটি বিজাতীয় পদার্থ, কিন্তু দুজনের বেড়ে ওঠার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। এজন্যে এটি উপমা অলঙ্কারের উদাহরণ। একইভাবে কচিকলাপাতা এবং সন্ধ্যা দুটি বিজাতীয় পদার্থ কিন্তু সন্ধ্যা ও কচিকলাপাতার রঙের মধ্যে বিশেষ সাদৃশ্য রয়েছে।

চিত্রকল্পের উদাহরণ:

‘নদীর ওপারে বন ছুঁয়ে চাঁদ উঠে এলো/ নটীর মতন নিটল চোখের নিচে কালি।’ এখানে চাঁদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে একজন নৃত্যশিল্পীর বা নটিনীর বেদনাদীর্ণ জীবনধারাকে। কাজেই এখানে উপমা ছাড়াও সৃষ্টি হয়েছে একটি সার্থক চিত্রকল্প।

অনেক কাব্য সমালোচক বলেন, চিত্রকল্পই কবিতা। একটি সার্থক চিত্রকল্প রচনা করা সত্যি খুব দুরূহ কাজ, তবে তা মহৎ কাব্যশক্তির পরিচায়কও বটে।

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১ , ৭ মাঘ ১৪২৭, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

কবিতার উপায় ও উপকরণ

দিলারা হাফিজ

image

শিল্পী : সমর মজুমদার

হাজার হাজার বছর কেটে গেলো, তবু যার মীমাংসা এলো না, তাহলো কবিতা শিল্প। কবিতার জন্মমুহূর্ত থেকে স্বয়ং কবি, দার্শনিক, সমালোচক, সাহিত্যের শাস্ত্রকারদের একটিই প্রশ্ন, কবিতা আসলে কী?

কবি, কীভাবে সৃষ্টি করেন তাঁর কাব্যশিল্পের মায়া-হরিণ।

শতভাগ, মীমাংসাহীন এই প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা আলো প্রথম জ্বালিয়েছিলেন আচার্য ভরত, তাঁর বিখ্যাত নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে। অলঙ্কারশাস্ত্রের ইতিহাসে এ যাবৎ প্রাপ্ত প্রাচীনতম গ্রন্থ হচ্ছে ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’ নামের এই গ্রন্থটি। ভাবা যায়! গ্রন্থটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

ভাবুন তো, সে কত কত সময়ের স্রোতে পেরিয়ে গেছে মানব সভ্যতার বাতাবরণে।

আচার্য ভরত ছিলেন মুখ্যত নাট্যশাস্ত্রকার, তাই তাঁর আলোচনার মূল বিষয় ছিল নাটক ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়।

তবে প্রসঙ্গক্রমে তিনি বাক্য, বাক্যবিন্যাস, বাক্যের দোষ, গুণ, অলঙ্কার, লক্ষণ ইত্যাদি এবং শৃঙ্গারাদি আট প্রকার রসের আলোচনাও করেছিলেন সেই গ্রন্থটিতে। আলোচনা, সমালোচনার প্রথম যাত্রাটি শুরু হয়েছিলো ঐ আঁকর গ্রন্থের আলো নিয়ে।

ভরতের পরে দণ্ডী তাঁর গ্রন্থে কাব্যের গুণ, ধর্ম ও প্রকারভেদের পাশাপাশি ছত্রিশটি অর্থালঙ্কারও উদাহরণসহ আলোচনা করেছেন।

দণ্ডীর মতে অলঙ্কারই হচ্ছে কাব্যের সৌন্দর্য-বিধায়ক ধর্ম।

দণ্ডীর পওে আচার্য বামন (৮০০-এর কাছাকাছি) তাঁর কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তি গ্রন্থে ‘উপমাকেই’ কবিতার প্রধান অলঙ্কার হিসেবে মেনে নিয়ে প্রসঙ্গত অন্যান্য অলঙ্কারের আলোচনা করেছিলেন।

এতো গেলো শাস্ত্রকারদের কথা। যারা কবিতার সৃষ্টিকর্তা তাঁরা কী ভাবেন কবিতা নিয়ে, কিংবা কী চোখে দেখেন এই অধরা শিল্পকে, কবিতাকে- সেটি একটু জেনে নিলে তবেই আশা করি, বায়বীয় এই আলোচনা মাটির তল খুঁজে পাবে সামান্য হলেও।

একসময় বলা হতো, মানুষ তার মনের ভেতরের যেকোনো ভাব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিগুলো যখন ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশ করে, তখনই সেটা হয়ে ওঠে কবিতা।

বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’

এবার না হয়, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সাহিত্যের দিকপাল কবিদের মুখ থেকে জানি, অসামান্য কিছু কথা।

কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘কবিতা হলো ‘পারফরমেন্স ইন ওয়ার্ডস’।

