মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাটাছেঁড়া আর কত দিন চলবে?

এনায়েত আলী বিশ্বাস

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা করা সম্ভব হয়নি। সংশোধন করা হয়েছে ছয়বার। আর মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পরিবর্তন করা হয়েছে ১২ বার। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ৩ মেয়াদে এখনও একটি সঠিক তালিকা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। অর্থ ও নিজেদের লোক বলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। এ প্রবণতা এখন আরও বেশি প্রকট। মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে প্রচুর টাকা খরচ করে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করছেন। আগামী ৩০ জানুয়ারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যে যাচাই-বাছাই হতে যাচ্ছে তাতে এই অর্থ বাণিজ্যের প্রক্রিয়া আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদের যাচাই-বাছাই হবে সেসব গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই ফরমে তিনজন মুক্তিযোদ্ধার নাম সাক্ষী হিসাবে থাকবে। যাদের নাম ভারতীয় তালিকা অথবা লাল মুক্তিবার্তায় আছে। আর এই প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে বেশ জোরেশোরে। এ নিয়ে অভিজ্ঞমহল আশঙ্কা করছেন টাকার জোরে অনেকই হয়তো পার পেয়ে যাবে। ফলে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় যে ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে কত জনকে বাদ দিতে পারবে?

তবে এদের মধ্যে সবাই যে অমুক্তিযোদ্ধা তা কিন্তু বলা যায় না। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তেমনি আবার রাজনৈতিক কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বাদ পড়েছেন। যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অথচ এ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হতে পারেননি, তার মধ্যে অনলাইনভুক্ত দাবিদার মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই ২০১৭ সালে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এখনও তাদের নাম গেজেটভুক্ত হয়নি। ২০১৭ সালে দাবিদার মুক্তিযোদ্ধাদের যে যাচাই-বাছাই হয় তাতে ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং ভারতের বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যারা ভারতে না যেয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করেছিলেন তারা কী মুক্তিযোদ্ধা নয়? তারা কী যাচাই-বাছাইতে মনোনীত হতে পারবেন না? জামুকা ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কাছে বহু জনের দাবি, যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অথচ এখনও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি, তারা যাতে মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে।

আগামী ৩০ জানুয়ারি ২০০২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত জামুকার অনুমোদনবিহীন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যে যাচাই-বাছাই হচ্ছে তা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সঠিক সংখ্যা ও সংজ্ঞা নির্ধারণে বিভেদ রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, কোন সংজ্ঞা নির্ধারণে ১৯৭২ সালকে পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। যার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নিয়েও অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে। আর সেই সঙ্গে বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কের পর অনেকে বাদও পড়েছেন। তবু এখনও অনেক অমুক্তিযোদ্ধা বাদ যায়নি। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিস্মিত হতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও যাদের ত্যাগে আজকের এই স্বাধীনতা, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ৪৯ বছরেও নিরুপিত করা যায়নি। এবারই যেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা যায়, জামুকা ও মুক্তিযোদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে জনগণের এই দাবি।

[লেখক : অধ্যাপক]

শনিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২১ , ৯ মাঘ ১৪২৭, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাটাছেঁড়া আর কত দিন চলবে?

এনায়েত আলী বিশ্বাস

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা করা সম্ভব হয়নি। সংশোধন করা হয়েছে ছয়বার। আর মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পরিবর্তন করা হয়েছে ১২ বার। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ৩ মেয়াদে এখনও একটি সঠিক তালিকা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। অর্থ ও নিজেদের লোক বলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। এ প্রবণতা এখন আরও বেশি প্রকট। মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে প্রচুর টাকা খরচ করে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করছেন। আগামী ৩০ জানুয়ারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যে যাচাই-বাছাই হতে যাচ্ছে তাতে এই অর্থ বাণিজ্যের প্রক্রিয়া আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদের যাচাই-বাছাই হবে সেসব গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই ফরমে তিনজন মুক্তিযোদ্ধার নাম সাক্ষী হিসাবে থাকবে। যাদের নাম ভারতীয় তালিকা অথবা লাল মুক্তিবার্তায় আছে। আর এই প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে বেশ জোরেশোরে। এ নিয়ে অভিজ্ঞমহল আশঙ্কা করছেন টাকার জোরে অনেকই হয়তো পার পেয়ে যাবে। ফলে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় যে ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে কত জনকে বাদ দিতে পারবে?

তবে এদের মধ্যে সবাই যে অমুক্তিযোদ্ধা তা কিন্তু বলা যায় না। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তেমনি আবার রাজনৈতিক কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বাদ পড়েছেন। যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অথচ এ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হতে পারেননি, তার মধ্যে অনলাইনভুক্ত দাবিদার মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই ২০১৭ সালে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এখনও তাদের নাম গেজেটভুক্ত হয়নি। ২০১৭ সালে দাবিদার মুক্তিযোদ্ধাদের যে যাচাই-বাছাই হয় তাতে ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং ভারতের বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যারা ভারতে না যেয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করেছিলেন তারা কী মুক্তিযোদ্ধা নয়? তারা কী যাচাই-বাছাইতে মনোনীত হতে পারবেন না? জামুকা ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কাছে বহু জনের দাবি, যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অথচ এখনও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি, তারা যাতে মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে।

আগামী ৩০ জানুয়ারি ২০০২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত জামুকার অনুমোদনবিহীন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যে যাচাই-বাছাই হচ্ছে তা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সঠিক সংখ্যা ও সংজ্ঞা নির্ধারণে বিভেদ রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, কোন সংজ্ঞা নির্ধারণে ১৯৭২ সালকে পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। যার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নিয়েও অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে। আর সেই সঙ্গে বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কের পর অনেকে বাদও পড়েছেন। তবু এখনও অনেক অমুক্তিযোদ্ধা বাদ যায়নি। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিস্মিত হতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও যাদের ত্যাগে আজকের এই স্বাধীনতা, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ৪৯ বছরেও নিরুপিত করা যায়নি। এবারই যেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা যায়, জামুকা ও মুক্তিযোদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে জনগণের এই দাবি।

[লেখক : অধ্যাপক]