পঞ্চাশ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অপেক্ষায় এক মুক্তিযোদ্ধা

সামসুজ্জামান

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে মর্মস্পর্শী খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম ছিল ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবক সুবল ভাই জীবনসায়াহ্নে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান’। খবরটি পড়লে যে কোনো দেশপ্রেমিক মানুষের মর্মস্পর্শ করে যাবে।

সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এবং মাথায় টুপি পরিহিত সদাহাস্য মানুষটির জন্ম গফরগাঁওয়ের সালটিয়া ইউনিয়নের রৌহা গ্রামে। তার পুরো নাম মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল। তাই সুবল ভাই নামেই তিনি গফরগাঁওয়ের মানুষের কাছে পরিচিত। এক সময় তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী ছিলেন। সে সময় থেকেই তিনি লুঙ্গি পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি ব্যবহার শুরু করেন। বয়স আটাশি বছর। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এ মানুষটির জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি এবং সনদ পাননি।

আজকে আমরা প্রতি পদে পদে দেখছি কীভাবে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের। চিকিৎসা নিতে বিড়ম্বনা, চাকরি করতে বিড়ম্বনা। এমনকি মৃত্যুর পর গার্ড অব অনারেও বিড়ম্বনা। সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে গার্ড অব অনারে সংশ্লিষ্ট অফিসারের না আসার কারণে এলাকাবাসী রাগে-দুঃখে, অভিমানে গার্ড অব অনার ছাড়াই বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফন করেন।

হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আজ সঠিক তালিকার অভাবে সরকারি ন্যূনতম ভাতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ আলবদর, রাজাকার অমুক্তিযোদ্ধারা ভাতা তুলছে। হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ কেবিনের ব্যবস্থা করা থাকলেও টাঙ্গাইলে বেড না পেয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা স্ট্রোকের রোগী দুই দিন পর মারা গেছেন। রংপুরে ছেলেকে কোন কারণ ছাড়াই ড্রাইভারের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার অভিমানে বৃদ্ধ পিতা হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর পর তাকে গার্ড অব অনার না দেওয়ার জন্য হুইপ সাহেব বরাবর চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন। চিঠিটি হুইপ সাহেবের হাতে পৌঁছার আগেই তিনি মারা গিয়েছেন। চোখের সামনে এমন সব ঘটনা দেখলে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, দেখেছি পাক সেনা এবং তার দোসর রাজাকার আলবদরদের হিংস্রতা, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির দৃশ্য, চুকনগর গণহত্যার দৃশ্য, যেখানে কমপক্ষে দশ হাজার লোককে কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়- আমাদের রক্ত তখন টগবগ করে ফুটতে থাকে। নিজেকে সংযত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও সুবল ভাই আজও পাননি মুক্তিযোদ্ধা সনদ। এর থেকে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে।

সরকারের হাতিসম একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করবার জন্য। কিন্তু তারা মনে হয় খবরও রাখেন না যশোরের কেশবপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. হামিদ গাজীর কথা। যিনি আজ বৎসরাধিক কাল যাবত স্ট্রোক করে বাড়িতেই পড়ে আছেন। আর হয়ত মৃত্যুর ক্ষণগণনা করছেন।

স্বাধীনতার স্থপতি দলটি আজ একযুগ যাবত দেশ শাসন করছে। কেন মুক্তিযোদ্ধারা আজ লাঞ্ছিত, বঞ্চিত। তাহলে পাক-প্রেতাত্মা কি এখনও জেঁকে বসে আছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে মুক্তবাংলার আকাশে বাতাসে। এর সদুত্তর তো একমাত্র সরকারই দিতে পারবে।

সোমবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২১ , ১১ মাঘ ১৪২৭, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

পঞ্চাশ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অপেক্ষায় এক মুক্তিযোদ্ধা

সামসুজ্জামান

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে মর্মস্পর্শী খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম ছিল ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবক সুবল ভাই জীবনসায়াহ্নে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান’। খবরটি পড়লে যে কোনো দেশপ্রেমিক মানুষের মর্মস্পর্শ করে যাবে।

সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এবং মাথায় টুপি পরিহিত সদাহাস্য মানুষটির জন্ম গফরগাঁওয়ের সালটিয়া ইউনিয়নের রৌহা গ্রামে। তার পুরো নাম মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল। তাই সুবল ভাই নামেই তিনি গফরগাঁওয়ের মানুষের কাছে পরিচিত। এক সময় তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী ছিলেন। সে সময় থেকেই তিনি লুঙ্গি পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি ব্যবহার শুরু করেন। বয়স আটাশি বছর। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এ মানুষটির জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি এবং সনদ পাননি।

আজকে আমরা প্রতি পদে পদে দেখছি কীভাবে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের। চিকিৎসা নিতে বিড়ম্বনা, চাকরি করতে বিড়ম্বনা। এমনকি মৃত্যুর পর গার্ড অব অনারেও বিড়ম্বনা। সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে গার্ড অব অনারে সংশ্লিষ্ট অফিসারের না আসার কারণে এলাকাবাসী রাগে-দুঃখে, অভিমানে গার্ড অব অনার ছাড়াই বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফন করেন।

হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আজ সঠিক তালিকার অভাবে সরকারি ন্যূনতম ভাতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ আলবদর, রাজাকার অমুক্তিযোদ্ধারা ভাতা তুলছে। হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ কেবিনের ব্যবস্থা করা থাকলেও টাঙ্গাইলে বেড না পেয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা স্ট্রোকের রোগী দুই দিন পর মারা গেছেন। রংপুরে ছেলেকে কোন কারণ ছাড়াই ড্রাইভারের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার অভিমানে বৃদ্ধ পিতা হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর পর তাকে গার্ড অব অনার না দেওয়ার জন্য হুইপ সাহেব বরাবর চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন। চিঠিটি হুইপ সাহেবের হাতে পৌঁছার আগেই তিনি মারা গিয়েছেন। চোখের সামনে এমন সব ঘটনা দেখলে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, দেখেছি পাক সেনা এবং তার দোসর রাজাকার আলবদরদের হিংস্রতা, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির দৃশ্য, চুকনগর গণহত্যার দৃশ্য, যেখানে কমপক্ষে দশ হাজার লোককে কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়- আমাদের রক্ত তখন টগবগ করে ফুটতে থাকে। নিজেকে সংযত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও সুবল ভাই আজও পাননি মুক্তিযোদ্ধা সনদ। এর থেকে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে।

সরকারের হাতিসম একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করবার জন্য। কিন্তু তারা মনে হয় খবরও রাখেন না যশোরের কেশবপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. হামিদ গাজীর কথা। যিনি আজ বৎসরাধিক কাল যাবত স্ট্রোক করে বাড়িতেই পড়ে আছেন। আর হয়ত মৃত্যুর ক্ষণগণনা করছেন।

স্বাধীনতার স্থপতি দলটি আজ একযুগ যাবত দেশ শাসন করছে। কেন মুক্তিযোদ্ধারা আজ লাঞ্ছিত, বঞ্চিত। তাহলে পাক-প্রেতাত্মা কি এখনও জেঁকে বসে আছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে মুক্তবাংলার আকাশে বাতাসে। এর সদুত্তর তো একমাত্র সরকারই দিতে পারবে।