কবি এডগার এলান বলেছেন, ‘কবিতা হলো সৌন্দর্যের ছন্দোময় সৃষ্টি।’

কবি এলিয়ট বলেছেন, ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’

একজন ইংরেজ কবি বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্বে কবিতার মৃত্যু নেই’।

বাংলা ভাষার কবি সৈয়দ শামসুল হকের মতে, ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। সর্বোত্তম ভাবের সঙ্গে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে।

আমি মনে করি, নানা মাত্রায় কবিতাকে সংজ্ঞাবদ্ধ না করে বরং এক কথায় বলা যায়, ‘কবিতা ঈশ্বরের আত্মার সঙ্গীত’।

শুদ্ধ শিল্প হিসেবে পৃথিবীতে কবিতার আগমনও প্রথমে। সাহিত্যের সেই শুদ্ধতম অশ্রুপাত, যা মানব অন্তরকে অলৌকিক আনন্দ আস্বাদনে দলিত, মথিত, স্পন্দিত করে।

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার পক্ষে যা সম্ভব নয়।

প্রত্যেক কবি তার কবিতার মধ্যে অলৌকিক এক মায়ার জগত সৃষ্টি করেন। যা পাঠককে সম্মোহনের মতো ধরে রাখে এবং পাঠে বাধ্য করে।

এ কথা আমার নয়, কাব্য-জিজ্ঞাসু অলঙ্কার শাস্ত্রকারদের। হাজার হাজার বছর আগেই তারা কবিতার জগতকে এভাবে মহিমান্বিত করে গেছেন, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কেন এবং কীভাবে তা সম্পাদন করেন একজন কবি।

কবিতার শরীরে ও আত্মায় লাবণ্য জুড়ে দিয়ে কবি সৃষ্টি করেন অনাস্বাদিতপূর্ব এক মরমী চৈতন্যের রস-ব্যঞ্জনা।

সৃষ্টিশীল কাব্য-কৌশলের সেই তন্ময় মুহূর্তে কবিতায় যুক্ত হতে থাকে এক এক করে তার প্রধান উপাদানসমূহ-।

কবিচিত্তের অনায়াস লব্ধজ্ঞান, কল্পনা ও ভাবাবেগ থেকেই তা উৎসারিত হয়ে থাকে। এজন্যে ভালো কবিতা রচনার জন্যে কবির পঠন-পাঠনও জরুরি বলে মনে করেন সমালোচকবৃন্দ। কবিতার পাঠকদেরকেও বলেছেন, সহৃদয়হৃদয়সংবাদী হতে।

কবিতা সৃষ্টিতে কী কী প্রয়োজন? প্রধানত চারটি উপাদান হলেই একটি সার্থক কবিতা রচনা সম্ভব।

১। ভাব ২। ভাষা ৩। ছন্দ ৪। অলঙ্কার।

১। ভাব: প্রথমেই ভাবের কথা আসে এই জন্যে যে, মনে ভাব না এলে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, যিনি কবি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কবিতা লিখবে কেন?

ভাব বা বিষয়বস্তু বলতে কবির মনের ভাব বোঝালেও প্রাচীন আলঙ্কারিক শাস্ত্র অনুযায়ী কবিতার ভাব বা বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট করে দেয়া ছিলো সেই যুগে।

মানুষের মন তো একটা অন্ধকার জঙ্গল। শিক্ষার আলো দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, সেটুকু ছাড়া বাকিটুকু তো অন্ধকার। সেখানে ঠাঁইঅঠাঁই কত ভাবের উদয় হয়? সবই কি কবিতা লেখার বিষয়? নিশ্চয় নয়।

প্রধানত, প্রেমবোধ, আদর্শ কিংবা ধর্মীয় আদর্শকে বিষয়বস্তু করে কবিতা লেখা হতো প্রাচীন ও মধ্যযুগে। জাতীয় জীবনের বীরত্বপূর্ণ কোনো কাহিনি বা আদর্শ বীরের জয়গাথা কিংবা কোনো আদর্শের কথা প্রচারের জন্যে কবিতা রচনা করাই ছিলো রীতি।

কাজেই আমরা লক্ষ করি, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য সাহিত্য প্রধানত দেবতাদের মাহাত্ম্য ও গুণ-কীর্তন করেই রচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে মধ্যযুগের শেষে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলে পরিচিত ও বিখ্যাত সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তই প্রথম তুচ্ছ যে কোনো বিষয়কে কবিতার বিষয় করে তুলেছিলেন।

উদাহরণত, তাঁর ‘তপসে মাছ’ পাঠা, রসময় রসের ছাগল ও আনারস, এমনকি নারী শিক্ষা নিয়েও তিনি অনেক সার্থক রঙ্গব্যঙ্গকবিতা রচনা করেছেন। এই সমসূত্রে কবিতার ভাব বা বিষয়বস্তুর নির্দিষ্ট অর্গলটিও তিনি ভেঙে দিয়েছেন।

আধুনিক সময়ে যে কোনো বিষয়, কবিতার বিষয় হতে পারে, কবি যদি তা যথোচিতভাবে ফুটিয়ে তুলে বিষয়টিকে কবিতা করে তুলতে পারেন। তবেই তা সার্থক।

কবির জীবনবোধ ও কবিতার বিষয় হতে পারে, যেমন-

‘না থেকেও, থাকে যে, বাতাসে প্রীতি

সে বড় অসহ আত্মরতি!

