মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্

মূল : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ভাষান্তর : সুরাইয়া ফারজানা হাসান

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী ছেলেটি এত বেশি সময়নিষ্ঠ যে, সে যখন এসে পৌঁছায়, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ তখনও স্নানের পোশাক পরে আছেন, মাথায় চুল কোঁচকাবার ক্লিপ, এবং তাঁকে যাতে আকর্ষণহীনা না দেখায়, সেজন্য তাঁর হাতে কেবল কানের পিছনে গোলাপ গোঁজার সময়টুকু আছে। এমনকি দরজা খোলার সময়ও, তিনি নিজের চেহারা নিয়ে মনে মনে আফসোস করছেন আর দরজা খুলে দেখেন- ছেলেটিকে তিনি যেমনটি ভেবেছেন, তেমনটি নয়, ও অন্যান্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মতো দুখী দুখী চেহারার কেউ নয়, বরং চেককাটা জ্যাকেট আর নানান রঙের পাখির ছাপওলা টাই পরা ভীরু চেহারার এক যুবক। ওর গায়ে ওভারকোট নেই, যদিও বার্সেলোনার বসন্তে বিশ্বাস নেই, আর এ সময়ের এলোপাতাড়ি দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি শীতকালের চেয়েও অসহ্য রকমের ঠাণ্ডা। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টায় অনেক পুরুষকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, অথচ আজ এই যুবককে দেখে তাঁর খুব বিব্রত বোধ হচ্ছে। তিনি সবেমাত্র ছিয়াত্তর বছর বয়সে পা দিয়েছেন এবং এরই মধ্যে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে বড়দিনের আগেই তিনি মারা যাবেন, আর তা সত্ত্বেও, তিনি লজ্জার বশে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের ছেলেটিকে একটুু অপেক্ষা করতে বলতে যাচ্ছিলেন, যাতে ঠিকঠাক মতো পোশাক পরে, ওকে অভ্যর্থনা জানাতে পারেন। তখনই তাঁর মনে হলো, ছেলেটি দরজার সামনের অন্ধকার জায়গায় শীতে জমে যাবে, তাই তিনি ওকে ঘরে ঢুকতে বললেন।

‘দয়া করে বিদঘুটে চেহারার জন্য আমায় ক্ষমা করবেন’, তিনি বলেন, তবে আমি কাতালোনিয়ায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছি, এবং এই প্রথম কেউ নির্দিষ্ট সময়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো।

তিনি নির্ভুল কাতালান, কিছুটা সেকেলে বিশুদ্ধ ভাষায় কথাগুলো বললেন, যদিও তাতে তাঁর ভুলে যাওয়া পর্তুগিজ ভাষার সুর শোনা যাচ্ছে। এত বয়স সত্ত্বেও, চুল কোঁকড়ানোর ধাতব ক্লিপ পরে, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্কে এখনও

তন্বী, সজীব, বর্ণসংকর মূলাতা নারীর মতো দেখাচ্ছে। তারের মতো শক্ত ঢেউ খেলানো চুল এবং নিষ্করুণ হলুদ চোখের এই বয়স্কা নারী বহু বছর আগেই পুরুষের প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী ছেলেটি, রাস্তার বাতির আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় কোনো মন্তব্য করে না, তবে জুতোর তলা পাটের পাপোশে মুছে নিয়ে, মাথা নুইয়ে তাঁর হাতে চুমু খায়।

‘তুমি অনেকটা আমাদের সময়ের পুরুষদের মতো’, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ শিলাবৃষ্টির মতো ধারালো হাসি হেসে বললেন, ‘বসে পড়ো।’

যদিও ছেলেটি এ কাজে নতুন, তবু ও ভালো করেই জানে, সকাল আটটায় কারও মুখে স্বাগত সম্ভাষণ আশা না করাই উচিত, অন্তত এই নির্দয় বৃদ্ধার কাছ থেকে তো নয়ই, যাকে প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে আমেরিকা মহাদেশগুলো থেকে পালিয়ে আসা এক ছিটগ্রস্ত মহিলা। আর তাই, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ যখন জানালার দামি ভারি দীর্ঘ পর্দাটা ঠেলে সরাতে তৎপর হলেন, ছেলেটি দরজা থেকে এক পা দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, বুঝতে পারছে না কী বলবে। তখন এপ্রিলের ফিকে আলো অতি যতে্ন সজ্জিত বসারঘরের কোণগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরটাকে এখন বৈঠকখানার বদলে পুরনো আমলের মূল্যবান জিনিসপত্রের বিক্রয় কেন্দ্রের মতো দেখাচ্ছে। এই বাড়ির রোজকার ব্যবহার্য জিনিসপত্র খুব বেশিও নয়, আবার কমও নয়, এবং প্রত্যেকটি জায়গামতো রুচিসম্মতভাবে সাজানো। বার্সেলোনার মতো পুরনো এবং নিরিবিলি শহরে এর চেয়ে সুরুচিপূর্ণ গৃহসজ্জার দেখা পাওয়া কঠিনই বটে।

‘আমায় ক্ষমা করুন’, ছেলেটি বলে। ‘আমি ভুল দরজায় কড়া নেড়েছি।’

‘আহা! তা-ই যদি হতো’, তিনি বলেন, ‘তবে মৃত্যু কখনো ভুল করে না।’

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিক্রয়কর্মী ছেলেটি খাবার ঘরের টেবিলের উপর, নৌযান চালনার মানচিত্রের মতো অনেকগুলো ভাঁজ হয়ে যাওয়া একটি নকশা পেতে দেয়, যাতে নানা রঙের ক্রুশ এবং মূর্তিসহ ছক কাটা আছে। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ মন্ত-হুইখ পাহাড়ের বিশাল কবরস্থানের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা দেখল, এবং এক পুরাতন ভয়ের স্মৃতি তাঁকে জেঁকে ধরে। কোনো এক অক্টোবর মাসে বৃষ্টিস্নাত মানাউসের কবরস্থানে টাপিরের দল অনুপ্রবেশ করে। বুনো পশুর দল পুরো কবরস্থানে ছড়িয়ে পড়ে বৃষ্টির থিকথিকে কাদা-জল ছিটিয়ে, নামবিহীন কবর এবং ফ্লোরেন্সের রঙিন কাচের জানালা শোভিত অভিযাত্রীদের সমাধি-স্তম্ভ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। খুব ছোট্টবেলার তাঁর আরেকটি স্মৃতি আছে। এক সকালে, আমাজনের বন্যা বীভৎস জলাভূমির রূপ নিল এবং তিনি বাড়ির উঠোনে ভাসতে থাকা এক ভাঙা কফিনের ফাঁকে ছেঁড়া ত্যানা আর মৃত মানুষের চুল দেখতে পান। এসব ভয়ানক স্মৃতির কারণে তিনি বাড়ির কাছের, অপেক্ষাকৃত চেনাজানা সান্ গরভাসিও’র করবস্থানের পরিবর্তে, মন্ত-হুইখ পাহাড় শেষ বিশ্রামস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

‘বুঝলে, আমি এমন জায়গা চাই, যেখানে বন্যা হবে না’, তিনি বলেন।

‘বেশ, এই জায়গায় তবে’, বিক্রয়কর্মী পকেট থেকে ঝরনা কলমের মতো দেখতে ভাঁজ করা যায় এমন পয়েন্টার দিয়ে মানচিত্রে নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে বলে, ‘পৃথিবীর কোনো মহাসাগরই এই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে না।’

মারিয়া কবরস্থানের রঙিন ছকটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রধান প্রবেশদ্বার, এবং তিনটি কাছাকাছি, একই রকম, নামবিহীন কবর দেখতে পান। কবরগুলোতে গৃহযুদ্ধে নিহত বুয়েনাভেন্তুরা র্দুরাতি, এবং আরও দুজন সন্ত্রাসবাদীকে সমাহিত করা হয়েছে। প্রতি রাতে কে বা কারা তাদের নাম সমাধির কালো পাথরে লেখে। ওরা তাদের নাম পেন্সিল, রং, কয়লা, ভ্রু আঁকার পেন্সিল, নেইলপালিশ দিয়ে লিখে দিয়ে যায়, এবং প্রতিদিন সকালে কবরস্থানের পাহারাদার মুছে ফেলে যাতে কেউ না জানে মৌনি পাথরের নিচে কারা শায়িত আছেন। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ র্দুরাতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন, বার্সেলোনার সবচেয়ে বেদনাবিধুর এবং বিক্ষুব্ধ সে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, এবং তিনি লোকটার কবরের আশেপাশে শেষ বিশ্রাম-স্থল চাইছিলেন। কিন্তু কোনোটাই পাওয়া যাচ্ছিল না, আর তাই তিনি সম্ভাব্য যেকোনো জায়গায় শেষ নিদ্রার জন্য নিজেকে সমর্পণ করেন। ‘তবে একটি শর্তে’, তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকঘরের মতো ওই পাঁচ বছর মেয়াদি কুঠুরিতে গাদা করে রাখবে না।’ এরপর কোনো এক দরকারি কথা মনে পড়ায়, তিনি কথা শেষ করেন : ‘এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমাকে কিন্তু শুইয়ে কবর দিতে হবে। কারণ মৃত্যুর আগে কবর কিনে রাখা বিষয়টি এত বেশি প্রচারিত হয়ে গেছে যে, গুজব উঠেছে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের লোকজন জায়গা বাঁচানোর জন্য দাঁড় করিয়ে কবর দেয়। অনেকটা মুখস্থ ও বক্তৃতা দেয়ার মতো নির্ভুলভাবে সেলসম্যান ব্যাখ্যা করে, গুজবটা সেকেলে সব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংস্থাগুলো বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ছড়িয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের কিস্তির ভিত্তিতে নজিরবিহীন কবর বিক্রি করার পরিকল্পনাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। ছেলেটি কথা বলার সময়, দরজায় তিনটি সতর্ক ছোট্ট টোকা পড়ে, এবং সে থতমত খেয়ে একটু থামে, তবে মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ তাকে কথা চালিয়ে যাওয়ার ইশারা করলেন। ‘অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই’, তিনি শান্তস্বরে বলেন। ‘ও নোই।’

বিক্রয়কর্মীর যেটুকু বলার বাকি ছিল, তা শুরু করে দিল এবং মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ ওর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হলেন। মানাউসের বন্যার পর বছরের পর বছর যে দুশ্চিন্তা তাঁর মনে পাকাপোক্তভাবে ঠাঁই করে নিয়েছিল, ভাবলেন দরজা খোলার আগেই সেটার চূড়ান্ত মীমাংসা করবেন। ‘আমি যেটা বোঝাতে চাচ্ছি’, তিনি বললেন, ‘তা হলো, আমি মৃত্যুর পর মাটিতে শায়িত হবার জন্য, যে জায়গা খুঁজছি, সেখানে বন্যার কোনো ঝুঁকি থাকবে না এবং যদি সম্ভব হয় গ্রীষ্মকালে গাছের ছায়া থাকবে, এবং নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর আমার দেহের অবশিষ্টাংশ উঠিয়ে জঞ্জালে ছুড়ে ফেলে দেয়া হবে না।’

তিনি সামনের দরজাটা খুললেন, এবং ছোট্ট একটি কুকুর বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ঘরের ভিতর ঢোকে। কুকুরটার অভব্য চেহারার সাথে এই বাড়ির কোনো কিছু মেলে না। আশেপাশের কোথাও প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছে, এবং ঘরে ঢুকেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। টেবিলের উপর লাফ দিয়ে ওঠে, পাগলের মতো ঘেউ ঘেউ করে, এবং আর একটু হলে কাদামাখা থাবা দিয়ে কবরস্থানের মানচিত্র নিয়ে দৌড়াতে যাচ্ছিল। তবে মনিবের একটু কঠোর চাহনিই ওটার বাঁদরামো থামানোর জন্য যথেষ্ট। ‘নোই!’ তিনি কণ্ঠস্বর একটুও না তুলেই বলেন, ‘বাইক্সা দ্য, আসি!’ (টেবিল থেকে নামো বলছি)!’

মারিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রাণিটি ভয়ে কুঁকড়ে যায়, এবং দু’ফোঁটা টলটলে অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। এবার মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ বিক্রয়কর্মীর দিকে মনোযোগ দিলেন, এবং ছেলেটিকে বেশ হতভম্ব মনে হলো।

‘কেয়োনস (এ কী)!’ সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল। ‘কুকুরটা তো কাঁদছিল!’

‘এ সময়ে ঘরে অন্য কাউকে দেখেছে বলেই ওর মন খারাপ হয়েছে,‘ মারিয়াদোস্ প্রাজেরেস্ নিচু স্বরে ক্ষমা চাওয়ার সুরে বলেন। ‘সাধারণত, ও যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন একজন পুরুষ মানুষের চেয়েও সৌজন্যতা দেখায়। কেবলমাত্র আজ দেখছি, আপনাকে দেখে এমনটি করল।’

‘কিন্তু ও যে কাঁদল, কী কাণ্ড!’ বিক্রয়কর্মী বলেই, বুঝতে পারে ওর কথাটা হয়তোবা ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তাই লজ্জায় লাল হয়ে, ক্ষমা প্রার্থনা করে। ‘আমায় ক্ষমা করুন, তবে আমি এমনটা বাস্তবে তো নয়ই, এমনকি সিনেমায় পর্যন্ত দেখিনি।’

‘সব কুকুরই এমন কাঁদতে পারবে, যদি আপনি ওদের শেখান’, তিনি বললেন, ‘অথচ দেখুন মালিকেরা সারাটা জীবন ওদের এমন কিছু শেখায়, যা ওদের ক্ষতিই করে- এই যেমন প্লেট থেকে খাওয়া অথবা নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে একই জায়গায় কোনো কাজ করা। এবং এখন পর্যন্ত ওদের জীবনকে উপভোগ করার মতো স্বাভাবিক জিনিস শেখায় না, যেমন হাসি, কান্না। যাক্গে, আমরা যেন কই ছিলাম?’

