হস্তশিল্প এগিয়ে নিতে প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

করোনা মহামারী বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তার প্রভাব পড়েছে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে। তৈরি পোশাকসহ অনেক পণ্যেরই চাহিদা কমে গেছে। ফলে কমেছে রপ্তানি আয়; কিন্তু ব্যতিক্রম হস্তশিল্প। বাংলাদেশের হস্তশিল্পের প্রধান গন্তব্য হচ্ছে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো। ধারণা করা হচ্ছে, করোনা মহামারীতে মানুষ বেশি সময় ঘরে থাকায় গৃহসজ্জার বিভিন্ন উপকরণের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর তাই বাংলাদেশ থেকে হস্তশিল্পের রপ্তানিও বেড়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের হস্ত ও কুটির শিল্প থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বরে) আয় হয়েছে এক কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এই আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮.৭০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তা ২৩.৩৬ শতাংশ বেশি। উদ্যোক্তাদের দাবি, সরকারি সহায়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা গেলে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই শিল্পের রপ্তানি আয় বছরে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

সর্বশেষ ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩১ কোটি ডলার আয় হয়েছে; লক্ষ্য ছিল ৩৫২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আয় হয়েছিল ৩৫২ কোটি ৯১ লাখ ডলার।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হস্তশিল্পকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে অনেক কথা বলা হলেও বাস্তবে পৃষ্ঠপোষকতা অনেক কম। ঐতিহ্যগতভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি হয়। কোথাও বাঁশ-বেত, কোথাও নকশিকাঁথা, কোথাও টেরাকোটা, আবার কোথাও বা শতরঞ্জি। হস্তশিল্পে নারীদেরই প্রাধান্য রয়েছে। আবার বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই অতি স্বল্প পুঁঁজিতে ব্যবসা করেন। তাদের পক্ষে মেলা, প্রদর্শনীর আয়োজন করা কিংবা বড় আকারে বাজারজাতকরণের উদ্যোগ নেয়া প্রায় অসম্ভব। এতে তারা আর্থিকভাবে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না। বড় শহরগুলোতে হস্তশিল্পের স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি প্রদর্শনীর আয়োজন করা গেলে হস্তশিল্পের স্থানীয় বাজার যেমন বৃদ্ধি পেত, রপ্তানি বাণিজ্যেও তা অনেক বেশি সহায়ক হতো। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পক্ষে ডিজাইন বা নকশা নিয়ে গবেষণা করা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা কিছু কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। উদ্যোক্তারা মনে করেন, সরকারি উদ্যোগে পণ্যের মানোন্নয়নে গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন বৃদ্ধি করা গেলে তা দেশে হস্ত ও কুটির শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত করবে। উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান এবং হস্তশিল্পের রপ্তানিতে প্রণোদনা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।

বাংলাদেশের কারুপণ্যের ইতিহাস হাজার বছরের প্রাচীন এবং এর রয়েছে জগৎজোড়া খ্যাতি। এক সময় হোগলা জ্বালানি এবং বেড়া তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। রপ্তানিকারকরা এই হোগলা দিয়ে হস্তশিল্প রপ্তানি করে লাখ লাখ গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে প্রতিটি রপ্তানি পণ্যের কাঁচামালের দাম বাড়তি হওয়াতে আমাদের রপ্তানিবাজার হারানোর উপক্রমের পাশাপাশি সুযোগবঞ্চিত গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় দেশীয় হস্তশিল্প এবং এর সঙ্গে লাখ লাখ গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ অব্যাহত রাখতে নগদ সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে।

[লেখক : সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই]

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১ , ৭ মাঘ ১৪২৭, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

হস্তশিল্প এগিয়ে নিতে প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

করোনা মহামারী বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তার প্রভাব পড়েছে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে। তৈরি পোশাকসহ অনেক পণ্যেরই চাহিদা কমে গেছে। ফলে কমেছে রপ্তানি আয়; কিন্তু ব্যতিক্রম হস্তশিল্প। বাংলাদেশের হস্তশিল্পের প্রধান গন্তব্য হচ্ছে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো। ধারণা করা হচ্ছে, করোনা মহামারীতে মানুষ বেশি সময় ঘরে থাকায় গৃহসজ্জার বিভিন্ন উপকরণের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর তাই বাংলাদেশ থেকে হস্তশিল্পের রপ্তানিও বেড়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের হস্ত ও কুটির শিল্প থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বরে) আয় হয়েছে এক কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এই আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮.৭০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তা ২৩.৩৬ শতাংশ বেশি। উদ্যোক্তাদের দাবি, সরকারি সহায়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা গেলে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই শিল্পের রপ্তানি আয় বছরে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

সর্বশেষ ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩১ কোটি ডলার আয় হয়েছে; লক্ষ্য ছিল ৩৫২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আয় হয়েছিল ৩৫২ কোটি ৯১ লাখ ডলার।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হস্তশিল্পকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে অনেক কথা বলা হলেও বাস্তবে পৃষ্ঠপোষকতা অনেক কম। ঐতিহ্যগতভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি হয়। কোথাও বাঁশ-বেত, কোথাও নকশিকাঁথা, কোথাও টেরাকোটা, আবার কোথাও বা শতরঞ্জি। হস্তশিল্পে নারীদেরই প্রাধান্য রয়েছে। আবার বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই অতি স্বল্প পুঁঁজিতে ব্যবসা করেন। তাদের পক্ষে মেলা, প্রদর্শনীর আয়োজন করা কিংবা বড় আকারে বাজারজাতকরণের উদ্যোগ নেয়া প্রায় অসম্ভব। এতে তারা আর্থিকভাবে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না। বড় শহরগুলোতে হস্তশিল্পের স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি প্রদর্শনীর আয়োজন করা গেলে হস্তশিল্পের স্থানীয় বাজার যেমন বৃদ্ধি পেত, রপ্তানি বাণিজ্যেও তা অনেক বেশি সহায়ক হতো। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পক্ষে ডিজাইন বা নকশা নিয়ে গবেষণা করা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা কিছু কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। উদ্যোক্তারা মনে করেন, সরকারি উদ্যোগে পণ্যের মানোন্নয়নে গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন বৃদ্ধি করা গেলে তা দেশে হস্ত ও কুটির শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত করবে। উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান এবং হস্তশিল্পের রপ্তানিতে প্রণোদনা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।

বাংলাদেশের কারুপণ্যের ইতিহাস হাজার বছরের প্রাচীন এবং এর রয়েছে জগৎজোড়া খ্যাতি। এক সময় হোগলা জ্বালানি এবং বেড়া তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। রপ্তানিকারকরা এই হোগলা দিয়ে হস্তশিল্প রপ্তানি করে লাখ লাখ গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে প্রতিটি রপ্তানি পণ্যের কাঁচামালের দাম বাড়তি হওয়াতে আমাদের রপ্তানিবাজার হারানোর উপক্রমের পাশাপাশি সুযোগবঞ্চিত গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় দেশীয় হস্তশিল্প এবং এর সঙ্গে লাখ লাখ গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ অব্যাহত রাখতে নগদ সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে।

[লেখক : সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই]