সাময়িকী কবিতা

শীত

বিমল গুহ

এখন পৌষের রাত

কুঁজো দেহে শীত নামে ঘরের নির্জনে

লণ্ঠনের ম্রয়িমাণ আলো কাঁপে থিরথির পড়ার টেবিলে।

লণ্ঠনের পাশ ঘিরে সারারাত জমা হয় কুয়াশার স্মৃতি

আমাদের ব্যবহৃত শব্দের দীর্ঘ সারি

দুদ- বিশ্রাম চায় এইবেলা। দূরে অশ্বত্থের ডালে

ঝিমোয় একাকী এক সঙ্গীহীন পেঁচা

বড় অলুক্ষণে বেলা যায়!

কবিও শীতার্ত হয়।

হাতে আর কলম চলে না সারাদিন

কনকনে শীতে

কম্বল মুড়ি দিয়ে কবিতা আওড়ায় ন্যুব্জ কবি:

এই শীতের রাতে কই তুই সজনী...

দেখি- এই শীতের সকালে পাতাকুড়ানিরা মিলে

আগুনের ওম নেয় পরম উল্লাসে,

আমাদেরও বেলা যায় শীতের সংগীতে সুর তুলে।

ঠিকানার খোঁজে

গৌতম রায়

আমায় চিঠি দিও মালতীপাটপুরের ঠিকানায়,

ওড্রদেশের বালির গায়ে লেগে থাকা লোনা জল,

একটু জমিয়ে রেখো আমাকে দাফনই করো বা

পুড়িয়েই দাও, তার আগে শেষবার শুদ্ধ করার তাগিদে-

লোনা হাওয়া আমার সয়ে গেছে।

মিঠে পানি আমার সইবে কি?

তাই হয়তো ওড্রভূমির লবণ শরীরে ধারণ করে নিমকহারামি

না করবার অহঙ্কারে আমি দপদপিয়ে পা ফেলছি মাটি মায়ের বুকে।

অতলান্ত জলকে স্পর্শের দাওয়াত দিয়েছিল

প্রিয়তমা নিজের আখেরি মোনাজাতকালে।

আমি প্রিয়তমার রুহের মাগফেরাত চাইতে গিয়ে

তার কুলখানিতে দুচার লোকমা ভাত বেশি খেয়ে ফেলেছি।

এবার আমি বরইপাতা আর আতপ চাল, পাটকাঠির

মিলেমিশে যাওয়া দেখতে রৌরব নরক থেকে রোজকেয়ামতে

দিনগুজরান করেই চলব, করেই চলব।

একদিন বেদনামুখার্জীর সাথে

শিউল মনজুর

ওলটপালট হচ্ছে কিচেন, ওলটপালট হচ্ছে ড্রইং রুম থেক গেস্ট রুম...। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভুল বুঝে শীতের কুয়াশারাত্রি পেরিয়ে আন্তঃনগরের পথে হুইসেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে আনন্দমুখার্জী আর এই মাত্র লেখার টেবিলে সঘন উষ্ণতা ছড়িয়ে পৌঁছে গেলো তারই যমজ বেদনামুখার্জী; জমকালো শীতের অনিন্দ্য বাসনার গল্পগুলো করতে করতে কবিতার পৃষ্ঠায় সেও ক্লান্ত বিষণ্ণ বন্দি হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তে। অবশ্য সে জানে, আনন্দমুখার্জী আবারো ফিরে আসবে সকালের লোকাল ট্রেনে, নিজস্ব কিচেনছাড়া জীবন কী চলে...