কথা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ নিজেকে গাছপালাবিহীন রুক্ষ গ্রীষ্মের কাছে সঁপে দিলেন, কারণ কবরে গাছের ছায়া সরকারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত করা আছে। অন্যদিকে, চুক্তির শর্ত এবং বিধি অনুযায়ী তা অসংগত, কারণ তিনি নগদ অর্থের বিনিময়ে বিশেষ মূল্যহ্রাসের সুযোগ পেতে যাচ্ছেন।

কথাবার্তা শেষ হলে, কাগজপত্র গুছিয়ে ব্রিফকেসে রেখে বিক্রয়কর্মী ঘরটির চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, এবং ঘরের জাদুকরী সৌন্দর্য দেখে শিহরিত বোধ করে। ও আবারো মারিয়া দোস্ প্রাজেরেসের দিকে চাইল, যেন এই প্রথম তাঁকে দেখছে।

‘আমি কি আপনাকে একটা এলেবেলে কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’, সে বলে।

মারিয়া ছেলেটির সাথে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এলেন।

‘নিশ্চয়ই’, তিনি বললেন, ‘তবে আমার বয়স বাদে যা ইচ্ছে।’

‘আমি লোকের বাড়িঘরের জিনিসপত্র দেখে, তাদের পেশা আন্দাজ করার চেষ্টা করি, এবং সত্যি বলতে কী, আমি আপনার এখানে তা পারিনি’, ও বলে, ‘আপনি কী করেন বলুন তো?’

হাসিটা কোনোমতে সামলে নিয়ে মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ উত্তর দিলেন :

‘আমি একজন দেহপসারিণী, বাছা। আমাকে কি ওরকম দেখাচ্ছে না?’

সেলসম্যানের মুখ লজ্জায় রাঙা হলো, ‘আমি দুঃখিত।’

‘আমার আরও দুঃখিত হওয়া প্রয়োজন’, বলে তিনি ছেলেটা যাতে দরজায় ধাক্কা না খায়, সেজন্য দুবাহু দিয়ে আগলে ধরলেন। ‘আর একটু সাবধানী হও! আমাকে ঠিকঠাক মতো কবর দেয়ার আগে তুমি নিজের মাথার খুলি ভেঙো না কিন্তু।’

দরজা বন্ধ করেই, তিনি ছোট্ট কুকুরটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন, আর তাঁর সুন্দর আফ্রিকান কণ্ঠে পাশের নার্সারি স্কুলের বাচ্চাদের গানের সাথে তাল মেলালেন। তিন মাস আগে, তিনি স্বপ্নে দেখেন মারা যাচ্ছেন, আর সেই সময় থেকে, তিনি তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে এই কুকুরছানাকে কাছে টেনে নেন। তিনি তাঁর সম্পদ-সম্পত্তির মরণোত্তর বিলিবণ্টনের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন এবং মৃত্যুর পর নিজের মৃতদেহের সদ্গতির ব্যবস্থা এত যতেœর সাথে করে রেখেছেন যে, তিনি হঠাৎ মারা গেলেও কারও কোনো অসুবিধা হবে না। তিনি তাঁর দেহপসারিণী জীবিকা থেকে অবসর নিয়েছেন। নিজের ভাগ্যটা তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন, তবে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর জীবনে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে যে বাড়িটা পুরনো ও অভিজাত গ্রাসিয়া শহরে কিনেছিলেন, নগর সম্প্রসারণের সাথে সাথে সেটাও গ্রাস হয়ে গেছে। তিনি একটি জীর্ণশীর্ণ বাড়ির দোতলায় অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যেখানে সর্বত্র ঝলসানো হেরিং মাছের চিরস্থায়ী গন্ধ লেগে আছে, দেয়াল সল্ট-পিটার ক্ষারে নোনা ধরে গেছে, এবং তবে এখনো কলঙ্কময় যুদ্ধের কিছু বুলেটের গর্ত রয়ে গেছে। এই বাড়িতে কোনো দারোয়ান নেই, যদিও অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় লোকজন বসবাস করছে, এছাড়া অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ির কোনো কোনো ধাপও উধাও হয়ে গেছে। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ রান্নাঘর আর গোসলখানা সংস্কার করে নিয়েছেন, দেয়ালে উজ্জ্বল ফ্যাব্রিক লাগিয়েছেন, জানালায় খাঁজকাটা কাচ বসিয়ে মখমলের লম্বা পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এরপর সূক্ষ্ম কাজ করা আসবাবপত্র, ঘর সাজানোর শৌখিন জিনিসপত্র এবং সিল্কে ব্রোকেডের কাজ করা সিন্ধুক কিনেছেন। জিনিসগুলো ফ্যাসিস্টদের পরাজয়ের পর পালিয়ে যাওয়া লোকজনের বাড়িঘর থেকে চুরি করে আনা, এবং তিনি বহু বছর ধরে এগুলো একের পর এক গোপন নিলামে দরকষাকষি করে কিনেছেন। অতীতের সাথে তাঁর একমাত্র সংযোগ হলো কার্দোনার কাউন্টের সাথে বন্ধুত্ব, যিনি প্রতিমাসের শেষ শুক্রবার তাঁর সাথে নৈশভোজন করার জন্য আসতেন এবং রাতের খাবারের পর প্রেম ভালোবাসা করার পর অবসন্ন হয়ে শুয়ে থাকতেন। তবে যৌবনে গড়ে ওঠা এই বন্ধুত্ব সবার কাছে লুকানো ছিল। কাউন্ট তার কোট অব আর্মস চিহ্নিত গাড়িটা বেশ দূরে সতর্কতার সাথে রেখে, মারিয়ার দোতালার অ্যাপার্টমেন্টে আসতেন, তাঁকে রক্ষার পাশাপাশি নিজের মান-সম্মান বজায় রাখার জন্য। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ জানতেন, তাঁর বাড়ির উল্টো দিকের বাড়ির নয় বছরের কন্যাসহ তরুণ দম্পতি বহু আগেই চলে গেছে, তিনি ওদের ছাড়া অ্যাপার্টমেন্টের কাউকেই চিনতেন না। তবে, সিঁড়িতেও যে কখনো কারও সাথে দেখা হয়নি, ব্যাপারটা মারিয়ার কাছে অদ্ভুত ঠেকে।

এখন মৃত্যুর পর বিষয় আশয় বিলিবণ্টন করতে গিয়ে দেখা গেল, ভদ্র মার্জিত কাতালনিয়ান সম্প্রদায়, যাদের তিনি অসংগঠিত বলে ভেবেছিলেন, তাদের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। তিনি তাঁর বাড়ির আশেপাশের লোকজনের, যাদের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক, তাদের জন্য সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ঘর সাজানোর শৌখিন জিনিসপত্র রেখেছেন। বিলি-বণ্টনের কাজটা সম্পন্ন হয়ে গেলে, তাঁর নিজেকে খুব বেশি নিরপেক্ষ বলে মনে হলো না, তবে তিনি নিশ্চিত, তাঁর কাছ থেকে কিছু আশা করে, মোটামুটি এমন সবাইকে তিনি মনে রেখেছেন। তিনি এত নিখুঁতভাবে উইল করে গেছেন যে, এর দায়িত্বে নিয়োজিত ‘কল দি আরবর’-এর নোটারি লোকটি, প্রশংসায় গদগদ হয়ে বলেছেন, তিনি তাঁর চোখকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, মারিয়া নোটারি অফিসের ক্লার্ককে মধ্যযুগীয় কাতালান ভাষায় গড়গড় করে, স্মৃতি হাতড়ে বলে যাচ্ছেন- নিজের সম্পত্তির বিস্তারিত তালিকার পাশাপাশি প্রতিটি জিনিসের সত্যিকারের নাম, এবং উত্তরাধিকারীদের সম্পূর্ণ তালিকা, তাদের পেশা, ঠিকানাসহ হৃদয়ে তাদের অবস্থান।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিক্রয়কর্মী বাড়িতে আসার পর থেকে, মারিয়া রোববারে কবরস্থানের অগুনতি দর্শনার্থীর মধ্যে একজন হয়ে গেলেন। তাঁর কবরস্থানের প্রতিবেশীদের মতো, তিনিও শবাধারগুলোর ওপর এক বছর মেয়াদি ফুলের গাছ লাগালেন, নতুন ঘাসে পানি দিলেন এবং ঘাস কাটার যন্ত্র দিয়ে বড় বড় ঘাসগুলো কেটেছেঁটে সাফসুতরো করেছেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত মেয়রের অফিসের গালিচার মতো দেখায়, এবং জায়গাটার সাথে এতবেশি পরিচিত হয়ে গেছেন যে, শেষমেশ তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না কেন তার কাছে শুরুর দিকে জায়গাটা এত নির্জন মনে হয়েছিল।

তিনি যখন প্রথম কবরস্থানে যান, প্রবেশদ্বারের কাছে তিনটা কবর দেখে তার হৃৎপিণ্ডের একটি স্পন্দন ছুটে যায়, তবে তিনি ওগুলোর দিকে না তাকিয়ে পারছিলেন না, কারণ কয়েক পা দূরে সতর্ক পাহারাদার দাঁড়িয়ে। তবে তৃতীয় রোববার পাহারাদারের এক মুহূর্তের অসতর্কতায় তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়, এবং তিনি বছরের প্রথম বৃষ্টিস্নাত পাথরে লিপস্টিক দিয়ে লিখলেন : র্দুরাতি। তখন থেকে, যখনই সুযোগ পেতেন, কখনো একটি সমাধিস্তম্ভে, কখনোবা দুই এমনকি তিনটি স্তম্ভেই দৃঢ় হাতে এবং পুরনো স্মৃতি মনে করে কবরে শায়িত ব্যক্তির নাম লিখে ফেলতেন।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এক রোববার, তিনি প্রথম পাহাড়ে লাশ সমধিস্থ করতে দেখেন। তিন সপ্তাহ পর ঠাণ্ডা, ঝড়ো হাওয়া বইছে, এমন এক বিকেলে, ওরা এক তরুণী বধূকে সমাধিস্থ করে তাঁর কবরের পাশে। বছর শেষে, সাতটি প্লট ভরে গেল, তবে অল্পস্থায়ী শীত মারিয়া দোস্ প্রাজেরেসের জন্য অশুভ লক্ষণ রেখে গেল না। তাঁর কোনো অসুখবিসুখই হলো না, এবং আবহাওয়া কিছুটা উষ্ণ হলে, খোলা জানালা দিয়ে মুষলধারে জীবনের কলরব প্রবেশ করতে লাগল, এবং তিনি তাঁর স্বপ্নের প্রহেলিকায় বেঁচে থাকায় নিবিষ্ট হলেন। প্রচণ্ড গরমের মাসগুলো পর্বতে কাটিয়ে ফিরে আসার পর, পঞ্চাশ বছর বয়সী মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্কে দেখে কার্দোনার কাউন্টের তাঁকে যৌবনের দিনগুলোর চেয়ে আরও আকর্ষণীয় মনে হয়।

অনেক ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্, উঁচু পাহাড়ের ওপর একই ধরনের অসংখ্য কবরের মাঝে নিজের কবরে নোইকে নিয়ে যেতে সফল হন। এরপর কুকুরটাকে তাঁর শূন্য সমাধিতে কাঁদতে শেখানোর কাজে লেগে যান, যাতে তাঁর মৃত্যুর পরও ওর কান্নার অভ্যেসটা থেকে যায়। তিনি অনেকবার ওকে বাড়ি থেকে হেঁটে কবরস্থানে নিয়ে গেছেন, বিশেষ বিশেষ জায়গা চিনিয়েছেন, যাতে ও রামব্লাসের বাস রুটটা মনে রাখতে পারে, যাতে একা একা কবরস্থানে যেতে পারে।

রোববার, চূড়ান্ত পরীক্ষার দিন বিকেল তিনটায়, গ্রীষ্মের বাতাস বইছে বলে তিনি কুকুরের গা থেকে বসন্তের জ্যাকেট খুলে ফেলেন, এবং আরেকটি কারণ হলো তাকে দেখে যেন কারও সন্দেহ না হয়। তিনি কুকুরটাকে ছেড়ে দেন। দেখলেন, নোই রাস্তার পাশ দিয়ে গাছের ছায়ায় ছায়ায় জোর কদমে যাচ্ছে, ওর উল্লসিত লেজের নিচে ছোট্ট পশ্চাদ্দেশটা টানটান এবং বিষণ্ণ, আর এ কারণেই মারিয়া চেষ্টা করছেন না কাঁদতে- তাঁর নিজের জন্য, তাঁর কুকুরের জন্য, অনেক কিছুর জন্য এবং বিভ্রান্তিতে কাটানো তিক্ততায় ভরা বছরগুলোর জন্য- যতক্ষণ না পর্যন্ত কুকুরটিকে ক্যালে মেয়ওে মোড় নিয়ে সাগরে এগোতে দেখেন। পনেরো মিনিট পর, তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে কুকুর পদযাত্রা দেখার জন্যে প্লাজা দে লেসেপ্সের কাছে রামব্লাস বাস ধরেন, বস্তুত তিনি দেখলেন, দূরে একগাদা বাচ্চার মধ্য দিয়ে কুকুরটি গুরুগম্ভীর চালে চলছে, এরপর পাস্কো দে গ্রাসিয়ার রাস্তার ট্রাফিক লাইট জ্বলার আগ পর্যন্ত খানিক থেমে যাচ্ছে।

‘হায় ঈশ্বর’, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ‘ওকে কী নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছে।’ (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১ , ১৪ মাঘ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্

মূল : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ভাষান্তর : সুরাইয়া ফারজানা হাসান

image

গল্পগুলোর অল্পঙ্করণ করেছেন সঞ্জয় দে রিপন

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী ছেলেটি এত বেশি সময়নিষ্ঠ যে, সে যখন এসে পৌঁছায়, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ তখনও স্নানের পোশাক পরে আছেন, মাথায় চুল কোঁচকাবার ক্লিপ, এবং তাঁকে যাতে আকর্ষণহীনা না দেখায়, সেজন্য তাঁর হাতে কেবল কানের পিছনে গোলাপ গোঁজার সময়টুকু আছে। এমনকি দরজা খোলার সময়ও, তিনি নিজের চেহারা নিয়ে মনে মনে আফসোস করছেন আর দরজা খুলে দেখেন- ছেলেটিকে তিনি যেমনটি ভেবেছেন, তেমনটি নয়, ও অন্যান্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মতো দুখী দুখী চেহারার কেউ নয়, বরং চেককাটা জ্যাকেট আর নানান রঙের পাখির ছাপওলা টাই পরা ভীরু চেহারার এক যুবক। ওর গায়ে ওভারকোট নেই, যদিও বার্সেলোনার বসন্তে বিশ্বাস নেই, আর এ সময়ের এলোপাতাড়ি দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি শীতকালের চেয়েও অসহ্য রকমের ঠাণ্ডা। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টায় অনেক পুরুষকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, অথচ আজ এই যুবককে দেখে তাঁর খুব বিব্রত বোধ হচ্ছে। তিনি সবেমাত্র ছিয়াত্তর বছর বয়সে পা দিয়েছেন এবং এরই মধ্যে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে বড়দিনের আগেই তিনি মারা যাবেন, আর তা সত্ত্বেও, তিনি লজ্জার বশে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের ছেলেটিকে একটুু অপেক্ষা করতে বলতে যাচ্ছিলেন, যাতে ঠিকঠাক মতো পোশাক পরে, ওকে অভ্যর্থনা জানাতে পারেন। তখনই তাঁর মনে হলো, ছেলেটি দরজার সামনের অন্ধকার জায়গায় শীতে জমে যাবে, তাই তিনি ওকে ঘরে ঢুকতে বললেন।

‘দয়া করে বিদঘুটে চেহারার জন্য আমায় ক্ষমা করবেন’, তিনি বলেন, তবে আমি কাতালোনিয়ায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছি, এবং এই প্রথম কেউ নির্দিষ্ট সময়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো।

তিনি নির্ভুল কাতালান, কিছুটা সেকেলে বিশুদ্ধ ভাষায় কথাগুলো বললেন, যদিও তাতে তাঁর ভুলে যাওয়া পর্তুগিজ ভাষার সুর শোনা যাচ্ছে। এত বয়স সত্ত্বেও, চুল কোঁকড়ানোর ধাতব ক্লিপ পরে, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্কে এখনও

তন্বী, সজীব, বর্ণসংকর মূলাতা নারীর মতো দেখাচ্ছে। তারের মতো শক্ত ঢেউ খেলানো চুল এবং নিষ্করুণ হলুদ চোখের এই বয়স্কা নারী বহু বছর আগেই পুরুষের প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী ছেলেটি, রাস্তার বাতির আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় কোনো মন্তব্য করে না, তবে জুতোর তলা পাটের পাপোশে মুছে নিয়ে, মাথা নুইয়ে তাঁর হাতে চুমু খায়।

‘তুমি অনেকটা আমাদের সময়ের পুরুষদের মতো’, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ শিলাবৃষ্টির মতো ধারালো হাসি হেসে বললেন, ‘বসে পড়ো।’

যদিও ছেলেটি এ কাজে নতুন, তবু ও ভালো করেই জানে, সকাল আটটায় কারও মুখে স্বাগত সম্ভাষণ আশা না করাই উচিত, অন্তত এই নির্দয় বৃদ্ধার কাছ থেকে তো নয়ই, যাকে প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে আমেরিকা মহাদেশগুলো থেকে পালিয়ে আসা এক ছিটগ্রস্ত মহিলা। আর তাই, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ যখন জানালার দামি ভারি দীর্ঘ পর্দাটা ঠেলে সরাতে তৎপর হলেন, ছেলেটি দরজা থেকে এক পা দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, বুঝতে পারছে না কী বলবে। তখন এপ্রিলের ফিকে আলো অতি যতে্ন সজ্জিত বসারঘরের কোণগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরটাকে এখন বৈঠকখানার বদলে পুরনো আমলের মূল্যবান জিনিসপত্রের বিক্রয় কেন্দ্রের মতো দেখাচ্ছে। এই বাড়ির রোজকার ব্যবহার্য জিনিসপত্র খুব বেশিও নয়, আবার কমও নয়, এবং প্রত্যেকটি জায়গামতো রুচিসম্মতভাবে সাজানো। বার্সেলোনার মতো পুরনো এবং নিরিবিলি শহরে এর চেয়ে সুরুচিপূর্ণ গৃহসজ্জার দেখা পাওয়া কঠিনই বটে।

‘আমায় ক্ষমা করুন’, ছেলেটি বলে। ‘আমি ভুল দরজায় কড়া নেড়েছি।’

‘আহা! তা-ই যদি হতো’, তিনি বলেন, ‘তবে মৃত্যু কখনো ভুল করে না।’

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিক্রয়কর্মী ছেলেটি খাবার ঘরের টেবিলের উপর, নৌযান চালনার মানচিত্রের মতো অনেকগুলো ভাঁজ হয়ে যাওয়া একটি নকশা পেতে দেয়, যাতে নানা রঙের ক্রুশ এবং মূর্তিসহ ছক কাটা আছে। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ মন্ত-হুইখ পাহাড়ের বিশাল কবরস্থানের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা দেখল, এবং এক পুরাতন ভয়ের স্মৃতি তাঁকে জেঁকে ধরে। কোনো এক অক্টোবর মাসে বৃষ্টিস্নাত মানাউসের কবরস্থানে টাপিরের দল অনুপ্রবেশ করে। বুনো পশুর দল পুরো কবরস্থানে ছড়িয়ে পড়ে বৃষ্টির থিকথিকে কাদা-জল ছিটিয়ে, নামবিহীন কবর এবং ফ্লোরেন্সের রঙিন কাচের জানালা শোভিত অভিযাত্রীদের সমাধি-স্তম্ভ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। খুব ছোট্টবেলার তাঁর আরেকটি স্মৃতি আছে। এক সকালে, আমাজনের বন্যা বীভৎস জলাভূমির রূপ নিল এবং তিনি বাড়ির উঠোনে ভাসতে থাকা এক ভাঙা কফিনের ফাঁকে ছেঁড়া ত্যানা আর মৃত মানুষের চুল দেখতে পান। এসব ভয়ানক স্মৃতির কারণে তিনি বাড়ির কাছের, অপেক্ষাকৃত চেনাজানা সান্ গরভাসিও’র করবস্থানের পরিবর্তে, মন্ত-হুইখ পাহাড় শেষ বিশ্রামস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

