সফল উদ্যোক্তা মানবিক যোদ্ধা তৃতীয় লিঙ্গের জয়িতা পাল

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির শখ। স্কুলে ড্রয়িংয়ে খুব ভালো ছিলেন। কিন্তু ড্রয়িংয়ের ওপর উচ্চতর পাঠ নেয়া সম্ভব হয়নি। তাই বলে কি তার আঁকাআঁকি থেমে আছে? থেমে নেই। শুধু ফর্মটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। কাগজে আঁকাআঁকি করতে না পারলেও ঠিকই মনের মাধুরি মিশিয়ে আঁকেন থ্রি-পিস কাপড় ও শাড়িতে। হ্যাঁ, নিজের ফ্যাশন হাউজের থ্রি-পিস ও শাড়িতে তিনিই নিজেই ডিজাইন করেন। শুধু ডিজাইন না, সেই ডিজাইনের ওপর অপটিকস ও বুটিকসের কাজও করেন তিনি।

তবে অবশ্য ব্যবসা বড় হয়ে যাওয়ায় এখন তাকে ঠিক সেভাবে অ্যাপ্লিক ও বুটিকসের কাজ না করলেও চলে। তার অধীনেই এখন ৪০০-এর অধিক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীরা কাজ করেন। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর হয়েও তিনি এখন সফল একজন নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী।

তার নাম জয়িতা পলি। রাজশাহী মহানগরীর মোল্লাপাড়া এলাকায় নিজ বাড়িতেই তিনি গড়ে তুলেছেন তার ‘ডি এ ফ্যাশন হাউজ’। তার এই ফ্যাশন হাউজ সার্বক্ষণিক ২০ জন লোক কাজ করেন। যার মধ্যে ১০ জনই তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর। নিজ বাড়িতেই বাবা-মাকে রেখে তাদের দেখভালও করেন তিনি। সেই জয়িতা পলিই এখন নারীদের অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের ওপর প্রশিক্ষণ দেন।

জয়িতা পলির শুরুটা ২০১৪ সালে মাত্র ৮ হাজার টাকা নিয়ে। সেই তিনিই এখন ১৫ লাখ টাকার মালিক। সব খরচ বাদে তার ক্যাশের পরিমাণ এখন ১৫ লাখ টাকা। তার এই ফ্যাশন হাউজের ওপর এখন অনেক পরিবার নির্ভরশীল। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে বিভিন্ন ধরনের হাতের তৈরি শাড়ি, থ্রি-পিস, বেডসিট ও কুশন কভার তৈরি করে বিক্রি করা হয়। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে তৈরিকৃত এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়।

জয়িতা পলি জানান, ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই অল্প অল্প করে ডিজাইন করতাম। এসএসসিতে পড়াকালীন তৃতীয় লিঙ্গ কমিউনিটি রাইটস নিয়ে কাজ শুরু করি। যে প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করতাম তা ২০১২ সালে শেষ হয়ে যায়। এইচএসসি পাসের পর মাত্র ৮ হাজার টাকা নিয়ে স্বল্প পরিসরে বুটিকসের কাজ শুরু করি। বাজার থেকে কাপড় কিনে নিজেই ডিজাইন করে অ্যাপ্লিক ও বুটিকসের কাজ করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি শুরু করি। স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও তা দু’একজন কিনতে শুরু করে।

তবে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর হওয়ায় প্রথমে লোকজন কিনতে চাইতো না। ডিজাইন এবং বুটিকস ও অ্যাপ্লিকসের কাজ ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়তে থাকে। শুরুতে শাড়ির ওপরই বেশি কাজ করা হতো। যশোরের এক ক্রেতার মাধ্যমে কলকাতাতেও বিক্রি হতো সেইসব শাড়ি। তিনি মারা যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন বেশিরভাগ থ্রি-পিস তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকে। প্রতি মাসে ৭০০ পিস থ্রি-পিস ও ৫০ পিস শাড়ি তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকে। তার কাছ থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকায় পণ্য কিনে নিয়ে সেখানে বিক্রি হয় বলে জানান তিনি। এছাড়া সিলেটের পার্টি আমার কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে সরাসরি লন্ডনে পাঠায়।

জয়িতা পলি জানান, তার হাউজ থেকে তৈরি এক একটি থ্রি-পিস বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায়, ওয়ান পিস বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ১১০০ টাকায়, টু-পিস বিক্রি হয় ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকায় এবং শাড়ি বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। খরচ বাদে গড়ে প্রতিমাসে তার দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়।

