নতুন নতুন বিধিতে বিব্রত সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা

সামসুল ইসলাম টুকু

সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক করার অর্থই হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের আয়করের আওতায় আনা এবং তাদের আমানতের পরিমাণ নজরে নিয়ে আসা।

বছরখানেক আগে থেকেই সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক করার ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। পরবর্তীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সীমা ৫০ লাখ পর্যন্ত করার ফলে তারা অনেকে অলস টাকা অন্য কোন ব্যবসা বা কৃষি খাতে বিনিয়োগ করেছে। আয়কর বিভাগের বিধিমালায় কারা আয়কর রিটার্ন দাখিল করবে সে ব্যাপারে ক ও খ এই দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক) যাদের করযোগ্য আয় রয়েছে খ) যাদের আবশ্যিকভাবে রিটার্ন দাখিল করতে হবে।

ক এর ১। কোন ব্যক্তি করদাতার (এককভাবে) আয় যদি ৩০০,০০০ তিন লাখ টাকার বেশি হয়। ক এর ২। মহিলা এবং ৬৫ বছর বা তদুর্ধ বয়সের করদাতার আয় যদি ৩৫০,০০০ তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি হয়।

ক এর ৩। গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের আয় যদি ৪৫০,০০০ চার লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকার বেশি হয়।

খ এর ১। যিনি ১২ ডিজিটের টিআইএন গ্রহণ করেছেন।

খ এর ২। করদাতার মোট আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করলে।

খ এর ৩। আয় পূর্ববর্তী তিন বছরের যে কোন বছর করদাতার কর নির্ধারণ হয়ে থাকে বা তার আয় করযোগ্য হয়ে থাকে। এছাড়া আরও কয়েকটি ধারা আছে যেগুলো নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য নয়। উল্লেখিত বিধিমালায় স্পষ্টই বলা হয়েছে কারা রিটার্ন দাখিল করবেন। এরপরেও আয়কর বিভাগের বরাত দিয়ে সম্প্রতি সংবাদপত্রে খবর এসেছে, টিআইএনধারীদের আয়ের পরিমাণ করযোগ্য না হলেও রিটার্ন জমা দিতে হবে। আর না করা হলে সংশ্লিষ্ট টিআইএনধারীকে জরিমানা গুনতে হবে। কর আইন অনুসারে তাদের জরিমানা হবে রিটার্ন দাখিল না করার জন্য প্রথমেই ১ হাজার টাকা। এরপরে রিটার্ন জমা না দেয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ৫০ টাকা হারে। অর্থাৎ বছর শেষে এই জরিমানার পরিমাণ হবে ১৯ হাজার ২৫০ টাকা।

এই বিধিমালা তো পূর্বে উল্লিখিত বিধিমালার অন্তর্ভুক্ত নয়। তাহলে নতুন করে এই বিধি তৈরি হলো। এর আগে তো এই ধরনের ঘোষণা ছিল না আয়কর কর্তৃপক্ষের। এই ঘোষণা অন্ততপক্ষে দেশের কয়েক লাখ নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বিব্রত করেছে। লাখ লাখ মানুষকে এই বিব্রতকর অবস্থায় না ফেলে আয়কর বিভাগই তো পারত এসব সঞ্চয়পত্র তাদের আইডি নম্বর ব্রাউজ করে তাদের সব তথ্য বের করতে। যদি আয়করযোগ্য হয়ে থাকে তবে আয়কর কর্তৃপক্ষ তাকে নোটিস করবে অথবা তার আয় থেকে আয়কর কেটে নিয়ে মেসেজ করে জানিয়ে দেবে সংশ্লিষ্ট সঞ্চয়পত্র ক্রেতাকে। লাখ লাখ রিটার্নের (অকরযোগ্য) বোঝা বাড়িয়ে কোন লাভ আছে কি? এজন্য প্রযুক্তি উন্নত করার বিষয়টিও সরকারের। যারা কোটি কোটি টাকা পাচার করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে আর নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ওপর ঝাল ঝাড়ছে। এটা শিষ্টের পালন দুষ্টের দমন নয় বরং উল্টোটা। আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারাই বলেন আয়কর বিভাগ সম্পর্কে জনসাধারণের ভীতি দূর করতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নতুন বিধি আরোপ করে ভীতি সৃষ্টি করা হচ্ছে।