‘বুঝলে, আমি এমন জায়গা চাই, যেখানে বন্যা হবে না’, তিনি বলেন।

‘বেশ, এই জায়গায় তবে’, বিক্রয়কর্মী পকেট থেকে ঝরনা কলমের মতো দেখতে ভাঁজ করা যায় এমন পয়েন্টার দিয়ে মানচিত্রে নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে বলে, ‘পৃথিবীর কোনো মহাসাগরই এই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে না।’

মারিয়া কবরস্থানের রঙিন ছকটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রধান প্রবেশদ্বার, এবং তিনটি কাছাকাছি, একই রকম, নামবিহীন কবর দেখতে পান। কবরগুলোতে গৃহযুদ্ধে নিহত বুয়েনাভেন্তুরা র্দুরাতি, এবং আরও দুজন সন্ত্রাসবাদীকে সমাহিত করা হয়েছে। প্রতি রাতে কে বা কারা তাদের নাম সমাধির কালো পাথরে লেখে। ওরা তাদের নাম পেন্সিল, রং, কয়লা, ভ্রু আঁকার পেন্সিল, নেইলপালিশ দিয়ে লিখে দিয়ে যায়, এবং প্রতিদিন সকালে কবরস্থানের পাহারাদার মুছে ফেলে যাতে কেউ না জানে মৌনি পাথরের নিচে কারা শায়িত আছেন। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ র্দুরাতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন, বার্সেলোনার সবচেয়ে বেদনাবিধুর এবং বিক্ষুব্ধ সে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, এবং তিনি লোকটার কবরের আশেপাশে শেষ বিশ্রাম-স্থল চাইছিলেন। কিন্তু কোনোটাই পাওয়া যাচ্ছিল না, আর তাই তিনি সম্ভাব্য যেকোনো জায়গায় শেষ নিদ্রার জন্য নিজেকে সমর্পণ করেন। ‘তবে একটি শর্তে’, তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকঘরের মতো ওই পাঁচ বছর মেয়াদি কুঠুরিতে গাদা করে রাখবে না।’ এরপর কোনো এক দরকারি কথা মনে পড়ায়, তিনি কথা শেষ করেন : ‘এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমাকে কিন্তু শুইয়ে কবর দিতে হবে। কারণ মৃত্যুর আগে কবর কিনে রাখা বিষয়টি এত বেশি প্রচারিত হয়ে গেছে যে, গুজব উঠেছে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের লোকজন জায়গা বাঁচানোর জন্য দাঁড় করিয়ে কবর দেয়। অনেকটা মুখস্থ ও বক্তৃতা দেয়ার মতো নির্ভুলভাবে সেলসম্যান ব্যাখ্যা করে, গুজবটা সেকেলে সব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংস্থাগুলো বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ছড়িয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের কিস্তির ভিত্তিতে নজিরবিহীন কবর বিক্রি করার পরিকল্পনাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। ছেলেটি কথা বলার সময়, দরজায় তিনটি সতর্ক ছোট্ট টোকা পড়ে, এবং সে থতমত খেয়ে একটু থামে, তবে মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ তাকে কথা চালিয়ে যাওয়ার ইশারা করলেন। ‘অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই’, তিনি শান্তস্বরে বলেন। ‘ও নোই।’

বিক্রয়কর্মীর যেটুকু বলার বাকি ছিল, তা শুরু করে দিল এবং মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ ওর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হলেন। মানাউসের বন্যার পর বছরের পর বছর যে দুশ্চিন্তা তাঁর মনে পাকাপোক্তভাবে ঠাঁই করে নিয়েছিল, ভাবলেন দরজা খোলার আগেই সেটার চূড়ান্ত মীমাংসা করবেন। ‘আমি যেটা বোঝাতে চাচ্ছি’, তিনি বললেন, ‘তা হলো, আমি মৃত্যুর পর মাটিতে শায়িত হবার জন্য, যে জায়গা খুঁজছি, সেখানে বন্যার কোনো ঝুঁকি থাকবে না এবং যদি সম্ভব হয় গ্রীষ্মকালে গাছের ছায়া থাকবে, এবং নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর আমার দেহের অবশিষ্টাংশ উঠিয়ে জঞ্জালে ছুড়ে ফেলে দেয়া হবে না।’

তিনি সামনের দরজাটা খুললেন, এবং ছোট্ট একটি কুকুর বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ঘরের ভিতর ঢোকে। কুকুরটার অভব্য চেহারার সাথে এই বাড়ির কোনো কিছু মেলে না। আশেপাশের কোথাও প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছে, এবং ঘরে ঢুকেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। টেবিলের উপর লাফ দিয়ে ওঠে, পাগলের মতো ঘেউ ঘেউ করে, এবং আর একটু হলে কাদামাখা থাবা দিয়ে কবরস্থানের মানচিত্র নিয়ে দৌড়াতে যাচ্ছিল। তবে মনিবের একটু কঠোর চাহনিই ওটার বাঁদরামো থামানোর জন্য যথেষ্ট। ‘নোই!’ তিনি কণ্ঠস্বর একটুও না তুলেই বলেন, ‘বাইক্সা দ্য, আসি!’ (টেবিল থেকে নামো বলছি)!’

মারিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রাণিটি ভয়ে কুঁকড়ে যায়, এবং দু’ফোঁটা টলটলে অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। এবার মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ বিক্রয়কর্মীর দিকে মনোযোগ দিলেন, এবং ছেলেটিকে বেশ হতভম্ব মনে হলো।

‘কেয়োনস (এ কী)!’ সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল। ‘কুকুরটা তো কাঁদছিল!’

‘এ সময়ে ঘরে অন্য কাউকে দেখেছে বলেই ওর মন খারাপ হয়েছে,‘ মারিয়াদোস্ প্রাজেরেস্ নিচু স্বরে ক্ষমা চাওয়ার সুরে বলেন। ‘সাধারণত, ও যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন একজন পুরুষ মানুষের চেয়েও সৌজন্যতা দেখায়। কেবলমাত্র আজ দেখছি, আপনাকে দেখে এমনটি করল।’

‘কিন্তু ও যে কাঁদল, কী কাণ্ড!’ বিক্রয়কর্মী বলেই, বুঝতে পারে ওর কথাটা হয়তোবা ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তাই লজ্জায় লাল হয়ে, ক্ষমা প্রার্থনা করে। ‘আমায় ক্ষমা করুন, তবে আমি এমনটা বাস্তবে তো নয়ই, এমনকি সিনেমায় পর্যন্ত দেখিনি।’

‘সব কুকুরই এমন কাঁদতে পারবে, যদি আপনি ওদের শেখান’, তিনি বললেন, ‘অথচ দেখুন মালিকেরা সারাটা জীবন ওদের এমন কিছু শেখায়, যা ওদের ক্ষতিই করে- এই যেমন প্লেট থেকে খাওয়া অথবা নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে একই জায়গায় কোনো কাজ করা। এবং এখন পর্যন্ত ওদের জীবনকে উপভোগ করার মতো স্বাভাবিক জিনিস শেখায় না, যেমন হাসি, কান্না। যাক্গে, আমরা যেন কই ছিলাম?’