জয়িতা পলি জানান, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর হলেও আমাকে কখনও আদি পেশায় নামতে হয়নি। বরং অনেক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মানুষকে আমি কর্মের ব্যবস্থা করে তাদের আদি পেশা থেকে সরিয়ে এনেছি। তারপও শুরুতে জেন্ডার আইডেনটিটির কারণে অনেক প্রবলেম ফেস করতে হয়েছে আমাকে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর হওয়ার কারণে আমাকে ব্যাংক লোন দেয়া হয়নি। অথচ বড় পরিসরে বিজনেস পরিচালনার জন্য তার ব্যাংক লোন প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

জয়িতা পলির কাজের স্বীকৃতির জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসন তাকে ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করে। এছাড়া এসএমই আঞ্চলিক পণ্য মেলা-২০২০ এ দ্বিতীয় নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পান তিনি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাকে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর করোনাকালীন মানবিক যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

জয়িতা পলির প্রতিষ্ঠানে চার বছর ধরে কাজ করছেন তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর রুবিনা। রাজশাহীর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। এখানে তিনি কাপড়ে ডিজাইন করা, প্রিন্ট করা, সেলাই, চুমকি ও পাথর বসানোসহ সব ধরনের কাজ করেন।

তিনি বলেন, আগে আমি আদি পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু এখানে এসে কাজ শুরুর পর আমার নিজের খরচ আমি নিজেই চালাতে পারি। মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান তিনি।

জয়িতা পলির কাছ থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে বাসায় নিয়ে গিয়ে অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের কাজ করেন নগরীর হড়গ্রাম শেখপাড়া এলাকার আজমিরা বেগম। তিনি বলেন, দুই বছর ধরে তার কাছ থেকে থ্রি-পিস ও শাড়ি নিয়ে তাতে পাথর ও চুমকি বসানোর কাজ করে দেন। এইজন্য তিনি একটা থ্রি-পিস বাবদ ৩৫০ টাকা ও একটি শাড়ি বাবদ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পান। তার সঙ্গে দুই বছর ধরে কাজ করলেও এখন লেনদেন নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। কাজ শেষেই পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেন তিনি।

শনিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২১ , ৯ মাঘ ১৪২৭, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

সফল উদ্যোক্তা মানবিক যোদ্ধা তৃতীয় লিঙ্গের জয়িতা পাল

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক | জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী

image

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির শখ। স্কুলে ড্রয়িংয়ে খুব ভালো ছিলেন। কিন্তু ড্রয়িংয়ের ওপর উচ্চতর পাঠ নেয়া সম্ভব হয়নি। তাই বলে কি তার আঁকাআঁকি থেমে আছে? থেমে নেই। শুধু ফর্মটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। কাগজে আঁকাআঁকি করতে না পারলেও ঠিকই মনের মাধুরি মিশিয়ে আঁকেন থ্রি-পিস কাপড় ও শাড়িতে। হ্যাঁ, নিজের ফ্যাশন হাউজের থ্রি-পিস ও শাড়িতে তিনিই নিজেই ডিজাইন করেন। শুধু ডিজাইন না, সেই ডিজাইনের ওপর অপটিকস ও বুটিকসের কাজও করেন তিনি।

তবে অবশ্য ব্যবসা বড় হয়ে যাওয়ায় এখন তাকে ঠিক সেভাবে অ্যাপ্লিক ও বুটিকসের কাজ না করলেও চলে। তার অধীনেই এখন ৪০০-এর অধিক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীরা কাজ করেন। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর হয়েও তিনি এখন সফল একজন নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী।

তার নাম জয়িতা পলি। রাজশাহী মহানগরীর মোল্লাপাড়া এলাকায় নিজ বাড়িতেই তিনি গড়ে তুলেছেন তার ‘ডি এ ফ্যাশন হাউজ’। তার এই ফ্যাশন হাউজ সার্বক্ষণিক ২০ জন লোক কাজ করেন। যার মধ্যে ১০ জনই তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর। নিজ বাড়িতেই বাবা-মাকে রেখে তাদের দেখভালও করেন তিনি। সেই জয়িতা পলিই এখন নারীদের অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের ওপর প্রশিক্ষণ দেন।