কনজ্যুমার

বদরুল হায়দার

তোমাকে কয়েন দিলে তুমি

সুবিধার পাপে ক্যাফে রেস্তরাঁর মূল্যহ্রাসে

বেচে দাও উপভোগ।

লাভ ক্যাবারের স্তনের ফিডারে জাত করো

ভাবাবেগ।

ফ্যাশন বাজারে ঘুরেফিরে এলোমেলো

দেউলিয়া কাম। নামের বাগানে ঢালে

পোড়া তেল, ঘাতকের বুকে রাখা মবিল ডিজেল।

পীর জঙ্গি জেগে। আছে নগরের কোলাহলে

তুমি তেলেসমাতির খেলে অন্তরের ব্যাবিলনে

মোহের বাঁশিতে বলি দাও ঐতিহ্যের ঘুম।

পাঁজরে সাম্পানে ভেসে চলে জলযোগ মন

ডিজনিল্যান্ড তুমি আনন্দের টমটমে

নবাবী লেবাসে টানো বুড়িগঙ্গা ঋণ।

বাংলাদেশ

রেহেনা মাহমুদ

মেয়েটির খোঁপা খুলে দিলে নক্ষত্রেরা ভেজা গায়ে উড়াল দিলো আকাশে। রাতটা গাঢ় হচ্ছে- মাথার ওপর তারকাখচিত ফুলের মেলা- ঝাপসা ঝাপসা। এরপর কতগুলো পাখি ফড়ফড় করে ডানা ঝাঁপটে চলে গেল! আর তাদের শিসে শিসে বিষাদ ভেসে এলো বহুদূর থেকে। মেয়েটির খোঁপা থেকে একে একে বেরিয়ে এলো হয়েনা, শকুন, কুকুর, চিল, বিষধর-তারা একে একে পালালো বনে।

মেয়েটির চোখ মেলে দিলে বেরিয়ে পড়লো দুইটি নদী। কাকের চোখের মতো কালো নদীর জল। মৃতপ্রায়, শুভ্র রাঁজহাস ডানা ঝাঁপটাচ্ছে নদীতে। এক নদী আরেক নদীর সাথে মিলেও মিলছে না!

সারারাত খুব শিশির ঝরলো ঘাসের বুকে। মু-ছিন্ন একটা শরীর আলিঙ্গন করলো ভোর। খোঁপা নেই, চোখ নেই। লাশের উপর ভনভন করছে মাছি!

একটি কবিতায় বিস্ময়চিহ্ন

টিপু সুলতান

চা পানের শেষ চুমুক ধরে ভিজে যাচ্ছি।

এক নেশাসক্ত কবি, তার কবিতা

লেখার আগে বন্দোবস্ত মন

নিয়ে বসে আছে, দ্রাক্ষার ভেতর;

এই মুহূর্তে, বুড়ো পৃথিবীর মুখোমুখি

সটান হয়ে পাঠ করছি, তাকে-

মরে যাবার আগে, ধূমাল বিস্তারে

পাকা পেঁপের মতো টসটসে আবৃত রূপ,

তীব্র হয়ে ওঠা শ্রমণ রূপ, ক্ষীয়মাণ নগর

প্রার্থনা পরা সাত স্বর্গের পৃথিবী

দুচোখের সামনে বড়সড় বিস্ময়চিহ্ন

কাঁটাচামচে ঝুলে আছে নীরবতা!

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১ , ৭ মাঘ ১৪২৭, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

সাময়িকী কবিতা

শীত

বিমল গুহ

এখন পৌষের রাত

কুঁজো দেহে শীত নামে ঘরের নির্জনে

লণ্ঠনের ম্রয়িমাণ আলো কাঁপে থিরথির পড়ার টেবিলে।

লণ্ঠনের পাশ ঘিরে সারারাত জমা হয় কুয়াশার স্মৃতি

আমাদের ব্যবহৃত শব্দের দীর্ঘ সারি

দুদ- বিশ্রাম চায় এইবেলা। দূরে অশ্বত্থের ডালে

ঝিমোয় একাকী এক সঙ্গীহীন পেঁচা

বড় অলুক্ষণে বেলা যায়!

কবিও শীতার্ত হয়।

হাতে আর কলম চলে না সারাদিন

কনকনে শীতে

কম্বল মুড়ি দিয়ে কবিতা আওড়ায় ন্যুব্জ কবি:

এই শীতের রাতে কই তুই সজনী...

দেখি- এই শীতের সকালে পাতাকুড়ানিরা মিলে

আগুনের ওম নেয় পরম উল্লাসে,

আমাদেরও বেলা যায় শীতের সংগীতে সুর তুলে।

ঠিকানার খোঁজে

গৌতম রায়

আমায় চিঠি দিও মালতীপাটপুরের ঠিকানায়,

ওড্রদেশের বালির গায়ে লেগে থাকা লোনা জল,

একটু জমিয়ে রেখো আমাকে দাফনই করো বা

পুড়িয়েই দাও, তার আগে শেষবার শুদ্ধ করার তাগিদে-

লোনা হাওয়া আমার সয়ে গেছে।

মিঠে পানি আমার সইবে কি?

