উৎসবমুখর হলেও আস্থা ফেরেনি ভোটারদের

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেয়া হয়েছে। সকাল ৮টায় এই ভোট শুরু হয়। তবে বেলা ১০টা পর্যন্ত বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কিছু কেন্দ্রে ভোটার নেই বললেই চলে। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারীদের অলস সময় পার করতে দেখা গেছে এসব কেন্দ্রে। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতির ধাক্কা, নগীর কয়েকটি ওয়ার্ডে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ইভিএম ভাঙচুর, গুলিতে নিহত, ভোটকেন্দ্র ঘেরাও করে হামলার ঘটনাগুলোয় ভোটাররা বাসা থেকে ভোট দিতে বের হয়নি বলে জানা গেছে।

নগরের ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ ভোটার এবার তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হয়নি এজন্য বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, সরকার সমর্থিত মনোভাবাপন্ন ভোটার ছাড়া অন্য মতাবলম্বীদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদেরও নানাভাবে ভোট থেকে দূরে রাখা হয়েছে। হামলা-মামলার পর এজেন্টদের অনেক জায়গায় বের করে দেয়া হয়েছে। তাই ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ইব্রাহীম হোসেন বাবুল বলেছেন, আমি সকাল থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গিয়েছি। সেখানে আমি দেখতে পেয়েছি উৎসবের সঙ্গে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন। বিচ্ছিন্ন যে কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোই বিএনপির নেতাকর্মীরা করেছেন। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই তারা মূলত এসব হামলা চালিয়েছেন এবং আমাদের নেতাকর্মীদের আহত করেছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোটের গ্রহণের শুরুর দিকে কিছু কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন থাকলেও অনেক কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম। ভোটের শুরুতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। ভোট নেয়ার দায়িত্বে আছেন ৭৭৫ প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ৪ হাজার ৮৮৬ সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং ৯ হাজার ৭৭২ পোলিং অফিসার। প্রতি সাধারণ কেন্দ্রে বিভিন্ন বাহিনীর ১৬ জন করে এবং ৪১৬টি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ জন করে সদস্য নিয়োজিত আছে। এছাড়া ২৫ প্লাটুন বিজিবি ও র‌্যাবের ৪১টি টিম মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও থামানো যায়নি নির্বাচনী সহিংসতা। সরাইপাড়া ও পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ঝরলো দুই প্রাণ। নগররের বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।

তবে সব আশঙ্কা দূরে সরিয়ে মোটামুটি নির্বিঘেœই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। তবে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। তবে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, সার্বিকভাবে একটি ভালো নির্বাচন হয়েছে। সরকারি যন্ত্র এবং নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা ছিল বলেই একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। কিন্তু চোখে যে বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়েছে সেটা হচ্ছে ভোটার উপস্থিতি। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, নির্বাচনে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেও ভোটার উপস্থিতি এত কম কেন? আমাদের দেশের নির্বাচনী বাস্তবতা ভিন্ন। তা হচ্ছে, যেকোন নির্বাচনে ৬০ শতাংশের ওপর ভোটার ভোট দেন। ভোটকে উৎসব মনে করেন। সেই উৎসব কি নষ্ট হয়ে গেল?

বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার অবনতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা বাড়ছে। এবারের নির্বাচনে যে ধরনের প্রচার হয়েছে তা আগের কোন নির্বাচনে দেখা যায়নি। এত প্রচারের পরও ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে কেন গেলেন না সে প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছে পর্যবেক্ষক মহলও। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, ভোটার উপস্থিতি এত কম হওয়ার কয়েকটি কারণ হতে পারে, বিশেষ করে কেন্দ্র ও ওয়ার্ডগুলোতে নির্বাচনী সহিংসতা, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় আতঙ্কে সাধারণভাবে মনে হয় মানুষ ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। অনেকের মতে, সাধারণ মানুষের ভোটের প্রতি ভোটের ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থাহীনতার প্রকাশ ঘটেছে এ নির্বাচনে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অতীতে নির্বাচনে নানা অনিয়ম, প্রচারে পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকিসহ নানা কারণে ভোট নিয়ে ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব দেখা দিয়েছে। এবারের নির্বাচন শুরু থেকে উৎসবমুখর এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ থাকলেও ভোটারদের মধ্যে ‘আস্থা’ ফেরেনি। আর সে কারণেই বেশির ভাগ ভোটার ভোট দিতে যাননি।

এসব ধারণা যদি সত্য হয়, তাহলে তা দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় দুর্ভাবনার বিষয় বলে বিশ্লষকরা মনে করেন। কারণ গণতন্ত্রের অন্যতম মূল বিষয় হচ্ছে ভোট। ভোটের মাধ্যমে জনগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। মানুষকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাশীল করতে এখন থেকেই কাজ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১ , ১৪ মাঘ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

উৎসবমুখর হলেও আস্থা ফেরেনি ভোটারদের

চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেয়া হয়েছে। সকাল ৮টায় এই ভোট শুরু হয়। তবে বেলা ১০টা পর্যন্ত বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কিছু কেন্দ্রে ভোটার নেই বললেই চলে। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারীদের অলস সময় পার করতে দেখা গেছে এসব কেন্দ্রে। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতির ধাক্কা, নগীর কয়েকটি ওয়ার্ডে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ইভিএম ভাঙচুর, গুলিতে নিহত, ভোটকেন্দ্র ঘেরাও করে হামলার ঘটনাগুলোয় ভোটাররা বাসা থেকে ভোট দিতে বের হয়নি বলে জানা গেছে।

নগরের ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ ভোটার এবার তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হয়নি এজন্য বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, সরকার সমর্থিত মনোভাবাপন্ন ভোটার ছাড়া অন্য মতাবলম্বীদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদেরও নানাভাবে ভোট থেকে দূরে রাখা হয়েছে। হামলা-মামলার পর এজেন্টদের অনেক জায়গায় বের করে দেয়া হয়েছে। তাই ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ইব্রাহীম হোসেন বাবুল বলেছেন, আমি সকাল থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গিয়েছি। সেখানে আমি দেখতে পেয়েছি উৎসবের সঙ্গে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন। বিচ্ছিন্ন যে কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোই বিএনপির নেতাকর্মীরা করেছেন। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই তারা মূলত এসব হামলা চালিয়েছেন এবং আমাদের নেতাকর্মীদের আহত করেছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোটের গ্রহণের শুরুর দিকে কিছু কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন থাকলেও অনেক কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম। ভোটের শুরুতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। ভোট নেয়ার দায়িত্বে আছেন ৭৭৫ প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ৪ হাজার ৮৮৬ সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং ৯ হাজার ৭৭২ পোলিং অফিসার। প্রতি সাধারণ কেন্দ্রে বিভিন্ন বাহিনীর ১৬ জন করে এবং ৪১৬টি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ জন করে সদস্য নিয়োজিত আছে। এছাড়া ২৫ প্লাটুন বিজিবি ও র‌্যাবের ৪১টি টিম মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও থামানো যায়নি নির্বাচনী সহিংসতা। সরাইপাড়া ও পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ঝরলো দুই প্রাণ। নগররের বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।

তবে সব আশঙ্কা দূরে সরিয়ে মোটামুটি নির্বিঘেœই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। তবে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। তবে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, সার্বিকভাবে একটি ভালো নির্বাচন হয়েছে। সরকারি যন্ত্র এবং নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা ছিল বলেই একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। কিন্তু চোখে যে বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়েছে সেটা হচ্ছে ভোটার উপস্থিতি। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, নির্বাচনে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেও ভোটার উপস্থিতি এত কম কেন? আমাদের দেশের নির্বাচনী বাস্তবতা ভিন্ন। তা হচ্ছে, যেকোন নির্বাচনে ৬০ শতাংশের ওপর ভোটার ভোট দেন। ভোটকে উৎসব মনে করেন। সেই উৎসব কি নষ্ট হয়ে গেল?

বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার অবনতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা বাড়ছে। এবারের নির্বাচনে যে ধরনের প্রচার হয়েছে তা আগের কোন নির্বাচনে দেখা যায়নি। এত প্রচারের পরও ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে কেন গেলেন না সে প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছে পর্যবেক্ষক মহলও। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, ভোটার উপস্থিতি এত কম হওয়ার কয়েকটি কারণ হতে পারে, বিশেষ করে কেন্দ্র ও ওয়ার্ডগুলোতে নির্বাচনী সহিংসতা, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় আতঙ্কে সাধারণভাবে মনে হয় মানুষ ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। অনেকের মতে, সাধারণ মানুষের ভোটের প্রতি ভোটের ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থাহীনতার প্রকাশ ঘটেছে এ নির্বাচনে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অতীতে নির্বাচনে নানা অনিয়ম, প্রচারে পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকিসহ নানা কারণে ভোট নিয়ে ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব দেখা দিয়েছে। এবারের নির্বাচন শুরু থেকে উৎসবমুখর এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ থাকলেও ভোটারদের মধ্যে ‘আস্থা’ ফেরেনি। আর সে কারণেই বেশির ভাগ ভোটার ভোট দিতে যাননি।

এসব ধারণা যদি সত্য হয়, তাহলে তা দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় দুর্ভাবনার বিষয় বলে বিশ্লষকরা মনে করেন। কারণ গণতন্ত্রের অন্যতম মূল বিষয় হচ্ছে ভোট। ভোটের মাধ্যমে জনগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। মানুষকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাশীল করতে এখন থেকেই কাজ করতে হবে।