শিক্ষা নিয়ে শঙ্কা দূর করতে হবে

গোপাল অধিকারী

করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ বার বন্ধের নোটিস দিয়েছে সরকার। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারের শিক্ষা সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আইনি (লিগ্যাল) নোটিস পাঠানো হয়েছে। এছাড়া নোটিসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। ভাওয়াল মির্জাপুর পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল আব্দুল কাইয়ুম সরকারের পক্ষে ১১ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারুক আলমগীর চৌধুরী এই লিগ্যাল নোটিস পাঠান।

এই নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেউ কেউ ভাবছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যোক্তিকতাই আসে না। কারণ, দেশের সব কিছুই স্বাভাবিক চলছে। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কি লাভ হচ্ছে? আবার কারও মতে, শিক্ষা যাই হোক শিশুর জীবন আগে, তাই এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলাই ভালো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিবে ইত্যাদিসহ বিভিন্ন মত রয়েছে। জগতে যত মত, তত পথ রয়েছে। তাই শিক্ষা নিয়ে এই ভিন্ন মত অস্বাভাবিক কিছু না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সরকারকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা একটি। আমার কাছে শিক্ষাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার বলে মনে হয় কারণ ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। শিক্ষার কারণেই ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ বৃদ্ধি পায়। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গত ১৭ মার্চ থেকে কয়েক দফা বৃদ্ধি করে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে। পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই হয়ত সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জগতে সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত সব কিছুরই ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে ভালো-মন্দ দুটোই হবে। তবে কোনটা বেশি ভালো বা বেশি মন্দ হবে তা বিবেচনায় রাখতে হবে।

শিক্ষা ছাড়া জাতি অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত হয়। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আঘাত করলেই যথেষ্ট উদ্দেশ্য সাধন হয়। তাই এই বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জানি না কি কি গুরুত্বপূর্ণ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে।

প্রথমত, শীতে করোনার প্রভাব বৃদ্ধি বা দ্বিতীয় ঢেউ আসবে এমন একটা ইঙ্গিত আমরা পেয়েছিলাম যে কারণে পূর্বের ছুটি যোক্তিক ছিল। কিন্তু সম্প্রতি করোনার সংক্রমণ কম। গত ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭১৮ জন। গত ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮৪৯ জন। ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১০৭১ জন। ৯ জানুয়ারি শনাক্ত হয়েছে ৬৯২ জন এবং গত ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭৮৫ জন। যা পূর্বের গরমকাল অনুযায়ী অনেক কম। যেখানে শনাক্ত তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবার চিন্তা করা হচ্ছিল সেখানে এই পরিসংখ্যান আমাদের জন্য ইতিবাচক। সেই দৃষ্টিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যোক্তিক হতে পারে না?

দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের নিরাপদে রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কিন্তু শিক্ষার্থীরা কি বাস্তবে বাড়িতে থাকছে? জরিপ করে দেখেন বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে ভিড় বাড়ছে। সেখানে কারা যাচ্ছে? তাহলে সরকারের নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে?

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। ফলে অনেকেই অর্থের অভাবে সন্তানদের স্কুলে পাঠান না। সরকারের শিক্ষানীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য কয়েক বছর ধরে শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু নিম্নআয়ের পরিবারগুলো অভাবের তাড়নায় সন্তানকে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনই খোলা না গেলে ঝরে যাবে বহু শিক্ষার্থী। ফলে দেশে শিক্ষার হার হবে নিম্নগামী। তারাও সচেতনতার অভাবে মরণফাঁদে পা দিবে। ফলে অপ্রাপ্তবয়সে মাতৃত্বকালীন বিভিন্ন বিপদে পড়বে তারা।