স্মৃতির খননে বাড়ে নিজেরই ক্ষতি,

নতুনের কাছে পুরোনো যেন চিহ্নহীন যতি।’

কবিতায় এখনো প্রেমবোধ একটি আকর্ষণীয় ভাব বা বিষয়। শতলক্ষকোটি কবিতা রচনা হয়েছে প্রেম নিয়ে। যুগে যুগে তার প্যাটার্ন বদলেছে, কিন্তু কবির ব্যক্তি অনুভূতির ছায়াপাতে প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে নানা মাত্রিকতায়। যেমন রফিক আজাদের প্রেমের কবিতা হিসেবে ‘প্রতীক্ষা’, ‘ভালোবাসার সংজ্ঞা’, ‘তুমি : বিশ বছর আগে ও পরে’ তুমুল জনপ্রিয় কবিতা। কবির ভক্ত পাঠক ও আবৃত্তিকারদের মুখে মুখে ফিরছে তা আজো।

‘ভালোবাসা মানে দু’জনের পাগলামি,

পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;

ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,

বিরহ-বালুতে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি;’

মধ্যযুগের চতুর্দশ শতকের বাঙালি কবি বড়– চণ্ডীদাস যখন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের আখ্যানে কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রেমের আকূতিকে শব্দরূপ দেন, একইভাবে আমাদের হৃদয়কে তা আলোড়িত করে।

‘কে না বাঁশি বায়ে বড়ায়ি কালিনী নই কূলে

কে না বাঁশি বায়ে বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে

আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন

বাঁশির শব্দে মোঁ আইলাইলো রান্ধন’।

পরিশেষে, একথা বলতে চাই যে, যে কোনো বিষয় আজ কবিতার বিষয়। যে কোনো বিষয় বা ভাব নিয়ে কবিরা কবিতা লিখতে পারেন আজ অনায়াসে। তবে শর্ত একটাই- তা যেন কবিতা হয়ে ওঠে!

২। ভাষা: ভাষা কী? ভাষা মানুষের সংযোগ সেতু। মন থেকে মনে ভাব বিনিময়ের প্রধান বাহন এই মাতৃভাষা বাংলা। এই মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে আনতে গিয়ে আমাদের সূর্য সন্তানেরা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছেন। সৃষ্টি হয়েছে বাঙালির বীজমন্ত্র বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, সেই শক্তি নিয়ে গর্জে উঠেছে মহান একাত্তর। আমরা পেয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্র ও লাল-সবুজ পতাকা। কাজেই বাংলা ভাষা আমাদের দ্বিতীয় ঈশ্বর।

শস্যদানার মতো কবিতার প্রধান উপাদান ভাষা। অবশ্যই মাতৃভাষা কবিতা রচনার উত্তম মাধ্যম। বিশেষভাবে পলিকাদার সহজ, স্বাদু-মিষ্টি ও কাব্যিক ভাষা হিসেবে বাংলা চিরকালই বিশেষ স্থান দখল করে আছে। উপরন্তু বাংলার নিজস্ব শব্দ ছাড়াও ভূ-রাজনীতির কারণে আরবি-ফারসি-ইংরেজি, চাইনিজ-পুর্তগীজ, সংস্কৃতসহ বিভিন্ন ভাষা থেকে অভিবাসিত শব্দাবলী নিয়ে বাংলা ভাষার শব্দ-ভাণ্ডার আজ পরিপূর্ণ, অফুরন্ত।

কথায় আছে- যে কোনো ভাষায় ‘শব্দই ব্রহ্ম’।

অভিধানে শব্দ পড়ে থাকে মৃত মাছির মতো। একজন কবিই তার ব্যবহার গুণে শব্দে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। একমাত্র কবির হাতেই শব্দের সর্বোত্তম ব্যবহার হয়ে থাকে। কীভাবে? এর উত্তরে একটি মাত্র উদাহরণই যথেষ্ট।

মনে করুন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ‘খোঁড়াখুড়ি’ শব্দটির কথা। সাধারণত এই কেজো শব্দটি ব্যবহার করি, মাটি ও কবরখোঁড়া প্রসঙ্গে।

কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাশ যখন দীর্ঘ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সাজিয়ে তাঁর ‘হায় চিল’ কবিতায় বলেন,

‘পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে

গেছে রূপ নিয়ে দূরে;

আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’!