তাই হয়তো ওড্রভূমির লবণ শরীরে ধারণ করে নিমকহারামি

না করবার অহঙ্কারে আমি দপদপিয়ে পা ফেলছি মাটি মায়ের বুকে।

অতলান্ত জলকে স্পর্শের দাওয়াত দিয়েছিল

প্রিয়তমা নিজের আখেরি মোনাজাতকালে।

আমি প্রিয়তমার রুহের মাগফেরাত চাইতে গিয়ে

তার কুলখানিতে দুচার লোকমা ভাত বেশি খেয়ে ফেলেছি।

এবার আমি বরইপাতা আর আতপ চাল, পাটকাঠির

মিলেমিশে যাওয়া দেখতে রৌরব নরক থেকে রোজকেয়ামতে

দিনগুজরান করেই চলব, করেই চলব।

একদিন বেদনামুখার্জীর সাথে

শিউল মনজুর

ওলটপালট হচ্ছে কিচেন, ওলটপালট হচ্ছে ড্রইং রুম থেক গেস্ট রুম...। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভুল বুঝে শীতের কুয়াশারাত্রি পেরিয়ে আন্তঃনগরের পথে হুইসেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে আনন্দমুখার্জী আর এই মাত্র লেখার টেবিলে সঘন উষ্ণতা ছড়িয়ে পৌঁছে গেলো তারই যমজ বেদনামুখার্জী; জমকালো শীতের অনিন্দ্য বাসনার গল্পগুলো করতে করতে কবিতার পৃষ্ঠায় সেও ক্লান্ত বিষণ্ণ বন্দি হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তে। অবশ্য সে জানে, আনন্দমুখার্জী আবারো ফিরে আসবে সকালের লোকাল ট্রেনে, নিজস্ব কিচেনছাড়া জীবন কী চলে...

কনজ্যুমার

বদরুল হায়দার

তোমাকে কয়েন দিলে তুমি

সুবিধার পাপে ক্যাফে রেস্তরাঁর মূল্যহ্রাসে

বেচে দাও উপভোগ।

লাভ ক্যাবারের স্তনের ফিডারে জাত করো

ভাবাবেগ।

ফ্যাশন বাজারে ঘুরেফিরে এলোমেলো

দেউলিয়া কাম। নামের বাগানে ঢালে

পোড়া তেল, ঘাতকের বুকে রাখা মবিল ডিজেল।

পীর জঙ্গি জেগে। আছে নগরের কোলাহলে

তুমি তেলেসমাতির খেলে অন্তরের ব্যাবিলনে

মোহের বাঁশিতে বলি দাও ঐতিহ্যের ঘুম।

পাঁজরে সাম্পানে ভেসে চলে জলযোগ মন

ডিজনিল্যান্ড তুমি আনন্দের টমটমে

নবাবী লেবাসে টানো বুড়িগঙ্গা ঋণ।

বাংলাদেশ

রেহেনা মাহমুদ

মেয়েটির খোঁপা খুলে দিলে নক্ষত্রেরা ভেজা গায়ে উড়াল দিলো আকাশে। রাতটা গাঢ় হচ্ছে- মাথার ওপর তারকাখচিত ফুলের মেলা- ঝাপসা ঝাপসা। এরপর কতগুলো পাখি ফড়ফড় করে ডানা ঝাঁপটে চলে গেল! আর তাদের শিসে শিসে বিষাদ ভেসে এলো বহুদূর থেকে। মেয়েটির খোঁপা থেকে একে একে বেরিয়ে এলো হয়েনা, শকুন, কুকুর, চিল, বিষধর-তারা একে একে পালালো বনে।

মেয়েটির চোখ মেলে দিলে বেরিয়ে পড়লো দুইটি নদী। কাকের চোখের মতো কালো নদীর জল। মৃতপ্রায়, শুভ্র রাঁজহাস ডানা ঝাঁপটাচ্ছে নদীতে। এক নদী আরেক নদীর সাথে মিলেও মিলছে না!

সারারাত খুব শিশির ঝরলো ঘাসের বুকে। মু-ছিন্ন একটা শরীর আলিঙ্গন করলো ভোর। খোঁপা নেই, চোখ নেই। লাশের উপর ভনভন করছে মাছি!

একটি কবিতায় বিস্ময়চিহ্ন

টিপু সুলতান

চা পানের শেষ চুমুক ধরে ভিজে যাচ্ছি।

এক নেশাসক্ত কবি, তার কবিতা

লেখার আগে বন্দোবস্ত মন

নিয়ে বসে আছে, দ্রাক্ষার ভেতর;

এই মুহূর্তে, বুড়ো পৃথিবীর মুখোমুখি

সটান হয়ে পাঠ করছি, তাকে-

মরে যাবার আগে, ধূমাল বিস্তারে

পাকা পেঁপের মতো টসটসে আবৃত রূপ,

তীব্র হয়ে ওঠা শ্রমণ রূপ, ক্ষীয়মাণ নগর

প্রার্থনা পরা সাত স্বর্গের পৃথিবী

দুচোখের সামনে বড়সড় বিস্ময়চিহ্ন

কাঁটাচামচে ঝুলে আছে নীরবতা!