আশা করছি দ্রুততম সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসবে। কারণ, করোনার কারণে অনেক অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা পরীক্ষা হবে কি না এই ভাবনায় পড়ালেখায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছেন না। বন্ধ প্রাইভেটসহ পড়ালেখা, দীর্ঘদিন এভাবে থাকলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসলেও মনোযোগ দিতে পারবে না। ফলে ঝরে পড়া ছাড়াও মধ্যম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা পরিণত হবে নিম্নœ শ্রেণীর শিক্ষার্থীতে। শ্রেণীর নির্দিষ্ট সিলেবাসটি সম্পূর্ণ না করলে আপনার সন্তান পিছিয়ে পরবে বা পরবর্তী শ্রেণীতে তার মেধার ওপর প্রভাব পরবে আমার মনে হয় বিষয়টি আমরা অনেকেই ভাবছি না। অথ্যাৎ পরীক্ষা না হলেও প্রথম শ্রেণীর বই আপনার সন্তানকে সম্পন্ন করতে হবে কারণ প্রথম শ্রেণীর বই সম্পন্ন করলেই আপনার সন্তান দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভালো ফলাফল করতে পারবে। তাছাড়া সে অনেক কিছু আয়ত্ত করতে পারবে না।

অধিকাংশ শিক্ষার্থী আছে যারা প্রতিষ্ঠান বাদে নিজ বইটি পড়তে চায় না। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে সেই শিক্ষার্থী মূল বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে ফলে সে জানতে পারে না পাঠ্যপুস্তকের অনেক বিবরণ। এক কথায় শিক্ষার্থীর সার্বিক দিক বিবেচনা করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিকল্প নেই। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ কাম্য নয়।

আমরা অনেকে ভাবছি সন্তানের জীবন আগে পড়ালেখা পরে। কথাটি ঠিক, কিন্তু আমি যদি কোন নিয়মনীতি না মেনে করোনা জোনে বেপরোয়া চলাফেরা করে সন্তানকে ঘরে রাখতে চাই তাহলে সেটা কতটুকু যৌক্তিক হবে? করোনাতো আসলে বড়দের বেপরোয়া চলাফেরায় হবে, সন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কি চলাফেরা করবে? প্রশ্নটা সবার কাছে? আমার মনে হয় দেশের সরকারি ও এমপিওভুক্ত সব শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তটা আরও আগেই আসতে পারত। কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছাড়া যেমন দেশ সমৃদ্ধ থাকে না ঠিক তেমনি সব শিক্ষক এক কাতারে থাকলে শিক্ষার জন্য কোনটি প্রাসঙ্গিক তা বুঝতে বেশি সুবিধা হতো। দেশের একটি বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কথা বিবেচনা করেই প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে আমার মনে হয় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত পাশাপাশি বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে স্বাস্থ্যবিধি ও সঠিক নির্দেশনা মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নিদের্শনা বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং ও প্রয়োজন। সব কিছুই একটি দিক বিবেচনা করে হয় না বা করা যায় না। শিক্ষা সেক্টরটিও তেমন। করোনার সংক্রমণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, সুস্থতা, ঝরে পরা ও দেশের সাক্ষরতার হার সব বিষয়ই বিবেচনায় আনতে হবে।

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এ সময় বাইরে ঘোরাঘুরি করছে, টিভি দেখে সময় ব্যয় করছে। এছাড়া মোবাইল ব্যবহার করে খারাপ অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি দীর্ঘদিন করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে এক সময় জনগণ স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অনিহা শুরু করে। আইন করেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় নি। জনগণের চলাফেরায় মনে হয়েছে করোনা বিদায় নিয়েছে। ঠিক একইভাবে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক স্থানে গোপনে পাঠদান শুরু হয়েছে। ফলে অনেকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক অভিভাবকদের মধ্যেও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। শঙ্কা কাটাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি দুটোর সমন্বয় করা যেতে পারে। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটোই জরুরি। তাই সরকারকে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে শিক্ষা নিয়ে শঙ্কা দূর করতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

[লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট]

gopalodikari1213@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১ , ৭ মাঘ ১৪২৭, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

শিক্ষা নিয়ে শঙ্কা দূর করতে হবে

গোপাল অধিকারী

image

করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ বার বন্ধের নোটিস দিয়েছে সরকার। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারের শিক্ষা সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আইনি (লিগ্যাল) নোটিস পাঠানো হয়েছে। এছাড়া নোটিসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। ভাওয়াল মির্জাপুর পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল আব্দুল কাইয়ুম সরকারের পক্ষে ১১ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারুক আলমগীর চৌধুরী এই লিগ্যাল নোটিস পাঠান।

এই নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেউ কেউ ভাবছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যোক্তিকতাই আসে না। কারণ, দেশের সব কিছুই স্বাভাবিক চলছে। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কি লাভ হচ্ছে? আবার কারও মতে, শিক্ষা যাই হোক শিশুর জীবন আগে, তাই এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলাই ভালো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিবে ইত্যাদিসহ বিভিন্ন মত রয়েছে। জগতে যত মত, তত পথ রয়েছে। তাই শিক্ষা নিয়ে এই ভিন্ন মত অস্বাভাবিক কিছু না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সরকারকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা একটি। আমার কাছে শিক্ষাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার বলে মনে হয় কারণ ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। শিক্ষার কারণেই ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ বৃদ্ধি পায়। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গত ১৭ মার্চ থেকে কয়েক দফা বৃদ্ধি করে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে। পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই হয়ত সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জগতে সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত সব কিছুরই ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে ভালো-মন্দ দুটোই হবে। তবে কোনটা বেশি ভালো বা বেশি মন্দ হবে তা বিবেচনায় রাখতে হবে।

শিক্ষা ছাড়া জাতি অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত হয়। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আঘাত করলেই যথেষ্ট উদ্দেশ্য সাধন হয়। তাই এই বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জানি না কি কি গুরুত্বপূর্ণ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে।

প্রথমত, শীতে করোনার প্রভাব বৃদ্ধি বা দ্বিতীয় ঢেউ আসবে এমন একটা ইঙ্গিত আমরা পেয়েছিলাম যে কারণে পূর্বের ছুটি যোক্তিক ছিল। কিন্তু সম্প্রতি করোনার সংক্রমণ কম। গত ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭১৮ জন। গত ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮৪৯ জন। ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১০৭১ জন। ৯ জানুয়ারি শনাক্ত হয়েছে ৬৯২ জন এবং গত ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭৮৫ জন। যা পূর্বের গরমকাল অনুযায়ী অনেক কম। যেখানে শনাক্ত তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবার চিন্তা করা হচ্ছিল সেখানে এই পরিসংখ্যান আমাদের জন্য ইতিবাচক। সেই দৃষ্টিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যোক্তিক হতে পারে না?

দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের নিরাপদে রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কিন্তু শিক্ষার্থীরা কি বাস্তবে বাড়িতে থাকছে? জরিপ করে দেখেন বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে ভিড় বাড়ছে। সেখানে কারা যাচ্ছে? তাহলে সরকারের নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে?

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। ফলে অনেকেই অর্থের অভাবে সন্তানদের স্কুলে পাঠান না। সরকারের শিক্ষানীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য কয়েক বছর ধরে শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু নিম্নআয়ের পরিবারগুলো অভাবের তাড়নায় সন্তানকে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনই খোলা না গেলে ঝরে যাবে বহু শিক্ষার্থী। ফলে দেশে শিক্ষার হার হবে নিম্নগামী। তারাও সচেতনতার অভাবে মরণফাঁদে পা দিবে। ফলে অপ্রাপ্তবয়সে মাতৃত্বকালীন বিভিন্ন বিপদে পড়বে তারা।