জয়িতা পলির শুরুটা ২০১৪ সালে মাত্র ৮ হাজার টাকা নিয়ে। সেই তিনিই এখন ১৫ লাখ টাকার মালিক। সব খরচ বাদে তার ক্যাশের পরিমাণ এখন ১৫ লাখ টাকা। তার এই ফ্যাশন হাউজের ওপর এখন অনেক পরিবার নির্ভরশীল। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে বিভিন্ন ধরনের হাতের তৈরি শাড়ি, থ্রি-পিস, বেডসিট ও কুশন কভার তৈরি করে বিক্রি করা হয়। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে তৈরিকৃত এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়।

জয়িতা পলি জানান, ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই অল্প অল্প করে ডিজাইন করতাম। এসএসসিতে পড়াকালীন তৃতীয় লিঙ্গ কমিউনিটি রাইটস নিয়ে কাজ শুরু করি। যে প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করতাম তা ২০১২ সালে শেষ হয়ে যায়। এইচএসসি পাসের পর মাত্র ৮ হাজার টাকা নিয়ে স্বল্প পরিসরে বুটিকসের কাজ শুরু করি। বাজার থেকে কাপড় কিনে নিজেই ডিজাইন করে অ্যাপ্লিক ও বুটিকসের কাজ করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি শুরু করি। স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও তা দু’একজন কিনতে শুরু করে।

তবে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর হওয়ায় প্রথমে লোকজন কিনতে চাইতো না। ডিজাইন এবং বুটিকস ও অ্যাপ্লিকসের কাজ ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়তে থাকে। শুরুতে শাড়ির ওপরই বেশি কাজ করা হতো। যশোরের এক ক্রেতার মাধ্যমে কলকাতাতেও বিক্রি হতো সেইসব শাড়ি। তিনি মারা যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন বেশিরভাগ থ্রি-পিস তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকে। প্রতি মাসে ৭০০ পিস থ্রি-পিস ও ৫০ পিস শাড়ি তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকে। তার কাছ থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকায় পণ্য কিনে নিয়ে সেখানে বিক্রি হয় বলে জানান তিনি। এছাড়া সিলেটের পার্টি আমার কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে সরাসরি লন্ডনে পাঠায়।

জয়িতা পলি জানান, তার হাউজ থেকে তৈরি এক একটি থ্রি-পিস বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায়, ওয়ান পিস বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ১১০০ টাকায়, টু-পিস বিক্রি হয় ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকায় এবং শাড়ি বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। খরচ বাদে গড়ে প্রতিমাসে তার দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়।

জয়িতা পলি জানান, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর হলেও আমাকে কখনও আদি পেশায় নামতে হয়নি। বরং অনেক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মানুষকে আমি কর্মের ব্যবস্থা করে তাদের আদি পেশা থেকে সরিয়ে এনেছি। তারপও শুরুতে জেন্ডার আইডেনটিটির কারণে অনেক প্রবলেম ফেস করতে হয়েছে আমাকে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর হওয়ার কারণে আমাকে ব্যাংক লোন দেয়া হয়নি। অথচ বড় পরিসরে বিজনেস পরিচালনার জন্য তার ব্যাংক লোন প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

জয়িতা পলির কাজের স্বীকৃতির জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসন তাকে ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করে। এছাড়া এসএমই আঞ্চলিক পণ্য মেলা-২০২০ এ দ্বিতীয় নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পান তিনি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাকে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর করোনাকালীন মানবিক যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

জয়িতা পলির প্রতিষ্ঠানে চার বছর ধরে কাজ করছেন তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর রুবিনা। রাজশাহীর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। এখানে তিনি কাপড়ে ডিজাইন করা, প্রিন্ট করা, সেলাই, চুমকি ও পাথর বসানোসহ সব ধরনের কাজ করেন।

তিনি বলেন, আগে আমি আদি পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু এখানে এসে কাজ শুরুর পর আমার নিজের খরচ আমি নিজেই চালাতে পারি। মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান তিনি।

জয়িতা পলির কাছ থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে বাসায় নিয়ে গিয়ে অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের কাজ করেন নগরীর হড়গ্রাম শেখপাড়া এলাকার আজমিরা বেগম। তিনি বলেন, দুই বছর ধরে তার কাছ থেকে থ্রি-পিস ও শাড়ি নিয়ে তাতে পাথর ও চুমকি বসানোর কাজ করে দেন। এইজন্য তিনি একটা থ্রি-পিস বাবদ ৩৫০ টাকা ও একটি শাড়ি বাবদ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পান। তার সঙ্গে দুই বছর ধরে কাজ করলেও এখন লেনদেন নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। কাজ শেষেই পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেন তিনি।