সরকার বারবার আইন পরিবর্তন করে চলেছে। যেন কোনটাতেই সন্তুষ্টি নেই। পূর্বে সঞ্চয়পত্র বা সঞ্চয় হিসাবের মুনাফা থেকে ৫% হারে আয়কর কাটা হতো। পরে এটা বৃদ্ধি করে ১০% করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হলো, সঞ্চয়পত্র কেনার সীমা একদফা পরিবর্তন করে অতি সম্প্রতি ৫০ লাখ এবং সঞ্চয় হিসাবে ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জানি না এরপরে আর কি পরিবর্তন হবে। এই সীমা নির্ধারণ করার ফলে যাদের আরও বেশি অর্থ সঞ্চিত হবে তা কোন খাতে বিনিয়োগ করবে? স্বাভাবিকভাবেই তাদের অতিরিক্ত অর্থ গোপন রাখবে অথবা এমন কিছু ব্যবসা করবে যেখানে আয়করের সমস্যা নাই। এটা তো সরকারের জন্য লাভজনক হতে পারে না।

যাদের ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এবং ১০ লাখ টাকার সঞ্চয় হিসাব আছে তারা দিব্যি প্রতি বছর ৫ লাখ টাকা মুনাফা পাবে এবং ১০ বছরে তা ৫০ লাখে উন্নীত হবে। সে টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে সরকার ১০% হারে আয়কর কাটতে পারত এবং অতিরিক্ত অর্থেরও আয়কর কাটতে পারত। কিন্তু সীমা নির্ধারণ করার ফলে যেমন সরকার অতিরিক্ত আয়কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি জনসাধারণকে বিপথে পরিচালিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে পক্ষান্তরে। বিষয়গুলো সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

[লেখক : সাংবাদিক]

শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী ২০২১ , ৮ মাঘ ১৪২৭, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

নতুন নতুন বিধিতে বিব্রত সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা

সামসুল ইসলাম টুকু

image

সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক করার অর্থই হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের আয়করের আওতায় আনা এবং তাদের আমানতের পরিমাণ নজরে নিয়ে আসা।

বছরখানেক আগে থেকেই সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক করার ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। পরবর্তীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সীমা ৫০ লাখ পর্যন্ত করার ফলে তারা অনেকে অলস টাকা অন্য কোন ব্যবসা বা কৃষি খাতে বিনিয়োগ করেছে। আয়কর বিভাগের বিধিমালায় কারা আয়কর রিটার্ন দাখিল করবে সে ব্যাপারে ক ও খ এই দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক) যাদের করযোগ্য আয় রয়েছে খ) যাদের আবশ্যিকভাবে রিটার্ন দাখিল করতে হবে।

ক এর ১। কোন ব্যক্তি করদাতার (এককভাবে) আয় যদি ৩০০,০০০ তিন লাখ টাকার বেশি হয়। ক এর ২। মহিলা এবং ৬৫ বছর বা তদুর্ধ বয়সের করদাতার আয় যদি ৩৫০,০০০ তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি হয়।

ক এর ৩। গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের আয় যদি ৪৫০,০০০ চার লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকার বেশি হয়।