তখন এই খুঁড়ে শব্দটি হৃদয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে তার দৈনন্দিনতা এবং দীনতা পরিহার করে ভিন্ন এক অলৌকিক রস-ব্যঞ্জনায় বেজে ওঠে। শব্দটির মহিমা বেড়ে যায় হাজার গুণ। পাঠকের শ্রুতিতেও নতুন হাওয়া বয়ে যায়। হৃদয় নেচে ওঠে বিদ্যুৎ লতার মতো। তাই নয় কি?

যে কবি প্রতিটি শব্দের বুক থেকে তার গানকে এভাবেই মুক্ত করে দিয়ে তাতে নতুনতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তিনি পাঠকহৃদয়ে বেঁচে থাকেন।

৩। ছন্দ: ছন্দ কি এবং কেন, তা বলবার আগে একটু ভূমিকা দরকার অবশ্যই। যেহেতু বর্তমান সময়ে, বিশেষভাবে ফেসবুক যখন কবিতা চর্চার কেন্দ্রভূমিতে রয়েছে, সম্পাদক ও সম্পাদনাহীন কবিতা পাঠ করছি প্রতিদিন। সেখানে প্রধানত, নবীন কবিদের কবিতায় ছন্দর সবিশেষ পরিচয় খুব কমই খুঁজে পাই।

ছন্দ ছাড়াই যেহেতু কবিতা লেখা যায়, কাজেই কবিতার ব্যাপক জন্ম-বিস্ফোরণ লক্ষ করছে আমার মতো অনেকেই।

কবিতায় ছন্দের ব্যবহার অনেকটা শৌখিনতার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে অতীতের মতো ছন্দ বাধ্যতামূলক নয় বলে, অকবিতার বৃদ্ধিও ততোধিক বলেই মনে করি।

কাজেই একথা বলা যায় যে, একবিংশ শতাব্দীতে কবিতা ও ছন্দের সম্পর্ক নিঃসন্দেহে অতীতের মতো নেই। প্রাচীনযুগ মধ্যযুগ হয়ে রবীন্দ্রনাথের কাল পর্যন্ত কবিরা ছন্দহীন কবিতা রচনার কথা ভাবতেও পারেননি একটা পর্যায় পর্যন্ত। কবিতার শিল্প বিচারের ক্ষেত্রে আধার ও আধেয়ের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখা যায় কবিদের কেউ কেউ তাদের কবিতায় ভাব-রস-ব্যঞ্জনার চেয়ে আঙ্গিকের প্রতি যতœবান বেশি। অর্থাৎ ভাষা ও ছন্দের দিকে মনোযোগ অধিক। এই প্রসঙ্গে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথা বলা যায়, সমালোচকেরা যাকে কবির চেয়ে ছান্দসিক হিসেবে অধিক বিখ্যাত মনে করেন। এ রকম কবির সংখ্যা অতীতে অনেক ছিলো।

গোল বাঁধলো তিরিশের দশকের পঞ্চপাণ্ডব বলে খ্যাত কবিবৃন্দ নিয়ে।

এদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ মাত্র ৫৫ বছর বেঁচেছিলেন অপরদিকে পাঁচজনের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী প্রায় ৮৭ বছরের দীর্ঘজীবী কবি। এই পাঁচজন কবিই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং পরবর্তী সময়ে অধ্যাপনা করেছেন।

পত্রিকা সম্পাদনায় সিদ্ধহস্ত। কবিতার ইতিহাসে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা পত্রিকা’ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকা একটি মাইল ফলক। ধারাবাহিকভাবে পাঁচজন কবির জন্ম ও মৃত্যুর সময়কাল মনে রাখলে তাদের বুঝতে সহজহবে।

১। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৫), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৭), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)।

কবি বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস কবিতার দ্বারা গদ্যরাজ্য জয়ের ইতিহাস। কবিতার এই পঞ্চপাণ্ডব সম্পর্কে আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর এক নিবন্ধে বলেছিলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী, ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কবিতাকে এরা আধুনিক কবিতা হিসেবে দেখেছিলেন।’