কথা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ নিজেকে গাছপালাবিহীন রুক্ষ গ্রীষ্মের কাছে সঁপে দিলেন, কারণ কবরে গাছের ছায়া সরকারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত করা আছে। অন্যদিকে, চুক্তির শর্ত এবং বিধি অনুযায়ী তা অসংগত, কারণ তিনি নগদ অর্থের বিনিময়ে বিশেষ মূল্যহ্রাসের সুযোগ পেতে যাচ্ছেন।

কথাবার্তা শেষ হলে, কাগজপত্র গুছিয়ে ব্রিফকেসে রেখে বিক্রয়কর্মী ঘরটির চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, এবং ঘরের জাদুকরী সৌন্দর্য দেখে শিহরিত বোধ করে। ও আবারো মারিয়া দোস্ প্রাজেরেসের দিকে চাইল, যেন এই প্রথম তাঁকে দেখছে।

‘আমি কি আপনাকে একটা এলেবেলে কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’, সে বলে।

মারিয়া ছেলেটির সাথে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এলেন।

‘নিশ্চয়ই’, তিনি বললেন, ‘তবে আমার বয়স বাদে যা ইচ্ছে।’

‘আমি লোকের বাড়িঘরের জিনিসপত্র দেখে, তাদের পেশা আন্দাজ করার চেষ্টা করি, এবং সত্যি বলতে কী, আমি আপনার এখানে তা পারিনি’, ও বলে, ‘আপনি কী করেন বলুন তো?’

হাসিটা কোনোমতে সামলে নিয়ে মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ উত্তর দিলেন :

‘আমি একজন দেহপসারিণী, বাছা। আমাকে কি ওরকম দেখাচ্ছে না?’

সেলসম্যানের মুখ লজ্জায় রাঙা হলো, ‘আমি দুঃখিত।’

‘আমার আরও দুঃখিত হওয়া প্রয়োজন’, বলে তিনি ছেলেটা যাতে দরজায় ধাক্কা না খায়, সেজন্য দুবাহু দিয়ে আগলে ধরলেন। ‘আর একটু সাবধানী হও! আমাকে ঠিকঠাক মতো কবর দেয়ার আগে তুমি নিজের মাথার খুলি ভেঙো না কিন্তু।’

দরজা বন্ধ করেই, তিনি ছোট্ট কুকুরটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন, আর তাঁর সুন্দর আফ্রিকান কণ্ঠে পাশের নার্সারি স্কুলের বাচ্চাদের গানের সাথে তাল মেলালেন। তিন মাস আগে, তিনি স্বপ্নে দেখেন মারা যাচ্ছেন, আর সেই সময় থেকে, তিনি তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে এই কুকুরছানাকে কাছে টেনে নেন। তিনি তাঁর সম্পদ-সম্পত্তির মরণোত্তর বিলিবণ্টনের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন এবং মৃত্যুর পর নিজের মৃতদেহের সদ্গতির ব্যবস্থা এত যতেœর সাথে করে রেখেছেন যে, তিনি হঠাৎ মারা গেলেও কারও কোনো অসুবিধা হবে না। তিনি তাঁর দেহপসারিণী জীবিকা থেকে অবসর নিয়েছেন। নিজের ভাগ্যটা তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন, তবে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর জীবনে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে যে বাড়িটা পুরনো ও অভিজাত গ্রাসিয়া শহরে কিনেছিলেন, নগর সম্প্রসারণের সাথে সাথে সেটাও গ্রাস হয়ে গেছে। তিনি একটি জীর্ণশীর্ণ বাড়ির দোতলায় অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যেখানে সর্বত্র ঝলসানো হেরিং মাছের চিরস্থায়ী গন্ধ লেগে আছে, দেয়াল সল্ট-পিটার ক্ষারে নোনা ধরে গেছে, এবং তবে এখনো কলঙ্কময় যুদ্ধের কিছু বুলেটের গর্ত রয়ে গেছে। এই বাড়িতে কোনো দারোয়ান নেই, যদিও অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় লোকজন বসবাস করছে, এছাড়া অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ির কোনো কোনো ধাপও উধাও হয়ে গেছে। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ রান্নাঘর আর গোসলখানা সংস্কার করে নিয়েছেন, দেয়ালে উজ্জ্বল ফ্যাব্রিক লাগিয়েছেন, জানালায় খাঁজকাটা কাচ বসিয়ে মখমলের লম্বা পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এরপর সূক্ষ্ম কাজ করা আসবাবপত্র, ঘর সাজানোর শৌখিন জিনিসপত্র এবং সিল্কে ব্রোকেডের কাজ করা সিন্ধুক কিনেছেন। জিনিসগুলো ফ্যাসিস্টদের পরাজয়ের পর পালিয়ে যাওয়া লোকজনের বাড়িঘর থেকে চুরি করে আনা, এবং তিনি বহু বছর ধরে এগুলো একের পর এক গোপন নিলামে দরকষাকষি করে কিনেছেন। অতীতের সাথে তাঁর একমাত্র সংযোগ হলো কার্দোনার কাউন্টের সাথে বন্ধুত্ব, যিনি প্রতিমাসের শেষ শুক্রবার তাঁর সাথে নৈশভোজন করার জন্য আসতেন এবং রাতের খাবারের পর প্রেম ভালোবাসা করার পর অবসন্ন হয়ে শুয়ে থাকতেন। তবে যৌবনে গড়ে ওঠা এই বন্ধুত্ব সবার কাছে লুকানো ছিল। কাউন্ট তার কোট অব আর্মস চিহ্নিত গাড়িটা বেশ দূরে সতর্কতার সাথে রেখে, মারিয়ার দোতালার অ্যাপার্টমেন্টে আসতেন, তাঁকে রক্ষার পাশাপাশি নিজের মান-সম্মান বজায় রাখার জন্য। মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্ জানতেন, তাঁর বাড়ির উল্টো দিকের বাড়ির নয় বছরের কন্যাসহ তরুণ দম্পতি বহু আগেই চলে গেছে, তিনি ওদের ছাড়া অ্যাপার্টমেন্টের কাউকেই চিনতেন না। তবে, সিঁড়িতেও যে কখনো কারও সাথে দেখা হয়নি, ব্যাপারটা মারিয়ার কাছে অদ্ভুত ঠেকে।