খ এর ১। যিনি ১২ ডিজিটের টিআইএন গ্রহণ করেছেন।

খ এর ২। করদাতার মোট আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করলে।

খ এর ৩। আয় পূর্ববর্তী তিন বছরের যে কোন বছর করদাতার কর নির্ধারণ হয়ে থাকে বা তার আয় করযোগ্য হয়ে থাকে। এছাড়া আরও কয়েকটি ধারা আছে যেগুলো নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য নয়। উল্লেখিত বিধিমালায় স্পষ্টই বলা হয়েছে কারা রিটার্ন দাখিল করবেন। এরপরেও আয়কর বিভাগের বরাত দিয়ে সম্প্রতি সংবাদপত্রে খবর এসেছে, টিআইএনধারীদের আয়ের পরিমাণ করযোগ্য না হলেও রিটার্ন জমা দিতে হবে। আর না করা হলে সংশ্লিষ্ট টিআইএনধারীকে জরিমানা গুনতে হবে। কর আইন অনুসারে তাদের জরিমানা হবে রিটার্ন দাখিল না করার জন্য প্রথমেই ১ হাজার টাকা। এরপরে রিটার্ন জমা না দেয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ৫০ টাকা হারে। অর্থাৎ বছর শেষে এই জরিমানার পরিমাণ হবে ১৯ হাজার ২৫০ টাকা।

এই বিধিমালা তো পূর্বে উল্লিখিত বিধিমালার অন্তর্ভুক্ত নয়। তাহলে নতুন করে এই বিধি তৈরি হলো। এর আগে তো এই ধরনের ঘোষণা ছিল না আয়কর কর্তৃপক্ষের। এই ঘোষণা অন্ততপক্ষে দেশের কয়েক লাখ নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বিব্রত করেছে। লাখ লাখ মানুষকে এই বিব্রতকর অবস্থায় না ফেলে আয়কর বিভাগই তো পারত এসব সঞ্চয়পত্র তাদের আইডি নম্বর ব্রাউজ করে তাদের সব তথ্য বের করতে। যদি আয়করযোগ্য হয়ে থাকে তবে আয়কর কর্তৃপক্ষ তাকে নোটিস করবে অথবা তার আয় থেকে আয়কর কেটে নিয়ে মেসেজ করে জানিয়ে দেবে সংশ্লিষ্ট সঞ্চয়পত্র ক্রেতাকে। লাখ লাখ রিটার্নের (অকরযোগ্য) বোঝা বাড়িয়ে কোন লাভ আছে কি? এজন্য প্রযুক্তি উন্নত করার বিষয়টিও সরকারের। যারা কোটি কোটি টাকা পাচার করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে আর নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ওপর ঝাল ঝাড়ছে। এটা শিষ্টের পালন দুষ্টের দমন নয় বরং উল্টোটা। আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারাই বলেন আয়কর বিভাগ সম্পর্কে জনসাধারণের ভীতি দূর করতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নতুন বিধি আরোপ করে ভীতি সৃষ্টি করা হচ্ছে।

সরকার বারবার আইন পরিবর্তন করে চলেছে। যেন কোনটাতেই সন্তুষ্টি নেই। পূর্বে সঞ্চয়পত্র বা সঞ্চয় হিসাবের মুনাফা থেকে ৫% হারে আয়কর কাটা হতো। পরে এটা বৃদ্ধি করে ১০% করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হলো, সঞ্চয়পত্র কেনার সীমা একদফা পরিবর্তন করে অতি সম্প্রতি ৫০ লাখ এবং সঞ্চয় হিসাবে ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জানি না এরপরে আর কি পরিবর্তন হবে। এই সীমা নির্ধারণ করার ফলে যাদের আরও বেশি অর্থ সঞ্চিত হবে তা কোন খাতে বিনিয়োগ করবে? স্বাভাবিকভাবেই তাদের অতিরিক্ত অর্থ গোপন রাখবে অথবা এমন কিছু ব্যবসা করবে যেখানে আয়করের সমস্যা নাই। এটা তো সরকারের জন্য লাভজনক হতে পারে না।

যাদের ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এবং ১০ লাখ টাকার সঞ্চয় হিসাব আছে তারা দিব্যি প্রতি বছর ৫ লাখ টাকা মুনাফা পাবে এবং ১০ বছরে তা ৫০ লাখে উন্নীত হবে। সে টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে সরকার ১০% হারে আয়কর কাটতে পারত এবং অতিরিক্ত অর্থেরও আয়কর কাটতে পারত। কিন্তু সীমা নির্ধারণ করার ফলে যেমন সরকার অতিরিক্ত আয়কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি জনসাধারণকে বিপথে পরিচালিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে পক্ষান্তরে। বিষয়গুলো সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

[লেখক : সাংবাদিক]