কথা সত্য। এই পঞ্চের বিদ্রোহটি শুরু হয়েছিলো রবীন্দ্রবলয় ভেঙে বেরিয়ে এসে আলাদা ধরনের নতুন কবিতা রচনার তাগিদ থেকে। ইংরেজি সাহিত্য পঠন-পাঠনের ফলে ইতোমধ্যে তাঁরা জেনে গেছেন যে, ১৮৮০ সালে ইউরোপীয় সাহিত্যে গড়ে ওঠা ডাডাবাদ, স্যুররিয়ালিজমসহ কবিতা কেন্দ্রিক বিভিন্ন আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে। সর্বোপরি ইউরেপীয় সাহিত্যে তখন শার্লবোদলেয়ার এবং মালার্মের আবির্ভাব কালকে আধুনিকতার সূচনাকাল হিসেবে ইতোমধ্যে গুনা করতে শুরু করেছে পাশ্চাত্যসাহিত্যবোদ্ধারা।

এই সূত্রেই বাংলা ভাষার কবিরাও প্রথমে ছন্দের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বক্তব্যকে ঢালাওভাবে ছড়িয়ে দিলেন গদ্য ছন্দে। ভাবের প্রশ্নে, রাবীন্দ্রিক প্রেমের প্লেটোনিক সূত্রকে অগ্রাহ্য করে পুরাতন প্রেমের মন-অস্তিত্বকে অস্বীকার করে সেখানে রক্ত-মাংসের দেহজ-কামনা-বাসনা সম্বলিত প্রেমিকার জয় ঘোষণা করলেন। সেই প্রেমকে আবাহন করে গোবিন্দ চন্দ্র দাস প্রথম কবিতায় ঘোষণা দিলেন, ‘আমি তাকে ভালোবাসি অস্থি-মজ্জাসহ।’

পরে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অর্কেস্ট্রা কাব্যের ‘শাশ্বতী’ নামক কবিতায় বললেন নতুন কথা। কবিতাটির বক্তব্যে নতুনত্ব এনেছেন, তাই বলে ছন্দ কিন্তু তিনি এখানে পরিহার করেননি। ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত এ কবিতাটি প্রেমের উৎকৃষ্ট কবিতার উদাহরণ। এক বাদল শেষের রাতে কবির দয়িতা এসেছেন তার কাছে, সহসা তার হাতে হাত রেখে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘ভালোবাসি’। মুহূর্তেই যেন সরণীজুড়ে মাধুরি-মদিরায় দেহ ও মন তাদের এক ঘোর অমৃতলোকে জেগে ওঠে।

হাতের সামান্য ছোঁয়া আর দয়িতার মুখ-নিঃসৃত একটি মাত্র ৪ মাত্রার শব্দ ‘ভালোবাসি’ মহাকালের চিরচঞ্চল গতিকে থামিয়ে স্থির করে দিয়েছিলো সেদিনের সেই মুহূর্তে, এখানেই প্রেমের কবিতার সার্থকতা।

‘একদা এমন বাদল শেষের রাতে/ মনে হয় যেন শত জনমের আগে/ সে এসে সহসা, হাত রেখেছিলো হাতে/ চেয়েছিলো মুখে সহজিয়া অনুরাগে/ অনাদি যুগের যত চাওয়া যত পাওয়া/ খুঁজেছিলো তার আনত দিঠির মানে... / একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে / ভর করেছিলো সাতটি অমরাবতী / একটি নিমেষ দাঁড?ালো সরণী জুড়ে / থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।’

তবে, এই তিরিশের দশক থেকে গদ্যছন্দের কবিতায় সাড়া দেন কবিরাও।

প্রত্যেক যুগেই কবিকে পুরোনো ঐতিহ্য পেছনে ফেলে সন্ধান করতে হয় আধুনিকতার। সেই আধুনিকতা কবিতায় দেখা দেয় দুভাবে কবিতার ভাব বা বিষয়বস্তুতে এবং আঙ্গিকে অর্থাৎ ভাষায় ও ছন্দে। সবাই জানি, ছন্দ ভাষার অন্যতম প্রাণশক্তি। প্রকৃতিতে ছন্দের অসংখ্য উদাহরণ আছে। বাতাসের দোলা, নদীর ¯্রােত, পাতার দুলুনি ইত্যাদি। ছন্দ মূলত বাণী বিন্যাস কৌশল।

মানুষ যখন কথা বলে, তখন স্বাভাবিকভাবে এক ধরনের ছন্দ সে ব্যবহার করে। ছন্দ অর্থ ছাঁচ, গড়ন বা ভঙ্গি। উপযুক্ত ছন্দ কবিতাকে অর্থের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি দানে সহায়তা করে।

বিষয়ভেদে কবিতাতে নানা রকম ছন্দ প্রযুক্ত হয়। ভাবকে কথার অপূর্ব লীলা দিয়ে মূর্ত করে তোলা হয় কবিতায়, সেক্ষেত্রে ছন্দ কাজ করে অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো। ছন্দ কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।

প্রধানত, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত- এই তিন প্রকার ছন্দের কথাই বলতে চাই আমি। নানা প্রকার ছন্দ আছে, বিশেষভাবে পাঠে আগ্রহীরা তা পড়ে জেনে নেবেন। প্রাথমিকভাবে একজন নবীন কবিকে এটুকু জানলেই চলবে, তিনি যদি ছন্দে কবিতা নাও লিখতে চান তবু ছন্দ জানা থাকলে গদ্যছন্দেও তিনি কবিতার সৌন্দর্য বিন্যাস অনিবার্য করে তুলতে পারবেন অনায়াসে।

বাংলা ভাষার প্রাচীন ছন্দ হিসেবে পয়ার বা অক্ষরবৃত্তের নাম সকলেরই জানা। এই ছন্দ তো একদিনে সৃষ্টি হয়নি, তার পেছনে মজার ইতিহাস আছে।

বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির আগে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে প্রাচ্য সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দুটি মহাকাব্য। রামায়ন ওমহাভারত। এছাড়াও ভবভূতি, ভর্তৃহরি এবং কালিদাসের মতো বিখ্যাত সংস্কৃত ভাষার কবির মূল্যবান রচনা আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। কালিদাসের বিখ্যাত ‘মেঘদূত কাব্য’ সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় চমৎকার অনুবাদ করেছেন তিরিশের কবি বুদ্ধদেব বসু। রামায়ণ, মহাভারত মধ্যযুগেই বাংলায় অনূদিত হয়েছে মাত্র।

কথিত আছে যে, আদি কবি বাল্মীকি, সংস্কৃত ভাষায় তাঁর রচিত দুই পংক্তির শ্লোক হলো প্রথম কবিতা।

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমঃ অগমঃ শাশ্বতী সমাঃ

যত্ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদ একম্ অবধী কামমোহিতম”।

বাংলায় যার অর্থ, হে নিষাদ তুমি মিলনরত ক্রৌঞ্চ পাখির একটিকে বধ করেছো, কাজেই জগতে তুমি প্রতিষ্ঠা পাবে না। ক্রৌঞ্চবধের শোক থেকে উচ্চারণ করেছিলেন বলেই বাল্মীকি তার নাম দিয়েছিলেন শ্লোক।

এই বাল্মীকি সংস্কৃত ভাষায় প্রথম রামায়ণ রচনা করেছিলেন অনুষ্টুপ ছন্দে। বলা হয়ে থাকে যে, এই অনুষ্টুপ ছন্দই বাংলা ছন্দের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। বাংলা কাব্য ইতিহাসের দীর্ঘ অবলোকনে এ কথা বলা সঙ্গত যে, বাংলা ভাষার কবিদের আবেগ সমৃদ্ধ মৌলিক সৃষ্টিধর্মী চিন্তা ও কৌশল সব চেয়ে বেশি কাজ করেছে বাংলা ছন্দের ইতিহাস বিনির্মাণে। এজন্যে বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন ছন্দ হিসেবে ‘পয়ার’-এর স্বীকৃতি সর্বজনবিদিত।

পয়ার বলতে সাধারণ আট-ছয় পর্বের চৌদ্দ অক্ষরের পংক্তিবিশিষ্ট কবিতার ছন্দকে নির্দেশ করে।

মধ্যযুগের পয়ারের উদাহরণ:

মহাভারতের কথা/ অমৃত সমান। ৮+৬=১৪

কাশীরাম দাশ ভণে/ শুনে পুন্যবান।। ৮+৬=১৪

লক্ষণীয় যে, পয়ারের প্রত্যেক চরণ শেষে এক। দাঁড়ি, দ্বিতীয় চরণে দুই।। দাঁড়ি।

প্রত্যেক চরণেই আলাদা আলাদা বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে।

যে কারণে বক্তব্যের মধ্যে কোনো প্রবহমানতা নেই।

পয়ার অক্ষরবৃত্তের একটি শাখা।

পয়ার ছাড়াও অক্ষরবৃত্তের আরো শাখাসমূহ নানা নামে পরিচিত। আমি কিছু নাম উল্লেখ করেছি শুধু ছন্দের বৈচিত্র্য বোঝাতে।

যেমন, তরুল পয়ার, মালঝাঁপ পয়ার, মালতি, বিশাখ পয়ার, কুসুম মালিকা, মহাপয়ার, সমিল মহাপয়ার, অমিল মহাপয়ার, পর্যায়সম, মহাপয়ার, মধ্যাসম মহাপয়ার, একাবলী, দীর্ঘ একাবলী, মিশ্রছন্দ, ত্রিপদী ছন্দ, লঘু ত্রিপদী, দীর্গ ত্রিপদী, অসমপর্বিক, ত্রিপদী, চতুষ্পদী, লঘু চৌপদী, দীর্ঘ চৌপদী ও অমিত্রাক্ষর।