এখন মৃত্যুর পর বিষয় আশয় বিলিবণ্টন করতে গিয়ে দেখা গেল, ভদ্র মার্জিত কাতালনিয়ান সম্প্রদায়, যাদের তিনি অসংগঠিত বলে ভেবেছিলেন, তাদের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। তিনি তাঁর বাড়ির আশেপাশের লোকজনের, যাদের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক, তাদের জন্য সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ঘর সাজানোর শৌখিন জিনিসপত্র রেখেছেন। বিলি-বণ্টনের কাজটা সম্পন্ন হয়ে গেলে, তাঁর নিজেকে খুব বেশি নিরপেক্ষ বলে মনে হলো না, তবে তিনি নিশ্চিত, তাঁর কাছ থেকে কিছু আশা করে, মোটামুটি এমন সবাইকে তিনি মনে রেখেছেন। তিনি এত নিখুঁতভাবে উইল করে গেছেন যে, এর দায়িত্বে নিয়োজিত ‘কল দি আরবর’-এর নোটারি লোকটি, প্রশংসায় গদগদ হয়ে বলেছেন, তিনি তাঁর চোখকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, মারিয়া নোটারি অফিসের ক্লার্ককে মধ্যযুগীয় কাতালান ভাষায় গড়গড় করে, স্মৃতি হাতড়ে বলে যাচ্ছেন- নিজের সম্পত্তির বিস্তারিত তালিকার পাশাপাশি প্রতিটি জিনিসের সত্যিকারের নাম, এবং উত্তরাধিকারীদের সম্পূর্ণ তালিকা, তাদের পেশা, ঠিকানাসহ হৃদয়ে তাদের অবস্থান।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিক্রয়কর্মী বাড়িতে আসার পর থেকে, মারিয়া রোববারে কবরস্থানের অগুনতি দর্শনার্থীর মধ্যে একজন হয়ে গেলেন। তাঁর কবরস্থানের প্রতিবেশীদের মতো, তিনিও শবাধারগুলোর ওপর এক বছর মেয়াদি ফুলের গাছ লাগালেন, নতুন ঘাসে পানি দিলেন এবং ঘাস কাটার যন্ত্র দিয়ে বড় বড় ঘাসগুলো কেটেছেঁটে সাফসুতরো করেছেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত মেয়রের অফিসের গালিচার মতো দেখায়, এবং জায়গাটার সাথে এতবেশি পরিচিত হয়ে গেছেন যে, শেষমেশ তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না কেন তার কাছে শুরুর দিকে জায়গাটা এত নির্জন মনে হয়েছিল।

তিনি যখন প্রথম কবরস্থানে যান, প্রবেশদ্বারের কাছে তিনটা কবর দেখে তার হৃৎপিণ্ডের একটি স্পন্দন ছুটে যায়, তবে তিনি ওগুলোর দিকে না তাকিয়ে পারছিলেন না, কারণ কয়েক পা দূরে সতর্ক পাহারাদার দাঁড়িয়ে। তবে তৃতীয় রোববার পাহারাদারের এক মুহূর্তের অসতর্কতায় তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়, এবং তিনি বছরের প্রথম বৃষ্টিস্নাত পাথরে লিপস্টিক দিয়ে লিখলেন : র্দুরাতি। তখন থেকে, যখনই সুযোগ পেতেন, কখনো একটি সমাধিস্তম্ভে, কখনোবা দুই এমনকি তিনটি স্তম্ভেই দৃঢ় হাতে এবং পুরনো স্মৃতি মনে করে কবরে শায়িত ব্যক্তির নাম লিখে ফেলতেন।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এক রোববার, তিনি প্রথম পাহাড়ে লাশ সমধিস্থ করতে দেখেন। তিন সপ্তাহ পর ঠাণ্ডা, ঝড়ো হাওয়া বইছে, এমন এক বিকেলে, ওরা এক তরুণী বধূকে সমাধিস্থ করে তাঁর কবরের পাশে। বছর শেষে, সাতটি প্লট ভরে গেল, তবে অল্পস্থায়ী শীত মারিয়া দোস্ প্রাজেরেসের জন্য অশুভ লক্ষণ রেখে গেল না। তাঁর কোনো অসুখবিসুখই হলো না, এবং আবহাওয়া কিছুটা উষ্ণ হলে, খোলা জানালা দিয়ে মুষলধারে জীবনের কলরব প্রবেশ করতে লাগল, এবং তিনি তাঁর স্বপ্নের প্রহেলিকায় বেঁচে থাকায় নিবিষ্ট হলেন। প্রচণ্ড গরমের মাসগুলো পর্বতে কাটিয়ে ফিরে আসার পর, পঞ্চাশ বছর বয়সী মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্কে দেখে কার্দোনার কাউন্টের তাঁকে যৌবনের দিনগুলোর চেয়ে আরও আকর্ষণীয় মনে হয়।

অনেক ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর, মারিয়া দোস্ প্রাজেরেস্, উঁচু পাহাড়ের ওপর একই ধরনের অসংখ্য কবরের মাঝে নিজের কবরে নোইকে নিয়ে যেতে সফল হন। এরপর কুকুরটাকে তাঁর শূন্য সমাধিতে কাঁদতে শেখানোর কাজে লেগে যান, যাতে তাঁর মৃত্যুর পরও ওর কান্নার অভ্যেসটা থেকে যায়। তিনি অনেকবার ওকে বাড়ি থেকে হেঁটে কবরস্থানে নিয়ে গেছেন, বিশেষ বিশেষ জায়গা চিনিয়েছেন, যাতে ও রামব্লাসের বাস রুটটা মনে রাখতে পারে, যাতে একা একা কবরস্থানে যেতে পারে।

রোববার, চূড়ান্ত পরীক্ষার দিন বিকেল তিনটায়, গ্রীষ্মের বাতাস বইছে বলে তিনি কুকুরের গা থেকে বসন্তের জ্যাকেট খুলে ফেলেন, এবং আরেকটি কারণ হলো তাকে দেখে যেন কারও সন্দেহ না হয়। তিনি কুকুরটাকে ছেড়ে দেন। দেখলেন, নোই রাস্তার পাশ দিয়ে গাছের ছায়ায় ছায়ায় জোর কদমে যাচ্ছে, ওর উল্লসিত লেজের নিচে ছোট্ট পশ্চাদ্দেশটা টানটান এবং বিষণ্ণ, আর এ কারণেই মারিয়া চেষ্টা করছেন না কাঁদতে- তাঁর নিজের জন্য, তাঁর কুকুরের জন্য, অনেক কিছুর জন্য এবং বিভ্রান্তিতে কাটানো তিক্ততায় ভরা বছরগুলোর জন্য- যতক্ষণ না পর্যন্ত কুকুরটিকে ক্যালে মেয়ওে মোড় নিয়ে সাগরে এগোতে দেখেন। পনেরো মিনিট পর, তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে কুকুর পদযাত্রা দেখার জন্যে প্লাজা দে লেসেপ্সের কাছে রামব্লাস বাস ধরেন, বস্তুত তিনি দেখলেন, দূরে একগাদা বাচ্চার মধ্য দিয়ে কুকুরটি গুরুগম্ভীর চালে চলছে, এরপর পাস্কো দে গ্রাসিয়ার রাস্তার ট্রাফিক লাইট জ্বলার আগ পর্যন্ত খানিক থেমে যাচ্ছে।

‘হায় ঈশ্বর’, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ‘ওকে কী নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছে।’ (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায় পড়ুন)