আশা করছি দ্রুততম সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসবে। কারণ, করোনার কারণে অনেক অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা পরীক্ষা হবে কি না এই ভাবনায় পড়ালেখায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছেন না। বন্ধ প্রাইভেটসহ পড়ালেখা, দীর্ঘদিন এভাবে থাকলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসলেও মনোযোগ দিতে পারবে না। ফলে ঝরে পড়া ছাড়াও মধ্যম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা পরিণত হবে নিম্নœ শ্রেণীর শিক্ষার্থীতে। শ্রেণীর নির্দিষ্ট সিলেবাসটি সম্পূর্ণ না করলে আপনার সন্তান পিছিয়ে পরবে বা পরবর্তী শ্রেণীতে তার মেধার ওপর প্রভাব পরবে আমার মনে হয় বিষয়টি আমরা অনেকেই ভাবছি না। অথ্যাৎ পরীক্ষা না হলেও প্রথম শ্রেণীর বই আপনার সন্তানকে সম্পন্ন করতে হবে কারণ প্রথম শ্রেণীর বই সম্পন্ন করলেই আপনার সন্তান দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভালো ফলাফল করতে পারবে। তাছাড়া সে অনেক কিছু আয়ত্ত করতে পারবে না।

অধিকাংশ শিক্ষার্থী আছে যারা প্রতিষ্ঠান বাদে নিজ বইটি পড়তে চায় না। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে সেই শিক্ষার্থী মূল বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে ফলে সে জানতে পারে না পাঠ্যপুস্তকের অনেক বিবরণ। এক কথায় শিক্ষার্থীর সার্বিক দিক বিবেচনা করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিকল্প নেই। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ কাম্য নয়।

আমরা অনেকে ভাবছি সন্তানের জীবন আগে পড়ালেখা পরে। কথাটি ঠিক, কিন্তু আমি যদি কোন নিয়মনীতি না মেনে করোনা জোনে বেপরোয়া চলাফেরা করে সন্তানকে ঘরে রাখতে চাই তাহলে সেটা কতটুকু যৌক্তিক হবে? করোনাতো আসলে বড়দের বেপরোয়া চলাফেরায় হবে, সন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কি চলাফেরা করবে? প্রশ্নটা সবার কাছে? আমার মনে হয় দেশের সরকারি ও এমপিওভুক্ত সব শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তটা আরও আগেই আসতে পারত। কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছাড়া যেমন দেশ সমৃদ্ধ থাকে না ঠিক তেমনি সব শিক্ষক এক কাতারে থাকলে শিক্ষার জন্য কোনটি প্রাসঙ্গিক তা বুঝতে বেশি সুবিধা হতো। দেশের একটি বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কথা বিবেচনা করেই প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে আমার মনে হয় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত পাশাপাশি বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে স্বাস্থ্যবিধি ও সঠিক নির্দেশনা মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নিদের্শনা বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং ও প্রয়োজন। সব কিছুই একটি দিক বিবেচনা করে হয় না বা করা যায় না। শিক্ষা সেক্টরটিও তেমন। করোনার সংক্রমণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, সুস্থতা, ঝরে পরা ও দেশের সাক্ষরতার হার সব বিষয়ই বিবেচনায় আনতে হবে।

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এ সময় বাইরে ঘোরাঘুরি করছে, টিভি দেখে সময় ব্যয় করছে। এছাড়া মোবাইল ব্যবহার করে খারাপ অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি দীর্ঘদিন করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে এক সময় জনগণ স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অনিহা শুরু করে। আইন করেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় নি। জনগণের চলাফেরায় মনে হয়েছে করোনা বিদায় নিয়েছে। ঠিক একইভাবে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক স্থানে গোপনে পাঠদান শুরু হয়েছে। ফলে অনেকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক অভিভাবকদের মধ্যেও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। শঙ্কা কাটাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি দুটোর সমন্বয় করা যেতে পারে। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটোই জরুরি। তাই সরকারকে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে শিক্ষা নিয়ে শঙ্কা দূর করতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

[লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট]

gopalodikari1213@gmail.com