সর্বশেষ অমিত্রাক্ষর ছন্দে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর আধুনিক ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য বাংলা ভাষায় রচনা করেন। পয়ারে যেমন প্রত্যেক পংক্তি শেষে অন্ত্যমিল ছিলো, তিনি তা পরিহার করেছেন, এবং প্রত্যেক পংক্তি শেষে এক ও দুই দাঁড়ি তুলে দিয়েছেন। বক্তব্যের প্রবহমানতা সৃষ্টির জন্যে দাঁড়ি ছাড়াও অন্যান্য বিরতি চিহ্নের ব্যবহার করেছেন প্রয়োজন অনুসারে। ছন্দটিকে মহাকাব্যের বীররস তথা বক্তব্যের গুরুভার বহনের যোগ্য করে তুলেছেন তিনিই প্রথম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রামায়ণের কাহিনির নবরূপ দিয়ে তিনি নয় সর্গে মহাকাব্যটি শেষ করেছেন। প্রথম সর্গের নাম ‘অভিষেক’। নায়ক রাবণের পুত্র বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ দিয়ে কাব্যের শুরু হয়েছে এভাবে:

‘সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি

বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে

অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,

কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,

পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি

রাঘবারি?’

এখানে বক্তব্যের প্রবহমানতা গড়িয়ে গড়িয়ে পাঁচ চরণে এসে শেষ হয়েছে। এটাই অমিত্রাক্ষর ছন্দের নতুনত্ব এবং পয়ার থেকে ভিন্ন হয়ে উঠেছে।

মাইকেল মধুসূদনের পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ছন্দের রূপ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত- তিন প্রকার ছন্দেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন। বিশেষভাবে মাত্রাবৃত্ত রচনায় স্বকীয়তা অভাবনীয়। মানসী কাব্যে মাত্রাবৃত্তের সফল প্রয়োগ লক্ষণীয়। নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতাটিরশুরু এভাবে:

আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে ৬+৬

হে সুন্দরী ৫

বলো, কোন্ পার ভিড়িবে তোমার ৬+৬

সোনার তরী। ৫

তেমনি ক্ষণিকা কাব্যে স্বরবৃত্তের মতো লঘু ছন্দে যে গুরুভার বক্তব্য প্রকাশ করা যায়, সেটিও প্রমাণ করেছেন।

চমকে দিয়েছেন পাঠককে।

নীলেরকোলে/শ্যামল সে দ্বীপ/প্রবাল দিয়ে/ঘেরা ৪+৪+৪+২

শৈল চূড়ায়/নীড় বেঁধেছে/সাগর বিহঙ/গেরা ৪+৪+৪+২

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বভাবগত কারণেই অক্ষরবৃত্তের তুলনায় স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অগ্নিবীণাকাব্যসহ অনেক গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে নতুন এক ধরনের ঝোঁক বা শ্বাসাঘাত তৈরির চেষ্টা করেছেন। তাঁর রচিত রণসঙ্গীত লক্ষণীয়,

চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে ৬+৬

বাজে মাদল ৫

নিম্নে উতলা ধরণীরতল ৬+৬

চলরে চল। ৫

মম/ এক হাতে বাঁকা/ বাঁশের বাঁশরী ২+৬+৬

আর হাতে রণ/তূর্য ৬+৩

‘মম’ শব্দটি দুই মাত্রার অতি পর্ব যা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে চরণের প্রথমে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় চরণে ৬ মাত্রার পূর্ণ পর্ব একটি এবং চরণ শেষে ৩ মাত্রার একটি অপূর্ণ পর্ব রয়েছে। অক্ষরবৃত্তের সর্বশেষ একটি ধারা গদ্যছন্দ।

গদ্যছন্দ (Prose Verse) : আধুনিক কালে কবিতায় গদ্যছন্দ ব্যবহার করা হয় বক্তব্যের প্রয়োজনে।

অনেকের ধারণা আধুনিক কবিতায় কোনো ছন্দ নেই। তাদের ধারণা, ছন্দ মানে অন্ত্যমিল। গদ্যছন্দের ক্ষেত্রে গদ্যভাষার ছন্দ, সুষমাকে ব্যবহার করা হয়। যাকে বলা চলে ছন্দস্পন্দ। এই ছন্দ অস্ফুট।

গদ্য ছন্দে পদ্য ছন্দের মতো যতির দ্বারা চরণ বা পংক্তি পর্বে বিভক্তি হয় না। উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ কাব্যের ক্যামেলিয়া কবিতাটির কথা ধরা যাক।

‘নাম তার কমলা।

দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা-

সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।

আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে’।

(ক্যামেলিয়া)

প্রবহমান পয়ার:

যে কবিতায় অন্ত্যমিল ঠিক রেখে পংক্তিগুলোর প্রবহমানতা বিদ্যমান থাকে, তা প্রবহমান সমিল পয়ার!

উদাহরণ:

“হে দারিদ্র্য তুমি মোরে/ করেছ মহান/ তুমি মোরে দানিয়েছ/ খ্রিস্টের সম্মান।/ কণ্টক-মুকুট শোভ!/-দিয়াছ, তাপস / অসঙ্কোচ প্রকাশের/ দুরন্ত সাহস:” (দারিদ্র্য / কাজী নজরুল ইসলাম)

নদী যেমন তটের শাসন মেনে চলে, অন্যথায় প্লাবিত করে জনপদ, ঘরদোর অনেক কিছু। কবির আবেগও যদি ছন্দের শৃঙ্খলা বা সামান্য শাসন মেনে প্রবাহিত হয়, তবে তা সহজেই কবিতা হয়ে ওঠে। অন্যথায় অন্ধ আবেগের উদ্গীরণে তা হয়ে ওঠে ভাবোচ্ছ্বাসবা ভাবালু কথকতা।

৪। অলঙ্কার: সংস্কৃত ‘অলম’ শব্দ থেকে অলঙ্কার শব্দটি এসেছে। যার অর্থ ভূষণ। নবম শতকের শেষদিকে কাব্য-জিজ্ঞাসার সমসূত্রে অলঙ্কার একটি বিশিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বাংলা অলঙ্কার শাস্ত্র মূলত সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রেরই যমজ।

নারীদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে মেয়েরা যেমন নানা অঙ্গে বিভিন্ন ডিজাইনের অলঙ্কার ধারণ করে, কাব্যদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যেও সৃষ্টি হয়েছে কাব্যালঙ্কার। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, যেগুণ দ্বরা ভাষার শক্তিবর্ধন ও সৌন্দর্য সম্পাদন হয়, তাকে অলঙ্কার বলে। অলঙ্কার প্রধানত, দুই প্রকার।

১। শব্দালঙ্কার: শব্দালঙ্কারের লক্ষ কবিতায় ব্যবহৃত শব্দে ধ্বনিমাধুর্য ও শ্রুতিসুষমা সৃষ্টি করা। বিভিন্ন রকমের শব্দালঙ্কারের মধ্যে প্রধানত, অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি, ধ্বনুক্তি ইত্যাদি।

অনুপ্রাসের একটি উদাহরণ:

‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নেশা’

‘র’ বর্ণটি পর পর চারবার উচ্চারিত হওয়ার ফলে যে ধ্বনিসুষমা ও সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে, এ কারণে অনুপ্রাস অলঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে এখানে।

২। অর্থালঙ্কার: যে অলঙ্কার শব্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অর্থের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে, তাকে অর্থালঙ্কার বলে। অর্থালঙ্কারের যথোচিত প্রয়োগের ফলে বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে।

অর্থালঙ্কার পাঁচ প্রকার। যথা- ১. সাদৃশ্যমূলক, ২. বিরোধমূলক, ৩. শৃঙ্খলামূলক, ৪. ন্যায়মূলক, ৫. গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক।

এই পঞ্চমের অধীনে উল্লেখযোগ্য অলঙ্কারসমূহ যথাক্রমে, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, সন্দেহ, বিরোধাভাস, ব্যাজস্তুতি অন্যতম।

উপমা: দুই বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে যখন তুলনা করা হয় তখন, উপমা অলঙ্কার সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ:

‘মেয়েটি লতার মতো দিন দিন বাড়িয়া উঠিতেছে’ কিংবা: ‘কচি কলপাতা সন্ধ্যা’।

এখানে লতা ও মেয়ে দুটি বিজাতীয় পদার্থ, কিন্তু দুজনের বেড়ে ওঠার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। এজন্যে এটি উপমা অলঙ্কারের উদাহরণ। একইভাবে কচিকলাপাতা এবং সন্ধ্যা দুটি বিজাতীয় পদার্থ কিন্তু সন্ধ্যা ও কচিকলাপাতার রঙের মধ্যে বিশেষ সাদৃশ্য রয়েছে।

চিত্রকল্পের উদাহরণ:

‘নদীর ওপারে বন ছুঁয়ে চাঁদ উঠে এলো/ নটীর মতন নিটল চোখের নিচে কালি।’ এখানে চাঁদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে একজন নৃত্যশিল্পীর বা নটিনীর বেদনাদীর্ণ জীবনধারাকে। কাজেই এখানে উপমা ছাড়াও সৃষ্টি হয়েছে একটি সার্থক চিত্রকল্প।

অনেক কাব্য সমালোচক বলেন, চিত্রকল্পই কবিতা। একটি সার্থক চিত্রকল্প রচনা করা সত্যি খুব দুরূহ কাজ, তবে তা মহৎ কাব্যশক্তির পরিচায়কও বটে।